Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ভোটবাজারে ওরা

ভোটবাজারে ওরা -- শুভ প্রতিম

শুভ প্রতিম

 



সংঘর্ষ ও সহাবস্থান সম্পর্কিত ক্ষেত্র সমীক্ষা ও গবেষণা গোষ্ঠী ‘আমরা —এক সচেতন প্রয়াস’-এর সদস্য

 

 

 

আনাচেকানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু কথা। এবারের ভোট বাজারে যেখানে ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কুঁড়েঘর’, ‘মোটা ভাই-এর দলিত বাড়িতে পাত পেরে খাওয়া’ খবরের শিরোনামে চলে আসছে, সেখানে কীভাবে যেন ব্রাত্য থাকছে এদের রোজনামচা। ‘খেলা হবে’ আর ‘আসল পরিবর্তন’-এর জোরালো আওয়াজে কানে তালা লাগার জোগার। এলাকায় এলাকায় এখন একাধিক ‘ফাটাকেষ্ট’। মানি এবং মাসল এখন স্বাভাবিক আঁতাত। কয়লাঞ্চলের কয়লা, সীমান্তের গরু, মফঃস্বলের সিন্ডিকেট এখন রাজ্য রাজনীতির চর্চায়। সর্বত্র লেলিহান ‘জয় শ্রীরাম’। মেচেদা বাসস্ট্যান্ড থেকে বারবনির ইটভাঁটা, দিনহাটার স্টেশন সংলগ্ন রাস্তা থেকে ক্যানিং বাজার, ‘হিন্দু রাষ্ট্র’-এর আস্ফালন জানানো পোস্টার। আব্বাসিপিএম নজরে আসেনি সেভাবে। তবে আছে তারাও।

টুকরো টুকরো কয়েকটা ছবির কোলাজ। ভোটবাজারে রাজ্যের কয়েকটি জনপদের। কোলিয়ারির ধস হোক বা পদ্মার ভাঙন অতলে তলিয়ে যাওয়া পরিবারগুলির নিত্যনৈমিত্তিকতা। বাড়ির নিতান্ত কিছু আসবাব, হাতপাখা, দেওয়ালে টাঙানো বিয়ের পরে স্টুডিয়োতে তোলা রঙিন ছবি— সব কিছুর পাতাল প্রবেশ। আর পাচার, তোলাবাজি, সিন্ডিকেট সহ সমান্তরাল অর্থনীতি। মাফিয়া অর্থনীতি। রে রে করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গ্রাম থেকে শহর।

 

চিত্র-১

একটা আস্ত গ্রাম খালি হয়ে গেল। তলিয়ে গেল কয়েকটা বাড়ি। গ্রামের মানুষ এখানে সেখানে আত্মীয়পরিজনের বাড়িতে আশ্রয় নিলেন কয়েকদিন। কিন্তু কতদিন আর এভাবে থাকা যায়? বাস্তবে উদ্বাস্তু হয়ে গেল একটা বর্ধিষ্ণু জনপদের বেশ কিছু পরিবার। পশ্চিম বর্ধমানের অন্ডাল ব্লকের হরিশপুর গ্রাম। খোলামুখ কয়লা খনি কীভাবে একটা এলাকাকে পরিবেশগতভাবে দূষিত করতে পারে, ধস নামাতে পারে তার জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হরিশপুর। ‘আমরা, এক সচেতন প্রয়াস’-এর পক্ষ থেকে পশ্চিম বর্ধমানের খোলামুখ কয়লাখনি এলাকায় কয়েকটি গ্রামে সমীক্ষা করতে গিয়ে ভয়ঙ্কর এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় আমাদের। পরে এর বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে। গ্রামের মানুষ জেলাশাসকের দপ্তরে অবস্থান বিক্ষোভ সংগঠিত করে, কিন্তু কোনও সুরাহা হয় না। তারপর তারা অবস্থানে বসেন জামবাদ কোলিয়ারির জিএম অফিসের সামনে। এখানে এরিয়া অফিস আছে। মার্চ মাসে এই অবস্থান বিক্ষোভে সামিল গ্রামবাসীদের হাহাকার এবং আন্দোলন চালানোর শক্ত চোয়াল আমরা দেখেছি। মাসাধিক কাল এই অবস্থানে সামিল হয় এলাকার সকল মানুষ। পার্টি নির্বিশেষে। কিন্তু ফল এক্ষেত্রেও শূন্য। নির্বাচন ঘোষণা হলে পুলিশ থেকে বারবার চাপ আসে অবস্থান তুলে দেবার জন্য। অবস্থান তুলে নিয়ে চরম সিদ্ধান্ত নেয় হরিশপুর এবং সংলগ্ন গ্রামগুলির বাসিন্দারা। ‘ভোট বয়কট’ করার সিদ্ধান্ত নেয় তারা।

