বামেদের মধ্যবিত্ত-কেন্দ্রিকতার সঙ্কট কিংবা দ্বিমেরু-বঙ্গের এক নিশ্চিন্ত নাগরিকের প্রলাপ

প্রতীক

 

 




সাংবাদিক, স্বাধীন ব্লগার, প্রাবন্ধিক

 

 

 

 

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের অন্তিম লগ্নে ভারতীয় জনতা পার্টির রাজ্য সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদারের সাংবাদিক সম্মেলন দেখছিলাম। ২০০১-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিরাট আশা জাগিয়ে বিধ্বস্ত হওয়ার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেহারাটা অনেকেরই মনে আছে। জয়ের জন্য প্রাণপণ লড়াই করার পর পরাজিত হলে কোনও নেতা বা নেত্রীর প্রতিক্রিয়া ওরকমই হওয়ার কথা। অথচ, জয়প্রকাশবাবু দেখলাম বেশ স্থিতধী। তিন থেকে ৭৭-এ পৌঁছনোতেই তিনি সাফল্য (নাকি সান্ত্বনা?) খুঁজে পেয়েছেন। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে শতাধিক বিধানসভা আসনে এগিয়ে থাকার কথা সুবিধামত ভুলেই গেলেন বোধহয়। কিংবা হয়তো ওটা কর্মীদের মনোবল ভাঙতে না-দেওয়ার কৌশল। তবে যে-কথা বলতে গিয়ে তাঁর মাস্ক-পরা মুখও মনে হল উদ্ভাসিত, কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট তৃপ্তি— তা হল তৃতীয় শক্তির অবলুপ্তি। বাম, কংগ্রেস, আইএসএফ যে রাজ্যের রাজনীতিতে কোনও সাড়াই ফেলতে পারেনি এবং আগামী দিনে এই রাজ্যের রাজনীতি যে বিজেপি আর তৃণমূলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে— এই ঘোষণায় রীতিমত জয়ের প্রকাশ দেখলাম। বোঝা গেল, রাজ্য জয়ের স্বপ্ন সফল না-হলেও পশ্চিমবঙ্গকে দ্বিমেরু রাজনীতির দিকে নিয়ে যাওয়াও বিজেপির পক্ষে যথেষ্ট সন্তোষজনক ফলাফল।

২০১৪-র পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের আয়তনের কোনও রাজ্যে বিজেপি-কে এরকম বিশ্রী হারের মুখ দেখতে হয়নি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা, দেশভাগের ইতিহাস ইত্যাদি নানা কারণে পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় মেরুকরণের খেলা শুরু হয়েছিল। আরও নানাবিধ মেরুকরণের আশঙ্কাও প্রকট হয়ে উঠেছিল। উপরন্তু, বিজেপি এই রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে জিতে গেলে ২০২৪-এ তাদের লোকসভায় জেতার পথ পরিষ্কার হয়ে যাবে, এরকমও অনেকে ভাবতে শুরু করেছিলেন। তা ছাড়াও বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোর যা সার্বিক অবস্থা, সেসব দেখে পশ্চিমবঙ্গবাসীর শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। সর্বোপরি অন্য রাজ্যের মানুষও উদগ্রীব ছিলেন দেখার জন্য যে, বাঙালি সংস্কৃতি হিন্দুত্বের কাছে হার মানে কি না। সেটা ঘটলে সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দুরাষ্ট্রের বৌদ্ধিক জয় হত। ফলে, তৃণমূল কংগ্রেসের জয় অনেকের কাছেই উল্লাসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজ্যের বাইরের মানুষের এই উল্লাস শতকরা একশো ভাগ সঙ্গত, কারণ যে কোনও মূল্যে বিজেপির পরাজয়ই তাঁদের প্রয়োজন ছিল। এই রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতাসীন হলে দেশব্যাপী তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তই। যেমন, এই মুহূর্তে করোনা সামলানোয় গাফিলতি এবং অনিচ্ছা প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার প্রবল চাপে পড়েছে বলেই দিল্লিতে আন্দোলনরত কৃষকদের করোনার দোহাই দিয়ে তুলে দিতে পারছে না— যা গত বছর শাহিনবাগের সিএএ-বিরোধী আন্দোলনের বেলায় করতে পেরেছিল। পশ্চিমবঙ্গে জিতে গেলে মোদি-অমিত শাহ জুটি কৃষকদের ওপর বলপ্রয়োগ করতেও পিছপা হতেন বলে মনে হয় না। কিন্তু সেসব সংক্রান্ত স্বস্তি ও উল্লাস পেরিয়েও, এই রাজ্যের মানুষের ভবিষ্যতের স্বার্থে কিছু কথা ভেবে দেখা প্রয়োজন বই কী!

