Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

লেনিনবাদ: লুকাচ ও স্তালিন-এর মূল্যায়ন

লেনিনবাদ: লুকাচ ও স্তালিন-এর মূল্যায়ন -- শুভেন্দু সরকার

শুভেন্দু সরকার

 


লেখক নিবন্ধকার, পেশায় অধ্যাপক

 

 

 

 

ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন (১৮৭০-১৯২৪)-এর মৃত্যুর অব্যবহিত পর, মার্কসবাদী তত্ত্ব ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে সদ্য প্রয়াত বিপ্লবীর অবদান নিয়ে নিজেদের মূল্যায়ন হাজির করেন গেওর্গ লুকাচ (১৮৮৫-১৯৭১) ও জোসেফ স্তালিন (১৮৭৮-১৯৫৩)। একই বিষয়ে দু-বছর পর, ১৯২৬-এ বেরোয় স্তালিনের ভাষণের আর-একটি লিখিত রূপ।

লেনিনবাদ সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণার জন্যে তাঁর মৌলিক রচনার পাশাপাশি এই তিনটি বিশ্লেষণই পড়া দরকার সকলের। ১৯১৭-র বিপ্লবের আগে-পরে লেনিনের লেখাজোখা থেকে তাঁর ভাবনা ও কাজের পরিপ্রেক্ষিত আর সেইসঙ্গে তাঁর চিন্তার বিবর্তন স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন এঁরা। দেখার ব্যাপার, বেশ কিছু বিষয়ে যেমন দুজন সমান জোর দিয়েছেন, তেমনি তাঁদের আবার টেনেছে লেনিনবাদের আলাদা-আলাদা বিশেষ কোনও দিক।

বিপ্লবের বাস্তবিকতা লেনিন-এর চিন্তা ও কাজকর্মর সামগ্রিক চালিকাশক্তি― এমনই মনে করতেন লুকাচ। অর্থাৎ, প্রলেতারীয় বিপ্লব ঘটানোই লেনিনের অভীষ্ট। সব ধরনের অবস্থাতেই তিনি সিদ্ধান্ত নিতেন বিপ্লবের দৃষ্টিকোণ থেকে। এই দার্শনিক আশ্রয়বাক্যর ভিত্তিতে লুকাচ নিজের বই (লেনিন: তাঁর চিন্তার ঐক্যবিষয়ে একটি পর্যালোচনা)-এ আলোচনা করেছেন লেনিন-এর বিভিন্ন প্রতিপাদ্য ও সিদ্ধান্ত। নিছক অর্থনীতিবাদ অথবা যান্ত্রিকভাবে পুঁজিবাদ পেরিয়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পরিবর্তে পরিস্থিতি অনুসারে সামন্ততান্ত্রিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ১৯০২-এই প্রলেতারীয় বিপ্লবকে (কী করতে হবে?) বেছে নেন লেনিন। কোনও দূর-কল্পনা নয়, বিপ্লবকে তিনি রোজকার জীবনের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন সেখানে। এভাবেই লেনিন-এর হাতে মার্কসবাদ হয়ে ওঠে মূর্ত― একটি ব্যবহারিক শক্তি।

লেনিন জানতেন, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী মালিকানা নির্ভর পুঁজিবাদী সমাজে অনিবার্যভাবে আসে  বেকারি, অনাহার, যন্ত্রণা আর দারিদ্র। আবার, পুঁজিবাদ-পূর্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কমিউনিস্টদের ফেরার প্রশ্নও ওঠে না। তাই তিনি চাইলেন, মূলত কৃষিভিত্তিক রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হোক পুঁজিবাদী শিল্পব্যবস্থা। সেক্ষেত্রে অবশ্য বুর্জোয়াদের লেজুড় হবে না শ্রমিকশ্রেণি― বরং ঐ ব্যবস্থায় সুবিধে পাবে খেটে-খাওয়া জনতা, মুনাফা থকে বঞ্চিত হবে বুর্জোয়ারা। সাধারণ জনগণের চেতনার উন্নতি করা যাবে রাষ্ট্রদখলের পর। খেয়াল রাখা দরকার, ইওরোপের অন্যন্য উন্নত দেশগুলির মতো রাশিয়ায় বুর্জোয়াশ্রেণি জৈবিকভাবে গড়ে ওঠেনি, তাই সংখ্যায় তারা ছিল কম আর ক্ষমতার দিক দিয়ে দুর্বল। এমনকি, সুযোগ বুঝে জারের সঙ্গে আঁতাতেও রাজি ছিল সেসব রক্ষণশীল বুর্জোয়ারা। অন্যদিকে, সাংস্কৃতিকভাবে পিছিয়ে থাকা আর চূড়ান্ত শোষিত বিশাল কৃষকসমাজকে বিপ্লবে সামিল করাও হয়ে পড়ে সমান জরুরি। সে-কাজের নেতৃত্ব দেওয়ার ভার বর্তায় শ্রমিকশ্রেণির ওপরই। শুধু তা-ই নয়, অন্যান্য শোষিত শ্রেণির সঙ্গেও প্রলেতারিয়েত-এর জোট বাঁধার কথা বলেন লেনিন।

