Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

জ্বর

অলোকপর্ণা

 

সেদ্ধ করা কাঁচালঙ্কা বাটিতে ভরে দিয়ে পূর্ণিমা দেখতে পেলেন একটু দূরে পেকে বুড়িয়ে যাওয়া পেয়ারাটা ছেত্‌ড়ে পড়ে আছে। পেয়ারা পর্যন্ত আঙুল পৌঁছোয় না পূর্ণিমার। খাঁচাটা একটু বেঁকিয়ে ধরার পর আধখাওয়া পেয়ারাটা গড়িয়ে চলে আসে তাঁর আঙুলের নাগালে। গলে যাওয়া পেয়ারাটা খাঁচার বাইরে আনার জন্য তদ্বির শুরু করতেই আচমকা টকটকে লাল ঠোঁট এসে ঠুকরে দিয়ে যায় পূর্ণিমার আঙুল। পূর্ণিমা চেঁচিয়ে ওঠেন, “খেয়েই ফেলল মা গো!”

পাশের ঘর থেকে বিজয় বলেন, “হল কী কোয়েলের মা!”

খাঁচার ভিতর থেকে জিভ দিয়ে খানিক ট- ট আওয়াজ করে পাখিটা বলে ওঠে, “আই লাভ ইউ! আই লাভ ইউ!”

রক্ত বেরিয়ে আসা আঙুলের দিকে তাকিয়ে পূর্ণিমা ঝাঁঝিয়ে উঠে বলেন, “আমার কপাল হয়েছে!”

সজোরে বাঁ হাতে খাঁচার দরজা বন্ধ করে ওষুধের সন্ধানে পাশের ঘরে ছুটলেন তিনি। খাঁচা দুলে উঠতে পেয়ারাটা গড়িয়ে আবার পাখিটার পায়ের কাছে চলে গেল।

রাতের দিকে বিজয়ের জ্বরটা একটু একটু করে আবার বেড়ে যায়। ব্যান্ডেজ করা হাতে জলপট্টি নিয়ে বিজয়ের মাথার কাছে এসে বসেন পূর্ণিমা। গরম কপালে ঠাণ্ডা পট্টি পড়তে দু’চোখ জুড়িয়ে আসে বিজয়ের।

পূর্ণিমা জিজ্ঞেস করেন, “ভালো লাগছে একটু?”

চোখ বুজে বিজয় জবাব দেন, “হুম…”

বিজয়ের বলিরেখা আড়াল করে রাখা জলপট্টি থেকে জলের ফোঁটা চোখের কোটরে এসে জমা হচ্ছে। পূর্ণিমা তাকিয়ে দেখেন, কী গভীর সে কোটর, মৃত আগ্নেয়গিরির অন্ধ জ্বালামুখ যেন! বিজয়ের সেই চোখ, সেই সুকোমল চোখ এই অন্ধকারের কোনও একখানে ডুবে রয়েছে। পূর্ণিমা বহুযুগ তার সন্ধান পান না। ভাবেন এবারে তাদের নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা করা যেতে পারে, জলপট্টি বদলাতে বদলাতে পূর্ণিমা ভাবতে থাকেন,– রাস্তায় রাস্তায় লিফলেট ওড়াউড়ি করছে, তাতে লেখা, “বিজয়ের সেই চোখ, সুকোমল, মরমি চোখ, যেখানেই থাকো ফিরে এসো… বহুদিন হল বিজয়,– তোমাকে দেখি না।” লিফলেট উড়ে বেড়ায় পূর্ণিমার কল্পনায়।

“কী ভাবছ?”

ফিরে আসেন পূর্ণিমা, দেখেন মৃত মাছের মতো দৃষ্টি মেলে বিজয় তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে।

“পাখিকে নিয়ে আর পারছি না!”

“কী করল আবার?”

“গতকাল থেকে কিচ্ছু খাচ্ছে না, আজকে লঙ্কা দিলাম, মুখেও তোলেনি…”

“পেট ঠিক আছে তো?”

“কই তেমন কিছু তো মনে হল না…” পূর্ণিমা বাইরের ঘরের দিকে তাকান, মেঝেতে খাঁচার ছায়া পড়েছে, তাতে পাখির ছায়াকে খাঁচার ভেতর দ্রুত পায়চারি করতে দেখেন পূর্ণিমা।

“পাখিরা ক’বছর বাঁচে কোয়েলের মা?”