প্রায় ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে বিজেপি। এর সবটাই সরকারবিরোধী ভোট তো বটেই, কিন্তু কী কারণে এই ভোটাররা সরকারের বিরোধী? যদি জনপ্রিয় যুক্তি অনুযায়ী ধরে নিই এদের বিজেপিকে ভোট দেওয়ার একটাই কারণ— মুসলমান বিদ্বেষ, তা হলে বিশেষ উদ্বেগের কারণ রয়েছে। গত পাঁচ বছরে বিজেপির ক্রমবর্ধমান শক্তিতে আসানসোল, ধূলাগড়, বসিরহাট, তেলেনিপাড়ার মতো নানা জায়গায় সাম্প্রদায়িক অশান্তি হতে দেখা গিয়েছে। এর কোনওটাই তৃণমূলের সংগঠন আটকাতে পারেনি। বহু জায়গাতেই মানুষের অভিযোগ, প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়াও পর্যাপ্ত ছিল না। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে। ২০১৬-তে ১০.১৬ শতাংশ ভোট পাওয়া সাকুল্যে তিন বিধায়কের বিজেপিই যখন এত অশান্তি পাকাতে পেরেছে, তখন প্রায় চার গুণ বেশি ভোট পাওয়া ৭৭ জন বিধায়কের বিজেপি লক্ষ্মী ছেলেটি হয়ে থাকবে কি? মনে রাখতে হবে, এখন তাদের ১৮ জন সাংসদও আছেন, কেন্দ্রে তাদের সরকার। পান থেকে চুন খসলে তা নিয়ে একটা বড়সড় কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলার রসদ তাদের আছে। গত কয়েক বছরে বাংলার সমাজে যে গভীর সাম্প্রদায়িক ক্ষত তৈরি হয়েছে তা যে বিজেপির পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে মিলিয়ে যাবে, এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপুল সমর্থন নিয়ে প্রত্যাবর্তনে প্রমাণিত হল যে, ইমাম ভাতা দিলে অন্যায় হয় না, পুরোহিত ভাতা দেওয়াও ভালো। যেহেতু বিজেপির প্রচার ছিল পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপুজো করতে দেওয়া হয় না, সেই প্রচারকে মিথ্যা প্রমাণ করতে সরকারের ক্লাবগুলোকে পুজোর খরচ দেওয়াও অন্যায় নয়। অতএব আগামী পাঁচ বছর বিজেপির প্ররোচনা দেওয়ার মতো ইস্যুর অভাব হবে না, আর তৃণমূল সরকার সে সব প্ররোচনার রাজনৈতিক মোকাবিলা না-করে দড়ির উপর ব্যালান্সের খেলা খেলে যাবেন— এমন সম্ভাবনা তাই প্রবল।

