Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মতপ্রকাশের ‘অপ’স্বাধীনতা— টক-শোয়ের বিষ

অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 


লেখক প্রযুক্তিবিদ্যার ছাত্র ও গবেষক

 

 

 

 

ছোটবেলায় আমরা সবাই সেই বিখ্যাত প্রবাদবাক্যটিকে গুরুজনদের কারও না কারও মুখে একাধিকবার উচ্চারিত হতে শুনেছি— শূন্য কলসি বাজে বেশি, an empty vessel sounds much। আজকাল দৈনন্দিন টেলিভিশনের পর্দাতে নিউজ-ডিবেটের নামে প্রতিনিয়তই যে ভয়াবহ মারমার-কাটকাট প্রাইম-টাইম মার্কা অনুষ্ঠানগুলির ঝকঝকে অবতারণা ঘটে, সেই সময়ে বারেবারেই কেন জানি না সেই পুরনো প্রবাদবাক্যটিকেই মনে পড়তে থাকে। অবশ্য আমাদের মাননীয় রাজনীতিজ্ঞ, নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে শিক্ষাগত যোগ্যতা কারও থাকুক বা না থাকুক, যে বিপুল সংখ্যায় বিভিন্ন দলের আইনপ্রণেতারা ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত অথবা সাজাপ্রাপ্ত হয়েও ক্ষমতার অলিন্দে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ান, সেখানে কোনও যুক্তিতর্কের অনুষ্ঠানে তাঁদের ভাষার ব্যবহারের বিষয়ে উচ্চাশা পোষণ না করাটাই বাঞ্ছনীয়। তবুও, জিনিসটা যেন ক্রমেক্রমেই মাত্রাছাড়া বিরক্তির পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে।

গত সপ্তাহে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় মুখপাত্র শ্রী রাজীব ত্যাগী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি স্বয়ং প্রিয়াঙ্কা গান্ধির স্নেহভাজন ছিলেন, কাজেই দুর্ভাগ্যজনক এই ঘটনাটির পরে সেটিকে নিয়ে সদরে-অন্দরে, দলে এবং দলের বাইরে, বেশ একটা হইচই পড়ে গেছে। সম্পূর্ণ বিষয়টি অনেকটা এইরকম, অসুস্থ হওয়ার দিন সন্ধ্যায় শ্রী ত্যাগী একটি সর্বভারতীয় হিন্দি নিউজ চ্যানেলের টক শোতে দলের তরফে বক্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে ভারতীয় জনতা পার্টির স্বনামখ্যাত নেতা শ্রী সম্বিত পাত্র প্রতিপক্ষ বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। আলোচনার বিষয় ছিল বেঙ্গালুরুর সাম্প্রতিক হিংসা। আলোচনা স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী কিছুক্ষণ পর থেকেই ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠতে শুরু করে। যেমনটা আজকাল দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এইসময়, স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে শ্রী পাত্র, শ্রী ত্যাগীকে ‘গদ্দার’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করতে শুরু করেন। আলোচনা একটা সময়ে গিয়ে শেষ হয়। এরপর, বাড়ি ফেরার কিছু পরেই শ্রী ত্যাগী হঠাৎ অসুস্থ বোধ করেন। হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতেই তাঁর মৃত্যু হয়। সংবাদে প্রকাশ, শ্রী ত্যাগী নাকি মৃত্যুর সময়ে তাঁর স্ত্রীকে বলতে চেষ্টা করেছিলেন, “ওরা আমাকে বাঁচতে দিল না” … ইত্যাদি।

