Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বিধানসভায় একজনও রইল না, জরুরি প্রশ্নগুলো তুলতে হবে রাস্তাঘাটেই

বিষাণ বসু

 



প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, পেশায় চিকিৎসক

 

 

 

শুরুতেই বলে রাখি, আমি বাম-সমর্থক। এই ভোটেও আমার সমর্থন ছিল বামজোটের পক্ষে। হ্যাঁ, সেই বামজোট, যারা এই ভোটে, এই খেলা হবে-র ভোটে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত তো বটেই, খেলার মাঠ থেকেই বাইরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে— আসনসংখ্যার বিচারেও, প্রাপ্ত ভোট শতাংশের হিসেবেও। কাজেই, নির্বাচনের ফলাফলে আমি ভয়ানক খুশি, এমন দাবি করতে পারি না। কিন্তু, বিজেপির হারে, চলতি লব্জে যাকে বলে ‘গুছিয়ে হার’— তাতে আশ্বস্ত হয়েছি অবশ্যই। বিশেষত, তৃণমূল এবং বিজেপির মধ্যে আসনসংখ্যার ব্যবধান এমনই, অন্তত এখনই বিধায়ক কেনাবেচার উদ্যোগ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা কম। অতএব, খুশি হতে না-পারলেও, স্বস্তি পেয়েছি। আর কে-ই বা না জানে, সুখের চাইতে স্বস্তি বড়।

এই রাজ্যের ভোটাররা কখনওই তাঁদের পছন্দের ব্যাপারে ধোঁয়াশা রাখেন না। যাঁদের জেতান, তাঁদের স্পষ্টভাবে জেতান। রাজ্য বিধানসভায় শেষ কবে একশোর বেশি আসন নিয়ে কোনও দল বিরোধী আসনে বসেছিল, তার খোঁজ পেতে ইতিহাস বই ঘাঁটতে হয়। এ দফাতেও তার ব্যতিক্রম হল না। এই ধারা অক্ষুণ্ণ থাকার সুবাদে এবারে বিজেপির পরাজয়টা বেশ ‘কনভিন্সিং মার্জিন’-এ, কিন্তু তাতে রাজ্যের সাধারণ নাগরিকের ঠিক কতখানি সুবিধে হল, সে নিয়ে কিছু সংশয় অবশ্য থাকছে। এই দফায় আমাদের রাজ্যটি বিজেপির খপ্পর থেকে বেঁচে গেল, সেটি যে শুভ ইঙ্গিত সে নিয়ে সংশয় নেই, সংশয় সামগ্রিক ফলাফল নিয়ে, যেভাবে যারা জিতল তার দীর্ঘমেয়াদি অভিঘাত নিয়ে। সংশয়, কেননা, অন্তত আমার চোখে, সংসদীয় গণতন্ত্রে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা, বা দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সরকারের পক্ষে স্বেচ্ছাচারিতার পথে পা বাড়ানোর সম্ভাবনা বেশি। সেদিক থেকে দেখলে, স্বল্প ব্যবধানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রাপ্ত সরকারই গণতন্ত্রের পক্ষে ভালো, কেননা স্বল্প ব্যবধানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারকে অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হয়, মানুষের দাবিদাওয়ার প্রতি চোখকান খোলা রাখতে হয়। আর অতীত অভিজ্ঞতার নিরিখে বিচার করলে, মাননীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন সরকার যে খুব সহজেই স্বেচ্ছাচারিতার দিকে এগোতে পারে, সে নিয়ে বিশেষ সংশয়ের অবকাশ আছে কি? অতএব, এর পরে দুর্নীতি-দৌরাত্ম্যের পাশাপাশি বিপক্ষ দলের কর্মীদের ওপর শারীরিক আক্রমণ, হানাহানি, খুনোখুনি অব্যাহত থাকলে, এমনকী বেড়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