যা গত দশ বছরে হয়নি, আগামী পাঁচ বছরে হবে— এমন আশা করা যুক্তিযুক্ত নয়। তাই ২০১১ থেকে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়া আরএসএস-এর সংগঠনের বিরুদ্ধে শাসক দল সত্যিকারের কোনও রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলবে— এমন ভাবা, অতএব, বাতুলতা হবে। অবশ্য সরকারি দল প্রতিরোধ করতে যাবেই বা কেন? মুখ্যমন্ত্রী তো এই সেদিন ইন্ডিয়া টুডে-র সাংবাদিক রাহুল কাঁওয়ালকে বলেছেন, আরএসএস-কে নিয়ে তাঁর কোনও সমস্যা নেই, কারণ তারা ভোটে লড়ে না।[1] তাঁর সমস্যা বিজেপিকে নিয়ে। বিজেপিকে হারানো হয়ে গেছে, অতএব আরএসএস এবং তৃণমূলের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চলতেই পারে বোধহয়। আগামী পাঁচ বছর, বা জয়প্রকাশবাবুর কথা ঠিক হলে, অতিদূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত বিজেপির রামনবমীর বিপরীতে তৃণমূলের হনুমানপুজো, অযোধ্যার রামমন্দিরের বিপরীতে দীঘার জগন্নাথ মন্দির[2]… এগুলোই বাংলার রাজনীতির অভিজ্ঞান হয়ে উঠতে পারে।

দুর্নীতির অভিযোগ, সে আম্ফানের ত্রাণেই হোক কিংবা এসএসসি পরীক্ষার মাধ্যমে চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্রেই হোক, বাংলার নির্বাচনে সে সব যে কোনও ইস্যু নয় তা এবারের নির্বাচনে পরিষ্কার হয়ে গেছে। ফলত কর্মসংস্থানও ইস্যু নয়, হয়তো আগামীদিনেও হবে না। শিল্প হবে কি হবে না, শিক্ষিত বেকাররা চাকরি পাবে কি পাবে না— প্রচারে অনবরত সে সব কথা বলে এবং ইশতেহারে লিখে বিরাট গোল্লা পেয়েছে বাম দলগুলো এবং কংগ্রেস, আইএসএফ একটার বেশি আসনে জিততে পারেনি। সাংবাদিক সম্মেলনে তাদের সম্বন্ধে প্রশ্ন আসতে মুখ্যমন্ত্রী একটাও শব্দ খরচ করতে চাইলেন না, করার কথাও নয়। তারা যে ইস্যুগুলো তুলে ধরেছিল, সেগুলো তাঁর মাথায় থাকলেই নাগরিকদের পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর দিক থেকে ভাবলে মানতেই হয়, তাঁর সে সব মনে রাখার কোনও প্রয়োজন নেই। যারা মনে রেখেছিল, তাদের সব মিলিয়ে সাড়ে আট শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছেন। অত কম মানুষের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে একজন মুখ্যমন্ত্রীর মাথা ঘামানোর অর্থ হয় না। আর বিজেপি যে ওসব নিয়ে ভাবতে রাজি নয় তা কেন্দ্রীয় সরকার এবং তাদের দখলে থাকা অন্য রাজ্য সরকারগুলোর কার্যকলাপ দেখলেই বোঝা যায়। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি এখন থেকে ইস্যুকেন্দ্রিক না-হয়ে চিহ্নকেন্দ্রিক হয়ে উঠলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রী কালীঘাট মন্দিরে গেলেন কি না, মহরমের দিন প্রতিমা বিসর্জনের অনুমতি দেওয়া হল কি না— এই সব।

সাধারণ নাগরিকের স্বস্তি এইখানে, যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চালু করা একগুচ্ছ জনমুখী প্রকল্প, যার সুবিধা গরিব প্রান্তিক মানুষ পেয়ে থাকেন, সেগুলো অন্তত চালু রইল। বিজেপি যেখানে যেখানে ক্ষমতায় আছে, সেখানে এরকম প্রকল্পের কোনও স্থান নেই। আয়ুষ্মান ভারত[3] বা ফসল বিমা যোজনার[4] মতো দু-একটা কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্প যা-ও বা আছে, সেগুলো সবই প্রকৃতপক্ষে ধোঁকার টাটি বলে অভিযোগ।

