অতিমারি: মানসিক অবসাদের এক তীব্র ট্রিগার

নিউজ রিলিজ, WHO

 

কোভিড-১৯ অতিমারি স্বাস্থ্য-শিক্ষা-অর্থনীতি সহ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কী বিষময় প্রভাব ফেলেছে সে-সব নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে এবং হয়ে চলেছে। এবং সেগুলি আমরা আমাদের জীবন দিয়েও অনুভব করতে পারছি সম্যক। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কোভিড-১৯-এর যে ভয়ঙ্কর প্রভাব, সে নিয়ে যথেষ্ট কথাবার্তা শোনা যায় না। সরকারগুলিও, যথারীতি, এ-বিষয়ে উদাসীন। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের এই জুন ২০২২ সংখ্যার রিজার্ভড বগি ‘মানসিক অসুস্থতা: এক নীরব অতিমারি’-তে আমরা এই বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গত ২ মার্চ ২০২২-এর সংবাদ প্রতিবেদনটি অনুবাদ করে প্রকাশ করলাম। অনুবাদ করেছেন সোমরাজ ব্যানার্জি

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে প্রকাশিত আজকের সায়েন্টিফিক ব্রিফের তথ্য অনুযায়ী, কোভিড ১৯ অতিমারির প্রথম বছরে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ ও অবসাদের প্রকোপ ২৫ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। কারা এই সমস্যার দ্বারা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত এই বিষয়টির উপর আলোকপাত করার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবার উপর অতিমারির প্রভাব এবং তার পরিবর্তন নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে ব্রিফটিতে।

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এই উদ্বেগের ফলস্বরূপ ৯০ শতাংশ দেশ তাদের কোভিড মোকাবিলার পরিকল্পনায় মানসিক স্বাস্থ্য ও মনস্তাত্ত্বিক সহায়তাকে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়েছে, যদিও তার মধ্যে বড়সড় কিছু ফাঁক বিদ্যমান।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল ডঃ টেডরস বলেন— “বিশ্বের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর কোভিড ১৯-এর প্রভাব সম্পর্কিত যে তথ্য আমরা এখনও অবধি জোগাড় করতে সমর্থ হয়েছি, তা হিমশৈলের চূড়া মাত্র। বিশ্বের সমস্ত দেশের কাছে এটা একটা ওয়েক আপ কল যাতে তারা জনগণের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে আরও বেশি মনোযোগ দিয়ে দেখেন এবং সেই সংক্রান্ত সহায়তার দিকটিতে আরও বেশি করে জোর দেন।”

 

মানসিক চাপের নানাবিধ কারণ

অতিমারিকালীন অত্যধিক মানসিক চাপ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি উঠে এসেছে তা হল নিভৃতবাস এবং এর সঙ্গে জুড়ে থাকা অন্যান্য বিষয় যেমন মানুষের কর্মক্ষমতা কমে যাওয়া, কাছের মানুষদের কাছ থেকে সাহায্য চাইতে না পারা এবং নিজের কমিউনিটিতে মিশতে না পারা। একাকিত্ব, সংক্রমণ, রোগভোগ, নিজের ও কাছের মানুষদের মৃত্যুভয়, প্রিয়জন বিয়োগের শোক এবং আর্থিক দুশ্চিন্তা— এই সবকিছুই উদ্বেগ ও অবসাদ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে কাজ করেছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ার একটা প্রধান কারণ হল অত্যধিক ক্লান্তি।

 

সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন যুবক-যুবতী ও মহিলারা

ব্রিফটিতে, যেখানে উপস্থিত প্রামাণ্যের উপর ভিত্তি করে মানসিক স্বাস্থ্য ও মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা সংক্রান্ত তথ্যের পাশাপাশি সাম্প্রতিক গ্লোবাল বার্ডেন অফ ডিজিজ স্টাডিজের অনুমানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে যে এই অতিমারি যুবক-যুবতীদের মানসিক স্বাস্থ্যকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে এবং তাঁদের ব্যবহারে আত্মহত্যা ও আত্মক্ষতি সংক্রান্ত চিন্তাকে বাড়িয়ে তুলেছে। এটাও লক্ষণীয় যে মহিলারা পুরুষদের থেকে বেশি মাত্রায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং যাঁদের শরীরে ইতিমধ্যেই হাঁপানি, ক্যানসার বা হৃদরোগের মতো গুরুতর রোগের উপস্থিতি ছিল, তাঁদের শরীরে মানসিক রোগের উপসর্গও ধরা পড়েছে।

তথ্য বলছে, যাঁরা ইতিমধ্যেই কোনও না কোনও মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন, কোভিড ১৯ তাঁদেরকে বিশেষ কাবু করতে পারেনি। কিন্তু, তাঁদের মধ্যে কেউ যদি একবার আক্রান্ত হন, তাহলে তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি, গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যুর হার মানসিকভাবে সুস্থ মানুষের তুলনায় অনেক বেশি। যাঁরা গুরুতর মানসিক রোগ যেমন সাইকোসিসে আক্রান্ত বা যে সমস্ত যুবাদের মানসিক ব্যাধি রয়েছে, তাঁদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

 

চিকিৎসার ফাঁক

মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার চিকিৎসা পরিষেবাতেও কিছু গুরুতর ফাঁক থেকে যাচ্ছে। বিশেষ করে যাঁদের এটা সবচেয়ে বেশি দরকার তাঁরা এই পরিষেবা পাচ্ছেন না। হু-র সদস্য দেশগুলির তথ্য অনুযায়ী, অতিমারির সময়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানসিক, স্নায়বিক এবং সাবস্ট্যান্স ইউজ ডিজর্ডার জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অসুস্থতার চিকিৎসা পরিষেবা সবচেয়ে বেশি ব্যাহত হয়েছে। এমনকি অনেক দেশে মানসিক স্বাস্থ্যের জীবনদায়ী পরিষেবাও গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যেমন— আত্মহত্যা প্রতিরোধ।

২০২১-এর শেষের দিকে এসে এই পরিস্থিতির কিঞ্চিৎ উন্নতি হলেও এখনও অনেক মানুষ আছেন যাঁরা কোভিডের আগে থেকেই মানসিক রোগে আক্রান্ত ছিলেন বা সাম্প্রতিক সময়ে যাদের এই উপসর্গ ধরা পড়েছে, তাঁরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা বা সহায়তা পান না।

মুখোমুখি চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে অনেকেই অনলাইন সহায়তা পাওয়ার দিকে ঝুঁকেছেন, যার ফলস্বরূপ নির্ভরযোগ্য ও উপযোগী ডিজিটাল পরিকাঠামোর উপস্থিতি খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। যাই হোক, যেসব দেশের সংস্থান খুবই সীমিত, তাদের পক্ষে ডিজিটাল মাধ্যমে এই পরিকাঠামোর ব্যবস্থাপনা ও উন্নতিকরণ একটা বড়সড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও দেশের কাজ

অতিমারির শুরু থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও তার সহযোগী দেশগুলি তাদের সংস্থানকে একাধিক ভাষায় ও ফরম্যাটে উন্নত করা ও প্রচার করার কাজ শুরু করেছে যাতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষ মানসিক স্বাস্থ্যের উপর কোভিড ১৯-এর প্রভাবকে সামাল দিতে পারে। যেমন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ৬-১১ বছর বয়সীদের জন্য ‘মাই হিরো ইজ ইউ’ বলে একটি বই প্রকাশ করেছে যা বর্তমানে ১৪২টি ভাষায় ও ৬১টি গণমাধ্যমে উপলব্ধ। এছাড়াও প্রাপ্তবয়স্কদের সহায়তার জন্য একটি টুলকিট বানানো হয়েছে যা ১৬টি ভাষায় পাওয়া যায়।

