Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নয়া কৃষি আইন (২০২০) – বিশ্বপুঁজি শৃঙ্খলের একটি গ্রন্থি?

জয়ন্ত ভট্টাচার্য

 



লেখক চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্য কর্মী; প্রাবন্ধিক

 

 

 

 

এই মুহূর্তে ভারতে খবরের শিরোনামে থাকা নতুন কৃষি আইনের (২০২০) প্রতিবাদে কৃষকদের আন্দোলন ঘিরে একটি কৌতুকপ্রদ ঘটনা ঘটেছে। তিন মন্ত্রী এবং ডজনখানেক আমলার উপস্থিতিতে কৃষক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচোনার পর্বে একটি সময়ে কৃষক প্রতিনিধিরা হঠাৎ করে মৌনি বাবা হয়ে যান। সরকারের তরফে চালানো আলচনায় কোন কথারই আর জবাব দিচ্ছিলেন না। শুধু প্ল্যাকার্ডে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন— “ইয়েস অর নো”। এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি! ক্ষমতা সবসময়েই চায় আলোচনা চালিয়ে আন্দোলনকারীদের ফাল্ট লাইন বা দুর্বল জায়গাগুলো বের করতে। কিন্তু আলোচনাই যদি না চলে তাহলে সেটা বেরোবে কী করে? সরকারের তরফে এক নিরুপায় অবস্থা। আজকের অর্থাৎ ৭.১২.২০২০-র একাধিক সংবাদপত্রের খবর— দিল্লির আশেপাশে ৫ জন “খালিস্তানি” সন্দেহভাজন জঙ্গি গ্রেফতার। এর কোন সুদূরপ্রসারী যোগাযোগ সরকারের তরফে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করা হবে কিনা সেটা ভবিষ্যৎ বলবে। কিন্তু আজকের বর্তমান বলছে— আন্দোলনকারী কৃষকেরা মাটিতে ফসল ফলানোর জন্য যেমন শোণিত এবং স্বেদ ঢেলে দেন আজ বাস্তবে কৃষকদের রক্তদান শিবির চলছে আন্দোলনের অঞ্চল থেকে, আরেকজন মুমূর্ষু মানুষকে বাঁচানোর লক্ষ্যে।

আনন্দবাজার পত্রিকার (৪.১২.২০২০) একটি খবরের শিরোনাম— “‘চাষিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার’ প্রতিবাদে পদ্মবিভূষণ ফেরালেন প্রকাশ সিংহ বাদল”। ৯২ বছরের বৃদ্ধ মানুষটি বলেছেন— “আমি সত্যিই আশ্চর্য হচ্ছি, সরকার কেন এত হৃদয়হীন, অকৃতজ্ঞ হয়ে পড়ল।” আরেকটি সংবাদে প্রকাশ— ৩.১২.২০২০ তারিখে ভারত সরকারের সঙ্গে ৭ ঘন্টা মিটিং-এর পরেও কোন সমাধান সূত্র মেলেনি। আন্দোলনকারী কৃষকেরা তাদের “কৃষি বিল প্রত্যাহার করতে হবে” এই অবস্থানে অনড়। তারা এই আইনের কোনও সংশোধন বা রদবদল চাইছেন না। সম্পূর্ণ আইনটি প্রত্যাহার করতে হবে, এ হল তাঁদের অবস্থান। এজন্য সরকারের সঙ্গে দ্বিতীয় বৈঠকের মাঝে সরকারের তরফে দেওয়া মধ্যাহ্নভোজ এঁরা প্রত্যাখ্যান করেছেন। নিজেদের লঙ্গরখানায় তৈরি খাবার খেয়েছেন। এর নির্গলিতার্থ— এক অদ্ভুত অবিশ্বাস কাজ করছে কৃষকদের মাঝে। আর সরকারের তরফে রয়েছে অস্বচ্ছতা

করোনা মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে যে দেশগুলো চোখে পড়ার মতো সাফল্য দেখিয়েছে— যেমন, নিউজিল্যান্ড, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি— সে দেশগুলোতে কয়েকটি বিষয় প্রধান গুরুত্ব পেয়েছে। সেগুলো হল— প্রথম, শক্তিশালী সামাজিক সুরক্ষা; দ্বিতীয়, শক্তপোক্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা, এবং তৃতীয়, নাগরিকের তরফে রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাস এবং রাষ্ট্র তথা সরকারের তরফে নাগরিকদের কাছে স্বচ্ছতা