কোলিয়ারির ধস, হরিশপুর

এবারে সপ্তম দফায় ভোট ছিল সেখানে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাক্তন এক ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীর খেদ, ‘ইস্টার্ন কোলফিল্ড আর থাকবে না। সব খনি প্রাইভেট কোম্পানিকে বিক্রি করে দেবে। কিন্তু কোথাও কোনও আন্দোলন দেখছেন? কলকাতার নাগরিক সমাজের কোনও মিছিল?’ ভগত রামের সঙ্গে দেখা রানিগঞ্জের বাজারে। আগে কোলিয়ারির ঠিকা শ্রমিক ছিলেন, এখন সবজি বেচেন। বললেন, ‘আশেপাশের গ্রামের অনেক যুবক পরিত্যক্ত কয়লাখনিতে যায় কয়লা তুলতে। ঝাড়খণ্ড থেকেও শ্রমিক আসে। অনেক ঝুঁকি নিয়ে কয়লা তোলে ওরা। বিশাল দালাল চক্র। কারও নাম করব না দাদা, বিপদে পরে যাব।’ ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী আবার বললেন, ‘বারাবনি, জামুরিয়া, আসানসোল সাবেক সিমিএম। শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থ দেখা ‘ঠিকাদার’রা বিকিয়ে গেছে। এলাকার মানুষ আরও বেশি করে হিন্দু হয়ে গেছে, মুসলিম হয়ে গেছে।’ পশ্চিম বর্ধমানে আব্বাসের সঙ্গে জোট করার জন্য গ্রামাঞ্চলে বাঙালি হিন্দুদের মধ্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে জোট নিয়ে। লাভ তাই বিজেপির। রানিগঞ্জ ও আসানসোলে ২০১৮ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। এলাকার মেরুকরণ ক্রমে স্পষ্ট হতে থাকে। আসানসোল স্টেশনের বাইরে লিট্টির দোকান। পূর্ব পরিচিতির সুবাদে দাঙ্গা নিয়ে কথা তুলতেই— ‘ইহা দাঙ্গা নেহি থা। আসলমে দাঙ্গা হুয়া থা তৃণমূলকা গুটবাজি কে চলতে। আসানসোলের দাঙ্গা ছিল তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ফল। মলয় ঘটক বনাম জিতেন তেওয়ারি। নাটের গুরু ছিল আসানসোলের মেয়র ওই জিতেন তেওয়ারি। অনেক নাটক করে সে এখন বিজেপি। আর দাঙ্গার ফলে আসানসোলও বিজেপি।’ ‘তো কোন লায়া ভাজপা (বিজেপি) কো?’

 

চিত্র-২

গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে এই গ্রাম পঞ্চায়েতে ভোট হয়েছে। রীতিমত ভাগ্যবান বলা যায়। ভোটের ফল তৃণমূল ১৪, বিজেপি ২। টিকিট না পেয়ে একসময়ের প্রধান এবং এলাকার ‘নামকরা’ সমাজ-বিরোধী সরাসরি চলে যায় বিজেপিতে। দাঁড় করায় নিজের স্ত্রীকে। জেতে তার স্ত্রী। গেদু মিয়াঁ, এক সময় ত্রাস ছিল মুর্শিদাবাদের খরগ্রাম ব্লকের পারুলিয়া গ্রামে।

