Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

লকডাউন— এক বছর বাদে ফিরে দেখা

বিষাণ বসু

 


প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, পেশায় চিকিৎসক

 

 

 

লকডাউন প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বলি, এই কোভিড অতিমারির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক— বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নামক গেরামভারি প্রতিষ্ঠানটির বিশ্বাসযোগ্যতা সান্ধ্য টিভির বিশেষজ্ঞদের পর্যায়ে নেমে আসা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং তাঁদের বড়কর্তারা আজ একরকম বলেন, তো কালই তার উল্টো। আসলে, আমাদের বিজ্ঞানসচেতনতা এমনই উচ্চগ্রামে বাঁধা, বিজ্ঞানীদের প্রায় ধর্মগুরুদের মতো শ্রদ্ধা করি— আশা করি, তাঁরা বসে বসে সারমন দেবেন, অব্যর্থ সুভাষিতানি শোনাবেন— কথার নড়চড় হবে না এক্কেবারে। করোনাভাইরাস নতুন কিছু ব্যাপার নয়— কিন্তু, ভাইরাসের এই বিশেষ ধরনটি বাজারে নতুন। সে ভাইরাস ছড়াচ্ছে কী করে বা মানুষ মারছে কী করে, সব নিয়েই বিস্তর ধোঁয়াশা। সবকিছু নিয়েই বিস্তর সংশয়— অতিমারি যেমন যেমন ছড়িয়েছে, গবেষণা ততই এগিয়েছে, প্রতিদিনই জানা যাচ্ছে অল্পবিস্তর নতুন নতুন তথ্য, পুরনো জানা বদলে যাচ্ছে নতুন আবিষ্কৃত তথ্যের ধাক্কায়— কিন্তু, আমাদের অত ভেবে দেখার সুযোগ নেই। বিজ্ঞানী, বা বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান, যদি তমুক বাবাজির মতো কনফিডেন্ট গাইডলাইনই না দিতে পারল, তাহলে দ্বিতীয়টাই প্রেফারেবল! তমুক ব্র‍্যান্ডের গেঞ্জি-জাঙ্গিয়ার মতো চোখ বন্ধ করে ভরসাই যদি না করা গেল, তাহলে তেমন স্বাস্থ্যসংস্থায় লাভ কী?

কিন্তু, সেসব কথা ছেড়ে আলোচনা করা যাক, এই অতিমারি মোকাবিলার একদম শুরুর দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অধিকর্তা যে কয়েকটি কথা বলেছিলেন, সে নিয়েই। কথাগুলো শুধুমাত্র করোনা থেকে একা বাঁচার জন্যে নয়— যেকোনও সঙ্কটের মুহূর্তে সবাই মিলে বেঁচে থাকতে জরুরি। তিনি বলেছিলেন, পাঁচটি পি— ইংরেজি বর্ণ পি-এর কথা।

  1. প্রিভেনশন— অর্থাৎ রোগপ্রতিরোধের উপরেই সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া।
  2. প্রিপেয়ার্ডনেস— অর্থাৎ বিপদ মোকাবিলায় প্রস্তুতির গুরুত্ব।
  3. পাবলিক হেলথ— অর্থাৎ জনস্বাস্থ্যে জোর দেওয়া।
  4. পলিটিকাল লিডারশিপ— অর্থাৎ রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছা।
  5. পিপল— এবং, এইটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ— আমজনতার সচেতনতা ও সক্রিয় সহযোগিতা ভিন্ন কিছুই হওয়া সম্ভব নয়।

কোভিডের স্কোরকার্ডে কোন দেশ শেষমেশ কেমন ফল করল, এতদিনের শেষে সে হিসেব মেলাতে বসলে দেখতে পাব, এই পাঁচটি পি মিলেই ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছে।

এবং, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বক্তব্যের মূলসুর ছিল, এই বিশ্বায়নের বাজারে, দেশের কোনও একটি বিশেষ শ্রেণির বা গোষ্ঠীর তো দূর, এই তামাম দুনিয়ায় কোনও একটি দেশেরও একা বেঁচে যাওয়ার আশা করা স্রেফ আহাম্মকি— জীবাণুঘটিত সংক্রামক মহামারি বিশ্বের সর্বত্র সামলানো না গেলে, যেখানে খানিকটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে সেখানেও আবার নতুন করে সংক্রমণ ছড়াবে। অতএব, অতিমারিকে সবাই মিলে সামলাতে হবে— বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের নিজের মতো করে নয়, সবাই মিলেই বাঁচতে হবে।

আলাদা আলাদা করে বিভিন্ন দেশের কথা বলে সেই প্রেক্ষিতে আমাদের দেশের সরকারের ক্রিয়াকলাপকে দেখা গেলে ভালো হত— দেখা যেতে পারত, প্রতিটি দেশ কেমন করে এই অভূতপূর্ব সঙ্কটের মোকাবিলা করতে চেয়েছিল, এবং পরবর্তী দিনের অভিজ্ঞতা সাক্ষী, ঠিক কোন পথ ধরে কিছুটা সাফল্য এসেছে। কিন্তু, সেসব সাফল্য বা ব্যর্থতার হিসেবনিকেশ বেশ কয়েকমাস পার করার পরের ব্যাপার। শুরুর দিনে বলা সম্ভব ছিল না, ঠিক কোন পথ ঠিক আর কোনটা ভুল। যেমন, সুইডেন সার্বিক লকডাউন না করেই চালিয়ে যেতে পেরেছিল বলে ভারতবর্ষের মতো জনবহুল দেশেও সেই মডেল একইভাবে কার্যকরী হত, এমন ভাবনা ঠিক নয়। মাথায় রাখা দরকার, পুরোটাই এগিয়েছে ট্রায়াল অ্যান্ড এরর পদ্ধতিতে— ভুল করতে করতেই শেখার মধ্যে দিয়ে।

