শুনুন… ওই মুখগুলো কী বলছে!

অয়নেশ দাস

 



গদ্যকার, প্রাবন্ধিক, শিল্পী

 

 

 

 

করুণাময়ী। বিধাননগরের ব্যস্ততম মোড়। এখানেই রাজ্যের শিক্ষা দপ্তরের বড় বড় দপ্তরগুলি আকাশে মাথা উঁচু করে আছে। আর মাটিতে রাস্তায় গার্ডরেল ডিঙিয়ে, কখনও প্রিজন ভ্যানের জাল দেওয়া জানলার ভিতরে, কখনও ভ্যানের চাকার নিচে যে ক্লান্ত, নিদ্রাহীন মুখগুলো অক্লান্ত ধর্ণায় বসে আছে যোগ্যতার হকের দাবিতে, সেই মুখগুলোর অনেকগুলোই কয়েকশো দিনে চেনা হয়ে গিয়েছে পথচলতি অফিসযাত্রী, ভ্রাম্যমান হকার অথবা এলাকার বাসিন্দাদের। কার্নিভ্যালে মেতে আছে কলকাতা। তাও অনেকেরই হয়তো জানা হয়ে গিয়েছে এই মুখগুলি কাদের, এই মুখগুলি কীসের প্রতিনিধিত্ব করে। সত্যিই এই আন্দোলন কাদের, কীসের প্রতিনিধিত্ব করে! এ কি শুধু ওই মুখগুলির নিজেদের দাবির আন্দোলন? শুধুই চাকরির জন্য আন্দোলন?

করুণাময়ী বাসস্ট্যান্ড। এখান থেকে রাজ্যের প্রায় সব প্রান্তেই বাসে চলে যাওয়া যায়। আপনি যদি কখনও উঠে পড়েন কাকদ্বীপের বাসে, দেড়-দু ঘন্টা চলার পরে এক ধূসর ইটভাটার পর আপনি পেয়ে যাবেন সেই বাঁকটা, যার ঢালে এক কামরার টালির বাড়িতে থাকে তারক। তারক হালদার। বাবা দিনমজুর আর মা পক্ষাঘাতগ্রস্ত শয্যাশায়ী। কোনওরকমে বাবার সঙ্গে দিনমজুরিতে হাত লাগিয়ে টেট পাশ করেছে তারক। না, চাকরি অধরাই থেকে গিয়েছে। যোগ্যতামান ছাড়াও আর যেটা আজকের দিনে দস্তুর, সেটা জোগাড় করা তার চৌদ্দপুরুষকে বিক্রি করেও সম্ভব নয়। হাঁপানিগ্রস্ত বাবাকে দিনমজুরি থেকে অব্যাহতি দেওয়াও সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। একমাত্র বোন একশো দিনের কাজে হাত লাগিয়েছে। হাত লাগিয়েছে সে নিজেও। কিছু সামান্য ট্যুইশানি তার আছে। তা থেকে কতটুকু হয় সে আপনি গ্রামাঞ্চলের অর্থনীতি সম্পর্কে সামান্য ওয়াকিবহাল হলেই জানতে পারবেন। এর থেকে ভদ্রস্থ কাজ জোগাড় করা কেন তারকের পক্ষে অসম্ভব, সেও আপনি তারকের গ্রামে গিয়ে পৌঁছলেই বুঝতে পারবেন। হাতে গোনা সরকারি চাকরি ছাড়া আমাদের গ্রামাঞ্চলে কাজের কী সুযোগ সে আপনি নিজেই প্রত্যক্ষ করে আসতে পারবেন।

না, করুণাময়ীর মোড়ে যে মুখগুলিকে আমরা এতদিনে চিনে ফেলেছি, তাদের মধ্যে দৃশ্যত হয়তো আপনি তারককে খুঁজে পাবেন না। সেটুকু সম্বলও তারকের নেই। সাহসও হয়তো নেই। তার একদিনের অনুপস্থিতি বাড়িতে ডেকে আনবে তিনদিনের অনাহার। তারক জানে পাশের গ্রামের ভেড়ির মালিকের ছেলে কীসের জোরে তার প্রত্যাশিত চাকরিতে যোগ দিয়েছে। তারক জানে সে নিরুপায়। তারক জানে চাকরি পাওয়া ছেলেটির পাশে সরকার আছে। রক্ষাবন্ধনীর মতো তার পাশে আছে এক অসুস্থ দূর্নীতিময় ব্যবস্থা। হ্যাঁ, ট্যুইশানিতে নাম আছে তারকমাস্টারের। গ্রামের লোকে বলত ছেলেটার মাথা ছিল। সুযোগ পেলে… আপাতত এক শনির বলয় গিলে নিয়েছে তারক হালদারের ভাগ্য। আপাতত তারক হালদারের ভাগ্য জবাই করে জমে উঠেছে নোটের স্তূপ। রাজধানীর বিলাসবহুল কুঠুরিতে। কার্নিভ্যাল জমে উঠেছে। আর করুণাময়ীর গার্ডরেল ডিঙিয়ে অবিচল প্রতিজ্ঞায় বসে আছে কিছু মুখ। ওখানে আছে, না থেকেও আছে আরও হাজারে তারক হালদার। দেখতে পাচ্ছেন কি?