‘ল্যান্ডস্লাইড ভিক্ট্রি’-র উচ্ছ্বাস অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে ধামাচাপা দিয়ে দিতে পারে। টিভিতে দেখলাম, এক বিজয়ী তৃণমূল প্রার্থী বলছিলেন, মানুষ অকৃতজ্ঞ নন— প্রতিটি বাড়ি বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধে পেয়েছে, লকডাউনের সময়, আমফানের সময় বিগত তৃণমূল সরকার যেভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, সে-কথা মানুষ ভোলেননি। ঠিকই! লকডাউন বা আমফানের সময় রাজ্য সরকারের উদাসীনতা, অতিমারি মোকাবিলায় অপদার্থতা ও ব্যর্থতা, সঙ্কটকালে স্থানীয় নেতাদের সীমাহীন দুর্নীতি— মানুষ ভুলতে পারবেন কি সহজে! তারপরেও মানুষ দুহাত তুলে তৃণমূলকেই ভোট দিলেন, কেননা অপর ‘অপশন’টি অনেক বেশি ভয়ঙ্কর— বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে মানুষ যদি বিষের পরিবর্তে বিষ্ঠা বেছে নেন, তার অর্থ এ হতে পারে না, যে, বিষ্ঠা ভারী উপাদেয়। কিঞ্চিৎ কম সমর্থনভিত্তি নিয়ে তৃণমূল সরকার পুনর্নিবাচিত হলে হয়তো নেতানেত্রীরা সতর্ক হতেন— অল্পবিস্তর আত্মসমীক্ষা করতে বাধ্য হতেন— দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব হয়তো দুর্নীতিগ্রস্ত স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাধ্য হতেন। এখন আশঙ্কা, সেসবের কিছুই হবে না। কেননা জয়ী নেতার চটজলদি প্রতিক্রিয়াতেই স্পষ্ট, তাঁদের ধারণা, সরকার তথা দলের পূর্ববর্তী পদক্ষেপগুলি যথেষ্ট সঠিক এবং সে-জন্যেই তাঁদের পক্ষে সমর্থনের এমন ভরা জোয়ার।

অনিবার্য প্রশ্ন আসতে পারে, তৃণমূলের এই বিপুল জয় কি প্রমাণ করে দিল যে, এই রাজ্যে দুর্নীতি তেমন কোনও বড় ইস্যু নয় আর? নারদা ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পরেও হাত পেতে ঘুষ নেওয়া নেতাদের বিপুল ভোটে নির্বাচিত হতে দেখে এই একই প্রশ্ন মাথায় এসেছিল। কিন্তু, ইদানীং রাজনীতির লোকেদের কাছ থেকে সততার প্রত্যাশা জনগণ বিশেষ করেন না। অসততা নিয়ে তখনই পাবলিক বিচলিত হন, যখন সেই দুর্নীতির আঁচ সরাসরি নিজের গায়ে লাগছে। তৃণমূল শাসনের দ্বিতীয় দফায় সেই আঁচ মানুষের গায়ে লেগেছে— আমফানে চাল-ত্রিপল বিলির মুহূর্তে তো বটেই, তা ছাড়াও বিবিধ সরকারি প্রকল্পের সুবিধে পাওয়ার ক্ষেত্রে কাটমানি দিতে বাধ্য হওয়ার সময়ও। তা হলে? তৃণমূলের দুর্নীতিতে মানুষ বিরক্ত অবশ্যই— কিন্তু ভোটের সময়ে বাছতে গিয়ে দেখেছেন, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের অনেকেই রাতারাতি জার্সি বদলে বিপরীত দলে চলে গিয়েছেন, বা স্রেফ যাওয়ার পক্ষে সুবিধেজনক সময়ের অপেক্ষায় রয়েছেন। অতএব… আর সর্বোপরি, বিজেপি নেতারা যে ইস্যুকে তুরুপের তাস ভেবেছিলেন, রাজ্যের মানুষ সেটিকেই প্রত্যাখ্যান করেছেন— ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি সরাসরি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে— এটা যে রাজ্যের মানুষের বিচক্ষণতার কত বড় প্রমাণ, তা বলাই বাহুল্য।

