Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

জল-জ্যোৎস্না

রিমি মুৎসুদ্দি

 

নৌকার গলুইতে বসে লোকটা ঢকঢক করে মদ খেয়ে চলেছে। ঈষৎ ঢুলু ঢুলু চোখে কাজরীর শরীরের জ্যামিতিক পরিমাপও করছে যেন। আর একটা লোক একের পর এক ছবি তুলে চলেছে। পূর্ণিমার রাত। আকাশের গায়ে একটা গোল থালার মতো উজ্জ্বল চাঁদ। চাঁদের ছায়া নদীর জলে পড়ে চিকচিক করছে। নৌকার ছই-এর ভেতরে একবার নেশাগ্রস্ত লোকটা একটু নড়ে উঠল। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। কাজরী বুঝতে পারে এই সঙ্কেত। এইবার সে টলমল শরীরটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে কাজরীর উপর। কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে কাজরীকে বিবস্ত্র করার চেষ্টা করবে। তারপর নেশার ভারে টলিয়ে পড়বে নৌকার মেঝেতে। আর ততক্ষণে ছবি তোলা শেষ করে নৌকার ছইতে ঢুকবে আরেকটা লোক। কাজরীর বিবস্ত্র শরীর এফোঁড়-ওফোঁড় করে চরম বীর্যসুখ অনুভব করবে।

কাজরীর কাছে ছবিটা পরিষ্কার। আগামী কয়েকঘণ্টায় ওর সাথে কী হবে সে বিষয়ে ওর স্পষ্ট ধারণা। কাজরীর পরিচয় তো দেওয়াই হয়নি। কাজরী নামটাও কি ওর সত্যিই নাম? কাজরীকে নিয়ে কখনও গল্প লেখা যায়? অথচ কাজরীদের জীবন জুড়েই গল্প। সেই গল্প পড়তে গেলে একটু সতর্ক থাকা দরকার। এ গল্প কেউ অরগ্যাজমের আশায় পড়বেন না যেন। পড়তে হলে একটুখানি সংবেদনশীলতা নিয়েই পড়ুন। কাজরীকে আপনারা কি কখনও দেখেছেন?

কোনারক ডান্স ফেস্টিভ্যালে আমার একবারই দেখা হয়েছিল কাজরীর সঙ্গে। পরিচয় হয়েছিলও সেদিন প্রথম। সে গল্প পরে কখনও শোনাব। আপতত জানাই, সেদিন শুনেছিলাম ওর কথা। লিখব লিখব করেও এত ফিলগুড প্লটের কাছে হারিয়ে গিয়েছিল কাজরীর কথা। যেমন জীবনের চোরা বাঁকে, অন্ধকার গলিতে হারিয়ে যায় কাজরীরা নিজেই।

কাজরীর জন্মক্ষণ বা জন্মতিথি কি ওর আজকের এই জোর করে বাধ্য করা, শতাব্দী প্রাচীন যাবতীয় আবর্জনা, ধ্বংসের বীজ ধারণ করার জন্য দায়ী? জন্মলগ্নই কি নির্দিষ্ট করে দেয় মানুষের ভবিতব্য? অন্ধকার মাতৃজঠর থেকে মুক্ত হয়ে ও যখন প্রথম আলোর ছোঁয়ায় কেঁদে উঠেছিল তখন বুঝি গ্রহ-নক্ষত্রপুঞ্জও কেঁদেছিল ওর সাথে।

কাজরীর ভাগ্যে কি তখনই লেখা হয়ে গিয়েছিল ওর ভবিতব্য? কখনও নৌকায়, কখনও কোনও হোটেল বা রির্সটের ঘরে প্রতিদিন ও একটু একটু করে ক্ষয় করবে ওর জীবনশক্তি? সমাজ প্রতিদিন তার যাবতীয় গরল ঢেলে দেবে ওর যোনিতে। আর সেই তীব্র গরল নিজের মধ্যে ধারণ করেও ও থাকবে পবিত্র। স্বর্গের অপ্সরীগণ দেবতাদের পরিতৃপ্ত করে স্বর্গের কল্যাণ সাধন করে। কাজরীর মতো মেয়েরাও মানুষরূপী দেবতা বা রাক্ষসদের পরিতৃপ্ত করেও সমাজের কল্যাণ করতে পারে কি? সমাজের কল্যাণ ব্যাপারটা আবার বড়ই জটিল। সে তার আপন নিয়মে চলে। সে নিয়মের সূচিপত্রে প্রথমেই লেখা থাকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য। ক্ষুধা তার রাক্ষসের গহ্বরের থেকেও ভীষণ। তাই খুন-ধর্ষণ, ধর্ষণের পর খুন আরও নানা সামাজিক ব্যাধি প্রতিনিয়ত এই খিদের আগুনে আহুতি দিয়েই চলেছে।