লকডাউনের সময়ে আমাদের এখানে কর্মহীন, ভিটেছাড়া, স্থানান্তরী (migratory-র বাংলা “পরিযায়ী” শব্দটিতে আমি অস্বস্তি বোধ করি, মানুষ আর পাখিকে এক করে দেখতে চাইছি না।) অসংগঠিত শ্রমিকদের কয়েকশো মাইল অবধি খিধে-মোচড়ানো পেটে শিশুকে কাঁধে নিয়ে অন্তহীন হেঁটে চলা। আশ্রয় দেওয়ার জন্য সরকার বা রাষ্ট্র নেই। অত্যন্ত নিদারুণভাবে ট্রেনে কাটা পরে ১৬ জন বা তার বেশি শ্রমিক মারা যাবার পরে এ নিরাপত্তাহীনতা আরও বেশি করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। দেখিয়ে দিল রাষ্ট্রের তরফে এদের জন্য চরম ঔদাসীন্য এবং এ “অব”-মানুষগুলোর রাষ্ট্রের প্রতি ট্রাস্ট না থাকা। এমনকি সুপ্রিম কোর্টের সদ্য অবসর নেওয়া বিচারপতি বিচারক দীপক গুপ্ত এই মানুষগুলোর ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের ঔদাসীন্যের যে বিষয়টি উত্থাপন করেছেন তা খুব শ্লাঘার বিষয় নয়।

কী হয়নি এই স্থানান্তরী অসংগঠিত শ্রমিক এবং এদের পরিবারের ওপরে? কয়েকশো মাইল রাস্তা হেঁটেছে, কোনও খাদ্যের কিংবা যানবাহনের ব্যবস্থা সরকারের তরফে করা হয়নি (অসরকারি বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন সময়ে তাদের সাধ্যমতো খাদ্যের জোগান দিয়েছে), পুলিশের লাঠিচার্জ হয়েছে, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে স্রেফ মরে গেছে, স্যানিটাইজার দিয়ে রাষ্ট্রের তরফে “পরিশুদ্ধ” করে নেওয়া হয়েছে, এমনকি ব্লিচিং পাউডার গোলা জলও খাওয়ানো হয়েছে, খোলা আকাশের নীচে রোদে পুড়েছে, বৃষ্টিতে ভিজেছে। আর কত মনোরম সংবর্ধনা ভাবা সম্ভব সাধারণ মেধা নিয়ে জন্মানো একজন মানুষের পক্ষে? এদের জন্য নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিকবার অন্তত ১,০০০ টাকা করে নগদ হাতে দিতে বলেছিলেন। রাষ্ট্র তথা সরকার শোনেনি, পাত্তাও দেয়নি। সম্ভবত ভোটের বাজারে এদের মূল্য প্রায় কিছুই নেই বলে।

আন্দোলন মোকাবিলার শুরুর দিকে ঠিক একই রকমের আচরণ করা হয়েছে আন্দোলনরত কৃষকদের সঙ্গেও। এই ঠান্ডার দিনে জলকামান থেকে জল দিয়ে ভিজিয়ে দেওয়া, লাঠি দিয়ে পেটানো, “দেশদ্রোহী” “খালিস্তানি” ইত্যাদি মারাত্মক বিশেষণে বিশেষিত করা— সবকিছুই করা হয়েছে এদের সঙ্গে। কিন্তু শেষ অব্দি এদের বিপুল সংখ্যার সংহতি এবং বোঝাপড়ার কাছে রাষ্ট্র তথা সরকার কিছুটা হলেও টলেছে। কৃষকদের বর্তমান বিক্ষোভের আগে NRC বা CAA বিরোধী যত আন্দোলন হয়েছে সেগুলোকে কেবল লাঠিপেটা জলকামান গুণ্ডা দিয়ে পেটানো এবং যেমন ইচ্ছে “টুকরে টুকরে গ্যাং” বলে জেলে ঢুকিয়ে দিয়েই সামাল দেওয়া গেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হল না। শুধু তাই নয়, সরকারকে খানিকটা নামতে হয়েছে। নেমে এসে এদের সঙ্গে বৈঠক করতে হয়েছে।