কিন্তু, লকডাউনকে ফিরে দেখতে চাইলে, সরকারের ভূমিকা নিয়ে কথা বলতে হলে, কিছুটা তাত্ত্বিক আলোচনা না করলেই নয়। এই ধরনের জীবাণুবাহিত মহামারি/অতিমারি নিয়ন্ত্রণে আসে ঠিক কোন পথে? অতিমারি নিয়ন্ত্রণের পেছনের বিজ্ঞানটা যদি দেখি—

প্রথমত, আমরা জীবাণুর দ্বারা সংক্রামিত হলে, শরীর তার বিরুদ্ধে লড়াই করে, তৈরি করে অ্যান্টিবডি। নির্দিষ্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়ার মতো স্পেসিফিক ইমিউনিটি সঙ্গে সঙ্গেই তৈরি করা যায় না, জীবাণুকে চিনতে ও জানতে সময় লাগে— ইত্যবসরে জীবাণু কিছুটা জমি দখল করে ফেলে, কাজেই, লড়াইয়ে কখনও শরীর সফল হয়, কখনও জীবাণু, কিন্তু, জীবাণুকে হারানো গেলে জয়ের প্রাপ্তি হিসেবে শরীরের মধ্যে থেকে যায় অ্যান্টিবডি, বা চটজলদি অ্যান্টিবডি তৈরির ক্ষমতা, যে অ্যান্টিবডি পরবর্তীকালে ওই একই জীবাণু আক্রমণ করতে এলে সঙ্গে সঙ্গে কাজ করতে শুরু করে। অতএব, সংক্রমণের শুরুর দিকে জীবাণুকে চেনা-বোঝার যে সময়টুকু সেটা আর দ্বিতীয়বার নষ্ট হয় না— জীবাণুকে নিকেশ করার কাজ শুরু হতে পারে সঙ্গে সঙ্গেই। আজ আমরা জানি, করোনাভাইরাস এমন দ্রুত ভোলবদল করে ফেলে, আগে আক্রান্ত মানুষ পুনরায় আক্রান্ত হতেই পারেন। যদিও, সংক্রমণ তথা অসুখের গতিবিধিতে কিছু ফারাক থাকে।

শুনতে আশ্চর্য লাগলেও, যিনি ইতোপূর্বে একই জীবাণু দ্বারা সংক্রামিত হয়েছেন, তাঁর শরীরে সে জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তো থাকেই, কিন্তু, সমাজের একটা বড় অংশ যদি একটি বিশেষ জীবাণুর দ্বারা সংক্রামিত হন এবং তাঁদের দেহে যদি সংশ্লিষ্ট ব্যধির বিরুদ্ধে প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি থাকে, তাহলে সমাজের বাকিদের শরীরে হাতেগরম জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করার মতো অ্যান্টিবডি না থাকলেও কমে যায় সংক্রামিত হওয়ার সম্ভাবনা— যাকে বলা হয় হার্ড ইমিউনিটি (herd immunity)— বাংলা করতে চাইলে, বলা যেতে পারে দলগত বা সমষ্টিগত রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা।

এই হার্ড ইমিউনিটি হয় কেন? যে জীবাণু ছড়াচ্ছে একজন মানুষ থেকে আরেকজনে, সেই অসুখের বাড়বাড়ন্তের জন্যে প্রয়োজন প্রতিরোধহীন মানুষ, যিনি জীবাণুর দ্বারা সংক্রামিত হবেন এবং অন্যকে সংক্রামিত করবেন। এখন সমাজে যদি এমন ভালনারেবল মানুষের সংখ্যা একটা নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে কমে যায়, তাহলে সমাজে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সুযোগই কমে যায়। মানে, খুব সরল করে বলতে হলে, ক-বাবু যদি সংক্রমণ খ-বাবুকে ছড়ান, তারপরই সংক্রমণ গ-বাবু আর ঘ-বৌদির কাছে যেতে পারে— কেননা, খ-বাবুর সঙ্গেই গ-পরিবারের বন্ধুত্ব, ক-বাবুর সঙ্গে গ-পরিবারের সরাসরি যোগাযোগ নেই। স্বাভাবিকভাবেই, খ-বাবুর যদি এই অসুখের বিরুদ্ধে ইমিউনিটি থাকে, তাহলে ক-বাবু রাস্তায় ঘুরে বেড়ালেও গ-বাবুদের বিপদ নেই। এভাবে যে কজন প্রতিরোধহীন মানুষ পড়ে রইলেন, তাঁদেরও বিপদ কমে যায়। ঠিক কত শতাংশ মানুষের শরীরে প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হলে পুরো সমাজ হতে পারবে সুরক্ষিত? সে এক জটিল গাণিতিক মডেল। চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যবহৃত আর পাঁচটা গাণিতিক মডেলের মতোই এ-ও সবসময় একশো শতাংশ নির্ভরযোগ্য বা রিপ্রোডিউসিবল নয়, কেননা অনিশ্চিত ও অজানা উপাদান প্রচুর, অঙ্কটা কষা হয় মুখ্যত অসুখ কতখানি ছোঁয়াচে, একজন অসুস্থ মানুষ কতজনের সংস্পর্শে আসতে পারছেন এসবের ওপর ভিত্তি করে। মনে করা হচ্ছে, সমাজের ষাট কি পঁয়ষট্টি শতাংশ মানুষের শরীরে যদি প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি থাকে, তাহলে সমাজ কোভিড উনিশের বিপদ থেকে মুক্ত হতে পারে।

দ্বিতীয়ত, জীবাণুর বিরুদ্ধে কোনও ভ্যাক্সিন আবিষ্কৃত হল— যাতে কিনা টিকার মাধ্যমে বেশিরভাগ মানুষের শরীরে জাগিয়ে তোলা গেল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা। এক্ষেত্রেও মাথায় রাখুন, সমাজের একটা বড় অংশকে টিকার মাধ্যমে সুরক্ষিত করা গেলে, সেই সুরক্ষার সুবিধে বাকি সকলেই পাবেন— অর্থাৎ সেই হার্ড ইমিউনিটি।

