Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অক্ষয় কুমার দত্ত: মুক্তবুদ্ধির অগ্রদূত

অশোক মুখোপাধ্যায়

 


লেখক প্রবন্ধকার, বিজ্ঞান আন্দোলনের কর্মী

 

 

 

 

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

।। ৪ ।।
অক্ষয় দত্তের ‘তত্ত্ববোধিনী’ পাঠশালা ও পরে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার দায়িত্বভার গ্রহণ দুজনকে দুদিক থেকে উপকৃত করেছিল। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পেয়েছিলেন একজন অত্যন্ত উপযুক্ত এবং নিষ্ঠাবান কাজের মানুষ, যাঁর বিদ্যাবুদ্ধির কাঁধে ভর দিয়ে তাঁর পাঠশালা এবং পত্রিকা দুটোই বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। তার ফলে তত্ত্ববোধিনী সভা ও তার মধ্য দিয়ে রামমোহনের ধর্মচিন্তাকে ব্রাহ্মধর্ম নাম দিয়ে প্রচার করার উদ্যোগেও ব্যাপক সাড়া মিলেছিল। নানা জায়গায় এর শাখাপ্রশাখা গড়ে উঠছিল। সেই যুগে এই পত্রিকার গ্রাহক সংখ্যা সাতশোয় পৌঁছেছিল। অন্য দিকে, অক্ষয় দত্তের সুবিধা হয়েছিল এই যে তিনি তাঁর কর্মজীবনের শুরুতেই মনের মতো কাজ করার একটা ভালো জায়গা পেয়ে গিয়েছিলেন। (একটু পরে অবশ্য আমরা দেখব, অচিরেই দুজনের পক্ষে পরস্পরকে মেনে নিয়ে একে অপরের সঙ্গে কাজ করা বেশ কষ্টকর হয়ে উঠতে থাকে।) প্রতিনিয়ত সম্পাদকীয় মন্তব্য লেখা ছাড়াও তিনি বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ লিখতেন এবং তা এই পত্রিকার পাতায় ছাপা হত। এই সময় দেবেন্দ্রনাথের প্রভাবে ও উৎসাহে তিনি ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন এবং রামমোহনের চিন্তার সঙ্গে সম্যকভাবে পরিচিত হন (ডিসেম্বর ১৮৪৩)।

রামমোহনের চিন্তা থেকে তিনি নিয়েছিলেন দুটি জিনিস— মানবতান্ত্রিকতা এবং যুক্তিবাদ। এর বাইরে আর কিছুই তিনি নিতে চাননি বা গ্রহণ করেননি। ধর্মবিশ্বাস তো নয়ই। বরং বিশ্বের জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় পড়াশুনা করা এবং তার উপর লিখতে থাকার ফলে তিনি ধীরে ধীরে ব্রহ্মতত্ত্ব বা একেশ্বরবাদেও আস্থা হারিয়ে ফেলেন। রামমোহন রায় বেদ ও বেদান্ত থেকে যুক্তি দিয়ে বিচার করে শিক্ষা নিতে বলতেন। সেই বিচারপদ্ধতি প্রয়োগ করার ফলে তিনি দেখলেন, বৈদিক ও বৈদান্তিক সাহিত্যে অনেক কিছুই আছে যা কোনওমতেই সত্য বলে মেনে নেওয়া যায় না। এই নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেবেন ঠাকুরেরও বাদবিবাদ শুরু হয় এবং তিনি এক সময় দেবেন্দ্রনাথকে স্বীয় মতে আনতে সক্ষম হন। বেদ অপৌরুষেয়— এই বিশ্বাস থেকে ধীরে ধীরে তিনি সরে আসেন। তাছাড়া, ১৮২২ সালে রামমোহন লর্ড আমহার্স্টকে লেখা চিঠিতে যেভাবে শঙ্করাচার্যের মায়াবাদকে সমালোচনা করে কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ স্থাপনের বিরুদ্ধে জোরালো আপত্তি তুলেছিলেন, তাও অক্ষয় দত্তকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছিল। সেই চিঠিতে রাজা বাস্তব জীবনের জ্ঞানচর্চার নিরিখে বেদান্তের ব্রহ্মতত্ত্বকে কার্যত খারিজই করে দিয়েছিলেন।