বিজেপির ছোট-বড় নেতারা যত বেশি করে বিভাজনের কথা বলেছেন, সংখ্যালঘু ভোট ততই সংহত হয়েছে তৃণমূলের পক্ষে, কিন্তু, সংখ্যাগুরুদেরও অকুণ্ঠ সমর্থন বিজেপি পায়নি। আসন অনুসারে ভোটের হিসেব দেখলেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে। মুর্শিদাবাদের মতো জেলাতেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ অধীর চৌধুরীকে ছেড়ে তৃণমূলকে জিতিয়েছেন। ব্যাপার-স্যাপার দেখে বিজেপির হারে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কর্পোরেটের এক উচ্চপদস্থ বন্ধু জানালেন, মুসলমানরা ধর্ম দেখে ভোট দেয়, কিন্তু হিন্দুরা সেরকম করতে পারে না। তাঁর বক্তব্যের মূল সুরের সঙ্গে সহমত হতে না-পারলেও, কথাটা এক অর্থে ঠিক। দেশের অন্যত্র বিজেপির শাসনের নমুনা মুসলমানদের এই শিক্ষা দিয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে বাকি সব পরিচয় অবান্তর— স্রেফ ওই ধর্মীয় ‘আইডেন্টিটি’-ই ‘ডিসক্রিমিনেশন’ এবং হয়রানির পক্ষে যথেষ্ট। সে-ক্ষেত্রে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে বাকি সব ভুলে স্রেফ সেই একটি পরিচয়ের ভিত্তিতেই সুরক্ষা চাওয়া ভিন্ন অন্য ‘চয়েস’ তাঁদের সামনে থাকে কি? কাজের সুযোগ, দুর্নীতি বা অপশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সবই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সপরিবার হয়রানিহীন বেঁচে থাকতে পারার অধিকার এই সবকিছুরই আগে, একেবারে প্রাথমিক চাহিদা। অতএব, ভোটের মুহূর্তে এমন আচরণকে যূথবদ্ধ সাম্প্রদায়িক সিদ্ধান্ত হিসেবে দাগিয়ে দেওয়ার আগে লক্ষ করুন, তাঁরা ধর্মীয় আইডেন্টিটির কোনও দলকে না-বেছে সঙ্ঘবদ্ধভাবেই একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলকে ভোট দিলেন। আবার বিজেপির হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও সংখ্যাগুরুরা, অর্থাৎ হিন্দুরা, সামগ্রিকভাবে নিজেদের এক এবং একমাত্র ধর্মপরিচয়ের ভিত্তিতে চিনছেন না, চিনতে চাইছেন না— দেশের পক্ষে এর চেয়ে সুখবর আর কী-ই বা হতে পারে! এবং এমন ভাবনার পেছনে কোনও মহানুভবতা বা উচ্চ আদর্শ থাকতে হবে, এমনও নয়— স্রেফ কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। দেশের জনসংখ্যার ২৫-৩০ শতাংশ মানুষের সন্ত্রস্ত ও আতঙ্কিত হয়ে থাকা যে সুস্থ ও নিরাপদ সমাজের পক্ষে অনুকূল পরিবেশ নয়— পড়শিপাড়া যদি লাগাতার আতঙ্কে থাকতে বাধ্য হয়, তা হলে নিজের পাড়াতেও আস্তে আস্তে সে ‘টেনশন’ ছড়িয়ে পড়তে পারে— এসব সহজ-সরল কথা ‘হাইরাইজ’ আবাসনের শিক্ষিত উচ্চমধ্যবিত্ত বাঙালি বুঝে উঠতে পারছেন না, কিন্তু গ্রামেগঞ্জের তথাকথিত অশিক্ষিতরা ঠিকই ধরতে পারলেন।

হ্যাঁ, বলে ফেলা যাক, গত মাসকয়েকের ভোটপ্রচারের দিনগুলোতে শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত, উচ্চপদস্থ – মানে এককথায় যাঁদের আমরা বঙ্গসমাজের ‘ক্রিমি লেয়ার’ বলি— তাঁদের একাংশের কথাবার্তা আচার-আচরণ দেখে আমরা চমৎকৃত। তাঁদের মনের মধ্যে লুকিয়ে রাখা সাম্প্রদায়িকতা যেভাবে প্রকাশ্যে দাঁতনখ বের করেছে, যেভাবে তাঁরা মোদিজির যাবতীয় পদক্ষেপকে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা ছাড়া খোলকরতাল বাজিয়ে সমর্থন করেছেন, কেন্দ্র সরকারের অপদার্থতা এবং একের পর এক জনবিরোধী সিদ্ধান্তকে যেভাবে তাঁরা দেশের উন্নতির পথ বলে বিশ্বাস করতে পেরেছেন, এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা মাত্রেই সমালোচককে দেশবিরোধী বলে দাগিয়ে দিয়েছেন, নিজেদের অরাজনৈতিক বলে দাবি করে মোদিভজনায় লিপ্ত থেকেছেন, পলিটিক্স-বুঝি-না-কিন্তু-মোদিজিকে-ভরসা-করি মার্কা বুলি মুখে নিয়ে যেভাবে ঘৃণা, মিথ্যা-সংবাদ ও বিদ্বেষ ছড়িয়েছেন— তাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় দক্ষ ‘শিক্ষিত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত’ বাঙালির কাছ থেকে আর বিশেষ কিছু আশা না-রাখাই ভালো। তথাকথিত অশিক্ষিত নিচুতলার মানুষই কোনও এক জায়গায় একত্রিত হয়ে, একজোট হয়ে, ভোটের মেশিনে প্রতিরোধ তৈরি করতে পেরেছেন। তাঁদের এই প্রতিরোধের পূর্বানুমান খুব বেশি সংখ্যক মানুষ করে উঠতে পারেননি— বিজেপি-ঘেঁষা শিক্ষিত জনগণ তো বটেই, এমনকী যাঁদের অবস্থান নাকি সর্বদাই মাটির কাছাকাছি, সেই বামেরা অবধি এই স্রোতের আঁচ পেতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ।

বামেদের প্রসঙ্গে যখন এলই, তখন আরও কিছু কথা বলা যাক। গ্রামেগঞ্জে সরকারি অনুদানভিত্তিক প্রকল্প দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে খুব বেশি লাভ না-হলেও, সাময়িক লাভ অবশ্যই হয়। সরকারি প্রকল্পে কারও যদি একশো টাকা প্রাপ্য হয়, তার মধ্যে সরকারি দলকে কুড়ি টাকা ঘুষ দিতে হলেও, তাঁর হাতে আশি টাকা আসে – দীর্ঘমেয়াদে লাভ না-হলেও, সেই টাকা দিয়ে গ্রামেগঞ্জের অর্থনীতি কিঞ্চিৎ সজীবও হতে পারে। গত দশকে সারা দেশ জুড়ে গ্রামীণ অর্থনীতির বিপর্যয়ের মধ্যেও এই রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, এটা তথ্যনির্ভর বাস্তবতা, যাকে অস্বীকার করাটা ভুল।

