বিষকন্যার পাপস্খালন

হিন্দোল ভট্টাচার্য

 

‘সে তো জানে, রাস্তার বাঁকে/ সুন্দর জেগে বসে থাকে’। সমালোচনা নামক বিষয়টির উপর যখন আস্থা হারাচ্ছি, তখন সেই সব বই নিয়েই লিখতে ইচ্ছে করে, যেগুলি হাতে পেলে মনে হয় এক একেকটি কবিতার মধ্যে কত গ্রাম, কত শহর, কত অনুভূতিমালা। কিন্তু আজকাল কবিতার বই নিয়ে লিখতে গেলেই মনে হয়, যা বলতে চাইছি, তা বলা তো দূরের কথা, তার কাছাকাছিই কিছু বলে উঠতে পারলাম না। কেন লিখতে পারলাম না, এই বিষয় নিয়ে ভাবতে ভাবতে আবিষ্কার করলাম, আসলে কবিতা বা অন্য কোনও লেখার মধ্যে দিয়ে ঘোরা প্রকৃতপক্ষে নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গেই ঘোরা। কিন্তু নিজে হয়তো সেই সব অভিজ্ঞতাগুলিকে লিখে ওঠার মতো ক্ষমতা অর্জন করতে পারিনি, অথবা, সেই সব অভিজ্ঞতাগুলি আমার পাশের চেয়ারে এসে বসে আছে, মুচকি মুচকি হাসছে, এমনকী চুমুও খেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি তার সঙ্গে সঙ্গম করতে পারছি না। এক হাত দূরত্বে তবু, এক হাত কয়েক আলোকবর্ষ মনে হচ্ছে। চৈতালী চট্টোপাধ্যায়ের শুধু বিঘে দুই প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত কাব্যপুস্তিকা ‘এখন হারমোনিয়মে বসলে পাপ হয়’ পড়তে পড়তে মনে পড়ে যায় জিওভান্নি বোক্কাচিওর ‘ডেকামেরন’-এর কথা। যখন প্লেগ ছড়িয়ে পড়ছে, তখন দশজন মানুষ একে অপরের কাছে গল্প বলছে, এই ভাবনায়, যে, সেই একশোটি গল্পের মাধ্যমে একটা ভিন্ন বাস্তবতা রচিত হবে কোনওদিন। কারণ ন্যারেটিভের মধ্যবর্তী সেই ভিন্ন বাস্তবতাগুলিও তো বাস্তবতা একধরনের। কে জানে, আমার এই ভাবনাই চৈতালী চট্টোপাধ্যায়ের মনের মধ্যে ঘুরছিল কিনা, কারণ তিনি এই কাব্যগ্রন্থে স্পষ্টই একপ্রকার দ্বন্দ্বের মধ্যে অবতীর্ণ হয়েছেন, আর সেই দ্বন্দ্বটি হল আমাদের সমসাময়িক বাস্তবতা এবং আবহমান স্রোতের মতো বাস্তবতার। বিষাদের যে রাশিয়ান ভায়োলিন তিনি বাজিয়েছেন, তা সাধারণত একটা বরফঘেরা প্রান্তরে একলা মানুষের হেঁটে চলার মধ্যে শোনা যায়, যেন বা ডক্টর জিভাগোর কবিতা, কিন্তু সেই বরফঘেরা প্রান্তরের মধ্যে তিনি সুন্দরকে দেখতে ভোলেননি, আর ভোলেননি বলেই পাস্তেরনাকের মতো জিভাগোকেও কবিতা বিষয়ে দূরবর্তী হয়ে পড়তে হয়, কারণ সুন্দরের স্পর্শ এই হিংসার পৃথিবীতেও বিদ্যমান, এই সত্য থেকে জিভাগো বা পাস্তেরনাক বা দান্তে বা আমাদের চৈতালী চট্টোপাধ্যায় বিস্মৃত নন। পাপ একপ্রকার ক্রিশিয়ানিটির ধারণা, কারণ সেখানে যে বিপরীতে পুণ্যের ধারণা থাকে, তা বড় অপ্রাসঙ্গিক। বরং পাপ-এর মধ্যেই এই পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো অনেককিছু থাকে। এক সময়ে মনে হয়, ভাগ্যিস মানুষ পাপ করেছিল, যার জন্য আজকে বাইবেলের ওল্ট টেস্টামেন্টের পৃথিবীতে থেকে যেতে হয়নি। মিল্টনীয় পাপ বা দান্তের পাপ বা বিবিলিকাল পাপ যে এই পাপ নয়, এই পাপ যে একপ্রকার উইলিং সাস্পেনশন অফ ডিসবিলিফ, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না, কারণ কীটসের ওডগুলির মতোই তিনি বারবার আছড়ে পড়েছেন এই ফিভার, ফ্রেট ও ওয়্যারিনেসের পৃথিবীতে কিন্তু তাঁর নেগেটিভ ক্যাপাবিলিটিই তাঁকে নিয়ে গেছে সত্য ও সুন্দরের সেই বিষাদের পৃথিবীতে, যেখানে থেকে যেতে ইচ্ছে হয়, যতই ঝরা পাতার ক্রমাগত ঝরে পড়া দেখতে দেখতে এক বিস্মিত ও বিপন্ন মৃত্যুচতনায় আক্রান্ত হওয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না।