রামমোহনের চিন্তাকে গ্রহণ করার পর তাঁর মননজগত থেমে যায়নি। বরং তা আরও সামনের দিকে এগোতে থাকে। ইউরোপের প্রাচীন দর্শন সাহিত্য ইতিহাস পড়তে গিয়ে তিনি ক্রমশ অনুভব করেন যে পৌত্তলিকতা (idolatry) এবং বহুদেববাদ (polytheism) আসলে একটি অত্যন্ত প্রাচীন ধর্মীয় বিশ্বাস, যা পশ্চিমের লোকেরা খ্রিস্টধর্মের একেশ্বরবাদের মধ্য দিয়ে বহুকাল আগেই কাটিয়ে উঠতে পারলেও সনাতন হিন্দুধর্ম তা আজও পারেনি। অথচ ভারতেও শঙ্করাচার্য কতকাল আগেই তো ব্রহ্মোপাসনার মত প্রবর্তন করেছিলেন। এইভাবে ধর্মকে ইতিহাসের আধারে দেখবার ফলে তিনি ধীরে ধীরে একটা সময়ে ধর্মবিশ্বাসকেই পরিত্যাগ করে বসেন। বেকন ও মিলের দর্শন এবং যুক্তিবাদকে গ্রহণ করার পাশাপাশি স্কটিশ চিন্তাবিদ কুম্ব এবং ফরাসি প্রত্যক্ষবাদী কোঁতে-র মতের প্রভাবে যতই তিনি বৈজ্ঞানিক বিচারপদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গি আয়ত্ত করতে থাকেন, সেই অনুপাতে তিনি ধর্ম ঈশ্বর প্রার্থনা উপাসনা ইত্যাদি সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়েন। ব্রাহ্ম থেকে প্রথমে সংশয়বাদী হয়ে অবশেষে তিনি একদিন সম্পূর্ণ বস্তুবাদী ও নিরীশ্বরবাদী চিন্তকে পরিণত হন। তাঁর চিন্তাজগতের এই ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তিনি উত্তরোত্তর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও তাঁর ভক্তিবাদী অনুগামীদের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন; তাঁদের মধ্যে মনোমালিন্য বাড়তে থাকে।

তিনি যখন তত্ত্ববোধিনীর পাতায় “ধর্মনীতি” এবং “বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধ” বিষয়ক প্রবন্ধগুলি লিখছিলেন, তখন থেকেই এই মতবাদিক সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। দেবেন্দ্রনাথ তাঁর ‘আত্মচরিত’-এ কোনও রাখঢাক না করেই বলে ফেলেন, “তিনি যা লিখতেন, তাতে আমার মতবিরুদ্ধ কথা কেটে দিতাম এবং আমার মতে তাঁকে আনবার জন্য চেষ্টা করতাম। কিন্তু তা আমার পক্ষে বড় সহজ ব্যাপার ছিল না। আমি কোথায় আর তিনি কোথায়। আমি খুঁজছি ঈশ্বরের সঙ্গে আমার কী সম্বন্ধ, আর তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন বাহ্যবস্তুর সঙ্গে মানবপ্রকৃতির কী সম্বন্ধ; আকাশপাতাল প্রভেদ!”

প্রভেদ সত্যিই আকাশ-পাতালের। কেননা, ব্রাহ্মসমাজের আলোচনায় যখন সাকার-নিরাকার পূজার তুল্যমূল্য বিচার চলত, ঈশ্বরকে বাতাসা প্রদানের প্রয়োজনীয়তা-অপ্রয়োজনীয়তা নিয়ে বাদানুবাদ হত, সেইরকম সময়ে, ১৮৪৯ সালে, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ব্রাহ্মধর্ম’ শীর্ষক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এতে তিনি শুদ্ধ চিত্তে ঈশ্বরের কাছে অন্তরের প্রার্থনা নিবেদন করলে ঈপ্সিত ফল লাভ হতে পারে বলে মত প্রকাশ করেছিলেন। সেই সময় একদিন হিন্দু কলেজের কিছু ছাত্র অক্ষয় কুমার দত্তের কাছে প্রার্থনার কার্যকারিতা বিষয়ে প্রশ্ন করে বসে। ডিরোজিও এবং ডিরোজিয়ানদের প্রভাব তো আর একেবারে নিঃশেষ করা যায়নি সমাজ থেকে! ফলে পনেরো-বিশ বছর আগেকার উত্থাপিত প্রশ্নগুলি নিয়ে তখনও কলকাতার কোনায় কোনায় ধিকিধিকি চর্চা চলছিলই। যাদের মনের ভেতরে প্রশ্নগুলি গুঞ্জরিত হচ্ছিল তারা ইতিমধ্যে জেনে ফেলেছে, ডিরোজিও স্যার বেঁচে না থাকলেও এখন কার কাছে গেলে এরকম সমস্যার সমাধান পাওয়া গেলে যেতেও পারে। দত্ত বেশি আলোচনায় গেলেন না। দুটো সরল সমীকরণ লিখে সমাধান করলেন:

পরিশ্রম = শস্য
পরিশ্রম + প্রার্থনা = শস্য
প্রার্থনা = ০

অর্থাৎ, তাঁর মতে, প্রার্থনায় কোনও ফল নেই। শস্য উৎপাদন করতে হলে পরিশ্রম করতেই হবে। তার সঙ্গে প্রার্থনা কেউ চাইলে করতেই পারে। কিন্তু প্রার্থনা না করলে যে পরিমাণ ফসল পাওয়া যাবে, প্রার্থনা করলেও সেই সমপরিমাণই ফসল ফলবে। সুতরাং প্রার্থনায় কোনও বাড়তি লাভ নেই। এমন যদি হত যে পরিশ্রম না করে শুধু প্রার্থনা করলেও ফসল পাওয়া যেত, কিংবা যদি শুধু পরিশ্রমের দ্বারা যতটা শস্য পাওয়া যায়, প্রার্থনা করলে তার সঙ্গে আরও কিছু বেশি পরিমাণ শস্য উৎপন্ন হয়, তাহলে প্রার্থনা করে লাভ হত। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে অঙ্কের হিসাবে প্রার্থনায় কোনও বিশেষ লাভ হয় না।