প্রধান হতে হলে প্রচুর টাকা দিতে হবে। পার্টির জেলা নেতৃত্ব হয়ে তা নাকি চলে যায় আরও উঁচু স্তরে। মুর্শিদাবাদের দায়িত্বে বেশ কয়েক বছর ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। মজার ব্যাপার হল তিনিও এখন বিজেপিতে। কত টাকা? কেউ বলে ১৬ লাখ কেউ বলে ২২ লাখ। একই কথা শুনিয়েছিল মুর্শিদাবাদের চর এলাকার শেখপাড়ার এক গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানের দেওর। বৌদির বকলমে তার দাদা সেখানের প্রধান। দিতে হয়েছে করকরে ১৬ লাখ। পারুলিয়াতে জমি মাফিয়াদের রমরমা বেশ। বাইরে থাকা গ্রামের মানুষদের এবং গ্রামের দুর্বল মানুষদের জমি দখল করে নেওয়া, স্থানীয় ভূমি রাজস্ব দপ্তরকে হাতে করে জমির রেকর্ড বদল করা, এনাদের ‘প্রতিভা’ বহুবিধ।

কথা হচ্ছিল সাঁওতাল যুবক মোহন মুর্মুর (নাম পরিবর্তিত) সঙ্গে। পারুলিয়ায় বিজেপি-তৃণমূল এক হয়ে গেছে। জমি মাফিয়াদের হাতে গ্রামের ‘প্রশাসন ও শাসন’। আমাদের জমিতেও হাত পড়েছে। গত ২০১৯ সালে একদল গুণ্ডা বোমা মারতে মারতে আসে জমি দখল করতে। আমরাও তিরধনুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, প্রতিরোধ করার জন্য। শেষে খরগ্রাম থানার পুলিশ এসে সম্ভাব্য সংঘর্ষ রোধ করে। গুণ্ডাদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। কিন্তু এখন আবার আগের মত অবস্থা। আবার হুমকি, জমি দখল চলছে। পাশেই বীরভূম, রামপুরহাট। মন্ত্রী আশিস ব্যানার্জি এই পথেই যাতায়াত করেন। একবার গ্রামের আদিবাসি, মাল, কোনাইরা মিলে ওনাকে আটকাব। দেখি কী হয়?

 

চিত্র-৩

অনিতার মা। বৈদ্যবাটি খালপাড়ে সবাই এই নামে ডাকলেও মাটিপাড়া, কাজিপাড়ায় সবাই ডাকত মাছ মাসি বলে। ব্যান্ডেল-বৈদ্যবাটি রেললাইনের দুইপাশে ঝুপড়িতে রেলের জায়গায় অসংখ্য মানুষের বাস। এদের মধ্যে অধিকাংশ মুর্শিদাবাদের ভরতপুর-বড়ঞা এলাকা থেকে এসেছেন। অনিতার মা নিজ পরিশ্রমে খালপাড়ে এক কাঠা জমি কিনেছিলেন, সে আজ ১৭-১৮ বছর আগের কথা। তারপর কালক্রমে ‘ভদ্রলোক’-দের বাড়িতে ঠিকে ঝিয়ের কাজ করে তিন সন্তানকে বড় করে, ঘর তুলেছিলেন একটা। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছিলেন আগেই, ছেলের বিয়েও হয়েছে। বছর আটেক হল, মাছ বিক্রি শুরু করেছিলেন। কারও মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে চাইতেন না।

আবাস যোজনার টাকা পেতে গেলে ব্যাঙ্কে পঁচিশ হাজার রাখতে হবে, কাউন্সিলরকে দিতে হবে মোটা টাকা। ভোটের আগে চাঁদা চাইতে এসেছিল তৃণমূলের স্থানীয় লোকজন। বলছিল, ‘মাসি, বাড়ি তো পাকা হচ্ছে, দিদির সরকার আনতে হবে, ভোটের জন্য চাঁদা দাও।’ কত জানতে চাইলে বলে, ‘৫ হাজার দাও।’ ‘অত টাকা কোথায় পাব বল দিকি?’ টাকা আর দিতে হয়নি মাসিকে। গত সোমবার চলে গেছেন, ওদের নাগালের বাইরে। অসুস্থ ছিলেন কয়েকদিন। শরীর ফুলেছিল। আগের বার তাও শ্রীরামপুরে ওয়ালশ হাসপাতালে ছিলেন কয়েকদিন। ফিরে এসেছিলেন বাড়ি। এবার কোভিডের ভয়ে হাসপাতাল যেতে ভরসা পাননি।