এত সব কথা ভাবার কারণ চৈতালী চট্টোপাধ্যায় এই কাব্যগ্রন্থের শুরু থেকেই এক বিষাক্ত ঘোরের মধ্যে ঠেলে দেন। এই বিষাক্ত ঘোর তাঁর আজীবনের কাব্যচেতনার এক অংশ। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে, সেই কাব্যবিষাদ-চেতনা অনেক বেশি করে আক্রমণ করছে পাঠককে। উৎসর্গের কবিতায় পাওয়া যায়— ‘মেয়েটাকে, ডাইনি যখন ধরে নিয়ে গেছিল, ও চকমকি পাথর ছড়িয়েছিল পথে। যে কটা দিন তুমি আছ, আর টানছ এই শরীরভরা মন, যেতে-যেতে চকমকি পাথর ফেলে যাচ্ছি আমিও। হয়তো দূষণ তাকে ময়লা করছে। খুনজখমের লালচে রং ধরছে। হয়তো, তোমার ডেলিবারেট অবহেলা, আমার অশ্রুজল ছিটিয়ে পাথরের আলোয় ধোঁয়া মাখাচ্ছে…/ কিন্তু জানো, সময় ছাড়িয়ে নিয়ে কেউ না কেউ একদিন ঠিক খুঁজে পাবে এই চকমকিবসানো ট্র্যাক। একে অন্যকে বলবে, ‘আরে! ভালোবাসা হয়েছিল বুঝি!’ এ কথা অস্বীকার করা যাবে না, যে চৈতালী চট্টোপাধ্যায় এক অন্তর্গত ভাষায় কথা বলেন। এই ভাষা আমাদের সেই সব অভিজ্ঞতার ভাষা, যে অভিজ্ঞতাগুলির সঙ্গে আমরা পরিচিত, কিন্তু সেই অভিজ্ঞতাগুলির মধ্যে যে সত্য, সেগুলির সঙ্গে পরিচিত নই। চৈতালী চট্টোপাধ্যায় সেই সব মুহূর্তগুলির সঙ্গে পরিচয় ঘটান, যে মুহূর্তগুলি আমাদের আরও বেশি বিপন্ন করে দেয়। এখন হার্মোনিয়মে বসলে পাপ হয় নামক সিরিজের ছটি কবিতাই এই অন্তর্ঘাতী বেদনা নিয়ে আছে। আঙ্গিক যে কখনও কখনও ছদ্মবেশী মানববোমার মতো কাজ করে, তা অতি অল্প কবির আঙ্গিকের ব্যবহারের মধ্যে দিয়েই টের পাওয়া যায়। এই সিরিজের কবিতাগুলির আঙ্গিক সম্পর্কে কিছুই মনে থাকে না কারণ এই কবিতাগুলি যে কথা বলছে, যেভাবে রক্তক্ষরণের কথা বলছে, তা একধরনের ক্যাথারসিসে আক্রান্ত করে পাঠককে। এই প্রসঙ্গে দুজন কবির কবিতার কথা মনে পড়ে, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এবং শঙ্খ ঘোষ, যাঁদের এমন অনেক কবিতা আঙ্গিক এবং ছন্দের বাকবিস্তারের মধ্যে রচনা করেন এক যুদ্ধশিবির। ‘মুখে কি তাহলে মৃত্যুর ছায়া পড়েছে?/ চুনকাম করা সাদা—’, অথবা ‘গানের খাতাখানা/ যুদ্ধে খোলা মানা/ বসন্তের মুখে রক্তগন্ধে আমি তো ভুলে গেছি আপনাকে’— আমার তো মনে হয় লঘু না হয়ে তরল না হয়ে কীভাবে সরলভাবে গভীরতম অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হওয়া যায়, এই কবিতাগুলি তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।