পাঠককে লক্ষ করতে বলি, ধাক্কাটা আসলে কোথায় গিয়ে পড়ছে। কালীপূজা ভূমিপূজা বাস্তুপূজা ইত্যাদির বিরুদ্ধে সমীকরণটি প্রযোজ্য হলে (কেননা, সেসব ক্ষেত্রেও একইভাবে এটা প্রয়োগ করা যেতে পারে) হিন্দুদের পৌত্তলিক বিশ্বাসের গায়ে ফোস্কা পড়লেও ব্রাহ্মদের নিরাকার ব্রহ্মের উপাসনায় কিছুই যেত-আসত না। এ তো তা নয়। প্রার্থনা তো ব্রাহ্মরাও করছে। নিরাকার ঈশ্বরকে স্মরণ করছে। একা একা করছে, সভায় লোকজন ডেকে এনে করছে। দেবেন্দ্রনাথ সকলকে প্রার্থনা করতে বলছেনও। অতএব এইরকম কঠোর বৈজ্ঞানিক যুক্তির অভিঘাত অনেক বেশি লাগছে ব্রাহ্মধর্মীয় বিশ্বাস ও আচারের মর্মমূলে। আর সেই সঙ্গে সেই সময়ে অক্ষয় দত্ত ব্রাহ্মসমাজ থেকে প্রার্থনা তুলে দেওয়ার জন্য দরবার করতে শুরু করেছিলেন। মেয়েদের জন্য ফুল বেলপাতা নৈবেদ্য সহযোগে ব্রহ্মোপাসনার প্রচলিত বিধিও তাঁর যুক্তিতর্কের প্রভাবে ব্রাহ্মসমাজ থেকে এক সময় উঠে যায়। দেবেন্দ্রনাথ ও অন্যান্যদের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হতে এবং বাড়তে থাকে।

আরও ঘটনা আছে।

তত্ত্ববোধিনী সভার মধ্যেই আবার অক্ষয় দত্ত রামমোহনের অনুসরণে আত্মীয় সভা নাম দিয়ে আর একটি সভার পত্তন করেন। তাতে বেশিরভাগ সদস্যই ছিলেন যুক্তিবাদী প্রশ্নশীল। তাঁরা অনেক সময় ভোটাভুটি করে ধর্মীয় তত্ত্বজিজ্ঞাসার সমাধান করতেন। সংখ্যায় অল্প হলেও তাঁরা দেবেন্দ্রনাথের প্রশ্নাতীত নেতৃত্বের পক্ষে অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠছিলেন। তার উপর এই সভার অনেকে দাবি করতে শুরু করলেন, প্রার্থনা যদি করতেই হয় তো তা বাংলায় কেন করা যাবে না? ঈশ্বর কি সংস্কৃত ছাড়া আর কোনও ভাষা বোঝেন না? একথা নিশ্চয়ই বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না যে এই ধরনের প্রশ্নগুলি শেষ পর্যন্ত যে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মবিশ্বাসের পক্ষে যথেষ্ট অস্বস্তিদায়ক।

এই মতবিরোধ আরও বহুগুণ বৃদ্ধি পায় বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের সপক্ষে আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে মতবাদিক চর্চা শুরু করলে। অক্ষয় দত্ত বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কার আন্দোলনের এই কার্যক্রমের পক্ষে দাঁড়িয়ে কলম ধরতে চান, কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ তাতে রাজি নন। তিনি বিদ্যাসাগরের শিক্ষাসংস্কার আন্দোলনের পক্ষে থাকলেও ধর্মসংস্কারের এইসব প্রচেষ্টার বিরোধী। পত্রিকার কর্তৃত্ব দেবেন্দ্রনাথের হাতে থাকা সত্ত্বেও অক্ষয় দত্ত এই ধরনের একটি লেখা ১৮৫৪ সালে প্রকাশ করেন তত্ত্ববোধিনীর পাতায়। এবং তাতে শুধু যুক্তি নয়, তাঁর স্বাভাবিক লেখনীর গতিমুখ খানিকটা পরিবর্তন করে প্রবল আবেগ সহকারে তিনি বিধবাবিবাহের পক্ষে বক্তব্য রাখেন।

