Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ডি-ভোটারদের দেশে ভোট মহোৎসব

তানিয়া লস্কর

 



প্রাবন্ধিক, পেশায় আইনজীবী

 

 

 

 

অসমের নাগরিকদের রাজনৈতিক জীবন যে একটি বিশেষ ব্যাপারকে ঘিরে আবর্তিত হয় সে হল নাগরিকত্ব সমস্যা। ডি-ভোটার, ডিটেনশন ক্যাম্প, ফরেনার্স ট্রাইবুনাল (এফটি) এবং এনআরসি এসবের মিলিত আক্রমণে অসমের ভাষিক এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা জেরবার। এবার এই ক্রমে সিএএ নামে আরেকটি নতুন বিষয় জুড়েছে। নির্বাচনী প্রচারে সর্বভারতীয় দলগুলো সেগুলো কিছুটা এড়িয়ে যাওয়ায় অনেকেই ধরে নিয়েছেন যে অসম নির্বাচনে সেগুলো নন-ইস্যু হয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবতা খতিয়ে দেখলে অন্য চিত্র ফুটে উঠে।

 

সর্বভারতীয় দল এবং তাদের এড়িয়ে চলার পরম্পরা

প্রায় সবসময়ই নাগরিকত্ব সম্পর্কিত ইস্যুগুলোতে সর্বভারতীয় দলগুলো স্পষ্ট অবস্থান নিতে দ্বিধাবোধ করে। তাই নির্বাচনী প্রচারেও মূলস্রোতের মিডিয়া এবং সর্বভারতীয় দলগুলো নাগরিকত্ব ইস্যুতে স্পষ্ট কথা বলাটা এড়িয়ে চলে। শুধু মাঝে মাঝে কিছু ফাঁকা ঘোষণা দিয়ে ঘোলা জলে মাছ ধরতে চায়। যদিও কংগ্রেস এবং বিজেপি দুই দলের ম্যানিফেস্টোতেই সিএএ বিষয়টি এসেছে, কিন্তু এনারসি, ডি-ভোটারের কোনও স্পষ্ট উল্লেখ নাই। কংগ্রেসের পাঁচটি প্রতিশ্রুতির মধ্যে একটি হল ক্ষমতায় এলে সিএএ-র বিরুদ্ধে একটি বিল পাশ করা। এবং বিজেপির প্রতিশ্রুতি হল সেটিকে বহাল করা। এছাড়া ডিটেনশন, ডি-ভোটার, এফটি ইত্যাদি নিয়ে কোনও মন্তব্য নেই। একটি প্রছন্ন এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা দেখতে পাওয়া যায়।

নাগরিকত্ব সমস্যার সমাধান করতে হলে এই অসমের ক্ষেত্রে এনারসি, ডি-ভোটার, ফরেনার্স ট্রাইবুনাল এবং ডিটেনশন ক্যাম্প এই চারটি ইস্যুকে নিয়ে একসঙ্গে কথা বলতে হবে।

 

জমিনি-রাজনীতিতে গুরুত্ব পাচ্ছে নাগরিকত্ব ইস্যু

মিডিয়ার হাইপের বাইরে, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ব্যয় না করে যেসব জায়গায় নির্বাচন হয় সেখানে এই মৌলিক ইস্যুগুলো উঠে আসে।

কাকদুয়ার রিজার্ভ চেঙা অঞ্চলে ২০০৯ সনে গড়ে ওঠা একটি গ্রাম। এই গ্রামের বাসিন্দারা আগে ঘুমা-ফুলবাড়ি নামে ব্রহ্মপুত্রের চরের একটি গ্রামে বাস করতেন। ২০০৭ সালে ব্রহ্মপুত্রের তীব্র ভাঙনে তলিয়ে যায় পুরো গ্রাম। তারপর তাদের চলে আসতে হয় এই নতুন জায়গায়। তখন থেকে তারা জমির পাট্টার জন্য লড়ছেন। সেই সঙ্গে সেখানে অনেক লোক ডি-ভোটার। তাদের সাফ কথা এই দুটি সমস্যার সমাধানের জন্য যারা চেষ্টা করবে তাকেই ভোট দেওয়া হবে। এইউডিএফ এর প্রার্থী আশরাফুল হুসেইনের মূল ইউএসপি এটাই যে তিনি এনারসি এবং ডি-ভোটার ইস্যুতে মানুষকে সাহায্য করেছেন।