সে যাই হোক না কেন, আমার পরিচিত একজন রাজনীতিক আমাকে একটা সময় বলেছিলেন যে, রাজনীতির প্রথম শর্তই হল কোনও পরিস্থিতিতে কোনওরকমভাবেই উত্তেজিত হওয়া চলবে না। নিজের ব্যক্তিগত আবেগকে সবসময় সংযত রাখতে হবে। নচেৎ যুক্তির ধার বাড়বে না, সে কেবল আবেগসর্বস্ব বাগাড়ম্বরে পরিণত হবে। এখনকার টক-শোগুলিকে দেখতে দেখতে বেশিরভাগ সময়েই তাঁর কথাগুলিকে মনে পড়ে। আর মনে পড়ে যে, গোদের উপরে বিষফোঁড়ার মতই আজকাল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, ‘নিরপেক্ষ’ সাংবাদিকতার নামে প্রত্যেকটি নিউজ চ্যানেলই হাওয়ামোরগের মত কোনও না কোনও দিকে হেলে রয়েছে, (এবং সেগুলির একটি বড় অংশই এখন শাসকের পক্ষে দাঁড়িয়ে তাঁদের অনুষ্ঠানকে সম্প্রচার করে)। অর্থাৎ কিনা, মানুষকে ভাবতে নয়— তাঁদের নিজস্ব ঢঙে প্রচারিত নিজস্ব (পড়ুন পার্টিলাইনে বলে দেওয়া) ‘সত্যি’টাকেই একমাত্র ‘সত্যি’ হিসেবে বিশ্বাস করতে শেখায়। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের কি আশ্চর্য পদস্খলন। নিরপেক্ষতা, ভারসাম্যের সাংবাদিকতা এখন অতীত, ঝাঁ চকচকে ওবি-ভ্যানের শহরে এখন সমস্তটাই ব্রেকিং নিউজ! অ্যাসিডিটি থেকে আমলাশোল পর্যন্ত, সবকিছুই।

এই প্রসঙ্গে সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়ানের একটি বক্তব্যের সূত্র ধরেই বলতে চাই, পরিস্থিতি এখন এমন একটা জায়গাতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে কিছু কিছু নিউজ চ্যানেলে বিভিন্ন দলের নেতারা আজকাল আর যেতেই চাইছেন না। কারণ সেখানে তাঁদেরকে বলবার সুযোগ তো প্রায় দেওয়া হয়ই না, উলটে যেনতেনপ্রকারেণ তাঁদেরকে রাগিয়ে দেওয়া, চটিয়ে দেওয়া এবং বিপক্ষ দলের নেতাদের দিক থেকে তাঁদের উপরে নাগাড়ে কুৎসা বর্ষণের সুযোগ করে দেওয়াটাই যেন চ্যানেল কর্তৃপক্ষের একমাত্র লক্ষ্য বলে মনে হতে থাকে। এমতাবস্থায়, এই সমস্ত চ্যানেল মালিকেরা যখন একেকটি দলের সরকারি মুখপাত্রকে তাঁদের চ্যানেলে এনে উঠতে পারেন না, তখন অনেক সময়ে কিছু অন্য মানুষকে সেই দলের সমর্থক, সমমনোভাবাপন্ন বলে সাজিয়ে এনে তাঁদেরকে হেনস্থা করেন। হেনস্থার মুখে পড়ে সেই ‘ধরে আনা মুখপাত্রে’রা বেফাঁস কিছু বলে ফেললে, তাকে আবার খানিকটা রং চড়িয়ে যেন সেটিই সেই দলের সরকারি বক্তব্য এমনভাবে সাজিয়ে প্রচার করা হতে থাকে। স্বভাবতই চ্যানেলমালিক যে দলের পৃষ্ঠপোষক, এর ফলে যে সেই দলের যারপরনাই সুবিধে হয়— তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যে সমস্ত সঞ্চালক, চাপে পড়ে, চাকরি রাখার দায়ে অথবা কেরিয়রের স্বার্থে এই কাদা-ছোঁড়াছুঁড়ির সাংবাদিকতাকে প্রশ্রয় দেন তাঁদের প্রতি কেবল অনুকম্পা রইল।