পশ্চিমী রেনেশাঁসের যুক্তিবাদী মনোভাবকে তিনি এতটাই আত্মস্থ করেছিলেন যে, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদকে অনুসরণ করে চলতেন। এরকম উদাহরণ আমাদের দেশে তো বটেই, এমনকি রেনেশাঁসের আঁতুরঘর ইউরোপেও খুব বেশি সংখ্যায় নেই। কেউ ধর্ম মেনে চলেন কিন্তু আচারবিচার মানেন না; কেউ হয়ত ভগবানে বিশ্বাস করেন না কিন্তু ভূত-প্রেতের ব্যাপারে ভয় পান। অনেকের প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে হয়ত আস্থা নেই, কিন্তু তারা কোনও এক দূরাসীন দার্শনিক আত্মভোলা নিকম্মা ভগবানে বিশ্বাস করেন। এইভাবে তাঁরা অনেকেই জীবনের নানা কোনায় খামচিতে বিভিন্ন মাত্রার আপস করে চলেন। অক্ষয় দত্ত ছিলেন সমস্ত আচারবিচার কুসংস্কার কুপ্রথার প্রশ্নে আপসহীন। তিনি সত্য প্রদর্শন করানোর ইচ্ছা নিয়ে সচেতনভাবে বারবেলা কালবেলা কালরাত্রি অশ্লেষা মঘা ত্র্যহস্পর্শ ইত্যাদি পাঁজি নির্দেশিত অশুভ দিন এবং/অথবা অশুভ ক্ষণে দূরস্থানে যাত্রা করতেন; কোনও প্রসিদ্ধ মন্দিরে গেলে শিল্পকর্ম দেখতেন এবং তারিফ করতেন, কিন্তু প্রণাম-কর্মটি করতেন না। লোকে যেদিন পবিত্রতা ও পুণ্যের সন্ধানে বিশেষভাবে দলে দলে গঙ্গাস্নানে যেত, তিনি সেদিন অনেকটা হৈচৈ করে, অর্থাৎ, সকলকে সচকিত করে বাড়ির বা পাড়ার পুকুরে স্নান সারতেন। যাবতীয় ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রীয় আচার বিচার বিশ্বাসের বিরুদ্ধে তিনি হয়ে দাঁড়ালেন একজন সরব ও মূর্তিমান প্রতিবাদী!

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর সুলিখিত ও সুবিখ্যাত “ফলিত জ্যোতিষ” প্রবন্ধ রচনার প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে অক্ষয় দত্ত ঘোষণা করেছিলেন তত্ত্ববোধিনীর পাতায় (১৮৫১): “সুগ্রহ কুগ্রহ এই দুই শব্দের অর্থ নিতান্ত অলীক। … মঙ্গল, বুধ, শুক্র, শনি, প্রভৃতি গ্রহসকল প্রস্তরাদির ন্যায় জড় পদার্থময়। বুদ্ধিমান জীবের ন্যায় তাহাদের সঙ্কল্প বিকল্প, প্রবৃত্তি নিবৃত্তি, অনুগ্রহ নিগ্রহ থাকা কোনক্রমেই সম্ভাবিত নহে। আর যদি তাহাদের এই গুণ থাকিত, তাহা হইলেও মর্ত্যলোকস্থ মনুষ্যদিগের সহিত তাহার কি সম্বন্ধ? … গ্রহের তুষ্টিরুষ্টিতে লোকের সুখদুঃখ উৎপন্ন হয়, একথা সদ্বিদ্যাশালী বিজ্ঞ লোকদিগের নিকট কহিলে হাস্যাস্পদ হইতে হয়।”

আবার এই সময় থেকেই তাঁর শিরঃপীড়া এক আজীবন সঙ্গী হয়ে ওঠে। সম্ভবত আমরা আজকাল যাকে আধুনিক পরিভাষায় বলি মাইগ্রেইন (migraine) তাঁর সেই রোগটি হয়েছিল। ফলে, এতকাল যেভাবে রাত জেগে পড়াশুনা করে লিখে এবং সংগৃহীত লেখা সংশোধন করে তত্ত্ববোধিনীর পৃষ্ঠাগুলিকে আকর্ষণীয় করে তুলছিলেন, তাঁর আশঙ্কা হল, আর বোধ হয় তা পারবেন না। সম্পাদকীয় দায়িত্ব তিনি ছেড়ে দিলেন। আর কী আশ্চর্য! বিগত বারো বছরের শ্রমে তিনি এই পত্রিকার যে সুনাম তৈরি করেছিলেন, তাঁর হাত থেকে অন্য হাতে দায়িত্ব যাওয়ার পর থেকে সেই সুনাম আর রইল না। যুক্তির সঙ্গে সঙ্গে শক্তিও চলে গেল, পড়ে রইল শুধু ভক্তি।

 

।। ৫ ।।
শোনা যায়, ব্রাহ্ম সমাজের অনেকেই সেসময় তাঁকে আক্রমণ করে লিখতে এবং বলতে থাকেন। যেমন, ঠাকুর পরিবারের ঘনিষ্ঠ রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬-৯৯) একবার ১৮৫০ সালের মাঘোৎসবের সভায় ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, “যে পর্যন্ত তোমার চরিত্র শোধন না কর— সে পর্যন্ত তুমি কেবল এক গ্রন্থবাহক চতুষ্পদ তুল্য।” প্রশ্ন হল, কী তাঁরা চেয়েছিলেন অক্ষয়কুমার দত্তের কাছে? চরিত্রের কী কী দোষ তাঁকে শোধন করতে বলা হচ্ছিল? এই নতুন বিশেষণটিরই বা রহস্য কী?

বেশি বেশি করে বই যাঁরা পড়েন এবং পড়তে ভালোবাসেন, বই থেকে উদ্ধৃতি বা রেফারেন্স দেন, তাঁদের উদ্দেশে অনেকে স্নেহচ্ছলে বা গাত্রজ্বালায় ‘গ্রন্থকীট’ বলে রসিকতা বা বিদ্রূপ বর্ষণ করে থাকেন। সমাজের অধিকাংশ মানুষই যেহেতু গ্রন্থবিমুখ, এই রস বা খোঁচা সহজেই জনমনে গৃহীত ও অনুমোদিত হয়। এটা আমরা সকলেই জানি। হয়ত সেদিনও হত। কিন্তু এখানে অন্য দুটি স্বল্প-পরিচিত শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ‘গ্রন্থবাহক চতুষ্পদ’। কী এর তাৎপর্য?