আমার বলার কথা এটুকু যে রাষ্ট্র তথা সরকারের সঙ্গে জনসমাজের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবসময়েই অবিশ্বাস এবং অস্বচ্ছতা অন্তর্লীন উপাদান হিসেবে থেকে গেছে।

এবার আমরা নতুন কৃষি আইনে সরাসরি প্রবেশ করি। আমি অর্থনীতিবিদ, সমাজতাত্ত্বিক বা পলিটিক্যাল সায়েন্টিস্ট কোনওটাই নই। বহু যোগ্য মানুষ এই আইন নিয়ে বিস্তারিত এবং মূল্যবান আলোচনা করেছেন। আমার সে যোগ্যতা নেই। একজন স্বাভাবিক বুদ্ধিসুদ্ধি সম্পন্ন শিক্ষিত মানুষ হিসেবে যা বুঝেছি সেভাবে আলোচনা করছি আইনটি নিয়ে।

এখানে লক্ষণীয় যে সমগ্র দেশ জুড়ে লকডাউনের অবরুদ্ধ অবস্থায় যখন সবাই নিজেদের এবং আত্মীয়পরিজন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত, কিভাবে সুরক্ষিত থাকা যায় এ চিন্তায় আকুল হয়ে রয়েছে সেসময় কতকগুলো ঘটনা চুপিসাড়ে সংসদে পাশ হয়ে গেল— অনেকগুলো কয়লাখনির বেসরকারিকরণ, বিপুল পরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ “মেক ইন ইন্ডিয়া”-য় বাস্তব করে তোলা, রেলের অংশকে বেসরকারি হাতে বেচে দেওয়া, সামরিক খাতে যুদ্ধাস্ত্রের জন্য বহু কোটি টাকার ব্যয় ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রও এর ব্যতিক্রম নয়। বিজনেস ইনসাইডার পত্রিকার (৩.০৮.২০২০) একটি সংবাদের শিরোনাম— “How billionaires got $637 billion richer during the coronavirus pandemic”। প্রথম দশজন এরকম বিলিয়নেয়ারের মধ্যে ভারতের মুকেশ আম্বানিও আছেন। এ যেন “জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি” আর কি!

এরকম এক পটভূমিতেই ৩ জুন, ২০২০, তিনটি কৃষি বিল অর্ডিন্যান্স হিসেবে সংসদে ভারতীয় জনতা পার্টির “ব্রুট মেজরিটি”র জোরে পাস হয়ে গেল। রাজ্যসভায় বিল পাস হবার পদ্ধতিটিও বিপজ্জনক। ধ্বনি ভোটে বিলের স্বপক্ষে প্রস্তাব গৃহীত হয়। এটা রাজ্যসভার নীতির বিরোধী, যেখানে ভোট নেওয়ার প্রস্তাব এসেছিল। এবং অধিকতর মারাত্মক হল যেসব সদস্যরা এই পদ্ধতির বিরোধিতা করেছিলেন তাদের সাসপেন্ড পর্যন্ত করা হয়। এরপরে নভেম্বর মাসে রাষ্ট্রপতির সইয়ের পরে এগুলো অ্যাক্ট হল। দেশের সর্বত্র সমানভাবে প্রয়োগ করা যাবে, প্রয়োগ হবে। এখানে বলার কথা সংবিধানের সপ্তম শিডিউল কৃষি সংক্রান্ত নিয়মকানুন তৈরির দায়িত্ব রাজ্যগুলির হাতে দেওয়া হয়েছে। এই অ্যাক্ট যেভাবে এবং যেসময়ে পাস করা হল সেটা মাথায় রেখে এবং অ্যাক্টের পরে রাজ্যের গুরুত্ব কমবে এমন আশঙ্কা থাকবে, ভারতের ফেডেরাল কাঠামো কেন্দ্রীভূত হয়ে উঠবে (যেরকম আরও কিছু আইনের ফলে হচ্ছে)। রাজ্যের ক্ষমতা কমে অতিরিক্ত শক্তিশালী কেন্দ্র গড়ে ওঠা ধীরে ধীরে একটি “অতিরাষ্ট্র”-র চেহারাকে জীবন্ত করে তুলছে। ভারতীয় জনসমাজের আগামী কালান্তক বিপদ সম্ভবত এখানে রয়েছে।