স্বাভাবিক যে, বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে গেলে চেতনার নিরিখে শ্রমিকশ্রেণিকে হতে হবে সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদের পিছুটান থেকে মুক্ত। কিন্তু এও ঠিক যে, শ্রেণিচেতনা আপনা থেকে গড়ে ওঠে না; তার জন্যে দরকার প্রত্যক্ষ ও দীর্ঘ সংগ্রাম― যেখানে আসে কখনও জিত, কখনও হার। আবার, শ্রমিকশ্রেণির স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের ওপর ছাড়লে সে-লড়াইয়ে সাফল্য আসবে না; তার জন্যে গড়ে তোলা দরকার নির্দিষ্ট সংগঠন― পার্টি। বলা চলে, লেনিন-ই প্রথম তাত্ত্বিক যিনি কমিউনিস্ট পার্টির গঠন ও উদ্দেশ্য নিয়ে বিস্তারে লিখেছেন। তাঁর মতে, পার্টির সদস্যরা হবেন পেশাদার বিপ্লবী― মনপ্রাণ দিয়ে সর্বক্ষণ যাঁরা পার্টির কাজ করবেন আর সবরকম ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকবেন। প্রলেতারিয়েতের সবচেয়ে সচেতন ও আগুয়ান এইসব কর্মীরা যেমন অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করে বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবেন তেমনি জনগণের থেকে শিক্ষা নিতেও পিছুপা হবেন না। এছাড়া, পার্টিকে আদর্শগত বিচ্যুতি থেকে রক্ষাও তাঁদের কাজ। কমিউনিস্ট পার্টি হল একইসঙ্গে বৈপ্লবিক গণসংগ্রামের পূর্বশর্ত ও পরিণাম― এই ছিল লেনিন-এর প্রতিপাদ্য। লক্ষ্য স্থির থাকলেও পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির বিচার-বিশ্লেষণ আর সেই অনুসারে পার্টির কর্মসূচি সর্বদা অদলবদল জরুরি। না-হলে কমিউনিস্ট পার্টি হয়ে পড়ে জনগণের থেকে বিচ্ছিন্ন।

লুকাচের আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে লেনিনের তত্ত্ব ও প্রয়োগের ঐক্য। স্তালিনও তা নির্দ্বিধায় মেনেছেন, কিন্তু তাঁর ভাষণ (লেনিনবাদের ভিত্তি)-এ বেশি জোর পড়ে লেনিনের তত্ত্ব ও প্রয়োগগত সংযোজনের ওপর। তাঁর মতে, লেনিনবাদ আদতে হল সাম্রাজ্যবাদী যুগে মার্কসবাদের পরিণত রূপ। মার্কস ও এঙ্গেলসের সময়ে গোটা দুনিয়া সাম্রাজ্যবাদ (পুঁজিবাদের চূড়ান্ত রূপ)-এর আওতায় আসেনি; বিশ্বযুদ্ধও তাঁরা দেখেননি। ইওরোপের উন্নত পুঁজিবাদী দেশই ছিল তাঁদের মতে শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবের পক্ষে উপযুক্ত। কিন্তু পরিবর্তিত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি অনুসারে লেনিন বিপ্লব ঘটালেন এক অনুন্নত দেশে যেখানে সংখ্যালঘু শ্রমিকশ্রেণি ক্ষমতা দখল করল। একেই ‘লেনিনবাদ’ বলেছেন স্তালিন। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক (১৮৮৯-১৯১৬)-এর দলগুলির মতামত ও কর্মনীতি লেনিন বাতিল করেছিলেন এই ভাবনার ভিত্তিতেই।