দ্বিতীয়ত, আক্রান্ত মানুষ সুরক্ষা খোঁজেন শক্তিধরের কাছে। তৃণমূলের অত্যাচারে বিপর্যস্ত মানুষ প্রাথমিকভাবে গিয়েছিলেন বিজেপির কাছেই— কেননা বামশক্তি তখন মুমূর্ষু— ময়দানি শক্তি কিম্বা আদর্শানুসারী পদক্ষেপ, কোনও দিক থেকেই সেই দিশাহীন বাম নেতৃত্ব কোনও ভরসা জোগাতে পারেননি। পাশাপাশি এও সত্য, সাধারণ মানুষ শান্তিপূর্ণ জীবন চান। ঘৃণানির্ভর বিভাজনের রাজনীতি সেই শান্তিপূর্ণ যাপনের বিপ্রতীপ। অতএব, বিজেপিকে প্রত্যাখ্যান ছিল স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। সাধারণ মানুষের সেই মোহভঙ্গ যে তাঁদের বামেদের দিকে ফিরিয়ে আনতে পারল না, তৃণমূলের অত্যাচার থেকে বাঁচতে বিজেপির দিকে যাওয়া ভোট যে বিজেপির বিপদ থেকে বাঁচতে শেষমেশ তৃণমূলেরই বাক্সে জমা পড়ল— সে ব্যর্থতার দায় অবশ্যই বাম নেতৃত্বের মানসিক আলস্য তথা অদূরদর্শিতার। এই ভোটে নতুন প্রজন্মের যে বামেরা লড়াই করলেন, দীর্ঘমেয়াদে ময়দানে সামনের সারিতে তাঁদের রাখা হলে সুফল মিলবেই।

গত একদশক ধরে বামেদের শীতঘুমের পরেও শহুরে বাম সমর্থকদের একাংশ অলীক স্বপ্ন দেখছিলেন— সোৎসাহে মাসছয়েক মাঠে নামলেই জয় হাতের মুঠোয় এসে যাবে, আশা এমনই। তাঁদের মধ্যে অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়ায় ভারী সক্রিয়— পোস্টের লাইকের হিসেব দিয়ে ভোটের ফলাফলের অঙ্ক কষেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী বলে গালি পাড়েন, কিন্তু কেউ সামান্য অপছন্দের কথা বলে বসলে তাঁর উদ্দেশ্যে মারমুখী হয়ে ওঠেন।

একটু আত্মপ্রচারের মতো শুনতে লাগলেও মার্জনা করবেন, উদাহরণ হিসেবে নিজেরই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলি। ভোটের কয়েকদিন আগে উপর্যুপরি দুটি লেখায় (একটি এই সময় সংবাদপত্রে ও অন্যটি চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম ওয়েব-পত্রিকায়) আমরা দেখানোর চেষ্টা করেছিলাম, যখন খাতায়-কলমে ত্রিমুখী লড়াই আদতে দ্বিমুখী লড়াইয়ে পর্যবসিত হয়, তখন তৃতীয় পক্ষের ভোটাররা ধন্দে পড়েন। ধন্দ, কেননা, নিজের দলের প্রতি দায়বদ্ধতার পাশাপাশি বাকি দুই দলের প্রতি অপছন্দের পরিমাণও ভোটদানের সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে— সে-ক্ষেত্রে নিজের দলের জেতার সম্ভাবনা কম থাকলে, বেশি অপছন্দের দলটিকে কীভাবে হারানো যায়, সেই হিসেব কষে অনেকেই ভোট দেন। মুশকিল হল, কে জিতবে সেই হিসেব আগাম কষতে পারা মুশকিল। আর সেই হিসেব মেলানোর চেষ্টায় সবাই এমন করে ভোট দিতে থাকলে নিজের দলের জেতার সম্ভাবনা তথা ভোটপ্রাপ্তির হার আরও কমে যায়। প্রসঙ্গত, সেই লেখায় কোথাও কাকে ভোট দেওয়া উচিত, সে বিষয়ে আলোচনা হয়নি— বরং কারা জিততে পারে-র হিসেব কষে ভোট দেওয়ার সীমাবদ্ধতা বা ‘স্ট্র‍্যাটেজিক ভোটিং’ ছেড়ে বাম কণ্ঠস্বরকে রক্ষা করার গুরুত্বের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাম সমর্থকরা মহা খাপ্পা হয়ে উঠলেন। ‘সিউডো-ইন্টেলেকচুয়াল’ থেকে শুরু করে ‘তৃণমূলের দালাল’, কিংবা ‘কাগজের-পয়সা-খেয়ে-বামেদের-বিভ্রান্ত-করতে-বসা ধান্দাবাজ’— সব বিশেষণই কপালে জুটল। ভ্রাতৃস্থানীয় এক বন্ধু জানাল, চাকুরিরক্ষার দায়েই নাকি আমার এবম্বিধ অধঃপতন তথা তৃণমূলের প্রতি নরম মনোভাব— ২ মে-র পর আমাকেই নিজের কথা গিলে উলটো সুর গাইতে হবে। অনেকে তো এমনও বললেন, এ-দফায় বামেদের ক্ষমতায় আসা সুনিশ্চিত! তা-ই আতঙ্কিত হয়ে আমা-হেন বামবিদ্বেষীর এইসব লেখাপত্র।