করুণাময়ী থেকে ঘন্টায় ঘন্টায় ছাড়ে উত্তরবঙ্গের বাস। মাঝরাতের বাসটা ধরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে পৌঁছবেন এক শহরতলির মোড়ে। মোড় থেকে দশ মিনিটের হাঁটাপথ মাস্টারমশাই অনিলবাবুর, মানে অনিল কুমার মজুমদারের বাড়ি। বহুদিনের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। তাঁর স্কুলের মেনগেটের মতোই বাড়ির সদর দরজার ওপরেও প্লাস্টার খোদাই করে লেখা— ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়ঃ’। ছোট শহর। সেখানেও বাড়বাড়ন্ত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের। জেদ করেই অনিলবাবু নাতিকে পড়িয়ে চলেছেন সরকারি স্কুলে। বাংলা মাধ্যমে। তাঁর বিশ্বাস সেখানেই এখনও সম্ভব প্রকৃত জ্ঞানার্জন। সেকেলে অনিলবাবুকে প্রায় প্রতিদিন ঠুকে চলেন বন্ধু বিকাশবাবু। বিকাশবাবুর নাতি পড়ে ইংরেজি মাধ্যমে। ঝকঝকে, স্মার্ট, ইংরেজি কইয়ে নাতির জন্য ছাতি ফুলে যায় তাঁর। বাংলা মিডিয়ামে তো পড়ে ঝি-চাকরের ছেলেমেয়েরা। সেখানে পড়াশোনা হয় না কি আবার! ছ্যা ছ্যা। অনিলবাবু খুব একটা গা করেন না। ওইসব ইংরেজি স্কুলে আসল লেখাপড়ার মান নিয়ে তাঁর যথেষ্ট সন্দেহ আছে। মাঝে মধ্যে বিকাশবাবুকে বলেও ফেলেন— ‘নাতিকে পড়াশোনা করানোর দরকার কী, দরকার তো শুধু একটা স্পোকেন ইংলিশের কোর্স। করিয়ে নিলেই পারো।’ কিন্তু এখন মাঝেমধ্যে একটু থমকে যান অনিলবাবু নিজেও। নাতির খাতাপত্র নাড়াঘাঁটা করতে করতে কিছু সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে তাঁর। এসব কারা শিক্ষক হয়ে আসছে! চারিদিকে সব দেখেশুনে তাঁর নিজেরও মনে হতে শুরু হয়েছে সরকারি শিক্ষাটাই বোধহয় শিকেয় ওঠার দিকে। কী করবেন তিনি? তাঁর মতো যাঁরা, তাঁরা? যাঁরা লালন করে এসেছেন একটা ব্যবস্থা? একটা বিশ্বাস? একা নিজের বিশ্বাসে ভর করে ডন কিহোতের মতো চারপাশের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের সঙ্গে লড়ে নিচ্ছিলেন, কিন্তু এখন বোধহয় সেই বিশ্বাসেও চিড় খেতে শুরু করেছে। আপাতত এক শনির বলয় গিলতে শুরু করেছে সে বিশ্বাস।

না, করুণাময়ীর মোড়ে যে মুখগুলিকে আমরা এতদিনে চিনে ফেলেছি, তাদের মধ্যে দৃশ্যত হয়তো আপনি শহরতলির সেকেলে, জেদি, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকটিকে খুঁজে পাবেন না। তাঁর সেখানে থাকার কথাই নয়। কিন্তু কী আশ্চর্য, রাজধানীর বিলাসবহুল কুঠুরিতে যে তারকের ভাগ্যের সঙ্গে একইসঙ্গে জবাই হয়েছে অনিলবাবুর বিশ্বাস! জমে উঠেছে নোটের স্তূপ! জমে উঠেছে কার্নিভ্যাল! আর করুণাময়ীর গার্ডরেল ডিঙিয়ে অবিচল প্রতিজ্ঞায় বসে আছে ক্লিষ্ট কিছু মুখ। ওখানে আছে, না থেকেও আছে আরও হাজারে অনিল মজুমদার। দেখতে পাচ্ছেন না?