ডিব্রুগড় জেলার ছাবুয়া সমষ্টি এমন একটি সমষ্টি যেখানে সিএএ-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সময় প্রতিবাদকারীরা ওখানকার বিধায়ক বিনোদ হাজারিকার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর বিজেপির অনেক প্রাথমিক সদস্যরা পদত্যাগ করেন। এবার বিনোদ হাজারিকা পার্শ্ববর্তী লাহুয়াল সমষ্টি থেকে নির্বাচন লড়ছেন। গত নির্বাচনে ডাবল মার্জিনে জেতা সত্ত্বেও অবস্থা বেগতিক দেখে এবার সিটটি অসমিয়া জাতিয়তাবাদী মিত্রদল অসম গণ পরিষদকে দিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে বিজেপি।

আমিনা বেগম সরুক্ষেত্রীর একজন ভোটার। ওঁর সোজা কথা বিজেপি যখন বলছে ওদের মিঞা মানুষদের ভোটের কোনও দরকার নাই, লুঙ্গি-টুপির ভোটের দরকার নাই, তাহলে ওদের যেচে ভোট দিতে যাব ক্যান? ওর ধারণা বিজেপির কথামতো এনারসি রিভেরিফিকেশন হলে পুরো অসমটাই একটা জেলে পরিণত হবে। তাই উনি ভোট দেবেন সেই ইস্যুতেই। উন্নয়নের ইস্যুতে ভোট দিচ্ছেন না ক্যান? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, জনগণের উন্নয়ন করা তো সরকারের দায়িত্ব; এতে এত বাহাদুরি করার কী আছে!

 

মিডিয়া ন্যারেটিভ-যুদ্ধে পিছিয়ে আছেন মজলুম জনতা

মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনওয়াল, বিজেপির রাজ্যিক সভাপতি রঞ্জিত দাস সহ সব নেতারা পত্র-পত্রিকায় বলে যাচ্ছেন যে সিএএ কোনও নির্বাচনী ইস্যু নয়। মূলস্রোতের মিডিয়াও তাদের উদ্ধৃত করে রিপোর্ট লিখছেন। এর পিছনের কারণ এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে নতুন করে ব্যাখ্যা করার কিছু নেই। তবে এসবের মাঝখানে গ্রাম-গঞ্জে, চর-অঞ্চলে কিন্তু মানুষের মনে গেঁথে আছে এনারসি এবং ডি-ভোটারের ফলে ভোগ করা যন্ত্রণা। তাঁরা এর জবাব দিতে চাইবেন এবং চাইছেন। তবে বিকিয়ে যাওয়া মিডিয়া এবং কর্পোরেটাইজ রাজনীতির কুচক্রের সঙ্গে তাঁরা কতটা পেরে ওঠেন সেটাই দেখার।

 

জন-গণ-মনের জয় হোক

এনারসির প্রথম তালিকা যখন বের হয় আমরা মানবাধিকার সংস্থার পক্ষ থেকে সচেতনতা শিবির করতে যেতাম। সেখানে যেসব মানুষেরা আসতেন তাঁদের চেহারা দেখলে চোখে জল আসে। গলার স্বর কাঁপা-কাঁপা। কপালে চিন্তার ভাঁজ। চোখে মুখে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে তারা ভয়ে ভয়ে টেবিলের পাশে ঘোরাঘুরি করতেন। কখনও দিদি-দাদাদের একান্তে পেয়ে যদি একটু ভালোভাবে কথা বলা যায়। বর্তমানে কিন্তু চিত্রটা ভিন্ন। নির্বাচনী মিটিংগুলোতে তাঁদের মুখে খৈ ফোটে। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত করে রাখেন তাঁরা তাঁদের প্রিয় নেতাদের সভাস্থল। আমরা যারা নিজ নিজ ঘরের আরামচেয়ারে বসে মাঝেমাঝেই ভাবি যে এসব ভোট-টোট একদমই বেকার, যে লঙ্কায় যায় সেই রাবণ হয় ইত্যাদি ইত্যাদি, তাদের আমার মতে জীবনে একবার কোনও ছোট রাজনৈতিক দল কিংবা নির্দল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা কোনও প্রার্থীর জন্য সেচ্ছাসেবী হওয়া উচিত। তাহলেই বোঝা যায় নিপীড়িত মানুষ আসলে কতটা আশা নিয়ে ভোট দিতে যান।