ভারতবর্ষের শিক্ষা, শিল্প, বাণিজ্য ইত্যাদি ক্রমাগত নির্দয়ভাবে বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হলেও ভারতের প্রাণকেন্দ্র কৃষিতে এতদিন হাত পড়েনি। কিন্তু উন্মুক্ত বাজার এবং বিশ্বপুঁজির সর্বগ্রাসী চেহারায় এখন কৃষিকে ছেড়ে রাখা সম্ভব নয়। একটি গ্লোবাল ফুড সাপ্লাই চেইন বা শৃঙ্খলের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে কৃষিকে— যার সরবরাহকারীর ভূমিকা পালন করবে “গ্লোবাল সাউথ” এবং ভোক্তার ভূমিকায় থাকবে “গ্লোবাল নর্থ” এবং এদের অনুগতরা, তারা যে দেশেই থাকুক না কেন। জন বেলামি ফস্টার তাঁর “COVID-19 and Catastrophe Capitalism” প্রবন্ধে এ বিষয়ে বলছেন— “In this system, exorbitant imperial rents from the control of global production are obtained not only from the global labor arbitrage, through which multinational corporations with their headquarters in the center of the system overexploit industrial labor in the periphery, but also increasingly through the global land arbitrage, in which agribusiness multinationals expropriate cheap land (and labor) in the Global South so as to produce export crops mainly for sale in the Global North.” এরকম এক অবস্থান থেকেই প্রধানমন্ত্রীর মুখে “এক দেশ এক বাজার”-এর তত্ত্ব বারেবারে শোনা যাচ্ছে (প্রসঙ্গত, “এক দেশ এক ভোট”-এর প্রস্তাবও এই প্রেক্ষিতে মাথায় রাখুন)।

আমার ধারণা, এরকম জায়গাতেই নতুন কৃষি বিল-এর বাস্তবতা ও যৌক্তিকতা। প্রথমে তৃতীয় বিলটি নিয়ে কথা বলি। এ বিলটি হল The Essential Commodities (Amendment) Bill, 2020। এ বিলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং মারাত্মক অংশ হল চাল, ডাল, আলূ, পেঁয়াজ, আটা, চিনি, ভোজ্য তেলের মতো ২০টির বেশি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যকে অত্যাবশকীয় পণ্যের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তুলে দেওয়া হয়েছে মজুতের ঊর্ধ্বসীমা। ১৯৫৫ সালের এই আইনে সরকার সরাসরি কৃষকদের থেকে খাদ্যশস্য কিনে গণবন্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে সঙ্কটের সময় সাধারণ মানুষের মাঝে বণ্টন করত। এই ব্যবস্থাটি ঊঠে গেল। কেন্দ্রীয় সরকার অবশ্য একটি ব্যবস্থা রেখেছে। যদি যুদ্ধ লাগে এবং ভয়ঙ্করভাবে মুল্যবৃদ্ধি ঘটে তাহলে সরকার হস্তক্ষেপ করবে।

আশা করি এরকম দুর্দিনের মুখে আম্বানি, আদানি, মনসান্টো কিংবা পেপসি-কোলাদের পড়তে হবে না! আর পড়ে গেলেও বিকল্প রাস্তা খুলে দেওয়া হবে নিশ্চয়ই।