এই মধুর সম্ভাষণের গূঢ়ার্থ বুঝতে হলে প্রার্থনা-সমীকরণটির কিছুদিন আগে থেকে শুরু করে এর কিছু দিন পর পর্যন্ত সময়কালে অক্ষয়কুমার দত্ত যে গ্রন্থগুলি রচনা করেন তাদের বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানতে হবে। এখানে সংক্ষেপে একটু সেই চেষ্টা করে দেখা যাক।

তাঁর রচিত পাঠ্যপুস্তক হিসাবে ভূগোল বইয়ের কথা আগেই বলেছি। দার্শনিক গুরুতর চিন্তার প্রকাশ হিসাবে অবশ্য তাঁর প্রথম বই ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধবিচার’— যার প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড যথাক্রমে ১৮৫১ ও ১৮৫৩ সালে প্রকাশিত হয়। এটি একেবারে মৌলিক রচনা নয়। স্কটল্যান্ডের বিজ্ঞান লেখক জর্জ কুম্ব-এর ১৮২৮ সালে লেখা Essay on the Constitution of Man and Its Relation to External Object বইটির প্রায় একরকম ভাবানুবাদ বলা যেতে পারে। এর বিষয়বস্তুর অনেক কিছুই সঠিক তথ্যসম্মত নয়। সেদিনও ছিল না। কিন্তু স্কটিশ লেখক যেভাবে ভৌতবস্তুর সঙ্গে মানুষের শারীরিক ও মানসিক বৈশিষ্ট্যের সম্পর্ক নির্ণয় করার চেষ্টা চালিয়েছেন, অক্ষয় দত্তও সেই জিনিসটিই এদেশের পাঠকদের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। জগৎ সংসারের সমস্ত ঘটনার পেছনে সদাসক্রিয় ঈশ্বর নয়, একটা সাধারণ জাগতিক কার্যকারণ সম্বন্ধ রয়েছে, কুম্ব-এর এই প্রতিপাদ্যটি অক্ষয় দত্তের কাছে বেশি আকর্ষণীয় ছিল। এইটিই তিনি বাঙালি পাঠকের দরবারে পেশ করতে চেয়েছিলেন। এই বইয়ের তত্ত্বকথাগুলি কুম্ব থেকেই তিনি কমবেশি নিয়েছিলেন, কিন্তু প্রায় সমস্ত উদাহরণগুলি তিনি সাজিয়ে দিয়েছিলেন ভারতীয় নৈমিত্তিক জীবন থেকে।

এরপর প্রকাশিত হয় তাঁর তিন খণ্ডে ‘চারুপাঠ’। প্রথম খণ্ড ১৮৫৩, দ্বিতীয় খণ্ড ১৮৫৬ এবং তৃতীয় খণ্ড ১৮৫৯ সালে বেরোয়। এইগুলিতে তিনি সম্পূর্ণ নিজের পছন্দমতো বিষয়ে শিশুদের উপযোগী করে বিজ্ঞানের নানা প্রসঙ্গ সহজসরল ভাষায় ব্যাখ্যা করেন। এই বইয়ের খণ্ডগুলিতে তিনি যে সমস্ত বিষয়ের উপর প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন, তার কয়েকটি নমুনা নিলে তাঁর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারের উদ্দেশ্যটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। যথা— আগ্নেয়গিরি, সিন্ধুঘোটক, বীবর, জলপ্রপাত, পৃথিবীর আকার পুরু ভুজ, পৃথিবীর পরিমাণ, উষ্ণ প্রস্রবন, দীপ মক্ষিকা, পৃথিবীর গতি, বনমানুষ, বল্মীক, হিমশিলা, মুদ্রাযন্ত্র, ব্যোমযান, বর্ষণবৃক্ষ, দিগদর্শন, প্রবাল, চন্দ্র, আলেয়া, সৌরজগত, গ্রহ ও উপগ্রহ, ধূমকেতু, তাপমান, উড্ডীয়মান মৎস, পতঙ্গভূক বৃক্ষ, ভূগর্ভস্থ হ্রদ, অন্ধ মৎস, ইত্যাদি। এই সমস্ত বিষয়গুলিকে উপলক্ষ করে তিনি সমকালীন প্রচলিত নানা রকম ভ্রান্ত ধারণা ও মতবাদগুলি থেকে মুক্ত করে কোমলমতি ছাত্রদের মধ্যে সঠিক ধারণা ও জ্ঞানের স্পর্শ দিতে চেয়েছিলেন।