ফিরে যাই কাজরীর জন্মলগ্নে। ওর জন্মস্থান উড়িষ্যার কোনও এক অখ্যাত গ্রাম। যে গ্রামে পরপর কন্যা সন্তান জন্মালে ফুটন্ত দুধের গামলায় চুবিয়ে শিশুটিকে মেরে ফেলা হয়। ও ভূমিষ্ঠ হওয়ার কিছু পরে ওর মার জ্ঞান ফিরেছিল। ওকে দেখে ওর মা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল। হয়ত শিশুটির পরিণতির কথা ভেবে, অথবা পুত্র-সন্তান জন্ম না দেওয়ার শোকেই ওর মা কেঁদেছিল। শিশুটির ভাগ্য সুপ্রসন্ন। তাই অগ্রজাদের মতো ওকে ফুটন্ত দুধের পাত্রে নিক্ষেপ করা হয়নি। ওর ছোট্ট নরম শরীরটা আশ্রয় পেয়েছিল নোংরা আঁতুরঘরের এক কোণে। ওর জন্মের প্রায় দশ বছর পর আরও দুটো জীবিত ও তিনটে মৃত কন্যাসন্তান প্রসবের পর ওর মার একটা পুত্রসন্তান হয়।

অখ্যাত সেই গ্রামের, অখ্যাত এক নদীর পাড়ে শৈশব কাটিয়ে কৈশোরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কাজরীর রূপকথা জীবনের ইতি। অনামী এক নিম্ন বুনিয়াদি স্কুলে প্রাথমিক পড়াশুনাও ও করেছিল। রূপকথা, কারণ এইটুকু পাওয়াও যে সেই অনামী গ্রামের মেয়েদের পক্ষে যথেষ্ট। বিশেষ করে সেই গ্রাম যদি হয় ভারতের দরিদ্রতম অঞ্চল কালাহাণ্ডির খুব কাছেই।

নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে সবুজ যেমন কমতে থাকল। নদীও তেমন শুকাতে লাগল। একদিকে ও বড় হয়ে উঠছে, আরেকদিকে প্রায় জ্ঞান হওয়া থেকেই যে নদীটা ওর জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে সে তার নদীত্ব হারিয়ে বালিতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। শুকনো বালির চরে দাঁড়িয়ে দু ফোঁটা জল কখনও ফেলেছিল নদীটার জন্য। পেছন থেকে ডাক আসে “বুই!……”

এ ডাক তো তার বাবার। ছুটে ঘরে চলে আসে সে। ঘরে তখন দুজন বয়স্ক মানুষ বসা। বাবার কথায় প্রণাম করে তাদের। মানুষগুলো বাবার সঙ্গে দেনাপাওনার কথা বলছে। বাবা হাতজোড় করে তাদের বলছে,

–পরপর খরা, বৃষ্টি নেই, আকাশে একফোঁটা মেঘও নেই। গত জোড় বছরে ফলন ভাল হয়নি! সম্বল বলতে ঐ জমিটুকুই। তাও ওইটুকু জমিই আমি আপনাদের নামে লিখে দিচ্ছি। মোর ঝিওকে উদ্ধার করেন, কৃপা করেন।

অবাক হয় ও। বাবা কেন ওদের জমি ঐ লোকগুলোকে দিয়ে ওকে উদ্ধার করতে বলছে? ওরা চলে গেলে বাবা যায় ওদের এগিয়ে দিতে। মার কাছে শোনে ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে কলকাতা শহরে।