কৃষকের নিজের আয় কমে যাওয়ার ও ভবিষ্যৎ নিয়ে চেপে বসা এরকম উদ্বেগ এবং দিনের পর দিন ধরে পথকে ঘর করে নেওয়ার মূলে রয়েছে আরও দুটি বিল— Farmers’ Produce Trade and Commerce (Promotion and Facilitation) Act, 2020 এবং Farmers’ (Empowerment and Protection) Agreement on Price Assurance and Farm Services Act, 2020। ১৯৬৫ সাল থেকে (অর্থাৎ সবুজ বিপ্লবের সমকালীন) চালু ছিল Agricultural Produce Market Act। এই অ্যাক্টের ফলে কৃষক সরকারের তৈরি নিয়ন্ত্রিত মান্ডিগুলোতে বা বাইরের বাজারে নিজেদের ফসল বেচতে পারে। যে জায়গাগুলোতে “সবুজ বিপ্লব” হয়েছে— পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ— সে অঞ্চলগুলোতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এবং মান্ডিতে কৃষকেরা ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের সাহায্য পেত। ২০০৪ সালে স্বামীনাথন কমিশন প্রতি ৮৯ কিলোমিটারে একটি করে নিয়ন্ত্রিত বাজার বা মান্ডি থাকার সুপারিশ করেছিল। যদিও একথাও সত্য যে কৃষকদের এক ক্ষুদ্রাংশ (৬ শতাংশের আশেপাশে) মান্ডির সুবিধে পায়, বাকি ৯৪ শতাংশ কৃষক পায় না, তা সত্ত্বেও মান্ডির উপস্থিতি এবং ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কৃষকদের একধরনের ইন্স্যিউরেন্স হিসেবে কাজ করে।

প্রথম বিলটিতে ট্যাক্সের ছাড় দেওয়া হয়েছে, মান্ডিতে হিসেবের খাতা রক্ষা করা আর বাধ্যতামূলক থাকছে না। উৎপাদক কৃষক, উৎপাদিত পণ্য বা ফসল এবং বিক্রি করা— সবকিছুই সম্পূর্ণত ছেড়ে দেওয়া হবে মুক্ত বাজারের হাতে। ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আর কোনও অস্তিত্ব থাকছে না। কৃষকদের আশঙ্কা, এর ফলে অর্থনীতির বড় হাঙরেরা, যাদের নাম আগে উল্লেখিত হয়েছে, তাদের সঙ্গে কোনওভাবেই যুঝে উঠতে পারবে না সাধারণ ছোট ফড়েরা— এ এক নির্মম অসম যুদ্ধ। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এনডিএ সরকারের নির্বাচনী প্রচারের একটি ইস্যু ছিল কৃষকদের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের সংস্থান রাখা। এর ফলে রাজ্যগুলোর কৃষি থেকে আয়ও কমবে। দেশের ফেডেরাল গঠনে এটাও একধরনের শক্ত আক্রমণ।

দ্বিতীয় বিলটিতে কৃষকদের জন্য সংস্থান রাখা হয়েছে তারা তাদের উৎপাদিত পণ্য বা ফসল দালাল, ব্যবসায়ী, বিজনেস হাউজ এবং বহুজাতিক সংস্থা সবার সঙ্গে আগাম দাম ধরে (pre-agreed) পণ্যের দামের চুক্তি (agreed price) করতে পারবে। এখানে দুটি বিচিত্র সংস্থানও রাখা হয়েছে— প্রথম, লিখিত কিংবা মৌখিক চুক্তি করা যাবে এবং দ্বিতীয়, সিভিল কোর্টে দুই পক্ষের বিবাদের কোন বিচার হবে না। প্রথমটি অনেকটা ঔপনিবেশিক নীল চাষ বা দাদন চাষের মতো। আর মৌখিক চুক্তি বহুজাতিকের তরফে ভঙ্গ করা হলে কজন কৃষক আছে যে উঁচুতলার কোর্ট অব্দি মামলা লড়তে পারবে? তাছাড়া প্রায় দাদন চাষের মতো এই চুক্তিতে GMO বীজ চাষ করতে দেওয়া হবে না এর গ্যারান্টি কে দেবে? ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং আমেরিকায় এর ফলাফল ভালো হয়নি। কৃষক আত্মহত্যা করেছে।

ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে-র ২০১৩ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী কৃষকদের পাঁচজনের একটি পরিবারের কৃষি থেকে আয় মাসে মাত্র ৬,৪২৬ টাকা। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র রিপোর্ট (২০১৬) অনুযায়ী, ১১,৩৭৯ জন কৃষক ঋণের দায়ে এবং ফসল বিক্রি করতে না পারার দরুন আত্মহত্যা করেছে। এতে হিসেবটা দাঁড়ায় প্রতিদিন ৩১ জন করে কৃষক আত্মহত্যা করেছে। করোনায় মৃত্যুর চেয়ে কোনও অংশে কম যায় না। কিন্তু মিডিয়ায় কোনও খবর নেই, নৈঃশব্দের আঘাতে খবরগুলো জনমানসের দৃষ্টি এবং শ্রুতি পথ থেকে ক্রমাগত হারিয়ে যায়।