মোদ্দা কথা, স্বাভাবিকপথে সংক্রামিত হয়েই তৈরি হোক প্রতিরোধক্ষমতা বা টিকার মাধ্যমে, উভয়ক্ষেত্রে ফল একই। সংশ্লিষ্ট জীবাণু যেই আক্রমণ করতে এগোবে, অমনি শরীরের ভিতরে আগের থেকেই তৈরি প্রতিরোধক্ষমতা জীবাণুকে আক্রমণ করবে। আর, একবার হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়ে গেলে সমাজের বাকিদের প্রতিরোধহীন শরীরও বিপন্মুক্ত থাকতে পারবে।

আপাতত ভ্যাক্সিন বা টিকা নিয়েই প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। ভ্যাক্সিন ভালো নাকি খারাপ, কার্যকরী নাকি বেকার, সত্যিই অতিমারি-নিয়ন্ত্রণের উপযুক্ত নাকি বহুজাতিক কোম্পানির উপার্জনের ধান্দাবাজি— সে বিতর্কের পরিসর এ লেখা নয়। তবু মনে করিয়ে দিই, আজ এই সেকেন্ড ওয়েভের মুখেও, লাগামছাড়া সংক্রমণ এবং সম্ভাব্য মৃত্যু এড়াতে চাইলে, ব্যক্তিগত সুরক্ষাবিধির সঙ্গে সঙ্গে আশার আলো ওই ভ্যাক্সিনই।

ভ্যাক্সিন বাদ দিয়ে হার্ড ইমিউনিটির আশার ক্ষেত্রেও সমস্যা, বিপুল সংখ্যায় আক্রান্ত হয়ে ইমিউনিটি অর্জন করতে গেলে যতজন মারা যাবেন (কোভিডে মৃত্যুহার এক কি দেড় শতাংশ ধরেও), আমাদের একশো তিরিশ কোটি জনসংখ্যার দেশে সেই সংখ্যা কম নয়। এবং, আমাদের নড়বড়ে স্বাস্থ্যপরিকাঠামোর কথা হিসেব করলে, বিপুল সংখ্যায় আক্রান্ত মানুষদের সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করা অসম্ভব— আর তাহলে মৃত্যুহার ওই এক-দেড় শতাংশে আটকে রাখাও সম্ভব নয়।

এই অতিমারি মোকাবিলার জন্য, সরকারের সামনে ঠিক কী কী পথ খোলা ছিল?

যেকোনও সংক্রামক মহামারি/অতিমারি মোকাবিলায় রাষ্ট্রের সামনে কয়েকটি মাত্র পথ খোলা থাকে।

এক, সক্রিয়ভাবে কিছুই না করে দেখতে থাকা। মহামারি কদ্দূর এগোয় এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মহামারি নিজে নিজেই প্রশমিত হবে, এমন আশা রাখা। এবং এর মাঝে আক্রান্ত মানুষজনের চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত রাখা। সমস্যা হল, এই পথে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এতটাই বেড়ে যায়— বিশেষত, কোভিড উনিশের মত ছোঁয়াচে অসুখের ক্ষেত্রে— কোনও রাষ্ট্রের পক্ষেই সব আক্রান্তের সঠিক চিকিৎসা সম্ভব হয় না। এমনকি, বেশ উন্নত পরিকাঠামোর দেশগুলোতেও না, আর আমাদের দেশে তো কথাই নেই।

দুই, এপিডেমিক মিটিগেশন। রাষ্ট্র মেনেই নেন, যে, মহামারিকে সম্পূর্ণ ঠেকানো সম্ভব নয়, চেষ্টা থাকে, তাকে যতখানি সম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখা। আক্রান্তের চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করা, সন্দেহভাজন মানুষকে আলাদা রাখা, তাঁদের সংস্পর্শে আসা মানুষজনকে কোয়ারেন্টিনে রাখা— এটুকুই করা হয়। সুস্থ-সবল মানুষের জীবনযাপনে তেমন নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা হয় না। ধরে নেওয়া হয়, এঁরা কোনও না কোনওভাবে জীবাণুর সংসর্গে আসবেন, আসবেনই, এবং নিজস্ব রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়ে সেই সংক্রমণ কাটিয়েও উঠবেন, এবং তাঁদের দেহে তৈরি হবে জীবাণুর বিরুদ্ধে বিশেষ প্রতিরোধক্ষমতা। এই ব্যবস্থায় আশা রাখা হয়, কখনওই আচমকা একইসঙ্গে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়বেন না। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যপরিকাঠামো বিপর্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনাও কম। উপরি পাওনা হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, অনেক সুস্থ মানুষ যেহেতু জীবাণুর দ্বারা সংক্রামিত হবেন এবং সেরেও উঠবেন নিজে নিজেই, তৈরি হয়ে যাবে জীবাণুর বিরুদ্ধে বিশেষ প্রতিরোধক্ষমতা। কিছুটা হলেও হার্ড ইমিউনিটির সুবিধে পাবে পুরো সমাজ। খুব জটিল আকার না নিয়ে মহামারি প্রশমিত হবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।

কিন্তু, যদি অঙ্ক না মেলে? যদি কিছুটা-হলেও-অবাধ জীবনযাত্রার ফলে অসুখ ছড়াতে থাকে লাগামছাড়া? মিটিগেশনের পথে চলতে শুরু করে পরবর্তীকালে ব্রিটেন তথা ইউকে পড়েছিল ঘোর ফ্যাসাদে। পাব্লিক ব্যাপক শোরগোল শুরু করলেন আরও কড়া পদক্ষেপের দাবীতে। মাঝপথে সে রাস্তা ছেড়ে লকডাউনে এলেন ব্রিটিশ সরকার— কিছুটা দেরি করেই। কোনও পথের সুবিধেই পুরোপুরি পাওয়া গেল না।