আজকের ফলাফলের পর তাঁদের উদ্দেশ্যে শ্লেষাত্মক কিছু মন্তব্য ছুড়ে দেওয়াই যায়, কিন্তু বামেরা শূন্য হয়ে যাওয়ায়, তাঁদের মতোই, আমিও দুঃখিত। কান্তি গাঙ্গুলি ভোটের মধ্যেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, অলীক আশাবাদ জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার বড় প্রমাণ। কান্তিবাবুর এই কথাটুকু মনে রাখলেই যথেষ্ট। বাড়তি হিসেবে যোগ করতে পারি, জনগণের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগের পাশাপাশি, নিজেদের অবস্থান বা পরিস্থিতি সঠিকভাবে বুঝতে হলে, বিভিন্ন স্রোত এবং চোরাস্রোত অনুধাবন করতে হলে কিছু আত্মসমীক্ষণ জরুরি— তার জন্য অল্পবিস্তর চিন্তাশক্তি ও ধীশক্তি প্রয়োজন— সর্বক্ষণ হ্যা-হ্যা করে এদিক-ওদিক মতামত দিয়ে বেড়াতে ব্যস্ত থাকলে সে-কাজ হয় না।

দ্বিতীয়ত, বাম রাজনীতি শিবজ্ঞানে-জীব-সেবা-মূলক সমাজসেবার চাইতে ভিন্ন, এটুকু রাজনৈতিক শিক্ষা সকলেরই স্মর্তব্য। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বামদলের লক্ষ হওয়া উচিত সরকারকে আরও দায়বদ্ধ হতে বাধ্য করা। কজনকে রোজ খাওয়ানো গেল সে হিসেবের চাইতেও শ্রমজীবী ক্যান্টিনের সার্থকতা তখনই বেশি, যখন সরকার পাঁচ টাকায় ডিমভাতের প্রকল্প ঘোষণা করেন। পরবর্তী ধাপ হিসেবে, নতুন করে আরও বেশি ক্যান্টিন চালানোর চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ, সরকারি ডিমভাতের ক্যান্টিন ঠিকভাবে চলছে কিনা তার খেয়াল রাখা, সেই ক্যান্টিনের আরও বেশি শাখা খুলতে সরকারকে বাধ্য করা। মানুষের দুর্দশার মুহূর্তে সমাজকল্যাণমূলক কাজকর্ম জরুরি অবশ্যই— কিন্তু এও মনে রাখতে হবে, সীমিত সামর্থ্য ও ক্ষুদ্র উদ্যোগে সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্প দিয়ে খুব বেশি মানুষের উপকার দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে করা যায় না। রাষ্ট্রের দায়িত্ব রাষ্ট্র যাতে যথাযথ পালন করে, সে-ব্যাপারে চাপ সৃষ্টিই বরং দীর্ঘমেয়াদে অনেক কার্যকরী পদক্ষেপ, বেশি মানুষের উপকারও সেভাবেই হতে পারে। একই কথা প্রযোজ্য রেড ভলান্টিয়ার্সদের প্রশংসনীয় ক্রিয়াকলাপের শেষেও। সমাজকল্যাণমূলক প্রকল্প যেন রাষ্ট্রের দায়ের বিকল্প হয়ে না-দাঁড়ায়।

গত দশ বছরে রাজ্যে উন্নয়নের মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে উৎকোচ ও অনুদান। সরকারি প্রকল্পের টাকা মানুষের হাতে এমন করে পৌঁছয়, যাতে মানুষ ভাবতে অভ্যস্ত হন যে, সরকারি দলের দয়াতেই এটুকু পাওয়া গেল। যেভাবেই হোক, যার হাত ঘুরেই হোক, টাকাটা বা তার কিছু অংশ জনগণের হাতে পৌঁছাতে পারছে— মুক্ত অর্থনীতির পক্ষে যাঁরা, তাঁদের কাছে ব্যাপারটা খুব খারাপ নয়— বেড়াল যেমনই হোক, ইঁদুর মরলেই তাঁরা খুশি। বামপন্থীরাও কি তেমন করেই ভাববেন? একশো টাকার জায়গায় দেড়শো টাকা দেওয়ার দাবি, কিংবা ওই একশো টাকা থেকে যেন কমিশন না-দিতে হয় এই দাবিই কি বাম রাজনীতির অভীষ্ট হতে পারে? মানুষকে নিজের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন করে তোলা, মানুষকে আত্মবিশ্বাসী স্বনির্ভর করে তোলা, অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হওয়া— এ কাজগুলো তবে কারা করবেন?