পাশাপাশি, হু তার সহায়ক সংস্থাগুলির সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করছে, যেমন, রাষ্ট্রপুঞ্জের বিভিন্ন এজেন্সি, বিভিন্ন আন্তজার্তিক বেসরকারি সংস্থা, রেড ক্রস, রেড ক্রেসেন্ট সোসাইটিজ, যাতে অতিমারিকালীন ইন্টার-এজেন্সি মানসিক স্বাস্থ্য ও মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা আরও জোরদার করা যায়। গোটা অতিমারির সময় জুড়ে হু সারা পৃথিবীব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্য ও মনস্তাত্ত্বিক সহায়তাকে চিকিৎসার সর্বস্তরে অন্তর্ভুক্ত করার উপর জোর দিয়ে গেছে।

হু-র সদস্য রাষ্ট্রগুলি মানসিক স্বাস্থ্যের উপর কোভিড ১৯-এর প্রভাবকে স্বীকার করে সেটিকে নিরাময় করার উদ্দেশ্যে পদক্ষেপ নিচ্ছে। অতি সাম্প্রতিক সময়ে করা অত্যাবশ্যক চিকিৎসা পরিষেবার ধারাবাহিকতা সংক্রান্ত হু-র একটি পালস সার্ভেতে দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ দেশ কোভিড ১৯ রোগী ও চিকিৎসাধীনদের একইভাবে মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা দিয়ে চলেছে। সর্বোপরি, গত বছরের ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলিতে কোভিড ১৯ ও ভবিষ্যতের অন্যান্য আপৎকালীন স্বাস্থ্য সঙ্কট মোকাবিলা করার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য ও মনস্তাত্ত্বিক সহায়তার বিষয়টিকে আরও জোরদার করে তোলার পক্ষে সওয়াল করেছেন। এক্ষেত্রে তারা ২০১৩-২০৩০ সালের আপডেটেড কম্প্রিহেনসিভ মেন্টাল হেলথ অ্যাকশনটি গ্রহণ করেছেন যার মধ্যে রয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা বিষয়ক প্রস্তুতি ও জনস্বাস্থ্যের জরুরি সঙ্কটের সময়ে মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা প্রদানের নির্দেশ।

 

স্টেপ আপ ইনভেস্টমেন্ট

যাই হোক, মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি দায়বদ্ধতার এই অঙ্গীকার তখনই বজায় থাকবে যখন সেটি বিশ্বব্যাপী স্টেপ আপ ইনভেস্টমেন্ট-এর সঙ্গে হাত মিলিয়ে এগোবে। দুর্ভাগ্যক্রমে, বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্য সংস্থানের ক্রমবর্ধমান ঘাটতি দেখা দিয়েছে। হু-র সম্প্রতি প্রকাশিত মেন্টাল হেলথ অ্যাটলাসে দেখা যাচ্ছে যে ২০২০ সালে সারা বিশ্বে সরকারের স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ খরচের মাত্র ২ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ব্যয় হয়েছে এবং বিভিন্ন কম-আয়ের দেশে প্রতি ১০০০০ জন লোক প্রতি মাত্র ১ জন মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীর খোঁজ মিলেছে।

ডিপার্টমেন্ট অফ মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড সাবস্ট্যান্স ইউজ-এর ডিরেক্টর ডেভরা কেস্টেল গোটা পরিস্থিতি নিয়ে এককথায় বলেছেন, “অতিমারির ফলে মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে মানুষের নজর যেমন পড়েছে, তেমনভাবে এই পুরো পরিস্থিতির দরুন এটাও বোঝা গেছে যে মানসিক স্বাস্থ্যখাতে ঐতিহাসিকভাবে কতটা কম অর্থ বরাদ্দ করা হয়ে এসেছে। প্রতিটি দেশের দ্রুত এইদিকে মনোযোগ দিয়ে এটা নিশ্চিত করা উচিত যাতে সবাই ঠিকমতো মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা পায়।”

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...