বিশ্বব্যাপী অতিমারির আতঙ্কের মুহূর্তে মিটিগেশন পদ্ধতিকে আমজনতা রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা বলে ভেবে নিতে পারেন। বিশেষত, বাকি দেশগুলো যখন যুদ্ধং দেহি তৎপরতা দেখাচ্ছে। আর আগেই বলেছি, নড়বড়ে স্বাস্থ্য-পরিকাঠামো নিয়ে আমাদের দেশ যদি সেই পথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেন, সেটা বিপজ্জনক হয়ে যেত।

তিন, এপিডেমিক সাপ্রেশন। এ একেবারে নো-ননসেন্স অ্যাপ্রোচ। মহামারিকে হারাতেই হবে ধরে নিয়ে এগোনো। নতুন করে রোগ ছড়াতে দেওয়া যাবে না, নতুন করে রোগী বাড়তে দেওয়া যাবে না— সন্দেহ হলেই পরীক্ষা করে দেখা— মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ ছড়ানো এক্কেবারে বন্ধ করতে হবে, করতেই হবে, মহামারি ছড়িয়ে পড়ার যে চেইন, তাকে ভেঙে দিতে হবে যে করেই হোক— এই পথে চলতে চাইলে, কোভিড উনিশের মতো অসুখের ক্ষেত্রে লকডাউনই সেরা পথ। কিন্তু, মাথায় রাখা যাক, লকডাউনই একমাত্র কাজ নয়— টেস্ট অ্যান্ড আইসোলেট, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং এগুলোই আসল কাজ। অর্থাৎ সন্দেহ হলেই পরীক্ষা করা, রিপোর্ট পজিটিভ এলেই তাঁদের আলাদা করা, তাঁদের সংস্পর্শে যাঁরাই এসেছেন তাঁদেরকেও খুঁজে বের করা, আবার পরীক্ষা করা, ইত্যাদি ইত্যাদি। লকডাউনের কাজ এই প্রক্রিয়াটিকেই সাহায্য করা। লকডাউন তো আদতে কিছুটা সময় কেনা— যে সময়টুকুতে পরিকাঠামো আরেকটু গুছিয়ে নেওয়া যায়।

কিন্তু, সাপ্রেশনের মুশকিল একটাই। এই পথে চললে হার্ড ইমিউনিটির কোনও আশা নেই। কেননা, আপনি তো সংক্রমণটাই আটকে দিচ্ছেন, সংক্রমণ ছাড়া তো স্পেসিফিক ইমিউনিটি তৈরি হতে পারবে না। মহামারি আপাত নিয়ন্ত্রণে এলেও নতুন করে জীবাণু এসে পড়লে একই মহামারির পুনরাবৃত্তি হতে পারে, হতেই পারে। তাহলে, এই পদ্ধতি ততদিন চালিয়ে যাওয়া দরকার, যতদিন অব্দি ভাইরাসটিই প্রকৃতি থেকে নির্মূল হচ্ছে, অথবা কার্যকরী ভ্যাক্সিন বাজারে আসছে। কার্যক্ষেত্রে সাপ্রেশনের অর্থ, এই সাপ্রেশনের দিনগুলোতে নিজেদের স্বাস্থ্যপরিকাঠামো গুছিয়ে নেওয়া, যাতে লকডাউনের পরে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গেলেও তাঁদের সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করা সম্ভব হয়। এবং, স্বাভাবিকভাবেই, এই কদিনে অসুখটার গতিপ্রকৃতি ও চিকিৎসা বিষয়ে বাড়তি খবরও জানা যাবে, সুতরাং চিকিৎসার বন্দোবস্ত কিঞ্চিৎ সরল হবে।

অতএব আমরা জানলাম, সরকারের হাতে ঠিক কী কী বিকল্প ছিল। দেখলাম, এই পরিকাঠামো নিয়ে, চটজলদি ঝাঁপিয়ে পড়ে সাপ্রেশনের পথ বাদে বিশেষ কিছুই উপায় ছিল না। এবার দেখে নেওয়া যাক, এদেশের সরকার ঠিক কী কী করলেন।

তিক্ত উত্তরটা হল, তেমনভাবে কিছুই করলেন না। করোনা নিয়ে দেশে যখন রীতিমতো আতঙ্কের পরিস্থিতি, সরকারবাহাদুর জারি করলেন একটি দিনের জনতা কার্ফু। আর আজকাল যেমন হয়, সরকারি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সোশাল মিডিয়া ছয়লাপ হয়ে গেল অবাস্তব কিছু “তথ্যভিত্তিক” সমর্থনের মেসেজে। যেমন, একটিমাত্র দিন রাস্তায় লোকজন না বেরোলেই নাকি অসুখের ট্রান্সমিশন চেইন ব্রেক করে যাবে। যেমন, এই ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী সৃষ্টিশীল ভাবনার কারণে সারা বিশ্ব ভারতের কৃতিত্বে চমৎকৃত। যেমন, বিশ্বের শক্তিশালী সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধান একযোগে ভারতের উদ্ভাবনীশক্তি দেখে হতবাক। ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু, সরকারবাহাদুর জানতেন, একদিন দিয়ে কিছুই হবে না— হওয়ার নয়। অতএব, সেইদিনই সন্ধেবেলা জারি হল টানা তিন সপ্তাহের লকডাউন, যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে বাড়তে চলল কয়েকমাস। লাগাতার সম্ভব-অসম্ভব সমর্থনের ঢেউয়ে হারিয়ে গেল অনেক অনেএএক প্রশ্ন। যেমন, দেশে প্রথম করোনা রোগীর খোঁজ পাওয়ার পরেও সরকার হাত গুটিয়ে বসেছিলেন কেন? যেমন, প্রথমদিকের সব আক্রান্তই বিলেতফেরত জেনেও, আন্তর্জাতিক উড়ান বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি কেন? যেমন, খবর পাওয়ার পরেও আন্তর্জাতিক উড়ান থেকে যাঁরা নামলেন, তাঁদের নজরে রাখা এবং পরীক্ষার বন্দোবস্ত হল না কেন? যেমন, সারা বিশ্ব যখন করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আতঙ্কিত, তখনও স্বাস্থ্যদপ্তর কোন আক্কেলে জানালেন, যে, করোনা কোনও এমার্জেন্সি পরিস্থিতি নয়? দুর্ভাগ্য আমাদের, প্রশ্নগুলো সেভাবে কেউই তুললেন না। অবশ্য, নাগরিক তো তেমন সরকারই পাবেন, যেমনটি তিনি ডিজার্ভ করেন— তাই না??