বিজয়ের দিকে তাকিয়ে পূর্ণিমা দেখেন, জ্বালামুখের ভিতর থেকে ধুকতে থাকা চোখে বিজয় তাকিয়ে আছেন। বিজয়কে যেন বড় ক্লান্ত দেখায়।

পূর্ণিমা উত্তর দেন, “জানি না।”

রাতের অন্ধকারে কিসের আওয়াজে যেন বিছানা ছেড়ে উঠে আসেন পূর্ণিমা। পাশের ঘরে ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ। পাখির ছোট্ট ডানায় এত জোর হল কবে! অবাক হয়ে পূর্ণিমা পর্দা সরিয়ে দেখেন সারা ঘরে লিফলেট উড়ে বেড়াচ্ছে, খপ করে তার একটাকে ধরে ফেলেন তিনি। পড়ার চেষ্টা করেন। লেখাগুলো এত ছোট, এতই ছোট, যে তাঁর চোখ ব্যথা করে ওঠে। তাঁর পায়ের কাছে পাখির খাঁচা রাখা, লিফলেট ছেড়ে খাঁচার ঢাকা সরিয়ে দেখেন পূর্ণিমা, দেখেন গোল গোল চোখ মেলে দাঁড়ায় বসে আছে পাখিটা। পূর্ণিমাকে দেখে সে ট-ট করে বলে ওঠে, “জল দাও গো কোয়েলের মা, জল দাও…”

ঘুম ভেঙে যেতে পূর্ণিমা দেখেন বিজয় হাত বাড়িয়ে আছেন তাঁর দিকে। চটজলদি জলের গ্লাসটা বিজয়ের মুখে ধরেন পূর্ণিমা। গ্লাস খালি করে দম নেন বিজয়। কপালে হাত দিয়ে পূর্ণিমা বোঝেন জ্বর ছেড়ে গেছে।

“এবেলা সেরে উঠলেও আমি বোধহয় আর বেশিদিন বাঁচব না কোয়েলের মা!”

আঁচল দিয়ে ঘাম ছেড়ে দেওয়া কপাল মুছিয়ে দেন পূর্ণিমা, বলেন, “ঘুমাও একটু এবারে…”

বিজয় চুপ করে থাকেন।

পূর্ণিমা শুয়ে পড়েন।

কিছুক্ষণ পর বিজয়ের কথায় তাঁর তন্দ্রা ভেঙে যায়, বিজয় বলেন, “পাখিটারও মনে হয় ঘুম আসছে না…”

পূর্ণিমা টের পান বাইরের ঘর থেকে ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ আসছে। ক্ষীণ।

হুইল চেয়ার ঠেলে ঠেলে ছাদে নিয়ে আসেন পূর্ণিমা। বহুদিন বাদে বিজয় রোদ্দুর দেখছে। বিজয়ের দুর্বল চোখ রোদের তাতে বুজে বুজে আসছে। পূর্ণিমা খাঁচাটা নিয়ে এসে বিজয়ের পাশে রেখে দেন। পাখিটা ঘাড় উঁচিয়ে সূর্য দেখে। বিজয়কে বসিয়ে রেখে পূর্ণিমা কাপড় জামার ক্লিপগুলো তুলে আনতে যান।

কিছু দূরে নারকেল গাছের গায়ে একটা ঘুড়ি আটকে আছে। ঘুড়িটার গায়ে রোদ লেগে ঝলসে উঠছে সকাল। বিজয়কে চমকে দিয়ে পাখিটা বলে ওঠে, “গুড মর্নিং কোয়েল! গুড মর্নিং কোয়েল!”

খাঁচাটা ভারী লাগলেও নিজের কোলে তুলে নেন বিজয়। তিন বছরের কোয়েলের মৃতদেহ এর চেয়ে অনেক বেশি ভারী ছিল। তাই তাঁর তেমন কষ্ট হয় না। খাঁচার দরজাটা খুলে বিজয় পাখির দিকে আঙুল বাড়িয়ে দেন। পাখিটা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। পাখির মাথায় আঙুল বুলিয়ে দেন বিজয়। পাখিটার আরাম লাগছে। বিজয়েরও। দু’জনেই চোখ বুজে আরাম অনুভব করেন। একটু পরে বিজয় হাত সরিয়ে নিয়ে দরজাটা আটকাতে যাবেন এমন সময় পাখিটার লাল ঠোঁট এসে লাগে তাঁর আঙুলে। বিজয় কাতরে উঠে হাত সরিয়ে নেন। খোলা দরজা দিয়ে পাখিটা বাইরে চলে এসে ছাদের পাঁচিলে গিয়ে বসে।

বিজয় চেঁচিয়ে ওঠেন, “ধরো ওকে ধরো!”

ছাদের একপ্রান্ত থেকে পূর্ণিমা বলেন, “কী হল!”

পাখিটা উড়ে গিয়ে সামনের নারকেল গাছে গিয়ে বসে। পূর্ণিমা ছুটে আসেন। পাখিটা উড়তে শুরু করে। দূর থেকে আরও দূরে গিয়ে চোখের আড়াল হয়ে যায়।

“ও চলে গেল পূর্ণিমা! আমি বুঝিনি ও চলে যাবে! ব্রেকটা ঠিক সময়ে লাগল না… আর ও চলে গেল, পূর্ণিমা!”

পূর্ণিমা হাত রাখেন বিজয়ের কাঁধে, বলেন, “কতদিন পর আমায় নাম ধরে ডাকলে…”

জ্বর ছেড়ে যাওয়া ফ্যাকাসে মুখে বিজয় তাকিয়ে থাকেন কোয়েলের মায়ের মুখের দিকে।