যে নদী মরুপথে

যে নদী মরুপথে : প্রবুদ্ধ বাগচী

প্রবুদ্ধ বাগচী

 

আর পাঁচটা দিনের মতোই ছিল সেই বিকেলটা। বেশ কয়েক বছর আগের কথা বলছি। সারাদিনের কাজ শেষে ক্লান্ত শরীরে ফিরে আসছিলাম বাড়ির পথে। শীত সন্ধ্যার কুয়াশা একটু একটু করে নেমে আসছিল মাটির কাছাকাছি। একটা অটো রিকশার পেছনের সিটে গুটিসুটি মেরে বসেছিলাম আমি। তখনও বালি হল্ট স্টেশন থেকে ডানলপগামী অটোটায় যাত্রী ভর্তি হয়নি। থেমে থাকা গাড়ির পাশ দিয়ে হুস হুস করে দ্রুতবেগে ছুটে যাচ্ছে বাস লরি ট্যাক্সি প্রাইভেট গাড়ি। নিবেদিতা সেতু তৈরি হওয়ার পরে এখন এই জায়গাটার রাস্তা যথেষ্ট প্রশস্ত ও মসৃণ। দ্রুত ধাবমান গাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে কখনও গা ছম ছম করে। খানিক পরেই যাত্রী বোঝাই হতে চলতে শুরু করল আমাদের অটোটা। সামনের দুজন সওয়ারির মুখ পেছনে বসে দেখার উপায় নেই, এমনকি অন্যমনস্ক থাকায় আমার পাশের দুই সহযাত্রীকেও সেইভাবে খেয়াল করা হয়নি। নদী পেরিয়ে অটো এসে থেমেছে দক্ষিণেশ্বরে। সামনের সিটে চালকের পাশে বসা থাকা দুজন নেমে দাঁড়িয়েছে এইবার, সেই সঙ্গে পেছনের সিটে বসে থাকা এক কিশোর। কিন্তু সেই দৃশ্যের সামনে এসে আমি থমকে যাই। কী আশ্চর্য! এই তিনজন হলেন এক দৃষ্টিহীন দম্পতি আর তাদের কিশোর পুত্র। এরাই এতক্ষণ নিজেদের মধ্যে অনর্গল কথা বলে চলেছিলেন! পেছনে বসে বোঝার উপায় ছিল না এই আন্তরিক কথাবার্তার ভেতরে ভেতরে কীরকম নিরুপায় এক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। কিশোর পুত্রের দুই দৃষ্টিহীন অভিভাবক কোনওদিন চোখেই দেখেননি তাদের নিষ্পাপ আত্মজের মুখের আদল! ঝলমলে হ্যালোজেন আলোয় উজ্জ্বল হয়ে থাকা পথঘাট, অবিন্যস্ত ভিড়ের মধ্যে জড়িয়ে থাকা একেকজন মানুষ— ব্যস্ত চৌরাস্তার ক্যাকোফানি পেরিয়ে চোখের আড়াল হয়ে যাচ্ছে ওই তিনজন।

অন্য কারও কাছে কী মনে হবে জানি না, তবে আমার কাছে এটা একটা কবিতার মুহূর্ত। এই দৃশ্য থেকে কবিতার জন্ম হতে পারে। আমি কবিতাকে অনেকদিন আগে ছুটি দিয়ে দিয়েছি আমার খাতা থেকে, তবু মনে হল লেখা যায়, কয়েকটা অনুভূতিময় পঙক্তি হয়তো লিখে ফেলা যায় এই উপলক্ষকে সামনে রেখে। কিন্তু তেমনটা হয়ে উঠল কই? সাময়িক একটা অনুভবের কাঁপন পেরিয়ে যখন এসে পৌছালাম বাড়িতে, তখন ওই চমকলাগা দৃশ্য, কিছু বা আবছায়া… আর কী অদ্ভুত পরিহাস— মাথার মধ্যে ঝাঁপিয়ে ওঠা একটা দুটো লাইনও যেন কখন লুকিয়ে পড়েছে মগজের চোরাগলিতে। কবিতার মুহূর্ত নয়, না লেখা কবিতার মুহূর্ত।

কথাসাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্র কোনও এক লেখায় একবার বলেছিলেন, তার না-লেখা গল্পের সংখ্যা নাকি লেখা গল্পের থেকে বেশি। প্রায় আক্ষেপের সুরেই বলা হয়েছিল সেই কথা যার মধ্যে ছিল না লেখা গল্পের জন্য একরকম দুঃখবোধ। কবিদের কলমে তাদের কবিতা লেখার মুহূর্তের কথা আমরা টুকরো টুকরোভাবে যে শুনিনি তা নয়। কিন্তু কবিদের কবিতা লেখার এই সব মুহূর্তের আড়ালে কি থেকে যায় অনেক না-লেখা কবিতারও মুহূর্ত? ঠিক যে মুহূর্তে তিনি আক্রান্ত হচ্ছেন কবিতায় আর তার পরের মুহূর্তেই ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে কবিতার সঙ্গে তার সংযোগের প্রান্ত! অথবা আবছায়া কোনও চলচ্ছবি তির্যক অভিক্ষেপ ফেলছে তার মনের মেরুপ্রদেশে, তিনি যখন ভাবছেন তাকে অবয়ব দেবেন অক্ষরের আবর্তে, ঠিক তখনই যেন ছিঁড়ে গেল তার— হারিয়ে গেল শব্দকে আঁকড়ে রাখার আয়োজন। কবিতা কেন, যে কোনও ভাষা শিল্পের ক্ষেত্রেই বিষয়টা অনেকটা একইরকম। কিন্তু কী করব আমরা এই না-লেখার মুহূর্তগুলোকে নিয়ে?