চারুপাঠ তৃতীয় খণ্ডের দুটি প্রবন্ধের নাম আমি এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাইছি— “ব্রহ্মাণ্ড কি প্রকাণ্ড” এবং “সুশিক্ষিত ও অশিক্ষিত লোকের সুখের তারতম্য”। অক্ষয় দত্ত বহু কাল ধরেই অবজ্ঞাত ও বিস্মৃতপ্রায়। তবু এখন যাঁরা তাঁকে নিয়ে চর্চার একটা নতুন বাতাবরণ নির্মাণ করছেন, সেই বিশ্লেষকরাও সচরাচর এই বিষয়গুলিকে আলোচনার মঞ্চে টেনে আনেন না। প্রথম প্রবন্ধটি একটি লোকপ্রিয় বিজ্ঞানের আলোচনা; কিছু মাপজোকের প্রশ্ন এবং গত দুই শতকে দত্তোত্তর আবিষ্কৃত মহাজাগতিক তথ্যের কথা বাদ দিলে, খুবই ঐক্ষণিক (uptodate), আজকালের একজন ছাত্রকেও এটা জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রাথমিক পাঠ হিসাবে পড়তে দেওয়া যায়। আর দ্বিতীয় প্রবন্ধটি সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রকে ধরে লিখিত। শিরোনামটিই খুব আকর্ষণীয়। ১৮৫০-এর দশকে তিরিশ-পঁয়তিরিশ বছর বয়স্ক একজন যুবকের এরকম একটা শুদ্ধ নৈতিক প্রশ্ন উত্থাপনই আমাদের প্রবলভাবে চমকিত করে। শিক্ষার গুণগত মানকে সংশ্লিষ্ট করে সুখের তারতম্য নির্ধারণের বিষয়টিই শুধু সেকালে নয় একালেও যথেষ্ট তাৎপর্যময়। তার সূচনা অনুচ্ছেদেই তিনি লেখেন:

জ্ঞানের কি আশ্চর্য প্রভাব! বিদ্যার কি মনোহর মূর্তি! বিদ্যাহীন মনুষ্য মনুষ্যই নয়। বিদ্যাহীন মনের গৌরব নাই। মানব-জাতি পশু-জাতি অপেক্ষায় যত উৎকৃষ্ট, জ্ঞান-জনিত বিশুদ্ধ সুখ ইন্দ্রিয়-জনিত সামান্য সুখ অপেক্ষা তত উৎকৃষ্ট। পৌর্ণমাসীর সুধাময়ী শুক্লযামিনীর সহিত অমাবস্যার তামসী নিশার যেরূপ প্রভেদ, সুশিক্ষিত ব্যক্তির বিদ্যালোক সম্পন্ন সুচারু চিত্তপ্রাসাদের সহিত অশিক্ষিত ব্যক্তির অজ্ঞান-তিমিরাবৃত হৃদয়-কুটিরের সেইরূপ প্রভেদ প্রতীয়মান হয়। অশিক্ষিত ব্যক্তি নিকৃষ্ট সুখে ও নিকৃষ্ট কার্যে নির্বৃত থাকিয়া নিকৃষ্ট সুখাধিকারী নিকৃষ্ট জীবের মধ্যে গণনীয় হয়, সুশিক্ষিত ব্যক্তি জ্ঞান-জনিত ও ধর্মোৎপাদ্য পরিশুদ্ধ সুখ সম্ভোগ করিয়া, আপনাকে ভূলোক অপেক্ষায় উৎকৃষ্টতর ভূধরাধিবাসের উপযুক্ত করিতে থাকেন। এই উভয়ের মনের অবস্থা ও সুখের তারতম্য পর্যালোচনা করিয়া দেখিলে উভয়কে এক জাতীয় প্রাণী বলিয়া প্রত্যয় হওয়া সুকঠিন।

তারপর তিনি শিক্ষার সুফল ও অশিক্ষার কুপরিণাম বোঝাতে চেয়ে যে কথাগুলি লেখেন তা আজকের দিনেও একটা বিজ্ঞান সংগঠনের পুস্তিকায় কথ্য ভাষায় পরিবর্তন করে দিলে অনায়াসে জায়গা করে নিতে পারে:

সুশিক্ষিত ব্যক্তি বুদ্ধিবৃত্তি মার্জিত ও বর্ধিত করিয়া,পরম পবিত্র সুখার্দ্র হৃদয়ে যেরূপ পরমাদ্ভূত পরিশুদ্ধ জ্ঞানারণ্যে বিচরণ করেন, অশিক্ষিত ব্যক্তি স্বপ্নেও তথায় একবার পদার্পণ করিতে পারগ হয় না। সে ব্যক্তি বিদ্যামন্দিরের দ্বারস্বরূপ ব্যাকরণ-বিদ্যাকেই যথার্থ বিদ্যা বোধ করে; জন্মপত্রিকা রচনা ও শুভাশুভ দিনক্ষণ গণনাকেই প্রকৃতি জ্যোতির্বিদ্যা বলিয়াই প্রত্যয় করে, অশৌচ ব্যবস্থা ও প্রায়শ্চিত্ত বিধানকেই প্রকৃত ধর্মোপদেশ বলিয়া বিবেচনা করে এবং মনঃকল্পিত পৌরাণিক ইতিহাসকেই ভূলোকের প্রকৃত ইতিহাস বলিয়া প্রত্যয় করে। স্বদেশীয় শাস্ত্রে যে বিষয়ে যেরূপ নিয়ম নির্দিষ্ট আছে, এবং স্বদেশ মধ্যে যে কার্যে যেরূপ রীতি প্রচলিত আছে, তাহাই সর্বোৎকৃষ্ট বলিয়া বিশ্বাস করে। পিতৃপিতামহাদি পূর্বপুরুষেরা যে প্রাচীন পথ অবলম্বন করিয়া চলিতেছেন, তাহাই সেই ব্যক্যির মতে সর্বোত্তম। তাহা নিতান্ত যুক্তি-বিরুদ্ধ ও একান্ত অসঙ্গত হইলেও তাহার অভিপ্রায় পরিবর্তনসহ নয়। … তাহার অজ্ঞানাবৃত অন্তঃকরণ সর্বস্থানেই নানা বিভীষিকা কল্পনা করে। ভূত, প্রেত, পিশাচ ইত্যাদি অবাস্তবিক পদার্থ তাহার হৃদয় ক্ষেত্রে নিরন্তর বিচরণ করে। সে ব্যক্তি সদাই শঙ্কিত, নিয়তই উৎকণ্ঠিত, কত প্রকার কুসংস্কার পাশে বদ্ধ হইয়া থাকে। বিহঙ্গ বিশেষের স্বর-বিশেষই বা কত ত্রাস ও কত উৎকণ্ঠা উপস্থিত করে।

