Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পাঠপ্রতিক্রিয়া: জারজস্থান

অলোকপর্ণা

 

 

বইটি পড়ার আগে অণুগল্প প্রসঙ্গে বিলাল হোসেনের স্পষ্ট মতামত জেনেছিলাম ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মেই প্রকাশিত কয়েকটি প্রবন্ধে। সেটি আমার মনে এই বইয়ের ভূমিকা হিসেবে কাজ করেছে। লেখক অণুগল্প সম্পর্কে সচেতন। এবং সচেতনভাবেই এই বইয়ের প্রতিটি অণুগল্প রচিত হয়েছে ধরে নিয়ে আমি বইটি পাঠ করেছি।

অণুগল্প আমার কাছে রোগা লিকলিকে মোমবাতিটির মতো, সার বেঁধে দীপাবলির সময় বাড়ির পাঁচিলে খাঁড়া হয়ে থাকে। জ্বলে ওঠা মাত্র তার নিভে যাওয়ার তাড়া। তবে আলোর ম্যাজিক হল, একনাগাড়ে তার দিকে চেয়ে থাকলে সে নিভে গেলেও চোখে আলোর মায়া রয়ে যায়। অণুগল্পকে আমি এভাবে বুঝি। প্রতিটি অণুগল্প পড়ার সময় আমি সেই আলোর ম্যাজিক খুঁজি। এই ম্যাজিক আমি কাজল সেন সম্পাদিত কালিমাটির ঝুরোগল্পে অর্ক চট্টোপাধ্যায়, অনুপম মুখোপাধ্যায়, অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের লেখায় পেয়েছি। একই ম্যাজিক লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তীর অণুগল্পে বর্তমান। প্রসঙ্গক্রমে সদত হসন মন্টোর স্বল্পদেহী গল্পগুলোকে জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ড বললে ভুল হয় না। গল্পগুলি মনের ভিতর আছড়ে পড়ে সুগভীর সব ক্ষতর আলপনা তৈরি করে দেয়। বিলাল হোসেনের বই “জারজস্থান”-এ সেরকমই কিছু ম্যাজিকের দেখা পেলাম।

প্রতিমুহূর্ত পার করে আমরা নিজেদের পেরিয়ে আসি। মিনিটখানেকের আগের আমিকে পার করে এখনকার আমি গল্পের পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখতে বসেছে। আবার ঘন্টাদুয়েক পরের আমি এখনকার আমিকে টপকে তাকিয়ে আছে আমারই দিকে। মুখাপেক্ষী। আমাদের যত ঋণ আমাদের অতীতের প্রতি। সাপের খোলসের প্রতি সাপের ঋণ, বাকলের প্রতি গাছের ঋণ, শুঁয়োপোকার প্রতি প্রজাপতির ঋণ সমান। মৃত্যু অবধি মানুষও মানুষের খোলস ছেড়ে ছেড়ে এগোতে থাকে। বাদামের খোসা উড়ে যায় ফ্যানের হাওয়ায়। “কে কার, কার কে” জানা যায় না। এসব অলীক আলোয় বিলাল হোসেন সাপের ছেড়ে যাওয়া খোলসের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিলেন এখনকার সাপের, যে কিনা ভবিষ্যতের আরেক সাপের খোলস ছাড়া অন্য কিছু নয়। গল্পটি ভাবায়। চোখে ঝিলমিল লাগিয়ে রাখে বেশ কিছুক্ষণ।

একদল পিঁপড়ে থেকে শুরু হয় “মহাপ্রভুগণ” গল্পটি। এবং শেষ হয় না কোথাও। এই সুতো ছেড়ে দিয়ে গল্পের উড়ানকে সায় দেওয়া ভালো লাগে। গল্পের শুরু কিঞ্চিৎ বিলম্বিত বলে মনে হয়েছে, অথচ শেষ দিকে গল্পের চলন রাশিয়ান ডলের মতো অথবা পেঁয়াজের খোসার মতো দ্রুত হ্রাসমান, কিন্তু সটান। এই চলন বইটির বেশ কিছু গল্পে লক্ষ করলাম। শব্দসংখ্যা সম্পর্কে সচেতনতা সম্ভবত এর কারণ।

বইটিতে সবচেয়ে ছোট গল্প “কিনু গোয়ালার গলিতে”, এই গল্পটি নজর কাড়ে তার উপস্থাপনার কারণে। মাত্র ৭০টি শব্দ ব্যবহার করে লেখক একটি গল্পের আশিরনখ তৈরি করেছেন। যে পরিপ্রেক্ষিতে আমরা দেখতে অভ্যস্ত, তার চেয়ে অন্য ন্যারেটিভে লেখক আমাদের নিয়ে গেছেন। ছোট ছোট বাক্যে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে নিয়ে যাওয়া মুগ্ধ করে।

৪৯টি গল্পের মধ্যে কিছু গল্পে বিষয়বস্তুর আত্মার আদানপ্রদান হতে দেখেছি। স্বল্প গল্প বাকিদের মত সমান অভিঘাত তৈরিতে অপারগ। এবং পাঠক হিসেবে আমার ব্যাক্তিগত চাহিদা অনুসারে এই বইয়ের অণুগল্পে পরীক্ষামূলক কোনও জানালা খোলা দেখলাম না। হয়তো তা কাম্যও ছিল না। বইটির দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদে ভাবনার পরিসরও আমি পাইনি। “জারজস্থান” মূলত সুখপাঠ্য একটি বই। আমার মতে “জারজস্থান” বইতে গল্পবৈচিত্র ছাপিয়ে লেখকের মূল হাতিয়ার হয়ে উঠেছে তাঁর কলমের মোচড়।

আমরা শুধু সেই পৃথিবীর নাম শুঁকি। আর পরস্পর বলাবলি করি
পৃথিবী
মা!
মা!
আমরা চমকে যাই। আমরা ঘাবড়ে যাই। আমাদের মনখারাপ হয়ে যায়।
আমরা মাকে শুঁকি। এখনও জঠরে মায়ের ওম। আমরা ওম শুঁকি।
মা!
আমরা ফুল হয়ে দুলে দুলে কান্না করি। মা গো!
জারজস্থান

#

অনেক গল্প। জোগান দেব তোমাকে।গল্প শেষ হয়ে গেলে তখন?
হবে না। স্ত্রীজাতির গল্প কখনও শেষ হয় না।
–শাহরাজাদের গল্প

#

লোকজন সবাই বলাবলি করে লোকটি মারা গেছে। পোস্টমর্টেমে অবশ্য দেহের কোথাও বুলেটের আঘাত নেই। শুধু পেটভরা অনেকগুলি খিদে পাওয়া গেছে।
–দৌড়

#

কোথায় যেন পটকা ফুটছে। বাতাসে তার শব্দ লেজ তুলে নাচে।
–বেলা অবেলা কালবেলা

বিলাল হোসেনের কলমে মায়ার চাদর পাতা। জ্যোৎস্নাস্নাত এই কলম আশা করি পাঠককে আরাম দেবে।

বই: জারজস্থান
লেখক: বিলাল হোসেন
প্রকাশক: সৃষ্টিসুখ প্রকাশন