বামশক্তির নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি, এই নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে অসন্তুষ্টির আর একটা কারণও এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ করা জরুরি। এ-দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, অধিকাংশ দলই মুখে গরিবের কথা বলে শেষমেশ বড়লোকের স্বার্থরক্ষা করে, মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে নরম সাম্প্রদায়িকতার তাস খেলে। ফর্দ লম্বা করার দরকার নেই। এ-সবের সঙ্গে রয়েছে স্বল্পমেয়াদি ভোটমুখী রাজনীতির প্রবণতা এবং রাজনৈতিক দিশাহীনতা। পাশাপাশি দুর্নীতি ও ‘ইনএফিশিয়েন্সি’। এতদ্‌সত্ত্বেও ভারতীয় রাজনীতির সজীবতার অন্যতম কারণ ছিল রাজনীতিকদের মানুষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ এবং কিছুটা স্বতঃস্ফূর্ত সিদ্ধান্তগ্রহণ ও তদনুসারী পদক্ষেপ— যেটা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যেতে চলেছে প্রশান্ত কিশোরদের সুবাদে। প্রতিটি দলেরই নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের স্ট্র‍্যাটেজি ছিল, থাকেও— কিন্তু দলনিরপেক্ষ ভাড়া করা ‘স্ট্র‍্যাটেজিস্ট’ জনগণের চাহিদা মেনে দলকে সেই অনুসারে আচরণ করতে বাধ্য করে। বিজ্ঞাপন যেমন ‘প্রোডাক্ট’-এর ভালোমন্দের কথা না-বলে প্রোডাক্টটি ঠিক কীভাবে লোকসমক্ষে পেশ করলে পাবলিক খাবে তার হিসেব কষে, এও তেমনই। অতএব, ভাড়া-করা স্ট্র‍্যাটেজিস্টের এঁকে দেওয়া লাইন মেনে রাজনৈতিক দলের সেই আপাত-আচরণ মূলগতভাবেই ছলনা ও অভিনয়, সুতরাং এক অর্থে লোক ঠকানো। আমার আশঙ্কা, ২০১৯-এর ভোটের বিপর্যয়ের পর পিকে-র পরামর্শ মেনে তৃণমূলের এই বিপুল জয় প্রশান্ত কিশোরদের উপস্থিতি রাজনৈতিক দলেদের কাছে অপরিহার্য করে তুলবে। ভারতীয় রাজনীতির পক্ষে সেটা খুব ভালো খবর নয়।

রাজনীতিতে আগ্রহ নেই বা আগ্রহ রেখে কী-ই বা হবে, যে-ই আসবে একই ব্যাপার, এ-ধরনের কথা আজকাল খুব শুনি। অথচ, দেশ কীভাবে চলবে, আপনার চাকরিটা থাকবে কি না, আপনার ছেলেমেয়েদের কাজের খোঁজে কতদূর পাড়ি দিতে হতে পারে, অসুস্থ হলে আপনি চিকিৎসা পাবেন কি না, দিনের শেষে কাজ সেরে আপনার বাড়ি ফেরাটা সুরক্ষিত কি না— রাজনীতিই সবটুকু নির্ধারণ করে দেয়। এবং এটুকু মেনে নিন, যে-ই আসুক, সব একইরকম চলে না। এই রাজ্যের হাসপাতালে অক্সিজেনের তেমন টানাটানি শুরু না-হলেও আমরা দুশ্চিন্তায়— সরকারি উদ্যোগ এখনও অবধি যথেষ্ট নয়— প্রকাশ্যে আমরা সে-নিয়ে আলোচনাও করতে পারছি। কিন্তু দেশেরই অন্য একটি রাজ্যে, পরিজনের জন্যে একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার খুঁজে ট্যুইট করেছেন বলে সেই রাজ্যের পুলিশ নাগরিককে গ্রেফতার করেছে। এই রাজ্যে ধর্ষণের খুব সুবিচার হয়, এমন কথা বলা মুশকিল। কিন্তু ধর্ষিতার আত্মীয়স্বজন পুলিশ হেফাজতে খুন হয়ে যাচ্ছেন, এমন ঘটনা ঘটে না। রাজ্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বর্গরাজ্য না-হলেও প্রশাসন ধর্মপরিচয়ের কারণে কাউকে হেনস্থা করছেন, এমনটি ভাবা যায় না। কাজেই অপশাসন সত্ত্বেও তুলনামূলকভাবে আরও ভয়ানক দিন আমরা দেখিনি— হ্যাঁ, যাঁরা গ্রামে-মফস্বলে তৃণমূলের উপদ্রব ও দৌরাত্ম্যের শিকার, তাঁদের প্রতি সহমর্মী হয়েও বলি, সমাজবিরোধীদের উপদ্রব কিংবা অপশাসন আর ফ্যাসিবাদের ভয়াবহতা একই হতে পারে না। অতএব, ভোটের ফলাফল আমাকে ব্যক্তিগতভাবে খুশি করল কি করল না, তার চাইতেও বড় কথা, অন্যরকম ফলাফল আমাদের বৃহত্তর বিপদের মুখে ফেলতে পারত কি না। ফলাফলে অখুশি হওয়া সত্ত্বেও সেই স্বস্তিটুকু অনস্বীকার্য। কিন্তু স্বস্তির শেষে কিছু দায়িত্বও থাকে।