বিয়ে হয়ে কাজরী চলে আসে কলকাতায়। ওর স্বামীকে দেখতে একেবারে রাজপুত্রের মতো। রূপকথার গল্প আবার এগোয়। কলকাতা শহরে ওর শ্বশুরবাড়ী খুবই ছোট। দুখানা মাত্র ঘর। ওর শ্বশুরের একটা মুদীর দোকান আছে। সেখানেই তার দুই ছেলে বসে। কাজরীর স্বামী বাড়ীর ছোট ছেলে। ছাদের চিলেকোঠার ঘরে ওর ফুলশয্যা হয়। ফুলশয্যার রাতে ওর স্বামী ওকে জিজ্ঞেস করে কী নাম?

ও কাঁপাকাপা গলায় উত্তর দেয়, “কাজরী”!

একদিকে ভয়, আরেকদিকে প্রচণ্ড ক্লান্তিতে ওর চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তখন রাজপুত্র কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবেই বলে ওঠে,

–আজ এ ঘরে আছ ভালো, কাল থেকে কখনও এ ঘরে ঢুকবে না। পূজা জানতে পারলে কী যে হবে?

কাজরী চমকে উঠেছিল। এ ঘরে না ঢুকলে ও কোথায় থাকবে? আর পূজাই বা কে? পূজা জানলে কী হবে? জিজ্ঞেস করতে হয় না! স্বামী রাজপুত্তুরটি নিজেই উত্তর দেয়।

–পূজা মাটিপাড়া ইস্কুলে পড়ে। আমার বান্ধবী, মানে গার্লফ্রেণ্ড। বাপের পয়সায় খাই, তোমার বাপের জমির লোভে বুড়ো এই বিয়ে দিয়েছে। এত আছে বুড়োর তবুও লোভ। তাছাড়া পূজা বিহারী। আমার প্ল্যান আছে। বুড়োর টাকাপয়সা মেরে একদিন পূজাকে নিয়ে পালাবো। আর তারপর শুধু পূজা আর আমি। হাম দো হামারা দো!

কথাগুলো বলে কিছুক্ষণ দম নেয় রাজপুত্র অর্থাৎ কাজরীর স্বামী। এরপর মস্ত এক হাই তুলে ওকে বলে,

–যাও এখন বিছানা থেকে নামো দেখি।

ফুলশয্যার রাতে মেঝেতে বিছানা পেতে কাজরী একটা স্বপ্ন দেখেছিল। ওর শৈশবের নদী জেগে উঠেছে। কুলকুল করে বয়ে চলেছে তার জল। জ্যোৎস্না রাতে জলপরীর মতো ও এসেছে নদীর পাড়ে। আঁজলা ভরে ঠাণ্ডা জল নিয়ে ও পান করছে, ছড়িয়ে দিচ্ছে সমস্ত চোখে মুখে। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে সে জল। ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠে ও দেখে নদীর জল ওর গালে লেগে রয়েছে। তবে কেমন যেন নোনতা! চোখের জলের মতো।

কাজরীর জীবনও গড়িয়ে চলে। স্বামীর অনুপস্থিতিতে ও চিলেকোঠার ঘরে ঢোকে। অবশ্যই শাশুড়ির নির্দেশে। স্বামী দোকানে বেরোনোর পর ঐ ঘরে গিয়ে ও ঘর মোছে, নোংরা জামা কাপড় কেচে মেলে দেয়। তারপর শুকিয়ে গেলে আবার পাট করে আলনায় রেখে আসে। রাতে ও শাশুড়ির ঘরের মেঝেতে শোয়। উপরের খাটে শ্বশুর-শাশুড়ি শোয়। শাশুড়ির ঘরের পাশে এক চিলতে বারান্দায় রান্নার জায়গা। দুপুরে সেখানেই ও শুয়ে পড়ে। এই ব্যবস্থায় সবাই বোধহয় খুশি। কারও কোনও হোলদোল নেই। জা-ভাশুর পাশের ঘরে তাদের ছেলে নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোয়। কাজরীর রূপকথার দুপুরগুলো রান্নাঘরের মেঝেতে শুয়েই কেটে যাচ্ছিল একরকম। যেন ওর কোনও কিছুই চাওয়ার নেই, পাওয়ারও নেই। জীবন ওকে ঢের দিয়েছে। ও এতেই খুশি। মাঝেমাঝে শুধু ওর নদীটাকে ছুঁতে ইচ্ছে করে। মনে হয় যদি ও রাস্তা চিনত তাহলে এক ছুটে স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে চেপে বসত।