সাম্রাজ্যবাদী যুগে উন্নত দেশে দেখা দেয় একচেটিয়া পুঁজি আর শ্রমের নজিরবিহীন দ্বন্দ্ব। অন্যদিকে, আগ্রাসী পুঁজিবাদ অনুন্নত দেশকে বেছে নেয় কাঁচা মাল, বাজার আর মুনাফার স্বার্থে। এর অনিবার্য ফল, পুঁজিবাদী দেশগুলির মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ। তাতে অবশ্য পুঁজিবাদই দুর্বল হয়। লেনিন এই পর্যায়ের পুঁজিবাদকে বলেছিলেন, ‘মুমূর্ষু’। এও মনে রাখার, অনুন্নত দেশ সাম্রাজ্যবাদের আওতায় এলে সেখানে যেমন চলে নির্মম অত্যাচার ও শোষণ তেমনি দেখা দেয় স্থানীয় মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি বুর্জোয়াশ্রেণি (যাঁদের মধ্যে প্রসার পায় জাতীয়তাবাদ) আর শ্রমিকশ্রেণি। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সেখানে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে এক বৈপ্লবিক জোট। এভাবে অনুন্নত দেশে পুঁজিবাদের প্রাণরস শুষে নিয়ে বিপ্লব ঘটানো সম্ভব― নতুন পরিস্থিতে এক নতুন তত্ত্বর সন্ধান দিলেন লেনিন। উন্নত পুঁজিবাদী দেশে নয়, বিপ্লব বরং সংগঠিত হবে সেই দেশে যেখানে সাম্রাজ্যবাদের সূত্র (যা সংযুক্ত করেছে সমগ্র দুনিয়া) সবচেয়ে বেশি দুর্বল। এ তত্ত্ব পাওয়া যায় তাঁর সাম্রাজ্যবাদ:পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর (১৯১৭)-এ। সে-বইয়ের ভূমিকায়  লেনিন ঘোষণা করেন, “সাম্রাজ্যবাদের পর্বটি হল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পূর্বমুহূর্ত।”

লেনিনের তত্ত্ব স্বাভাবিকভাবেই শুধু রাশিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল না। দেশে-দেশে শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলে সমগ্র দুনিয়ায় সাম্রাজ্যবাদকে পরাস্ত করার কথাও তিনি বলেছেন। কিন্তু রাশিয়ায় বিপ্লব প্রথম সফল হল অনুকূল সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত ও কাজের জন্যে। বিপ্লবী তত্ত্ব প্রয়োগের জন্যে সেখানে ছিল পার্টির যোগ্য নেতৃত্ব। লেনিন অবশ্য মনে করতেন বৈপ্লবিক অনুশীলন পদ্ধতি সর্বদা বজায় রাখতে হবে পার্টির অন্দরেও। প্রলেতারীয় পার্টির আত্মসমালোচনা, শুদ্ধিকরণ, নির্দ্বিধায় ভুল স্বীকার ও পর্যালোচনা আর তা শোধরানো― এসবই লেনিনবাদের অঙ্গ।

দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের দলগুলি বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার সঙ্গে আপস করে ফেলে। নির্বাচনে লড়ে কিছু আসন দখল, শ্রমিক ধর্মঘট আর ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে তাদের কর্মসূচি। রাষ্ট্রব্যবস্থা দখল আর সেসব দলের লক্ষ্য ছিল না। বলা যায়, মার্কসবাদের বৈপ্লবিক দিকটি একেবারে ভোঁতা হয়ে গেছিল তখন। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের ফোঁপরা নীতির বিরুদ্ধে লেনিন শুধু নিরন্তর লড়াই চালাননি, মূর্ত পরিস্থিতির (বাইরে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ আর অন্দরে জারের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ) মূর্ত বিশ্লেষণ করে শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবের জন্যে পার্টি র্প্রতিষ্ঠা করেছেন। আপ্তবাক্য নয়, প্রয়োগই বরং তাঁর তত্ত্বকে পথ দেখিয়েছে। কিন্তু এও সত্যি, তত্ত্বকে কখনো লেনিন খাটো করেননি― তিনি হামেশাই বলেছেন, বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া বিপ্লবী আন্দোলন সম্ভব নয়। তত্ত্ব ও প্রয়োগের দ্বান্দ্বিক ঐক্য গড়াই লেনিনের বিশেষ কীর্তি।

প্রসঙ্গত বলা দরকার, সাম্রাজ্যবাদী প্রথম বিশ্বযুদ্ধর অনেক আগেই শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবের তত্ত্বর হদিশ দিয়েছিলেন লেনিন। ১৯০৫-এ (দুটি কৌশল) তিনি দু-স্তরের বিপ্লবের কথা বলেন― প্রথম, গণতান্ত্রিক বিপ্লব, যখন কৃষকদের সঙ্গে আঁতাতের ফলে জবরদস্তি গুঁড়িয়ে যাবে স্বৈরতন্ত্রর প্রতিরোধ আর পঙ্গু হবে বুর্জোয়াদের অস্থায়িত্ব; দ্বিতীয়, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, যখন জনগণের আধা-প্রলেতারীয় অংশর সঙ্গে সন্ধির পর শ্রমিকশ্রেণি গুঁড়িয়ে দেবে বুর্জোয়াদের প্রতিরোধ আর পঙ্গু করবে কৃষক ও পাতি-বুর্জোয়াদের অস্থায়িত্ব। এছাড়া, ১৯০৫-এ পার্টির তৃতীয় কংগ্রেসে প্রলেতারিয়েত ও কৃষকশ্রেণির একনায়কতন্ত্রকে ‘যুদ্ধর সংগঠন’ নামে উল্লেখ করেছিলেন লেনিন। লক্ষ্যপূরণের জন্যে তিনি লড়াইয়ের বিভিন্ন পন্থা নিয়ে বিশদে বলেছেন। সেই সূত্রে আসে বিপ্লবের স্বার্থে সার্বিক রণনীতি (স্ট্র্যাটেজি) আর তাৎক্ষণিক কৌশল (ট্যাকটিক্স), দৃঢ়তা, সঠিক সময় নির্বাচন, পিছু হঠা, কর্মসূচি-সংস্কার ইত্যাদি প্রসঙ্গ।

লেনিনের তত্ত্বে কৃষকশ্রেণির ভূমিকা নিয়ে আলাদা গুরুত্ব চোখে পড়ে স্তালিনের লেখায়। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের দলগুলি কৃষকদের বৈপ্লবিক সামর্থ্যকে আমল দেয়নি। কিন্তু লেনিন সর্বদা জনগণের এই বিশাল শোষিত অংশকে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনে সামিল করতে চেয়েছেন। রাশিয়ার প্রথম বিপ্লব (১৯০৫) থেকে দ্বিতীয় বিপ্লব (ফেব্রুয়ারি ১৯১৭) অব্দি ক্যাডেট (উদারপন্থী বুর্জোয়া যারা ইংল্যান্ডের ধাঁচে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী ছিল)-দের প্রভাব থেকে কৃষকশ্রেণিকে মুক্ত করে প্রলেতারিয়েতের দিকে আনাই ছিল বলশেভিকদের অন্যতম প্রধান কাজ। ক্যাডেটরা যে জারের পক্ষে, তা বোঝার পর কৃষকশ্রেণি জোট বাঁধে প্রলেতারিয়েতের সঙ্গে। পশ্চিম ইওরোপের উন্নত দেশে সামন্ততান্ত্রিক শোষণ থেকে কৃষকদের মুক্তি দিয়েছিল বুর্জোয়ারা। জৈবিকভাবে বুর্জোয়াশ্রেণির উদ্ভব না-হওয়ায় রাশিয়ায় অন্য ঘটনা দেখা গেল। সেখানকার বিপ্লবে নেতৃত্ব দিল প্রলেতারিয়েত। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর প্রধান প্রশ্ন ছিল, বিধ্বস্ত অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি আর সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ থেকে মুক্তি। তাই প্রলেতারিয়েত-এর সঙ্গে কৃষকশ্রেণির মৈত্রী আরও দ্রুত ঘটল। শ্রমিক-কৃষকের জোটই হয়ে উঠল সোভিয়েত শক্তির ভিত্তি। প্রসঙ্গত মনে রাখা ভালো, পুঁজিবাদের পূর্ণ বিকাশের জন্যে অপেক্ষা না করে (যখন চাষি, কারিগর সকলেই হবেন সর্বহারা) ছোট কৃষকদের শোষণ থেকে বাঁচানো (সমবায় গঠন) ও প্রলেতারিয়েত-এর দিকে টানার কথা আগেই বলেছিলেন এঙ্গেলস।

