Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আষাঢ়ে গল্প

চৈতালী চট্টোপাধ্যায়

 

রতন যখন খুব ছোট, স্কুলেও যায় না আর কী, সেসময় থেকেই ওর ডিটেকটিভগিরি শুরু। বাবা টিচার ছিলেন বিবেকানন্দ হাইস্কুলের। যৌথপরিবারের যাবতীয় তন্তু ছিঁড়ে ফেলে বেরিয়ে এসেছিলেন রতনের বাবা ভবভূতি। নদীয়া জেলায় চাকরি নিয়েছিলেন তিনি। কোথাও কিছু না পেয়ে, খড়কুটোর মতো এটাই আঁকড়ে ধরে, স্ত্রীর মৃদু, নিরীহ আপত্তির তোয়াক্কা না করে সংসার এনে ফেললেন রানাঘাটে।

মায়ের লক্ষ্মীমন্ত স্বভাব আর অভাব এই দুইয়ে মিলিয়ে টেনেটুনে কেটে যেত ওদের। ভবভূতির মাইনে কম, কিন্তু বাড়ির বাইরে অনেকটা সময় থাকতে হত। রোজ চূর্ণী নদী পার হয়ে স্কুলে যেতেন। মা, রত্না, সংজ্ঞামানা সুন্দরী না হলেও চোখা-চোখা চেহারা ছিল। নজরকাড়ামতো। স্কুল যাওয়ার সময়, বাড়ির দরজা ডিঙোনোর আগে হাত নেড়ে ইশারায় রতনকে কাছে ডাকতেন বাবা।

–শোন, তোর মা সারাদিন কোথায় যায়, ঘরে কারা আসে, এসব একটু দেখেশুনে রাখিস তো!

রতন ফ্যালফ্যাল করে তাকাত।

–মা কি হারিয়ে যাবে? ও তো বড়!

বাবা চাপা গর্জন করত,

–আহ্, মুখে-মুখে তর্ক করিস কেন? আমি ফিরলে সবটা বলবি। আর, মা যেন টের না পায়। ফেরার সময় হজমি লজেন্স আনব তোর জন্য, দুটো!

সেই শুরু। স্বভাবটা ওর রক্তে চারিয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। দুয়েক বছর পর ও নিজেই স্কুলে ভর্তি হল যখন, একদিন, টিফিনের ঘন্টা পড়ার পর, সবাই বেরিয়ে গেছে, রাজু বাথরুমে গেছে আর তখন খোকন রাজুর টিফিনবাক্স খুলে টিফিন খাচ্ছিল, খেয়েই ছুটে বেরিয়ে গেল, দেখে ফেলেছিল রতন। অনিমেষ স্যারকে চুপিচুপি সেকথা বলতে যেতেই স্যার কটাং করে একটা গাঁট্টা মেরেছিলেন মাথায়।

‘খুব টিকটিকি হয়েছ, অ্যাঁ?’

সেইপ্রথম ও জানে ডিটেকটিভকে হেলাফেলায় টিকটিকি বলা হয়! তবু ডিটেকটিভ হওয়ার সাধ থেমে থাকেনি রতনের। প্রতিবেশী উপেনকাকা চানের আগে নারকেল তেল চাইতে এসেছিল ওদের বাড়ি, সেটাও দেখে ফেলে রতন। পেট কামড়াচ্ছিল, তাই সেদিন স্কুলে যায়নি ও। বাবা ফেরামাত্র হুবহু ঘটনাটা বলে দেওয়ার পর রাতে রত্নাকে যখন ভবভূতি বেড়ালপিটুনি পেটাচ্ছিল, কান্না পায় রতনের। কিন্তু ক্লাসে রচনা লেখার সময় বড় হয়ে গোয়েন্দা হব লিখতে দুবার ভাবেনি ও।