করুণাময়ী থেকে বিকেলবেলা ছাড়ে দুবরাজপুরের বাস। মাঝরাত্তির পেরিয়ে একটা ছোট্ট টিলা পার করলে দূর অন্ধকারে খুব নজর করলে আপনি দেখতে পেলেও পেতে পারেন একটা নিঃসঙ্গ কুপির আলো। ওখানে পড়ছে এগারো বছরের পূর্ণিমা। সকাল-বিকেল পাথরের খাদানে কাজ করে, মাঝের সময়টাতে কয়েক ঘন্টা নিম্ন বুনিয়াদি স্কুলে যেত পূর্ণিমা। পড়তে যে খুব ভালবাসে সে। রান্নাবান্না সারার পর স্কুলের পড়া তাকে সারতে হয় মাঝরাতেই। এখন স্কুল নেই। গত কয়েকবছর ধরে শিক্ষকের অভাবে বন্ধ রয়েছে স্কুল। মিড ডে মিলও তাই নেই। দুপুরের খাবারের বদলে বাবুদের বাড়িতে দু ঘন্টা খেটে আসতে হয় তাকে। তবুও এখনও পুরনো বইখাতাগুলো নেড়েঘেঁটে দেখতে ইচ্ছে করে তার। তারই বা সময় কই? সেই মাঝরাত। তাই আপনি পূর্ণিমার কুপির আলো আজও হয়তো দেখতে পাবেন। রাজ্যে কত হাজার নিয়োগ বকেয়া রয়েছে সেসব হিসেব জানে না পূর্ণিমা। আপাতত একজন শিক্ষক এসে তালা খুললেই খুশিতে ভেসে যেত সে। স্বপ্ন দেখতে খুবই ভালবাসে সে। পড়াশোনার একটু সুযোগেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করে সে। স্বপ্ন ভেসে চলে পাথরের খাদান পেরিয়ে, গিন্নিমার মুখঝামটা এড়িয়ে এক সবুজ দিগন্তের দিকে। সেখানে আকাশে ফুটে ওঠে নানা রঙের অক্ষর। সাজিয়ে নিয়ে ভবিষ্যতের পূর্ণিমা বানাতে চায় এক রামধনু। আপাতত এক শনির বলয় গিলে নিচ্ছে পূর্ণিমার রামধনু-স্বপ্ন।

না, করুণাময়ীর মোড়ে যে মুখগুলিকে আমরা এতদিনে চিনে ফেলেছি, তাদের মধ্যে দৃশ্যত হয়তো আপনি পাথর খাদানের কর্মরত মেয়েটির পাথরের গুঁড়োয় সাদা হয়ে যাওয়া মুখটিকে খুঁজে পাবেন না। ওর তো সেখানে থাকার কথাই নয়! কিন্তু কী আশ্চর্য, রাজধানীর বিলাসবহুল কুঠুরিতে যে তারকের ভাগ্যের সাথে যেখানে একইসঙ্গে জবাই হয়েছে অনিলবাবুর বিশ্বাস, সেখানে একই সঙ্গে জবাই হয়েছে পূর্ণিমার স্বপ্ন-ও! জমে উঠেছে নোটের স্তূপ! জমে উঠেছে কার্নিভ্যাল! আর করুণাময়ীর গার্ডরেল ডিঙিয়ে অবিচল প্রতিজ্ঞায় বসে আছে ক্লিষ্ট কিছু মুখ। ওখানে আছে, না থেকেও আছে আরও কয়েক শত পূর্ণিমা। এখনও দেখতে পাচ্ছেন না?

করুণাময়ীর গার্ডরেল ডিঙিয়ে যে মুখগুলো দেখছেন, এরাই তারক হালদার। এরাই অনিল মজুমদার। এরাই পূর্ণিমা। শুধু চাকরির আবদার বলে আরও কতদিন অগ্রাহ্য করবেন? আর ঢেকে রাখবেন কর্কট রোগের মতো ছড়িয়ে পড়া শনির বলয়? যা দ্রুতলয়ে গিলে ফেলছে এই রাজ্যের সর্বজনীন সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা! আপনার কানে যেটা শুধু চাকরির দাবি হয়ে বাজছে, শুনুন, মুখগুলো আসলে চিৎকার করে বলছে— আমাদের প্রাপ্য ছিল আমাদের যোগ্যতার অধিকার, আমাদের বিশ্বাসের মর্যাদা, আমাদের স্বপ্নের নির্মাণ। আমাদের প্রাপ্য ছিল আমাদেরও জন্য আমাদের সরকার। ভবিষ্যতের অভিবাসী শ্রমিক হয়ে কোনওদিন ট্রেন কাটা পড়ে মরে পড়ে থাকার আগে তারক হালদার, আদর্শের ফসিল হয়ে ফোটোগ্রাফে বাঁধাই হয়ে যাওয়ার আগে অনিল মজুমদার, খাদানের ধুলোয় সাদা অস্থিসার কঙ্কাল হয়ে মিলিয়ে যাওয়ার আগে পূর্ণিমা— একবার কি সেই প্রাপ্য তারা পেতে পারে না, সরকার বাহাদুর?

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. আহা চমৎকার দরদী লেখা। সবাই কেন আপনার মত ভাবতে,লিখতে পারেন না!
    হীরক সেনগুপ্ত

আপনার মতামত...