কাজরীর বিয়ে হয়েছিল শীতকালে। শীতও প্রায় শেষ হতে চলল। বসন্ত আসন্ন। এক দুপুরবেলা শাশুড়ি গেছে কীর্তন শুনতে। কাজরীর জা তার ছেলে নিয়ে বাপের বাড়ী। ভাশুরঠাকুর আর শ্বশুরমশাই কোথায় বাইরে গেছেন, ও জানে না। ওকে এসব বলা হয় না। ঘরের বউ রাঁধবে-বাড়বে, ঘরের কাজ করবে, ফাইফরমাইশ খাটবে। তার অত খোঁজখবরে দরকার কী?

দুপুরের এঁটো বাসন ধোয়ার পর ও খানিকটা অবসর পায়। রান্নাঘরের মেঝেতে চাটাই বিছিয়ে সেদিন ও ঘুমানোর চেষ্টা করছিল। ঘুমোলে ও নদীটাকে দেখতে পাবে। কাজরীর মধ্যেও একটা নদী আছে। যে নদী সেই ছোটবেলা থেকেই ওর সঙ্গী। কাজরীর কিশোরবেলায় সেই ভরা নদী সরু হতে হতে এতটাই সরু হয়ে যায় যে হেঁটেই সবাই পারাপার করতে পারে নদীর এপার ওপার। কাজরী এখানে আসার আগেই নদীটা কখন যেন শুকিয়ে গেছে। জ্যোৎস্নারাতে ওর আর জলপরী হওয়া হল না ভেবে দুফোঁটা চোখের জলও বুঝি ফেলেছিল।

সদর দরজায় কড়া নাড়ার জোর শব্দ হচ্ছে। আপাতত নদীটাকে সরিয়ে রেখে ও দরজা খোলে। ওর স্বামী একটা মেয়ের সাথে হুড়মুড় করে বাড়ীতে ঢুকে পড়ল। তাড়াতাড়ি দরজায় খিল দিয়ে ওর স্বামী মেয়েটাকে নিয়ে উপরে উঠে যায়। চিলেকোঠার ঘরের দরজা বন্ধ হল। সিঁড়ির দিকে কিছুক্ষণ ও তাকিয়ে থাকল। কি মনে হতে সদর দরজার খিল খুলে বাইরে বারিয়ে আসে ও। সামনের সরু গলিটা দিয়ে হাঁটতে থাকে। নিজের অজান্তেই কিছুদূর ও চলে আসে।

একটা ছেলে ক্যামেরা নিয়ে পাকুড় গাছের ছবি তুলছে। ও থেমে একটু দাঁড়ায়। ফেরার রাস্তা কি ও গুলিয়ে ফেলেছে? ও কি আদৌ ফিরতে চায়? ছেলেটাকে ও স্টেশনের রাস্তা জিজ্ঞেস করে। ছেলেটা বলে,

–আমি তোমাকে দেখেছি। তুমি বাচ্চুদার বউ। আমার নাম তীর্থ। তোমাদের বাড়ীর উল্টোদিকের দোতলা বাড়ীতে আমি থাকি। আমি ছাদ থেকে তোমাকে প্রায়ই দেখি। তুমি ছাদে কাপড় কাচো।

কাজরীর ভালো লাগছে ছেলেটার সঙ্গে কথা বলতে। ও জিজ্ঞেস করে,

–তুমি পাকুড় গাছের ছবি তুলছ কেন?