স্পষ্টত, আর একটা আশা নিয়ে মানুষ তৃণমূলকে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করেছেন, তা হল, বাংলায় এনআরসি হবে না। আইনত এনআরসি করা বা না-করা কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত। তবে মানুষ নিশ্চয়ই আশা করেন দিদি এই রাজ্যে এই প্রক্রিয়া প্রাণপণে আটকাবেন। গত বছর যখন বিভিন্ন ধারার বামপন্থীরা, নানা বয়সের মহিলারা সিএএ-এনআরসি-এনপিআর আটকাতে আন্দোলন করছিলেন তখন দেখা গিয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী নিজে এই নিয়ে মিছিল-মিটিং করলেও অন্যদের আন্দোলনের প্রতি রাজ্য প্রশাসন বিশেষ সদয় নয়। আশা করা যায়, এখন আর সে সমস্যা হবে না। প্রধান বিরোধী দল বিজেপি তো আর এ নিয়ে আন্দোলন করতে যাবে না, শক্তিহীন বামফ্রন্টই বা কী এমন আন্দোলন করবে? হাতে রইলেন বিকল্প বামেরা, যাঁরা এরপর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন আরও তীব্র করবেন বলে শোনা যাচ্ছে। তাঁরা তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিবেক। তৃণমূলের এই বিপুল জয়ে তাঁদের ‘নো ভোট টু বিজেপি’ আন্দোলনের যথেষ্ট অবদান— এই দাবিতে রবিবাসরীয় আকাশ-বাতাস তাঁরা মুখর করে তুলেছিলেন। সুতরাং তাঁরা আন্দোলন করলে মমতা নিশ্চয়ই আপত্তি করবেন না। আশা করা যায়, দিদি আগামী পাঁচ বছর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এঁদের সংগ্রামকে মমতাময়ী পক্ষিমাতার মতো দুই ডানা দিয়ে আগলাবেন। ২০১৮ সালে যেমন চেয়েছিলেন পঞ্চায়েতে শুধু তাঁর দলই থাকুক, এখন তেমন দাবি আশা করা যায় করবেন না যে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধেও শুধু তাঁর দলই লড়ুক।

শূন্যে পৌঁছে যাওয়া কংগ্রেসের এ-রাজ্যে ভবিষ্যৎ কী, বলা দুষ্কর। একা কুম্ভ অধীর চৌধুরীর গড় মাটিতে মিশে গেছে, প্রবীণ জনপ্রিয় নেতা আব্দুল মান্নান ধরাশায়ী। বৃদ্ধতান্ত্রিক সিপিএমেও একগুচ্ছ নতুন মুখ দেখা গেছে, কিন্তু কংগ্রেসে? সিপিএমের কচিকাঁচারা যদি ‘একলা চলো রে’ নীতিতে ফিরে যেতে চান তা হলে কংগ্রেসের কী হবে, দেবা ন জানন্তি।