কিন্তু এর সমাধান কৃষিকে বাজারের হাতে পুরোপুরি উন্মুক্ত করা বা বহুজাতিক হাঙ্গরদের আহ্বান জানানো নয়। ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের সংস্থান এবং রাষ্ট্রের তরফে কৃষিকে সহযোগিতে করা এর বিকল্প পথ। আমেরিকার হিসেব দেখায়, পূর্ণ মুক্ত বাজারের ঐ দেশে ১৯৬০ সাল কৃষকদের আয় লাগাতার কমে যাচ্ছে। ফলে মুক্ত বাজার এবং বিশ্বপুঁজির উদ্বাহু নৃত্য কৃষকের মুক্তির পথ নয়।

স্বামীনাথন কমিশন ১৫ বছর আগে কৃষিতে মোট খরচ তথা comprehensive cost-এর ওপরে ৫০ শতাংশ বেশি মুল্য দেওয়ার সুপারিশ করেছিল— একে বলা যেতে পারে C2। কিন্তু সরকার হিসেবের মধ্যে ধরেছে কেবল নগদ টাকায় কি কেনাবেচা হচ্ছে এবং কৃষক বীজ, কীটনাশক এবং সারের জন্য কত খরচ করছে (A2) আর পারিবারিক শ্রমের যে অংশটি কোনও মূল্যমানে ধরা হয় না (FL)— A2+FL। এতে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে জমির জন্য যে ভাড়া দিতে হয় এবং মূলধনের ওপরে যে সুদ দিতে হয় তার হিসেব। এই হিসেবকে A2+FL-এর সঙ্গে যুক্ত করলে C2-র হিসেব বেরোবে। স্বামীনাথন কমিশনের হিসেব ছিল এই C2-কে ধরে। আজ কৃষকদের ভয় কৃষির বাজারকে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে কর্পোরেট পুঁজির হাতে ছেড়ে দিলে ৮৫ শতাংশ প্রান্তিক কৃষক কর্পোরেটদের হাতের পুতুল হবে বা আত্মহত্যা করবে। ফলে সরকারের ওপরে গভীর অবিশ্বাস এবং নির্ভরহীনতা জন্ম নিয়েছে।

অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ার অবদমিত আতঙ্ক এবং বেঁচে থাকার অনিশ্চয়তা কৃষকের আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে। এ আন্দোলন তেভাগা বা তেলেঙ্গেনার আন্দোলন নয়। সেরকমটা হবেও না। কিন্তু কৃষক যে টলে যাওয়া ভবিষ্যতের আশঙ্কা করে পথে নেমেছে সে আশঙ্কা সমাজের সর্বস্তরে সত্যি। সমাজের অন্য অংশগুলো কি কৃষকের পাশে দাঁড়াবে? ছাত্রদের আন্দোলনের পাশে কিন্তু সমাজের অন্য অংশরা দাঁড়ায়নি। এই দূরত্ব এবং বিভাজনের বাস্তব অস্তিত্ব রাষ্ট্রকে অতিরাষ্ট্র করে তোলার পথ সুগম করে। আমরা সাক্ষী হয়ে ত্থাকি!

কিন্তু পরিস্থিতির সাপেক্ষে মনে হচ্ছে আজকের ভারতে Invictus চলচ্চিত্রে চিত্রায়িত নেলসন ম্যান্ডেলার মতো একজন জননেতার প্রয়োজন আছে— যিনি inclusionary তথা সবাইকে নিয়ে চলতে চান। Exclusionary তথা বাতিল করা, বিভাজিত করার রাজনীতিতে ভারতের মানুষ রিক্ত, হতাশ্বাস এবং তিতিবিরক্ত। কিন্তু ক্রোধের থোকা থোকা আঙুর নেই, স্ফুলিঙ্গ অনুপস্থিত।

*আমি আমার এ লেখাটির জন্য অংশত টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত “দ্য গ্রেপস অফ রথ” প্রবন্ধটির কাছে ঋণী