আবারও শুরুর কথাতেই ফিরে আসছি। বড় জয়। বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতা। জয়ী দলের উচ্ছ্বাসের মধ্যেও বড় প্রশ্নগুলো যাতে হারিয়ে না-যায়, সেটুকু দেখা আমাদেরই দায়িত্ব। সমাজবিরোধীদের দৌরাত্ম্য, দুর্নীতি, ঘুষ, কাটমানি সমাজের সর্বস্তরে মাথা তুলেছে। শিক্ষিতদের জন্যে কর্মসংস্থান তলানিতে ঠেকেছে। অসংগঠিত ক্ষেত্রে উপার্জনের সুযোগ কমছে। জনসংখ্যার বড় অংশ অধিকারের চাইতে অনুদান পেতে আগ্রহী। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা এবং সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার হাল খারাপ। হাসপাতালের বিল্ডিং তৈরি করতে যতখানি আগ্রহ, চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগে সেরকম উদ্যোগ নেই। অনুদানের ভরসায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে অল্পবিস্তর উন্নতি হলেও শহরের অর্থনীতির বৃদ্ধি বিপর্যস্ত। আর কোভিড পরিস্থিতি নিয়ে কথা শুরু করলে তো আস্ত একখানা অধ্যায় লিখতে হয়। চিন্তা হয়, নতুন সরকারের মধুচন্দ্রিমায় প্রশ্নগুলো হারিয়ে না যায়!

প্রশ্নগুলো তুলবেন তা হলে কারা? সাত-পাঁচ না-ভেবেই যে কোনও সিদ্ধান্তের সমর্থনে যাঁরা বলেন, মোদিজি যখন করেছেন নিশ্চয়ই ভালো কিছু ভেবেই করেছেন, তাঁদের কাছ থেকে অতখানি আশা করা মুশকিল। অতএব প্রশ্নগুলো তুলতে হবে বামেদেরই। এবং প্রশ্নগুলো তুলতে হবে রাস্তাঘাটে— কেননা, বিধানসভায় একজনও বাম প্রতিনিধি প্রশ্ন করার জন্য থাকছেন না। সিপিএম সহি বাম কিনা, সেই কূট তর্কে না-জড়িয়েও বলা যায়, সহি বামদেরও কেউ বিধানসভায় রইলেন কি? বিজেপির হারের চাইতেও সিপিএম শূন্য হয়ে যাওয়ায় যে বামপন্থীরা উল্লসিত, তাঁরা নিজেদের লক্ষ্য বা অভীষ্ট নিয়ে আর একটু ভেবে দেখবেন? বিধানসভা বাম-শূন্য হয়ে গেল, অথচ বামেরা ছাড়া, সত্যিই, আমজনতার পক্ষে জরুরি প্রশ্নগুলো করার লোক নেই। বামফ্রন্টের দলগুলো তো বটেই, বিজেপিকে ঠেকাতে তৃণমূলকে ভোট দিলেন যে বাম দলগুলি, তাঁদেরও বলি— আগামীদিনে বৃহত্তর বাম ঐক্য ছাড়া পথ নেই। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ফ্যাসিবাদের আগমন ত্বরান্বিত করে, নিজেদের দুরবস্থায় অপরকে শত্রু ঠাউরে কোণঠাসা মানুষ ঘৃণার মধ্যে আপাত নিরাপত্তা খোঁজে, এ-রাজ্যেও তেমন পরিস্থিতি খুব দূরে নয়। ফ্যাসিবাদকে প্রতিহত করা একটিমাত্র নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের বিষয় নয়। সে এক দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রাম। এগিয়ে আসতে হবে বামেদেরই। বিধানসভায় নিশ্চিহ্ন হলেও রাস্তার লড়াইটার দায় তাঁদেরই।