আমাদের আজকের দিনের মতোই দত্তও সেদিন অবাক হয়ে দেখেছেন, “আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সমস্ত অসত্য বিষয়ে তাহার যেরূপ বিশ্বাস আছে, তাহা কদাচ বিচলিত হইবার নয়; কিন্তু বিজ্ঞানের অনুশীলন দ্বারা যে সমস্ত যথার্থ বিষয় নিরূপিত হইয়াছে, ও যে সকল অভিনব তত্ত্ব উদ্ভাবিত হইয়াছে, তাহাতে তাহার প্রত্যয় জন্মানো সুকঠিন কর্ম।” শিক্ষার অভাবজনিত কুসংস্কার সমূহের সর্বব্যাপী প্রভাব ও প্রকাশকে তিনি শুধু বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তির দিক থেকেই সমালোচনা করেননি, তাকে যথার্থ মনুষ্যসুলভ সুখের অপ্রাপ্তি হিসাবে চিহ্নিত করে গেছেন। জ্ঞানের আলোকপ্রাপ্ত এবং কুসংস্কারমুক্ত মানুষই যে সত্যিকারের অর্থে মানুষ, এবং সুখী মানুষ— অক্ষয় দত্তের এ এক অসাধারণ উপলব্ধি এবং শিক্ষা। এবং এ কথা নিশ্চয়ই বলা বাহুল্য যে শিক্ষিত বলতে দত্ত নিছক ডিগ্রিপ্রাপ্ত বোঝাননি, প্রকৃত সত্য জ্ঞানপ্রাপ্তিকেই বুঝিয়েছেন।

প্রায় এই সময়েই তিনি লেখেন আরও দুখানা বই— ধর্মনীতি এবং পদার্থবিদ্যা (১৮৫৬)। এরও প্রথমটি কুম্ব-এর বই Moral Philosophy অনুসরণ করে লেখা। দ্বিতীয়টিও ইংরেজিতে লেখা বিভিন্ন পদার্থবিজ্ঞানের বই থেকে প্রয়োজনীয় অংশবিশেষ তুলে তুলে অনুবাদ করে নিজের ভাষায় ও ঢঙে রচিত। কিন্তু দুটি বইয়েরই উদ্দেশ্য অভিন্ন। বস্তুজগত সম্পর্কে ছাত্রদের মধ্যে একটা ন্যূনতম জ্ঞান পৌঁছে দেওয়া, ধর্মের নামে বা নৈতিকতার নামে আচার বিচার কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেওয়ার বিরোধিতা করে সরল স্বাভাবিক সুস্থ সুন্দর জীবন গড়ে তোলা এবং সমাজের হিতের জন্য জীবন অতিবাহিত করাকে সু-উচ্চ নৈতিকতা হিসাবে তুলে ধরা। প্রতিটি বইয়ের মধ্যে মানবতান্ত্রিক যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক অক্ষয় কুমার দত্তের হস্তশিল্প ফুটে উঠেছিল।