তবু, যে কথাটা খুব বেশি করে বলা জরুরি ছিল, সেই কথাটুকু সেভাবে কেউই তুললেন না— অন্তত, লকডাউনের শুরুর দিকে তো তোলাই হল না। বিশ্বের বাকি দেশগুলো, যেখানে লকডাউন নিয়ে ভাবনাচিন্তা হয়েছে, প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রে সঙ্গেসঙ্গেই ঘোষিত হয়েছে লকডাউনের সময় কাজ হারানো মানুষগুলোর জন্যে বিকল্প বন্দোবস্ত— আর্থিক সহায়তা, খাবার, ভাতা ইত্যাদি। এদেশে এই কাজ ছিল আরও জরুরি, কেননা দেশের নাগরিকদের অধিকাংশই কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে, এবং কাজে না যেতে পারলে, তাঁদের আয়ও নেই। আমাদের এই রাজ্যে, রাজ্য সরকার এধরনের কিছু ভাবনার কথা বললেও, দেশব্যাপী লকডাউনের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্তরেও এবিষয়ে কিছু ভাবনার উল্লেখ ছিল জরুরি। দুর্ভাগ্যজনক, তেমন কিছুই জানা যায়নি। এই বন্দোবস্ত ছাড়া দীর্ঘ লকডাউন লাগু করার অর্থ বিপুল সংখ্যার মানুষকে নিশ্চিত অনাহারের দিকে ঠেলে দেওয়া। এদেশে করোনা মহামারির আকার নিলে কজন মারা যেতে পারেন, তার পূর্বাভাস দিতে না পারলেও, উপযুক্ত ব্যবস্থা ছাড়া গরীব মানুষের উপর দীর্ঘমেয়াদি লকডাউন নামিয়ে আনলে অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যাটা তার চেয়ে কম কিছু দাঁড়াবে না, অনুমান করা কঠিন কি? এবং, দ্বিতীয়ত, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া অনাহারক্লিষ্ট মানুষ যে-করেই-হোক কিছু উপার্জনের আশায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লে লকডাউনের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হওয়া নিশ্চিত। সরকারি তরফে লকডাউনের সঙ্গে সঙ্গে আনুষঙ্গিক কোনও সুপরিকল্পিত পদক্ষেপই নেওয়া হল না। কাজেই, কোভিডে মৃত্যু কতখানি কমল, তার চাইতেও বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল, আরও কত প্রাণ চলে গেল “কোভিড নিয়ন্ত্রণে”। লকডাউনের সমর্থনে যেসব দিগগজরা বলছিলেন, অর্থনীতির কথা পরে ভাবা যাবে, আগে তো প্রাণে বাঁচা যাক— তাঁদের কথাটা একদিক থেকে সত্যি— কিন্তু, তাঁদের কাছে অর্থনীতি বলতে বড় বড় সংস্থা এবং সেখানে কর্মরত মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী শ্রেণির স্বার্থ। আগে তো বাঁচি কথাটা ঠিক— সেই বেঁচে থাকার মধ্যে খাদ্যের জোগানটা জরুরি— এটা ভুলে গেলে চলবে না। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান মানুষের জীবনে একেবারে মূলগত প্রয়োজন— এবং তার মধ্যেও অন্ন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

শুরুতেই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা মিলে একটা হিসেব কষেছিলেন, যাতে দেখা গিয়েছিল, করোনা মোকাবিলায় সবচেয়ে কড়া পদক্ষেপ যেসব দেশ নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য আমাদের দেশ (বর্তমান প্রবণতা মেনে, অনেকেই হিসেবের শুধুমাত্র সেই অংশটুকু বেছে নিয়ে দিব্যি গৌরববোধও করছেন)— কিন্তু, লকডাউনের পরিস্থিতির মোকাবিলায় যেসব দেশ অন্তর্কালীন অর্থ বরাদ্দ করেছেন, সেই অর্থবরাদ্দের অঙ্কে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর মধ্যে আমরা। জার্মানির বরাদ্দ যেখানে জিডিপির তিরিশ শতাংশ— আমাদের সেখানে শূন্য দশমিক আট শতাংশ। আর বড়লোক দেশের সঙ্গে তুলনা করে লাভ নেই, এই বলে যুক্তি দিতে চাইলে, বলে রাখা যাক, ঘরের পাশে মালয়েশিয়াতে বরাদ্দ ছিল জিডিপির ষোল শতাংশ। অতএব, যে দেশে অধিকাংশ মানুষের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের বেসিক চাহিদা পূরণ হয় না নিয়মিতভাবে, সেদেশে কড়া লকডাউন এবং সঙ্গে সরকারি তরফে কার্পণ্য— এ যুগলবন্দির পরিণাম সহজেই অনুমেয়।