 

চিত্র-৪

শামসেরগঞ্জ ব্লকের নিমতিতা গ্রাম পঞ্চায়েত। ফি বছর পদ্মার ভাঙনে গৃহহীন হয় বেশ কিছু পরিবার। পরিবারগুলির মহিলারা বিড়ি শ্রমিক। পুরুষেরা বেশিরভাগ অভিবাসী শ্রমিক। গতবারের লকডাউনে দলে দলে ফিরে এসেছিলেন সুদূর কেরল থেকে। ‘কদিন আর বাড়িতে বসে খাবে? পদ্মা জমি কেড়েছে। পদ্মার পারে বিএসএফ-এর ক্যাম্প, আমাদের ওপর সবসময় নজর’, বললেন দুর্গাপুরের বৃদ্ধ কলিমুদ্দিন শেখ। দুর্গাপুরে বেশকিছু বাড়ি যেকোনও সময় পদ্মায় তলিয়ে যেতে পারে। বাড়িতে ফাটল দেখা গিয়েছে। ‘এক জীবনে ৪ বার বাস্তুহারা হলাম বাপ।’ দুর্গাপুরের পাশে কামালপুর গ্রাম। গত নভেম্বরে ১০টা বাড়ি পদ্মার জলে তলিয়ে গ্যাছে। রাজনৈতিক কর্মী দেলোয়ার হুসেন বলেন, সরকার যায় সরকার আসে, আমাদের ভাগ্য বদলায় না। গত ৫ বছরে কামালপুরে যতগুলো বাড়ি ডুবে গেছে তার তালিকা নিয়ে একাধিকবার শামসেরগঞ্জ বিডিও অফিসে যাওয়া হয়েছে, কিছু তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিয়েছে প্রশাসন। যেমন, চিঁড়ে-গুড়, ত্রিপল। কখনও বোল্ডার ফেলা হয়েছে, নদি আটকাতে। কিন্তু যেখানে হাতির খোরাক লাগার কথা সেখানে টুনটুনির খাবার দিলে হয়? আর বিএসএফের কথা কী আর বলব, এখানে এমন কোনও বাড়ি নাই যে বাড়ির কোনও না কোনও সদস্য ওদের সন্ত্রাসের শিকার না হয়েছে। গুলি করে মেরে লাশ পদ্মায় ভাসিয়ে দেয় আমাদের রক্ষার জন্য নিয়োজিত এই বাহিনি।

ভাঙন, দুর্গাপুর, শামসেরগঞ্জ। নভেম্বর ২০২০

প্রার্থী করোনায় মারা যাওয়ায় এবারের ভোট হচ্ছে না শামসেরগঞ্জ বিধানসভায়। পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের সন্ত্রাস চলেছে। ভোটই হয়নি। কলিমুদ্দিন জানালেন, এই প্রথম কালির দাগ লাগল না আঙুলে। মানুষ ক্ষেপে আছে, কিন্তু তৃণমূলের বদলে যাদের আনবে ভাবছে তারা তো দেশটাকেই বেচে দেবে। বছর ত্রিশের সিরাজ জানালেন, মিম কিছু সদস্য করেছিল। দাঁড় করিয়েছে কিছু প্রার্থী। কিন্তু ওদের সভা করতে দিচ্ছে না পুলিশ। ঘরে ঢুকে হুমকি দিচ্ছে তৃণমূল। বিড়ি ব্যবসার শিল্পপতিরা শোষণ করছে বিড়ি শ্রমিকদের, সরকার চুপ। শিল্পপতিরা এখন রাজনৈতিক ক্ষমতায়। সাধারণ মানুষ ভাঙনে, বিএসএফের নির্যাতনে, বিড়ি শিল্পের মালিকদের শোষণে খাদের শেষ কিনারায়।

ভোট বয়কট করবেন ভেবেছেন কখনও? ‘জিনা হারাম করে দেবে আমাদের। চাই বা না চাই ভোটের লাইনে আমাদের যেতেই হবে’, খেদোক্তি কলিমুদ্দিনের।