মা-বাবা দুজনেই পরপর চলে গেলেন যখন, কোলকাতায় আবার সেই যৌথপরিবারেই জায়গা করে নিল সে। ততদিনে সেখানে লোকসংখ্যা বাড়লেও ওটা ছিল দাদুর দস্তানা। তাই জায়গা হয়ে যায় ওরও। একটু নিজেকে সামলে নিয়ে ডিটেকটিভ এজেন্সি সার্চলাইট খোলে বন্ধু রঞ্জনের কৃপায়। ওদের পুরনো বাড়ি ছিল একটা। বটগাছ, বাদুড়ে ভর্তি। একটা কেয়ারটেকার, কেয়ার নিতে সাতদিনেও একদিন আসে কিনা সন্দেহ! গাড়ি ছিল না, গ্যারাজ ছিল। সেখানেই সাইনবোর্ড টাঙাল রতন। অজস্র বোকামো, অসংখ্যবার ভুল করা সত্ত্বেও যেহেতু গোয়েন্দাগিরি ওর ফার্স্ট লাভ, চলে যাচ্ছিল মোটামুটি।

এই প্রায় মধ্যযুগ থেকে উঠে-আসা গ্যারেজে আরশোলারা যত ফড়ফড় করে উড়ে বেড়াত, তার সিকির সিকিও ক্লায়েন্ট আসত না। একদিন হাঁফাতে হাঁফাতে এলেন একজন এসেই সশব্দ টেবিলফ্যানটা নির্লজ্জের মতো তাঁর দিকে ঘুরিয়ে দিতে বললেন।’আমার ছেলেকে পাওয়া যাচ্ছে না’, বলতে বলতে ভদ্রলোক হেঁচে নিলেন বারকয়েক।

‘আপনার ব্যাগ থেকে টাকা চুরি করে না প্রেম করে পালিয়েছে?’ রতন নিরীহ মুখে প্রশ্নটা করতেই খিঁচিয়ে উঠলেন। ‘অত বড় ছেলে থাকার মতো বয়স মনে হচ্ছে আপনার? কেজি ট্যুতে পড়ে।’খুব ভয় পেয়ে, আর জেরা করতেই ভুলে গেল রতন।বলল,’কাল যাই আপনাদের বাড়ি?’ আবার খিঁচিয়ে উঠলেন ভদ্রলোক। ‘কাল আমার মা নাতির জন্য সত্যনারায়ণ রেখেছে, কাল কী করে যাবেন, পাগল!তদন্তের জন্য দরকারি কিছু নিয়ে পরের পরেরদিন ওবাড়িতে নক করল রতন। একটা পুঁচকে ছেলে দরজা খুলে কাকে চাই জেনে নিয়েই বাবা! বাবা! করে ভেতরদিকে ছুটে গেল। রতনের সোনাবাঁধানো কপালখানায় সবে ভাঁজ পড়বে কি পড়বে না ভাবছে, ভদ্রলোক এসে বললেন,’ওর মাসি নিয়ে চলে গিয়েছিল, এরা এত ট্যালা, টেরই পায়নি কেউ।’

রতন আস্তে বলল, ‘ফোন করলে পারতেন। তিনি আবার আগের দিনের মতো খিঁচিয়ে উঠলেন, “টিকটিকির পেছনে টিকটিক করা আমার কাজ নয়। ভুলে গেছিলাম আপনি আসছেন। তা, পথখরচ চাই?’