আবারও মনে করিয়ে দিই, লকডাউন নিজে নিজেই কোনও সমাধান নয়। লকডাউন অসুখ সারায়ও না, অসুখের বিরুদ্ধে সমষ্টিগত প্রতিরোধের ক্ষমতাও তৈরি করে দেয় না। বাকি সব ব্যবস্থাগুলোর সহযোগী হিসেবে ব্যবহার করা গেলে লকডাউন, অবশ্যই, খুব কার্যকরী ব্যবস্থা— কার্যকরী মহামারির ভয়াবহতা ঠেকানোর ক্ষেত্রে; কার্যকরী একজন মানুষ থেকে অন্যজনের শরীরে সংক্রমণ ঠেকিয়ে রাখতে; কার্যকরী অসুস্থ মানুষের সংখ্যা কমিয়ে রাখতে, যাতে আমাদের পরিকাঠামো দিয়ে সেই সীমিতসংখ্যক মানুষের সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করা যেতে পারে; কার্যকরী, আরও প্রস্তুত হওয়ার জন্যে সময় কিনতে। কিন্তু, এগুলো সবই হতে পারে, হতে পারত, যদি লকডাউনের সঙ্গে সঙ্গে বাকি ব্যবস্থাগুলোও নেওয়া হয়, তবেই। কিন্তু, এদেশে লকডাউনকেই একটা দুর্দান্ত স্ট্র‍্যাটেজি হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া হল এবং সরকারপক্ষের সমর্থকবৃন্দ এই লকডাউনের পেছনে কী গভীর ভাবনা-অন্তর্দৃষ্টি রয়েছে, তার প্রচারে ব্যস্ত রইলেন। আসলে, লকডাউন করতে তো বিশেষ পরিশ্রম নেই— স্রেফ একটা ঘোষণা করলেই চলে। বাকি কাজগুলোর জন্যে প্রস্তুতি লাগে, প্রশাসনিক উদ্যোগ লাগে— এমনকি একটা লকডাউন কার্যকর করতেও সেগুলো লাগে— সম্ভবত এ কারণেই, আমাদের লকডাউন দিনের হিসেবে যেমন করে বেড়েছে, কার্যকারিতায় তেমন নয়।

যেকোনও ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে— প্রয়োগের মুহূর্তে সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। লকডাউনের বিপদও কিন্তু কম কিছু নয়। ফাঁকফোকড় রয়ে গেলে, বা কোনও না কোনও কারণে লকডাউন ভেঙে পড়লে আচমকা মহামারি ভয়ঙ্কর আকার নিতে পারে। একদিকে প্যানিকগ্রস্ত মানুষ আর অন্যদিকে মহামারি-অনাহার-দারিদ্র‍্য, দুইয়ে মিলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া সম্ভাবনাও প্রচুর। লকডাউন কার্যকরী অস্ত্র— অতিমারির ক্ষেত্রে অন্য দেশে পরীক্ষিত অস্ত্রও বটে— কিন্তু, উপযুক্ত প্রয়োগপদ্ধতি ছাড়া এই অস্ত্র ভালোর চেয়ে খারাপ হয়ে দাঁড়ানোর সম্ভাবনাটিও মাথায় রাখা উচিত। সরকারবাহাদুর জানতেন না কিছুই, এমনটা ভাবার কারণ আছে কি??

সে তো গেল একটা দিক। আরেকদিকে, লকডাউনের সময়টা ঠিক কীভাবে ব্যবহৃত হল? শুরু থেকেই প্রশ্ন উঠেছে, আমাদের দেশে করোনায় আক্রান্ত ঠিক কত? কীভাবে পরীক্ষা হচ্ছে? ঠিক কাদের মধ্যে পরীক্ষা হচ্ছে? জনসংখ্যার কত শতাংশে পরীক্ষা করা হচ্ছে? পরীক্ষা যাঁদের মধ্যে হচ্ছে, তাঁদের ঠিক কত শতাংশ পজিটিভ? সারা দেশে তো বটেই, বিশেষত এই রাজ্যে তো স্বচ্ছ তথ্য বা সদুত্তরের আশা করাটাও অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল— অন্তত, শুরুর দিকে তো বটেই। বিদেশের নামীদামী গবেষণা-সংস্থার তরফে ভারত থেকে প্রাপ্য তথ্যকে ধাপ্পাবাজি ও বিভ্রান্তিকর বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওদিকে সোশ্যাল মিডিয়া ভরিয়ে দেওয়া হয়েছে হাস্যকর মিথ্যে দিয়ে— করোনা মোকাবিলায় এদেশের অভাবনীয় সাফল্যে মোহিত বিশ্ববাসী নাকি ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রীকে মাথায় বসিয়ে বিশ্বব্যাপী করোনা-মোকাবিলা কমিটি তৈরি করছেন। অথচ, সঠিক তথ্য তো জরুরি ছিল। বিপদের পরিমাণ, বিস্তার আর গভীরতার আঁচ না পাওয়া গেলে বিপদ মোকাবিলার প্রস্তুতি ঠিকভাবে নেওয়া যায় না।

পরিকাঠামোর অন্যতম অঙ্গ মানবসম্পদ। এই লড়াইয়ে সামনের সারির সৈনিক চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা। তাঁদের সুরক্ষার বন্দোবস্ত, অন্তত শুরুর দিকে, অপর্যাপ্ত কেন? বাকি দেশ যখন তাঁদের দেশের চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার জন্যে পিপিই (পার্সোনাল প্রোটেকশন ইক্যুইপমেন্ট) জোগাড়ে ব্যস্ত, তখনও আমাদের দেশ পিপিই রপ্তানি করতে দিয়েছে, এমনকি তখনও, যখন দেশের চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা সুরক্ষাসামগ্রী পাননি। কেন?