অবশ্য ফলপ্রকাশের পর আটচল্লিশ ঘন্টা কেটে গিয়ে থাকলেও রাজ্য সিপিএমের শীর্ষ নেতাদের কেউ দায়িত্ব স্বীকার করে পদত্যাগ করেছেন, এমন খবর নেই। একটি তথাকথিত বিপ্লবী পার্টির শান্ত হ্রদের মতো অন্দরমহলে একমাত্র ঢেউ বলতে টিভির পর্দায় পরাজিত সিপিআইএম প্রার্থী তন্ময় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অকস্মাৎ বিষোদ্গার। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীর বাইরে এ-ভাবে কথা বলা শৃঙ্খলাভঙ্গ কি না, সে বিতর্কে না-গিয়েও বলা যায়, তাঁর সমালোচনায় গঠনমূলক কিছু ছিল না। এই ফলের জন্য “পলিটব্যুরোর দু-একজন নেতা” ছাড়া তিনি দুটো কারণ দেখিয়েছেন। সর্বক্ষণের কর্মীদের যথেষ্ট ভাতা না-পাওয়া আর আইএসএফ-এর সঙ্গে জোট করা। দ্বিতীয়টার ব্যাখ্যা দেননি, আর প্রথমটা ঠিক থাকলে কীভাবে শূন্যের বদলে খাতায় পাঁচটা বা দশটা আসন জমা পড়ত, তা বুঝতে চেষ্টা করার চেয়ে বাইফোকাল চশমা হারানো মানুষের পক্ষে সূচে সুতো পরানো সহজ। উপরন্তু তন্ময়বাবু যে ভাষায় বামপন্থীদের রাস্তার রাজনীতিতে বিশ্বাস রাখাকে কটাক্ষ করেছেন, তাতে তাঁর মার্কস্‌বাদে আস্থাকে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। আইএসএফ-এর সঙ্গে জোট করা নিয়ে আপত্তি আর কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করা নিয়ে প্রবল আবেগ দেখে মনে হয়নি, আন্দোলনের মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ স্থাপন করার মতো কোনও পথ তিনি নিজের দলকে দেখাতে চান। বোধহয় তাঁর মনে হয়েছে স্রেফ আইএসএফ-কে জোটের বাইরে রাখলেই মানুষ তাঁদের ঢেলে ভোট দিতেন। মীনাক্ষী, ঐশী, দীপ্সিতা, সৃজন, প্রতীকুরদেরও তা-ই ধারণা কি না, কে জানে! যদি তা-ই হয়, তা হলে অদূর ভবিষ্যতে বামেদের বাংলায় ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা শূন্য।

আসলে সিপিএমের রাজনীতিতে শ্রেণির প্রশ্ন বহুদিন ধরেই অবহেলিত। তা না-হলে ওঁরা আগেই বুঝতে পারতেন যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে নির্ণায়ক ভোট দেন গরিব মানুষ, যাঁরা তাঁর বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে উপকৃত। আমাদের দেশে যে কোনও নির্বাচনেই নির্ণায়ক ভোট আসলে গরিব মানুষের, কারণ তাঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। গত কয়েক বছরে সিপিআইএম-এর সোশাল মিডিয়া নির্ভরতা, এবং কারা সোশাল মিডিয়ায় ওই পার্টির জয়পতাকা ওড়ান তা দেখলে পরিষ্কার বোঝা যায় সিপিআইএম-এর মূল ভোটার হয়ে দাঁড়িয়েছেন মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত মানুষ। এঁদের অনেকেই আসলে অভ্যাসে সিপিআইএম। পরিবার সিপিআইএম সমর্থক বলে এঁরা সিপিআইএম সমর্থক, অথবা অল্প বয়সে কোনও বাম গণসংগঠনের সদস্য ছিলেন, সেই আবেগ রয়ে গেছে। গরিব মানুষ কোনও পার্টির দ্বারা, সরকারের দ্বারা উপকৃত হলে তা তাঁর ভোটকে প্রভাবিত করে। কিন্তু উপর্যুক্ত শ্রেণির মানুষের সেভাবে উপকৃত হওয়ার ব্যাপার নেই, তাঁরা চলতি হাওয়ার পন্থী। এ বারের ভোটে হাওয়া ছিল বামেরা জিতবে না, অতএব ভোট দিয়ে লাভ নেই। উপরন্তু দাড়ি-টুপি পরা মুসলমান ধর্মগুরুর সঙ্গে জোট বাঁধাও এঁদের পছন্দ হয়নি। তাই লোকসভা নির্বাচনে পাওয়া সাত শতাংশের মধ্যে থেকেও এই দুই বা তিন শতাংশ বেরিয়ে গিয়ে বিজেপি-বিরোধিতার কারণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভোট দিয়েছেন, এখন সোশাল মিডিয়া ভরিয়ে তুলছেন স্বীকারোক্তিতে। এরই মধ্যে হঠাৎ দ্বিমেরু রাজনীতির বিপদগুলো খেয়াল হওয়ায় কেউ কেউ লম্বা পোস্ট লিখে তৃণমূল কংগ্রেসকে খেয়াল করাচ্ছেন, তাঁদের ভোট দেওয়া হয়েছে স্রেফ বিজেপিকে আটকাতে। পার্টিটাকে পছন্দ হয়েছে বা সরকারের কাজ পছন্দ হয়েছে বলে নয়।