বৃহত্তর বাম ঐক্য অবশ্য সরল নয়। একদিকে সিপিআইএম দলটির দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার সুবাদে বাম রাজনীতির মৌরসিপাট্টা নিয়ে বসে থাকার মানসিকতা এবং জমিদারসুলভ ঔদ্ধত্য– অপরদিকে অতিবাম তথা বাকি বামদলের দীর্ঘদিন যাবৎ সিপিএমের বিরোধিতা করার অভ্যেসসঞ্জাত সিপিএম-বিদ্বেষ এবং আদর্শবান হিসেবে হোলিয়ার-দ্যান-দাউ মনোবৃত্তি– দুইয়ের মধ্যে কমন গ্রাউন্ড খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবু বিধানসভায় শূন্যে নেমে আসার সুবাদে ভোটে জেতার হিসেবে সিপিএমের সাথে বাকি বামদলের ব্যবধানটি ঘুচে গেল। এবার অন্তত সমস্তরে বসে আলোচনার পথে বাধা রইল না। বাহাত্তর থেকে সাতাত্তর ভুলে সিপিএম যদি কংগ্রেসের হাত ধরতে পারে, অতিবামেরা যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে জননেত্রীকে খুঁজে পেতে পারেন– তাহলে বৃহত্তর বাম ঐক্যের পথে অলঙ্ঘ্য বাধার কারণ কী? কমন মিনিমাম অ্যাজেন্ডার ভিত্তিতে যদি অ-বাম দলের সাথে নির্বাচনী জোট হতে পারে, তাহলে কে বাম ভাবাদর্শের সাচ্চা ধারক ও বাহক সেই চর্চা ছেড়ে কমন মিনিমাম বাম আইডিওলজির ভিত্তিতে বৃহত্তর বাম ঐক্য হোক। তিন রাজ্যের নির্বাচনের ফলাফল ফ্যাসিবাদী শক্তিকে পাকাপাকিভাবে পর্যুদস্ত করার সুযোগ তৈরি করেছে। দেশজুড়ে বিজেপি-বিরোধী রাজনীতির মুখ হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তুলে ধরে মোদি-শাহকে গদিচ্যুত করার কথাও অনেকে বলছেন। কিন্তু হিন্দুত্বের রাজনীতিকে পরাস্ত করতে হলে বিকল্প আদর্শের কথা বলতে হবে, বলতেই হবে– যখন যেমন তখন তেমন, যাকে যেমন তাকে তেমন, যেখানে যেমন সেখানে তেমনের ভোটমুখী রাজনীতি দিয়ে আরএসএস-বিজেপির সংগঠিত শক্তিকে হারানো যাবে না। এখন এই সঙ্কটমুহূর্তেও যদি বামেরা নিজেদের ক্ষুদ্র দলীয় খেয়োখেয়ি না ভুলতে পারেন, তাহলে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার কথাগুলো মাথা থেকে সরিয়ে রাখাই ভালো।

পাশাপাশি এই ফলাফল থেকে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত দলটিরও অল্পবিস্তর শিক্ষালাভ জরুরি বইকি! যে সর্বাধিনায়িকা ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তায় এতটাই আস্থা রাখেন, যে, রাজ্যের সর্বত্র সব আসনে তিনি নিজেই প্রার্থী বলে ভোট চান– তাঁর পক্ষে কি নন্দীগ্রামের ফলাফল কোনো শিক্ষার বার্তা আনবে না? বিশেষত সেই নন্দীগ্রাম, যে মাটি তাঁকে ক্ষমতায় এনেছিল? অন্তত এটুকু বার্তা কি তিনি পাবেন না, যে, এই ফলাফল যতখানি না তাঁর বিগত এক দশকের শাসনের সমর্থনে, তার চেয়েও অনেক বেশি, অধিকতর বিপদকে এড়াতে চাওয়ার তাগিদের কারণে?? বিজেপির বিপদ ঠেকানোর তাগিদ বারবার তাঁকে পুনর্নিবাচিত করতে পারবে না। অনুদান-নির্ভর রাজনীতি কিম্বা মেলা-খেলা-খয়রাতি দীর্ঘমেয়াদে কাজে আসা মুশকিল। কন্যাশ্রী কিম্বা স্কুলের বাচ্চাদের জামাজুতো স্কুলব্যাগ দেওয়ার প্রকল্প অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ– কিন্তু সামগ্রিক উন্নয়ন করতে হলে পরবর্তী ধাপের কাজগুলোও জরুরি– শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সহ সামগ্রিক পরিকাঠামো নিয়ে ভাবনা জরুরি। সেসব নিয়ে না ভাবলে কিন্তু বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার পাশা উলটে যেতেও সময় লাগবে না। প্র‍্যাক্টিকাল পলিটিক্সে দক্ষ রাজনীতিক হিসেবে এটুকু বাস্তবতা তিনি নিজেও, সম্ভবত, বোঝেন– আশা করি, বুঝবেন।