ছোটবেলায় ব্রেকিং নিউজ শব্দবন্ধটিকে কালেভদ্রে টিভির পর্দাতে ভেসে উঠতে দেখতাম। ব্রেকিং নিউজ দেখালে বুঝতে হত, সত্যি সত্যিই একটা না একটা কোনও বড় ঘটনা ঘটে গিয়েছে। এখনকার টিভি চ্যানেলগুলিতে অষ্টপ্রহরই ব্রেকিং নিউজ, সবসময়েই সেনসেশন্যাল কিছু না কিছু একটা ঘটে চলেছে। সত্যিই সেগুলি খবরের চ্যানেল, নাকি লালমোহন গাঙ্গুলির রহস্যরোমাঞ্চ সিরিজের একেকটি ঠাসবুনোট উপন্যাস, ধরতেই পারবেন না! একেকটি বৃহৎ সংবাদসংস্থা অবশ্য এমনও ব্যবস্থা করে রেখেছে যে, একই গোষ্ঠীর মালিকানাধীন একাধিক কাগজ অথবা চ্যানেল বাজারে চলছে। তাদের কেউ কেউ হয়ত বা শাসকপন্থী, আবার কেউ কেউ হয়ত বা ঈষৎ যেন বিরোধী-ঘেঁষা, অপোজিশন-মনোভাবাপন্ন। সাধারণ পাঠক হয়ত ভাবছেন যে, যাক, দুটি বিরুদ্ধ মতকেই এখনও তাহলে পাশাপাশি রেখে দেখা যাচ্ছে। পাঠক জানছেন না যে, দুটি কাগজেরই মালিকানা আসলে একই কর্তৃপক্ষের অধীনে। সুতোর খেলায় তিনি যতটুকু নাচাবেন, মানুষ ঠিক ততটুকুই নাচতে পারবে। পুঁজির দাসত্বে এখানে হার মেনেছে সবকিছুই। এই বিশেষ বিষয়টিকে নিয়ে যদি বর্তমান প্রবন্ধের পাঠক উৎসাহ বোধ করেন, তাহলে অরুন্ধতী রায়ের ‘ক্যাপিটালিজম’ বইটিকে অল্পস্বল্প উলটেপালটে দেখতে পারেন। এক ধাক্কায় অনেকটা দেখে ফেলবেন না, অপ্রিয় সত্যকে ধাপে ধাপে জানতে হয়। নচেৎ ধাক্কা সামলাতে পারবেন না বোধহয়।

জাতীয় কংগ্রেসের তরফে নিউজ ব্রডকাস্টিং স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি ওরফে এনবিএসএ-র কাছে এই মর্মে লিখিত অভিযোগ জানানো হয়েছে যে, শ্রী রাজীব ত্যাগীর মৃত্যুর পরিপ্রেক্ষিতে আজ ব্রডকাস্টিং অথরিটির তরফে যেন টক-শোর নামে চ্যানেলে চ্যানেলে এই নির্বিচার ঘৃণা, কাদা-ছোঁড়াছুড়ি ও ব্যক্তিগত আক্রমণ বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে এনবিএসএ যেন প্রয়োজনে, ব্রডকাস্টিং রুলসের বিষয়ে আরও স্বচ্ছতা আনে। অসৌজন্যমূলক আচরণ অথবা অ্যাক্রিমনিয়াস বলতে সংস্থার নিয়মাবলিতে ঠিক কী বলতে চাওয়া হয়েছে তাও যেন বিশদে ব্যাখ্যা করা হয়— জাতীয় কংগ্রেসের তরফে এমনটিও দাবি জানানো হয়েছে। এখন ডিবেটকে যদি টিআরপি (টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট)-র স্বার্থে বিজ্ঞাপনী পরিভাষায় ‘স্ট্রিট ফাইট’-এর পর্যায়ে নামিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়, তাহলে মানুষ আর কষ্ট করে নিউজ চ্যানেলের অনুষ্ঠান না দেখে বিলিতি সাজানো মল্লযুদ্ধের অনুষ্ঠানগুলিকে দেখলেও পারেন। তাতেও বোধকরি তাঁরা একইরকমের আনন্দ উপভোগ করবেন।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আজ ক্রমশই মতপ্রকাশের ‘অপ’স্বাধীনতায় পর্যবসিত হচ্ছে। মত প্রকাশ নয়, মত চাপিয়ে দেওয়াটাই আজকের দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংখ্যাগুরুর আস্ফালন, বিরুদ্ধ মতের বিলুপ্তি— গণতন্ত্রের পক্ষে মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। মানুষের মনে রাখা উচিত যে সংখ্যাগুরুর ভোটে জিতে আসা হিটলার বা মুসোলিনিই, ফ্যাসিবাদের অন্ধকারকে পৃথিবীতে নামিয়ে এনেছিলেন। আজ টিআরপি বাড়িয়ে নিজেদের কেরিয়রকে সুনিশ্চিত করলেও, সেই সমস্ত অনুষ্ঠানের সঞ্চালক, সাংবাদিক, কর্তৃপক্ষেরা আয়নাতে নিজেদের মুখটুকুকেও ভবিষ্যতে ফিরে দেখতে পারবেন তো ? যাঁরা আজ খবরকে প্রকাশ নয়, বিক্রি করতে ভালোবাসেন …