‘ধর্মনীতি’ গ্রন্থে তিনি নৈতিক আলোচনা করতে গিয়ে সমস্ত প্রচলিত দেশাচারের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করেছেন। একদিকে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরুদ্ধে লিখেছেন, অপরদিকে বিধবাবিবাহ ও অসবর্ণ বিবাহের সপক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন। তখনও ঈশ্বরে বিশ্বাস তাঁর হয়ত ছিল, কিন্তু তা তখন দ্রুত বিলীয়মান। বহুপ্রচলিত বিশ্বাসের বাইরে গিয়ে একজন প্রকৃত যুক্তিবাদীর মতো তিনি নীতিবোধ (morality)-কেও ধর্ম থেকে আলাদা করে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছিলেন। যে ভাবনা অনেকটা জিওর্দানো ব্রুনো কিংবা বারুখ স্পিনোজার দার্শনিক মতবাদের অনুসারী। এই জায়গায় কুম্ব-এর সঙ্গে তাঁর সবিশেষ পার্থক্যও ছিল। প্রথমজনের রচনায় বিজ্ঞানসম্মত আলোচনার পাশাপাশি ঈশ্বরভক্তি উপাসনা এবং প্রার্থনাও ছিল; অক্ষয় দত্ত ভক্তিমার্গ থেকে ক্রমাগতই জ্ঞানমার্গের দিকে সরে সরে যাচ্ছিলেন। আর এই জ্ঞানের জন্য তিনি হিন্দুশাস্ত্র নয়, ইউরোপীয় বিজ্ঞানের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ছিলেন। ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধবিচার (১ম খণ্ড)’-এর ভূমিকায় অনস্পষ্ট ভাষায় তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “সংস্কৃত শাস্ত্রোক্ত প্রমাণ ভিন্ন অন্য কোনও প্রমাণ গ্রাহ্য নহে, এবং সংস্কৃত শাস্ত্রকারেরা যে বিষয় যতদূর নিরূপণ করিয়াছেন, তাহার অধিক আর জানা যায় না, এই মহানর্থকর চিন্তা নিতান্ত ভ্রান্তিমূলক এবং অত্যন্ত হেয় ও অশ্রদ্ধেয়।” কেননা, তাঁর মতে, “অখিল সংসারই আমাদিগের ধর্মশাস্ত্র। বিশুদ্ধ জ্ঞানই আমাদের আচার্য।” তিনি তখন বিভিন্ন সভায় বলে বেড়াতেন, “ভাস্কর ও আর্যভট্ট এবং নিউটন লাপ্লাস যে কিছু যথার্থ বিষয় উদ্ভাবন করিয়াছেন তাহাও আমাদের শাস্ত্র; গৌতম ও কণাদ এবং বেকন ও কোম্‌ত যে কোনও প্রকৃত তত্ত্ব প্রচার করিয়াছেন তাহাও আমাদের শাস্ত্র।”

নামগুলি লক্ষ করার মতো। যাজ্ঞবল্ক্য বশিষ্ঠ বাদরায়ন মনু পরাশর রঘুনন্দন মেধাতিথি কুল্লুকভট্ট শঙ্কর রামানুজ— ইত্যকার ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্যের অধ্যাত্মরসশ্রেষ্ঠ মুনি-ঋষিদের নাম অক্ষয় দত্তের আচার্য তালিকায় ঢোকার ছাড়পত্র পায়নি। ধর্মবিশ্বাসীরা তাঁদের সর্বমান্য গুরুদের বেছে নিয়েছেন। যাঁদের পথে তাঁরা চলবেন। বিজ্ঞানপন্থীদের তরফ থেকে অক্ষয় দত্তও পূর্বসূরি শিক্ষকদের চিনে নিয়েছেন এবং আমাদের চিনিয়ে দিয়েছেন। যাঁরা অতীতের অন্ধকারের গুহাতেও জ্ঞানের আলোর মশাল জ্বেলে মানুষকে একটু একটু করে এগিয়ে চলার পথ দেখিয়ে দিয়ে গেছেন।

সুতরাং এতে আশ্চর্যের কিছু নেই যে এই মানুষটির জ্ঞানচর্চার প্রাবল্য ও অভিমুখ ভক্তিমার্গীয় বিশ্বাস ও আচরণের পক্ষে ক্ষতিকারক বলে বিবেচিত হবে। রাজনারায়ণের সঙ্গে অক্ষয়কুমারের ব্যক্তিগত সম্পর্ক খারাপ ছিল না। আজীবন বন্ধুত্ব ছিল তাঁদের মধ্যে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বসু দীর্ঘলালিত অন্ধ বিশ্বাসে আঘাত পড়ায় তাঁর ভেতরের অসন্তোষ চেপে রাখতে পারেননি। বলতে চেয়েছেন, ‘তুমি পিঠে করে অনেক গ্রন্থ বহন করে চলেছ; কিন্তু সব গ্রন্থের সার যে ঈশ্বরভক্তি তা তুমি অন্তরে গ্রহণ করতে পারনি। অথচ বইয়ের ভার এত বেশি যে তোমাকে শুধু দু পায়ে ভর দিয়ে নয়, দুই হাতেও ভর দিয়ে চলতে হচ্ছে।‘ মন্তব্যটিতে যুক্তিবাদীর বিরুদ্ধে সৌজন্যের কিঞ্চিৎ ঘাটতি থাকলেও ভক্তিবাদীর মর্মবেদনা প্রকাশে তা একেবারে অনবদ্য। তাঁদের এই বিরোধিতা অক্ষয় দত্তের মৃত্যুর পরেও বজায় ছিল। মহেন্দ্রনাথ রায় বিদ্যানিধির লেখা অক্ষয়কুমার দত্তের প্রামাণ্য জীবনী-গ্রন্থে ব্রাহ্ম সমাজের নেতাদের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্যের বিষয়টি বিস্তারিতভাবে দেওয়ায় এবং তাঁর আসন একটু উঁচুতে রাখায় ব্রাহ্ম সমাজের পক্ষ থেকে গভীর অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। তাঁরা নকুড়চন্দ্র বিশ্বাস নামে দেবেন্দ্রনাথের বিশ্বস্ত একজনকে দায়িত্ব দেন নতুন করে অক্ষয়-জীবনী লেখার জন্য, যেখানে তাঁর ভূমিকা অনেকটাই খাটো করে দেওয়া হয়। কর্তায় ইচ্ছায় কর্ম করার মতো গুণী লোকের অভাব যে এই ঐতিহ্যমণ্ডিত দেশে কোনওদিনই হয়নি— এই ঘটনা তারই আর একটি প্রমাণ।

[আগামী সংখ্যায় সমাপ্য]