আরেকটা কেলো হল একবার। একজন এসে বলল, ‘মশাই, আমার চাকরকে হাতেনাতে ধরতে হবে। বাজার করতে গিয়ে আমাকে লুটেপুটে শেষ করে দিচ্ছে। মাছওয়ালা, তরকারিওয়ালাগুলোও হয়েছে হাড়ে হারামজাদা। ফোন করি, সত্যি-দাম বলে না।’রতন লেগে পড়ল সেই ছেলের পেছনে।রোগা। দেখলেই মায়া হয়। সে যে-দোকানির কাছেই যাচ্ছে, তারা ওর সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে। কেউ আবার মাথায় হাত বুলিয়েও দিচ্ছে। এক বুড়ি মাটিতে বসে শাকপাতা বেচছে, লোক নেই কোনো, সেখানে গিয়ে ও দাঁড়াতেই খপ করে ধরল রতন। ভূত দেখার মতো চমকে উঠল ছেলেটা। তারপর ভেউভেউ করে কাঁদতে লাগল। বুড়ি বলল, ‘ওকে কাঁদাচ্ছ কেন গো। ওর বাপমার খুব অসুখ।’ তিনদিনপর ওই ভদ্রলোক খোঁজ নিতে এলে রতন বলল, “দাদা,আমি আর এখন ডিটেকটিভ নই!’

মনমরা থাকা ধাতে নেই রতনের। গায়ে মাখত না কিছু। আর, এভাবেই আদরে অনাদরে ব্যবসাটা চলছিল।

সব ঘেঁটে গেল।

ইতোমধ্যে মক্কেল হল অমৃতা ঘোষ। প্রেমিকা টাইপের একটা মেয়ে। যাকে দেখলেই বসন্তবাতাস বইবে।

রতনকে বলে, ‘বস্, আমার বরকে একটা কেস খাইয়ে দিন না। ও কোথায় যায়, কার কার সঙ্গে মেশে। একটা অ্যাফেয়ার্স যদি দুগ্গা বলে ধরা পড়ে তো আমি ডিভোর্স পেয়ে যাব।’

রতনের এখন সবসময় গান গাইতে ইচ্ছে করে।

ইন্দুবালা গো…
তুমি কার আকাশে থাকো
কোন জোছনা মাখো
কার আকাশে পড়ো ঝরিয়া…

অমৃতা বলে,

‘প্লিজ রতন, আপনাকে খুশি করে দেব।’

রতন অফ শোল্ডার জামা দেখতে দেখতে বলে,

–শুনুন, এই গ্যারেজে আসবেন না আর। ইয়ে, মানে, বাইরে দেখা করব আমরা।
–কোথায়? সিসিডি? স্টারবাকস্? কটাক্ষ, অমৃতার।
–না না। আপনি তো নর্থের মেয়ে। অসুবিধা হবে না। কাশীমিত্র ঘাটে একটা ক্ষয়া সিঁড়ি গঙ্গায় নেমে গেছে… আধভাঙা কালীমূর্তি… ওখানে, সিঁড়ির ধাপিতে…

রতন সবটাই জানত। অমৃতা ঘোষ আসবে, তারপর একটার পর একটা ঘটে যাবে ঘটনাবলি। জানত। কারণ রতন নামে কেউ, সশরীর, ছিল না ততদিনে, আর। অমৃতা যেদিন ফোন করে ওর চেম্বার থুড়ি গ্যারাজের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছিল, সেদিনই পথে রানওভার হয়ে যায় ও। ডিটেকটিভ হওয়ার প্রবল স্পৃহাই ওর ভূতকে বাঁচিয়ে রেখেছে এতদিন। অমৃতার সঙ্গে যা-যা ইন্টারঅ্যাক্ট করেছে ও, পথেঘাটে গায়েপড়ে কথা বলেছে ওর বরের সঙ্গে, অমৃতার বর, মানে সঞ্জীব অপমান করেছে ওকে, একদিন তো পাব্লিক ডেকে মার খাওয়াতেও গেছিল এমনকী! তারপর বাগবাজার ঘাটে অমৃতার পা জড়িয়ে ধরেছিল ও, কবে যেন চুমু খেতেও এগিয়েছিল!

এসবের কোনওটাই মানুষ-রতন করেনি!

শুধু, ও যেটা জানত না ভূত হয়েও, সেটা হল, অমৃতার প্রতি প্রেম ওকে ছাড়বে না। অঙ্গবিহীন আলিঙ্গনে জড়িয়ে রেখে দেবে।