–আমি ছবি তুলতে ভালবাসি। এইসময় গাছের পাতারা রং বদলায়। এই নতুন রঙের ছবি তুলতে আমার খুব ভালো লাগে।

ওরা হাঁটতে থাকে। এলোমেলো কথা হয়। ও ভুলে যায় ওর কোথায় যাওয়ার কথা? ছেলেটির সাথে ও হাঁটতেই থাকে। হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছায় ওর শ্বশুরবাড়ীর গেটের সামনে। দরজা খুলে ও ভেতরে ঢোকে। ছেলেটা চলে যায়। ওদের মধ্যে কোনও বিদায় সম্ভাষণ হয় না। যেন এমনটাই হওয়ার ছিল। ও পথ ভুলে যাবে আর কেউ ওকে ফিরিয়ে আনবে। ও ছাদে চলে যায়। তীর্থর দোতলা বাড়ী খোঁজার চেষ্টা করে। চিলেকোঠার ঘরের দরজা খোলে। আলুথালু বেশে ওর স্বামী বেরিয়ে এসেছে। ওকে ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রথমে একটু হতবাক হয়। কিছু বলেও বোধহয়। কাজরী শুনতে পায় না। ও তখন শুধুই নদীটাকে দেখছে। মেয়েটাকে নিয়ে ওর স্বামীর চুপিচুপি বাড়ী থেকে বেরিয়ে যাওয়া, কিছুক্ষণ পর  শাশুড়ির বাড়ী ফিরে আসা কোনওটাই যেন ও টের পায় না। ওর সময় পার হয়ে যায়। ও তীর্থকে ওর নদী দিতে চায়। মাত্র একদিন কিছু পথ একসাথে হেঁটেই কি ওদের মধ্যে একটা নদী ভাগাভাগি হয়ে যায়?

সারাদিন নিত্যকার কাজ সেরে ও অপেক্ষা করে কখন শাশুড়ি কীর্তন শুনতে যাবে আর ওর স্বামী পূজাকে নিয়ে চিলেকোঠার ঘরে দরজা দেবে। ও তখন নদী হতে যাবে তীর্থর কাছে। তীর্থর মোটরবাইকে চেপে অজানা রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে ওর বড়ই ভালো লাগে।

এরকমই একটা ভাল লাগা নিয়ে ও ফিরে এসেছে বাড়ীতে, ওর ভাল লাগা মুহূর্তগুলোয় স্নান করছিল। তীর্থ ওকে আজ বলেছে গাছের পাতাদের মতো ওরও নতুন রং লেগেছে। স্নান সিক্ত শরীরে ও খুঁজছে সেই রং। এমন সময় বাইরে থেকে ভেসে এল প্রচণ্ড চিৎকারের শব্দ। তাড়াতাড়ি কাপড় পরে বাইরে বেরিয়ে এল ও। শাশুড়ি পূজাকে অকথ্য গালাগাল দিচ্ছে। চুলের মুঠি ধরে ঠাস ঠাস করে কয়েকটা চড় কষাল পূজার গালে। পূজার প্রেমিক অর্থাৎ কাজরীর স্বামীকে দেখা যাচ্ছে না। বোধহয় সে পালিয়েছে। কাজরীকে দেখামাত্র শাশুড়ি অগ্নিশর্মা হয়ে উঠল।

–এই যে রাজকুমারী এতক্ষণ কলঘরে গা ধোওয়া হচ্ছিল?

আরও কত গালাগাল শাশুড়ি দিল ওকে। স্ত্রী কলঘরে আর স্বামী অন্য মেয়েমানুষ নিয়ে ঘরে দরজা বন্ধ করে? ওকে তো গালাগাল শুনতেই হবে। ওর কষ্ট হচ্ছিল পূজার জন্য। ও দেখছিল পূজার শরীরেও কি নতুন রং লেগেছে?