শ্রেণি সচেতনতার অভাবে, সমাজবিজ্ঞানের অ-আ-ক-খ জ্ঞানের অভাবে এই শ্রেণির চিন্তাভাবনাই কিন্তু বর্তমান বাম নেতা এবং প্রার্থীদের বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। তাই মমতার জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোকে সিপিআইএম কর্মীরা প্রায়ই হেয় করেন। “মানুষ আপনার দান/ ভিক্ষা চায় না, মানুষের রোজগারের ব্যবস্থা করুন”— এই চরম নব্য উদারনীতিবাদী কথাটা মিটিং-এ বা সোশাল মিডিয়ায় সিপিআইএম-এর লোকেদের প্রায়শই বলতে দেখা যায়। ওঁরা জানেন না অথবা উপলব্ধি করেন না যে, সরকারের টাকা আসলে করদাতাদের টাকা এবং সে কর একজন ধনী ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে একজন রিকশাচালক পর্যন্ত সকলেই দেন। সুতরাং নাগরিকের জন্য চালু করা কোনও সরকারি প্রকল্প আদতে দান নয়। কন্যাশ্রীর সাইকেল যেমন দান নয়, স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের প্রিমিয়ামও দান নয়। শুধু তা-ই নয়, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার মধ্যে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য এগুলো করা কল্যাণকামী রাষ্ট্রের বহু পুরনো কৌশল। বামফ্রন্ট সরকারও এমন প্রকল্প চালাত। কথাগুলো কিন্তু বিস্তর প্রশংসা কুড়োয় মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত সমর্থকদের থেকে। ফলে, ওঁরা ভাবেন, একেবারে ঠিক কথাই বলা হয়েছে এবং বাস্তবে গরিব মানুষের থেকে আরও দূরে সরে যান।

এই মধ্যবিত্ত-কেন্দ্রিকতা না-কাটলে সিপিআইএম-এর আর কোনও ভবিষ্যৎ নেই।

অতএব দ্বিমেরু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে রুজিরোজগারের প্রশ্ন জিইয়ে রাখার দায়িত্ব এখন পড়ল বিকল্প বামেদের কাঁধে। তাঁদের অনেককালের অভিযোগ, সিপিআইএম বামপন্থার বদনাম করছে। একটিবার সুযোগ পেলেই তাঁরা দেখিয়ে দিতে পারেন আসল বামপন্থা কী, কিন্তু সিপিআইএম তাঁদের জায়গা ছাড়ে না। সিপিআইএম ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পরের দশ বছরেও সে সুযোগ ওঁরা পাননি। অনেকটা ওই ‘আনফিট’ বর্ষীয়ান ক্রিকেটার যেমন অতীতের পারফরম্যান্সের জোরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে খেলেই যান, আর বেচারা তরুণ প্রতিভাবানদের রিজার্ভ বেঞ্চে বসেই জীবন কাটাতে হয়। নির্বাচকদের অসীম কৃপা, এবার তাঁরা দলের সেই বোঝাগুলিকে বিদেয় করার বন্দোবস্ত পাকা করে দিলেন। আশা করা যাক, তরুণরা সেঞ্চুরি, ডবল সেঞ্চুরির ফুলঝুরি ছোটাতে পারবেন শিগগিরই।


[1] https://youtu.be/eMdVXLZdsnw
[2] https://www.sangbadpratidin.in/bengal/jagannath-temple-in-digha/
[3] https://twitter.com/oxfamindia/status/1045899935126867968?lang=bn
[4] https://www.youtube.com/watch?v=jAWubQAK6iI

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4861 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...