পিপিই বা ওইধরনের সামগ্রী যাঁরা প্রস্তুত করেন, তাঁদের অ্যাসোসিয়েশনের কনভেনর জানিয়েছিলেন, গতবছরের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকেই, অর্থাৎ বিশ্ব জুড়ে করোনা-মোকাবিলার প্রস্তুতির শুরুর সময় থেকেই, তাঁরা সরকারের কাছে বারবার জানতে চেয়েছেন ঠিক কী ধরনের সামগ্রী তাঁরা তৈরি করবেন, ঠিক কী কী স্পেসিফিকেশন— সরকারের কাছ থেকে উত্তর আসেনি। কাজেই, তাঁদের তরফে উপযুক্ত প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয়নি। পুরোদস্তুর পিপিই তৈরির পরিকাঠামো তাঁদের সবার কাছে নেই, মিলিয়েজুলিয়ে একে অপরের সহযোগিতায় তৈরি করারই চল। পিপিই পুরো ঠিকঠাক কার্যকরী কিনা, পরীক্ষা করে দেখার পরিকাঠামোও তাঁদের নিজেদের নেই। কারওই স্বয়ংসম্পূর্ণ পরিকাঠামো না থাকার কারণে সবটুকু উপযুক্ত মান অনুসারে তৈরি করা তাঁদের পক্ষে সময়সাপেক্ষ— আচমকা চাহিদা অনুসারে জোগান দেওয়া তাঁদের পক্ষে দুঃসাধ্য। এমতাবস্থায় কাপড়ের গাউন এবং তার উপরে প্লাস্টিক অ্যাপ্রন, হয়ত এই দিয়েই কাজ চালাতে হয়েছে। মুখ ঢাকার ফেস-শিল্ড যাঁরা তৈরি করছেন, তাঁদের অনেকেরই সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা নেই। কাজেই, সেই প্রোটেক্টিভ ইক্যুইপমেন্টে কতখানি প্রোটেকশন মিলেছে, বলা মুশকিল। জলনিরোধক উপাদান (যেমন পলিথিন) দিয়ে তৈরি পিপিই-র জায়গায় কাপড়ের গাউন এবং তার উপরে প্লাস্টিকের অ্যাপ্রন— তড়িঘড়ি বানানো মাস্ক— প্রশ্নযোগ্য মানের ফেস শিল্ড— সুরক্ষা বলতে এই। সার্জিকাল গাউনের উপর প্লাস্টিক অ্যাপ্রনের তুলনায় রেইনকোট আলাদাভাবে খারাপ হয়ত নয়— কিন্তু, শুরুতে সর্বত্র সেটুকুরও ব্যবস্থা করা যায়নি।

এদেশে ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীদের সংখ্যা, জনসংখ্যার নিরিখে কম— যেকোনও উন্নত দেশের অনুপাতে ভয়ানক কম। তাঁদের সুরক্ষার জন্যে ব্যবস্থা রাখা উচিত ছিল সর্বোচ্চমানের। বাস্তবে হয়েছে তার বিপরীত। অতএব, শুরুর দিকে একের পর এক হাসপাতালে চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হয়েছেন পাইকারি হারে। অনেক সময় আস্ত বিভাগ, এমনকি পুরো হাসপাতালও বন্ধ করে দিতে হয়েছে। এদেশের সর্বত্রই, করোনা-আক্রান্তদের জন্যে বিশেষ হাসপাতাল ও তদনুসারী পরিকাঠামোর ব্যবস্থা করার ব্যাপারেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে অনেক দেরিতে। অথচ, লকডাউনের শুরুর দিনগুলোতে এগুলোই হতে পারত অগ্রাধিকার— হওয়া উচিত ছিল।

অতিমারির মুহূর্তে বাড়তি ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন যাঁরা, সেই চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের কেউ মারা গেলে বীমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সরকারবাহাদুর— কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়ই। এখনও পর্যন্ত মারা গিয়েছেন কয়েকশো ডাক্তার— স্বাস্থ্যকর্মী আরও বেশি— চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী সবমিলিয়ে কয়েক হাজার তো বটেই। কজন পেয়েছেন সেই ক্ষতিপূরণ? ডাক্তারদের সংগঠনের প্রশ্নের উত্তরে সরকার জানিয়েছেন, ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন ষাটজনের মতো ডাক্তার (গত সেপ্টেম্বরের তথ্য)। ডাক্তার বাদে বাকি স্বাস্থ্যকর্মীদের হয়ে জোরগলায় দাবি তোলার মতো সংগঠন আরও কম, তাঁদের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। এবম্বিধ সরকারি সদিচ্ছায় চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা যে বাড়তি অনুপ্রাণিত হবেন, সে তো সহজেই অনুমেয়, তাই না!!

আর করোনা বাদে বাকি সব অসুখ? করোনা-আক্রান্ত তো বটেই, কিন্তু তাঁদের বাদ দিয়েও বাকি মানুষ যাতে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হন, সে নিয়ে বাড়তি সজাগ থাকতে বলেছিলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু, লকডাউনের সুবাদে ক্যানসার-আক্রান্ত মানুষজন রেডিওথেরাপি বা কেমোথেরাপি নিতে পারেন না ঠিকভাবে, ব্লাডব্যাঙ্কে রক্তের আকাল, নিয়মিত ডায়ালিসিস প্রয়োজন যাঁদের, তাঁরাও মুশকিলে, অধিকাংশ হাসপাতালে ইলেক্টিভ অপারেশন বন্ধ, এমার্জেন্সি বাদ দিয়ে অধিকাংশ চিকিৎসা স্থগিত— আর, এদেশে যেহেতু স্বাস্থ্যপরিকাঠামো বিকেন্দ্রীভূত হতে পারেনি, অনেককেই চিকিৎসার জন্যে পাড়ি দিতে হয় দীর্ঘ পথ। লকডাউনে যাতায়াত দুরূহ। দেশের বিপুল সংখ্যার শিশু টিকা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এদের একটা বড় অংশের, পরবর্তীতে, ভ্যাক্সিন দিয়ে ঠেকানো যায় এমন অসুখে ভোগার সম্ভাবনা। কাজেই, মাসছয়েকের লকডাউন ও অনিবার্য চিকিৎসাহীনতায় সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যের হাল কেমন দাঁড়িয়েছে, সে নিয়ে কথা না বাড়ানোই ভালো।