ঐ দিনের পর অনেকদিন কাজরীর সাথে তীর্থর কোনও কথা হয়নি। দেখা প্রায়ই হয়। কাজরী যখন ছাদে যায় কাপড় কাচতে অথবা টুকটাক কোনও কাজ করতে, উল্টোদিকের বাড়ীর ছাদে ও তীর্থকে দেখতে পায়। এভাবেই চলছিল কিছুদিন। বাড়ীর কেউই কিছু টের পায়নি। একদিন অলস দুপুরে আবার বাড়ী ফাঁকা। তীর্থকে খুঁজতে ও বাইরে বের হয়ছে। কোথায় খুঁজবে ভেবে পায় না। খানিকক্ষণ এলোমেলো হেঁটে আবার ও বাড়ীর পথ ধরেছে।

রূপকথার গল্পের রাজপুত্রের মতো (পক্ষীরাজ ঘোড়ার বদলে অবশ্য বাইকে চড়ে) উদয় হয় তীর্থ। সেই পক্ষীরাজ ঘোড়া অর্থাৎ বাইকে চড়ে ও বেড়াতে বেরোয়। সময়ের হিসাব থাকে না। আজ ওরা অনেক দূর চলে গেছে। ফেরার সময় বেশ রাত হয়ে যায়। কাজরী ভয় পায় বাড়ী ফিরতে।

–না হয় নাই ফিরলে। আমি কাল কোনারক ফেস্টিভ্যালে যাব ছবি তুলতে। আজ কোন হোটেলে থেকে কাল আমার সাথে যাবে কোনারকে?

কাজরীর তো সত্যি ফেরার ইচ্ছে নেই। রূপকথার রাজপুত্রের সাথে যে কোনও দেশে ও ভেসে যেতে রাজী।

কোনারকে কয়েকটা দিন স্বপ্নের মতোই কাটল। সারাদিন তীর্থর সাথে ঘুরে সূর্যমন্দির, নৃত্যানুষ্ঠান এইসব দেখে আর নানা জায়গায় ঘুরে ওর দিনগুলো বেশ কাটছিল। ফেরার সময় হয়ে এল। ফেরার দিন তীর্থ ওকে একটা ট্রেনের টিকিট দিয়ে হাওড়ার ট্রেনে বসিয়ে দিল। তীর্থ বলে, সে পরে যাবে। একা কাজরী কোথায় যাবে? স্বপ্নের রাজপুত্র বলে দিয়েছে সে পারবে না কাজরীর দায়িত্ব নিতে। একসাথে ফেরাও তার পক্ষে সম্ভব নয়। কাজরীকে একাই ফিরে আসতে হয় কলকাতায়। ওর ফেরার কোনও জায়গাও নেই। অগ্যতা স্টেশনেই ও বসে ছিল। সেখানেই ওর সাথে দেখা হয়েছিল লিলি আন্টির। লিলি আন্টিরা বোধহয় বুঝতে পারে কাজরীর মতো মেয়েদের যাওয়ার কোনও জায়গা নেই। হাওড়া বা শিয়ালদা স্টেশনে এরকম অসংখ্য কাজরী বোধহয় অপেক্ষা করে থাকে। রূপকথার পেছনে ছুটে তাদের বেশীরভাগেরই ঠিকানা হয় লিলি আন্টিদের ফ্ল্যাট।

লিলি আন্টির মেয়েদের মধ্যে কাজরী সবথেকে বেশী সুন্দরী। তাই ওর রেটও অনেক বেশী। এবার ওকে আবার কোনারক ফেস্টিভালে আসতে হয়েছে খদ্দেরের সাথে। বলতে গেলে এখান থেকেই ওর বেচা-কেনার দোকানে যাত্রা শুরু হয়েছিল। প্রতিদিন মাংসের দোকানের মতো যাচাই করে এখন ওর দরদাম করা হয়। রূপকথার রাজপুত্রদের সাহিত্যে, শিল্পে বা বাণিজ্যে সাফল্য পেতে এখনও কাজরীদের প্রয়োজন হয়।

নৌকার ছই থেকে বেরিয়ে কাজরী চন্দ্রভাগার তীরে যায়। কাজরীর প্রিয় ছেলেবেলার নদীর মতো এই নদীও তার নদীত্ব হারিয়ে বালিতে বিলীন। জ্যোৎস্না-রাতে চাঁদের ছায়া বালিতে পড়ে চিকচিক করছে। একমুঠো বালি ও কাগজে মুড়ে নেয়। ঐ বালি ওকে নদীর কথা মনে করাবে। সাগরে মেশার আগেই নদী ফুরিয়ে গিয়েছে। নদীর দুঃখ ভাবলে ওর কষ্টও অনেকটাই কমে যায়।