লেনিনের জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত চিন্তাতেও বাড়তি জোর দিয়েছেন স্তালিন। সাম্রাজ্যবাদী শাসন থেকে উপনিবেশগুলির মুক্তি, সব পরাধীন জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, সেখানকার গণআন্দোলনের সঙ্গে আগ্রাসী উন্নত দেশের শ্রমিকশ্রেণির যৌথ আঁতাত, আন্তর্জাতিক স্তরে প্রলেতারিয় ঐক্য, লগ্নি-পুঁজির পরাজয়― এসব হল লেনিনবাদের অবিচ্ছেদ্দ অঙ্গ। অবশ্য এসব অর্জনের জন্যে দরকার সঠিক বৈপ্লবিক শিক্ষা যা জনগণের সংকীর্ণ বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব কাটাবে।

ধাপে-ধাপে শ্রমিকশ্রেণির একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অবশ্য ১৮৫০-এই সামনে আনেন মার্কস। এর সঙ্গে তিনি যুক্ত করেন দেশে-দেশে বিপ্লব ছড়িয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গও। সেটাই অব্যাহত বা ‘স্থায়ী বিপ্লব’-এর তত্ত্ব। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধর জন্যে পরে বিপ্লব সম্ভব হল; মার্কসের তত্ত্ব শুধু মূর্ত হয়ে উঠল না লেনিনের প্রয়োগে, তার বিকাশও ঘটল। বোঝা গেল, শ্রমিকশ্রেণি বা পার্টি চাইলেই বিপ্লব হয় না, তার জন্যে নির্বিশেষ অনুকূল পরিবেশও চাই। এই প্রসঙ্গে লেনিনের বক্তব্য, বিপ্লব তখনই ঘটে যখন শাসকশ্রেণি আর পুরনো কায়দায় শাসন করতে পারে না; অন্যদিকে, শাসিতশ্রেণিও আর পুরনো কায়দায় শাসিত হতে রাজি থাকে না। অর্থাৎ, গোটা দেশ জুড়ে এক সঙ্কট তৈরি হয়― যখন বেশিরভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে।

মার্কসের বিপ্লবোত্তর পর্ব (প্রলেতারীয় একনায়কতন্ত্র)-র তত্ত্ব আরও পোক্ত হয় পারী কমিউন (১৮৭১)-এর অভিজ্ঞতার নিরিখে। তিনি বুঝেছিলেন, ক্ষমতাদখলের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণির কাজ শেষ হয় না; ক্ষমতাচ্যুত বুর্জোয়াদের পাল্‌টা আক্রমণ থেকে বিপ্লবকে রক্ষাও অত্যন্ত জরুরি কর্তব্য। অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস ছাড়াও কৃষক, আধা-প্রলেতারিয়েত, পাতি-বুর্জোয়া, এমনকি, শ্রমিকদেরও সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক চেতনায় আনা দরকার আমূল পরিবর্তন। এই দীর্ঘ ও কঠিন প্রক্রিয়ায় সফল হতে কেটে যায় বহুদিন। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে হিংসা-অহিংসা, এগোনো-পেছনো, জয়-পরাজয়― সবই অনিবার্য। এমনকি, লক্ষ্য হাসিলের জন্যে দরকার পড়লে আপসও জরুরি। এ ব্যাপারে চমৎকার আলোচনা আছে লেনিন-এর “বামপন্থী” কমিউনিজম, এক শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা (১৯২০)-য়।