আর আগেই তো বলেছি, সমাজে যাঁরা নীচের সারিতে রয়েছেন— অর্থাৎ আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ— অসুখ সামলানোর বিবিধ সরকারি ক্রিয়াকলাপে তাঁরা প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে। তাঁদের জন্যে সামাজিক সুরক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা করার কথা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বললেও এদেশের সরকার তেমন কিছু কার্যকরী পদক্ষেপের কথা জোরগলায় বললেন কই!! এর মধ্যে কাজ হারালেন দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ— এই বিপুল জনসংখ্যার, এই বিপুল কর্মহীনতার দেশে নতুন করে কাজ হারালেন কয়েক কোটি মানুষ— না, ন্যূনতম সুরক্ষার বন্দোবস্ত সরকার করেননি।

অতএব, লকডাউন চলল। অসুখ কমল না। দেশের অর্থনীতির হাল কোভিড পরিস্থিতির আগে খুব হইহই করে গল্প করার মতো ছিল, এমন নয়। ধুঁকতে থাকা অর্থনীতি ভেন্টিলেটরে দেওয়ার অবস্থায় পৌঁছাল। কোভিডে ঠিক কতজন মারা গেলেন, বলা মুশকিল— কেননা, নির্ভরযোগ্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এদেশের তথ্যকে নির্ভরযোগ্য বলেননি। সরকারি হিসেবেই সংখ্যাটা লাখের আশেপাশে, সত্যি কত কে জানে!! ওদিকে বিনা চিকিৎসায় অন্যান্য অসুখে মারা গেলেন অজস্র, না খেতে পেয়েও অনেকে, কাজ হারানোর হতাশায় বা তিলে তিলে বা অসুখ জটিলতর হয়ে আগামী দিনে লকডাউনের এফেক্টে মারা যাবেন কত, কেউই জানেন না।

আস্তে আস্তে আনলক শুরু হল। হতেই হত। নাগরিকদের ভালোমন্দের ব্যাপারে গভীর দায়বোধ থেকে নয়— স্রেফ অর্থনীতির কারণেই (অবশ্য, তার সঙ্গেও তো নাগরিকদের ভালোমন্দ অনিবার্যভাবে জড়িত)। লকডাউন শুরুর সময় আক্রান্ত ছিলেন কয়েকশো, লকডাউন তোলার সময় প্রতিদিন নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক হাজার। বাকি সব “কোল্যাটারাল ড্যামেজ” নিয়ে সরকারের কাছে “তথ্য নেই”। এই বিপুল তথ্যের সুনামির মাঝে বসে— যেখানে আপনি কী খেতে ভালোবাসেন থেকে শুরু করে আপনার একান্ত গোপন ফ্যান্টাসি, সবই কেউ না কেউ গুছিয়ে রাখে, সাজিয়ে রাখে— বাইট, কিলোবাইট, মেগাবাইটের হিসেবে সংগ্রহ করা হতে থাকে— আপনার ভায়রাভাইয়ের বিবাহবার্ষিকীতে আপনার হাতঘড়িটি কোন ব্র‍্যান্ডের ছিল, সেই তথ্য গোপনে জেনে নিয়ে আপনাকে নেট সার্চের সময় বিশেষ প্রোডাক্টের বিজ্ঞাপন দেখানো গিয়েছে— আর কতগুলো মানুষ এই লকডাউনের দিনগুলোতে বেঘোরে মারা গেল, সে নিয়ে কোনও তথ্য নেই!!

আমরাও ভাবলাম কতটুকু? টুকরো টুকরো খণ্ডদৃশ্য জুড়েই পুরো ছবিটা। খণ্ডদৃশ্য খুঁজে খুঁজে চেনার ধৈর্য বা অবকাশ কই আমাদের এই আত্মকেন্দ্রিক যাপনে?

…তবু ততটা সেয়ানা নই বলে, যদি তুমি অবোধ জিজ্ঞাসা নিয়ে জেগে ওঠো, যদি জানতে চাও আমাদের বালক-ভৃত্যের ওই কুসুম-কুসুম মুখে ছায়া কেন, সত্যি বলছি মুশকিলে পড়ব। যদি প্রশ্ন করো সমাজব্যবস্থা নিয়ে, রাষ্ট্রীয় নির্বাচন নিয়ে, উত্তর থাকবে বইকী। কিন্তু, হে স্বর্গের পাখি, সরল সত্যের সামনে দাঁড়াতে চাইলে বস্তুত হাঁটু কাঁপে, নত হয় মুখ।…

(আলোর পাখিকে; চৈতালী চট্টোপাধ্যায়)

না, শুধুই হতাশার কথা বলব না। এটুকুই বলার, রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি, কিন্তু, সেই সদিচ্ছা যাতে অটুট থাকে, সেটা নিশ্চিত করাও আমাদেরই দায়িত্ব। প্রতিটি সঙ্কটই শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ, কোভিড উনিশের বিপদও কেটে যাবে নিশ্চিত, আজ না হলে কাল— হ্যাঁ, এই সেকেন্ড ওয়েভের মুখে বসেও বলছি, কোভিড-সঙ্কট তো চিরকালীন কিছু নয়, কিন্তু, এই বিপদ থেকে কিছু শিক্ষা নেওয়া গেলে আখেরে ভালোই হবে, তাই না? শিক্ষা নিতে পারলে ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি না করার স্বপ্ন তো দেখতেই পারি…

…দ্যাখো পাখি, সঙ্কোচে বলতে পারিনি,/
সেদিন সন্ধ্যায়, ম্লান আলো, চায়ের দোকানে বসে বন্ধুটির চোখে/
আমিও দেখলাম এক বিশাল ভারতবর্ষের স্বপ্ন, চশমায়,/
নামানো পল্লবে লেগে আছে।…

(আরো একবার আলোর পাখিকে; চৈতালী চট্টোপাধ্যায়)


*ধানসিড়ি প্রকাশনা থেকে প্রকাশিতব্য “কোভিডকাল” বইয়ের প্রথম নিবন্ধের অংশবিশেষ