অক্টাভিও পাজ (পাস কি?) এক জায়গায় লিখেছিলেন— ‘অনেক সময় শব্দ তার সত্যকে তুলে ধরতে পারে না, তখন সত্যের কাছে শব্দের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকতে হয়। তখন যে শব্দ আসে, তাকেই গ্রহণ করতে হয়।’ ঠিক সে রাস্তা ধরেই, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়ের এই কাব্যপুস্তিকার কবিতাগুলি শব্দ থেকে সত্যে (সত্য বলতে ধ্রুব কোনও নির্দেশিকার কথা বলছি না, একধরনের অনুভূতিমালার কথা বলছি) চলেছে বলে মনে হয়। তিনি যেন বা এই কাব্যগ্রন্থে এক অনুবাদকের ভূমিকা পালন করছেন। আসল কবিতাগুলি এই প্রকৃতিতে লেখা হচ্ছে। হয়তো আদি কোনও প্রাকৃতিক ভাষায়, যা এক গুহামানবকেও প্ররোচিত করত ছবি আঁকার দিকে। ‘জুন মাসের কবিতা’, ‘আফটার ইমেজ’, ‘সহবাস’, ‘কবিতা-১’, ‘সেন্সরশিপ’ প্রতিটি কবিতাই অস্তিত্বের শিকড় ধরে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। অথচ এই সব অনুভূতিমালাই আমাদের পরিচিত। কিন্তু কখনও এই সব অনুভূতিমালার ভিতরের বোধিকে অনুবাদ করার চেষ্টা আমরা হয়তো করিনি, বা এমনভাবে পারিনি। এই কবিতাগুলি একধরনের হলোগ্রাম, যা বারবার আমাদের জীবনে ফিরে ফিরে আসে। হয়তো এই কবিতাগুলি পড়ার পর থেকে সেই জীবনপ্রবাহকে আলাদাভাবে দেখার যোগ্যতা অর্জন করব, এই বইটি পড়ার আগে, যা সম্পর্কে অজ্ঞই ছিলাম বলা চলে। নতুন এই চৈতালী চট্টোপাধ্যায় তাঁর কবিতাসংগ্রহে নেই। কবিতাসংগ্রহের চৈতালী চট্টোপাধ্যায়কে আবার খুঁজে পাওয়া যায় এই কাব্যগ্রন্থের-ই একটি কবিতায়— কবিতাটির নাম আকাশপ্রদীপ। সেই পুরনো বিষাক্ত রেস্তোরাঁর কবি সহসা মাথা তুলে বলেন, আমি এখনও রিটায়ারমেন্ট নিইনি। কারণ আর কিছুই না, এত সবকিছুর মধ্যেও কবি এই কবিতাতে তাঁর পুরনো সত্তার কাছে ফিরে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য কবরের ধারে বসেছিলেন। ‘হেমন্তরাতের মুখে বিষণ্ণ আগুন’ যেখানে জ্বলে থাকে সারারাত, সেখানে একজন একাকী মানুষ নিজের মনের কাছে মাথা রাখে বিষণ্ণ যুবতীর মতো। ‘পাঁচমিশালি স্বাদে ও সবজিতে/ তুমিই আমার ভিটামিনের রূপ’ একেবারেই বিজ্ঞাপনের মেয়ে আত্মপ্রকাশ করেন। কিন্তু মনে হয় এই কবিতাটি এই কাব্যপুস্তিকায় না থাকলেই ভালো হত। তবে, এই পর্যায়ে, অতি অল্প কথা বলে, যে কী গভীরভাবে আন্তর্মহাদেশীয় শীর্ষনামহীন যন্ত্রণাবোধের প্রকাশ করা যায়, তার প্রমাণ উইমেনস লিব কবিতাটি। প্রকাশকের বিরাগভাজন হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কবিতাটি তুলে দিলাম—

মাঝরাতে আলো জ্বেলে রাখতে ভালোই লাগে।
আলমারি খুলি।
কাপড়ের ভাঁজ ভেঙে ডানাদুটো বের করে এনে
মেঝেয় বিছোই।
মোমের পালিশ ঘষি।
ফের তুলে রাখি।
একদিন উড়ে যাব বলে

ব্যক্তি এবং আকাশের মধ্যে সম্পর্কটিকে অতি অল্প মোচড়ে স্পর্শ করে ফের সেই অনুরণনকে হালকা করে বাতাসে মিশিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা কম কবিরই আছে। কবি চৈতালী চট্টোপাধ্যায় ‘কবিতাসংগ্রহ’ পরবর্তী অন্য এক ‘কবিতাসংগ্রহ’-এর দিকে এগিয়ে চলেছেন একদম নতুন এক ভাষায়। এই কাব্যগ্রন্থটি তার এক ভূমিকামাত্র। ‘আমিই কেবল বিষকন্যা হয়ে গেলাম’— বলেছেন তিনি। পড়ে মনে মনে বললাম— ভাগ্যিস!

গ্রন্থ- এখন হার্মোনিয়মে বসলে পাপ হয়
চৈতালী চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশক- শুধু বিঘে দুই
প্রচ্ছদ- চিরঞ্জিৎ সামন্ত
দাম- ৪০ টাকা

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4411 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...