তাঁর গীতাঞ্জলির কবিতায় রবীন্দ্রনাথ আশ্বাস পেয়েছিলেন এই ভেবে যে, জীবনের অসমাপ্ত পুজো কোথাও একটা তার অর্থ বহন করে চলে। যার সূত্রে তিনি ভাবতে পারেন, ধরণীতে পড়ে থাকা না-ফোটা ফুলের কুঁড়ি বা মরুপথে হারিয়ে যাওয়া কোনও নদীর ধারারও ব্যঞ্জনা থেকে গেছে কোথাও। রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে যারা বসত করেন তাঁরা পুজো শব্দটার আধ্যাত্মিক খোলসটুকু সরিয়ে রেখেও যদি নিজের লেখালিখির সঙ্গে অমন একটা আস্থা যুক্ত করে নেন, তবে তাঁরা রবীন্দ্রনাথের অপার আস্তিক্যের পাশে নিজেদের দাঁড় করাতে পারেন অবশ্য। মনে করে নেওয়া যেতে পারে রবীন্দ্রনাথেরই অন্য একটা গানের কথা, যেখানে তিনি প্রশ্ন রেখেছেন, যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইব কত আর? একজন শব্দজীবীর সামনে এই প্রশ্নও কখনও পথ জুড়ে দাঁড়ায়। এই প্রশ্নের সূত্র আসলে ওই না-লেখা লেখাটির মুহূর্ত, সেই হারিয়ে ফেলা ভাবনার উদ্ভাস। কিন্তু হারানো লিখন মুহূর্ত আগলে না রাখার সহজ সিদ্ধান্তের পাশে এটাও মনে রাখার মতো কথা, হারিয়ে যাওয়া মুহূর্তকে আগলে রাখার সহজাত প্রবণতা জড়িয়ে আছে কবি লেখকদের স্বভাবে। জড়িয়ে আছে বলেই আসলে তাকে নিয়ে আক্ষেপ, জড়িয়ে আছে বলেই কখনও প্রত্যাশা ভাঙার বেদনা।

এই বেদনার উৎসে পৌছানো যায় আরও একটা কথাকে মনে রাখলে। প্রতিটি লেখকের কাছেই তার প্রত্যেকটি লেখা মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ— হতে পারে শেষ বিচারে তারই মধ্যে কিছু স্মরণীয় হয়ে থাকে এবং বাড়তি গুরুত্ব দাবি করে। কিন্তু লেখাটা শুরুর সময় লেখক কি অনুমান করতে পারেন লেখাটা তার প্রার্থিত মানে পৌঁছে যেতে পারবে কি না? তিনি তো প্রতিটি লেখাই একইরকম নিবেদন থেকে লেখেন। তারই মধ্যে কিছু থেকে যায় কিছু বা তুলনায় নিষ্প্রভ হয়ে থাকে— এও তো এক না-লেখা কাহিনির ঝরে পড়ার মুহূর্ত!

না-লেখার মুহূর্তের পাশে লেখার অসম্পূর্ণতা থেকে যাওয়ার বিষয়টিও কম ভাববার নয়। একজন ভাষাশিল্পীর অনেকরকম সৃজন মুহূর্তের সমান্তরালে এই প্রার্থিত মানে পৌছাতে না পারাও একরকম বেদনার গহন গুঞ্জন নিয়ে আসে। সঙ্গীতের ভাষায় যাকে বলা যেতে পারে কণ্ঠ ঠিক ঠিক সুরে না বেজে ওঠা— তবে তো সম্পূর্ণ গানটিই হয়ে পড়ল শিথিল, সুরছুট! তার মানেই একটা অতৃপ্তি, না-পারার অসহায় বোধ। এই অতৃপ্তি থেকেই কেউ কেউ নতুন কোনও লেখার উদ্দীপন পেয়ে যান, কেউ বা দ্রুত হাতে ছিঁড়ে ফেলেন সদ্য-রচিত কোনও গল্প বা কবিতার পাণ্ডুলিপি, জীবনানন্দের মতো কেউ কেউ বা ওই অক্ষম সৃষ্টিগুলোকে আড়াল করে রাখতে চান পাঠকের দৃষ্টি থেকে। একদিকে লিখতে না পারার আক্ষেপ, অন্যদিকে নিজের লেখাকে নির্দিষ্ট উচ্চতায় বেঁধে না ফেলতে পারার স্খলন— এই দুরকম দ্বন্দ্ব পেরিয়েই কি তবে চলতে হয় একজন স্রষ্টাকে? তারই ভিতর দিয়ে কখনও বেজে উঠবে একটি কবিতার শুদ্ধ স্বর, একটি কাহিনির নির্মোকভাঙা আদল। দুরকম হারানোর মধ্যে দিয়েই কি তবে আমরা পেয়ে যাব আমাদের গতিপথের নিজস্ব এক অক্ষরেখা? একটা আক্ষেপের বিকেল থেকে অন্য এক অতৃপ্তির সাঁঝের আলোয় আমরা দুলে চলব ক্রমশ? একজন স্রষ্টার জীবন জুড়ে কেবলই বেজে যেতে থাকে এই বিভাস আর ললিতের যুগলবন্দি। কেবলই ফুটে উঠতে না পারার আর্তিতে থেমে যেতে চাইবে কোনও অস্পষ্ট বিকেল অথবা কোনও ঘনঘোর সন্ধ্যা।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4644 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...