মার্কসের বিশ্লেষণ আর পারী কমিউনের ব্যর্থতার শিক্ষা লেনিন কাজে লাগালেন রাশিয়ায়। তাঁর মতে, নভেম্বর ১৯১৭-য় বুর্জোয়া রাষ্ট্রযন্ত্রকে গুঁড়িয়ে দেওয়া ছিল প্রলেতারিয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ। বলশেভিকরা চেয়েছিলেন, নতুন শাসনব্যবস্থা কায়েম ও তা পরিচালনায় অগ্রণী ভূমিকা নেবে শ্রমিকশ্রেণির গণসংগঠন― সোভিয়েত। সমাজতন্ত্রর স্তরে পৌঁছনোর রাজনৈতিক উপায় হিসেবে ধরা হয়েছিল এই সোভিয়েতগুলির গণরাষ্ট্রকে।

লেনিনবাদ সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে এই বক্তৃতায় ১৯২৬-এ স্পষ্টতার খাতিরে লেনিন-এর তত্ত্ব ও প্রয়োগের কয়েকটি দিক আবার বিশদে ব্যাখ্যা করলেন স্তালিন। পাশাপাশি সেখানে যোগ হল কিছু বাড়তি প্রসঙ্গ। বোঝা যায়, স্তালিনের কাছে তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রে লেনিনবাদ অনুসারে প্রলেতারিয় একনায়কতন্ত্র কায়েম― তত্ত্বর নিরিখে প্রয়োগের যাথার্থ্য প্রতিষ্ঠা। স্বাভাবিকভাবেই, এখানে পার্টি ও তার শাখা গণসংগঠন (যেমন, ট্রেড ইউনিয়ন, সোভিয়েত, সমবায়, যুব লিগ ইত্যাদি)-এর ভূমিকা আর শ্রমিকশ্রেণির সঙ্গে সেসবের সম্পর্ক আলোচিত হল বেশি। স্তালিন পরিষ্কার বললেন, শ্রমিকশ্রেণির আগুয়ান অংশ হওয়া সত্ত্বেও খেটে-খাওয়া জনতার কথা পার্টি মন দিয়ে শুনবে। রণনীতি ও কৌশলের মাধ্যমে ধীরে ধীরে জনতার ভরসা আদায় করবে। এমনকি, তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, এমন নীতি কার্যকর করলে ক্রমশ দূরে সরে যাবে পার্টি। একইসঙ্গে, শ্রেণিচেতনা, বিপ্লবের প্রতি নিষ্ঠা, ত্যাগ আর বীরত্ব দিয়ে জনগনের বিশ্বাস অর্জন করতে হবে কমিউনিস্ট পার্টিকে।

এবার বড় হয়ে দেখা দিল এক দেশে সমাজতন্ত্র আর বিশ্ববিপ্লবের প্রশ্ন। প্রলেতারীয় শাসন কায়েমের পর আসে তা টিকিয়ে রাখার বাস্তব সমস্যা; ভেতরের ও বাইরের শত্রুদের রোখার প্রয়োজনীয়তা। লাগাতার সংঘর্ষ, মতাদর্শগত লড়াই আর সামরিকশক্তির ব্যবহার― কমিউনিস্টদের কাছে আবশ্যিক হয়ে ওঠে সবকিছুই। তবু স্বীকার করা হল, বিশ্ব বিপ্লব অথবা সমাজতন্ত্রর চূড়ান্ত জয় তখনই সম্ভব যখন পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠবে দেশে-দেশে প্রলেতারিয় শাসনব্যবস্থা। সেই উদ্দেশ্যে চালাতে হবে লাগাতার প্রচেষ্টা― যার নেতৃত্ব দেবে সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র। সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির লড়াইয়ে শেষে যে-কোনও একটিই শেষে জিতবে― এমনটাই ছিল লেনিনের মত।

স্বাভাবিক যে, শ্রমিকশ্রেণির একনায়কতন্ত্র পেরিয়ে দূর ভবিষ্যতের সমাজতান্ত্রিক সমাজের দ্বন্দ্ব ও অন্যান্য খঁটিনাটি নিয়ে কিছু বলা মার্কস বা লেনিন― কারও পক্ষেই সম্ভব ছিল না। কোনও ইউটোপিয় পূর্বধারণা নয়, দার্শনিক ভিত্তি এক রেখে নতুন-নতুন বাস্তব পরিস্থিতির বিশ্লেষণ ও মোকাবিলার মধ্যে দিয়ে সমাজতন্ত্রে পৌঁছনো ও তারপর আরও এগিয়ে চলার কথা বলেন তাঁরা। এমনকি, তাঁদের নিজেদের ভাবনাচিন্তা আর কর্মসূচিও সময়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল। মার্কসবাদে আপ্তবাক্যর কোনও জায়গা নেই। ১৯৬৭-তে সে-কথাই মনে করালেন লুকাচ।

লুকাচ-এর লেনিন: তাঁর চিন্তার ঐক্যবিষয়ে একটি পর্যালোচনা  একটি উত্তরলেখ সমেত আবার ছেপে বেরোয়  ১৯৬৭-তে। সেই উত্তরলেখে লুকাচ শুধু ১৯২০-র দশকের শ্রমিক আন্দোলনের ঐতিহাসিক বিচার অথবা ব্যক্তি লেনিন-এর ব্যক্তিগত লক্ষণ ও কর্মপদ্ধতি ব্যাখ্যা নয়, স্তালিন আমলে পার্টি যে ক্রমশ অপরিবর্তনশীল আমলাতান্ত্রিক সংগঠনে পরিণত হয়েছিল ― তা নিয়েও সোচ্চার হন। তিনি স্মরণ করালেন লেনিন-এর উক্তি, “তত্ত্বে সবরকম গোঁড়ামি আর সংগঠনে সবধরণের অনমণীয়তা পার্টির পক্ষে সর্বনাশা।“ সেই খেই ধরে এল লেনিনবাদেরও ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ। লুকাচ বললেন, তৎকালীন পরিস্থিতিতে লেনিন সঠিক হলেও এমন সাধারণ সিদ্ধান্ত করা যায় না যে, সাম্রাজ্যবাদের অবশ্যম্ভাবী পরিণাম বিশ্বযুদ্ধ। লেনিন-এর বিচার পদ্ধতি অনুসরণ করে আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পারমাণবিক যুগের রাজনৈতিক সমীকরণ দেখে লুকাচ-এর এমন বোধ জাগে। নীতি (শ্রমিকশ্রেণির ক্ষমতাদখল আর সমাজতন্ত্রর দিকে এগোন) স্থির রেখে হালের পরিস্থিতি থেকে প্রয়োগের নতুন তত্ত্ব তালাশই মার্কসবাদ তথা লেনিনবাদের আসল শিক্ষা।

সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রর পতনের পর এখন দরকার, অতীতের পর্যালোচনার পাশাপাশি বর্তমান থেকে নিরন্তর শিক্ষা, জনগণের মধ্যে প্রচার, সংগ্রামের জন্যে ফের আগাম প্রস্তুতি আর অনুকূল পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার। লেনিন মনে করতেন, “বুদ্ধিমান লোক কোনও ভুল করেন না, তা নয়। এমন মানুষ অতীতে ছিল না, ভবিষতেও হবে না। তিনিই বুদ্ধিমান যিনি বুনিয়াদি ভুল করেন না আর যিনি জানেন কীভাবে তাঁর ভুলগুলি তাড়াতাড়ি ও বেদনাহীনভাবে শুধরে নিতে হয়।“ এখানে প্রয়োগগত ভুলের সঙ্গে ‘মৌলিক ভুল’-এর তফাত বোঝা দরকার। দেশ-কাল-পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রয়োগগত ভুল হওয়া সম্ভব। সেসব চটজলদি শুধরে নেওয়াও জরুরি। কিন্তু মৌলিক ভুল আদতে নীতিগত ব্যাপার। সেটি বিশ্ববীক্ষার বিষয়।

রচনাপঞ্জি