পশ্চিমবঙ্গে ফ্যাসিবাদ-বিরোধিতায় বামেরা আস্থা হারাচ্ছে

শঙ্কর রায়

 



প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক

 

 

 

 

 

পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু ফ্যাসিবাদের সর্বাত্মক দখলের অভিযান ব্যর্থ করে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধানা নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর শুধু বিপুল আস্থা রাখেনি, এক নতুন ইতিহাস রচনা করেছে। সারা দুনিয়ার মানুষ দেখল, যখন সাবেকি সরকারি মার্ক্সবাদীরা (পড়ুন লেনিনবাদী) ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামের পতাকা বহনের শক্তি হারিয়ে ফেলে, তখম এমন এক রাজনৈতিক শক্তি সেই পতাকা তুলে ধরতে পারে। অথচ একদা (১৯৯৮-৯৯ সালে, ২০০৪-এও) সেই দলই হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল, সরকারও গড়েছিল। হিন্দু ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) ও তার প্রধান রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-কে বিপুলভাবে পরাস্ত করে রাজ্যের ৭ কোটি ৩৩ লক্ষ ভোটদাতা ভোট প্রয়োগ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতেই শাসনদণ্ড তূলে দিয়েছে। বলা যেতে পারে, তাঁর হাতেই শাসনদণ্ড তুলে দেওয়ার ঝুঁকি নিয়েছে। ঝুঁকি না নেওয়ার বিকল্প ছিল না।

ইতিহাস হয়ে থাকল যে সাবেকি সরকারি মার্ক্সবাদীদের হাত থেকে কার্যত ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামের পতাকা যখন খসে পড়ে যায়, মানুষ খড়কুটোর মত আঁকড়ে ধরে এমন এক রাজনৈতিক শক্তিকে, যার অতীত বাম-বিরোধিতা। কিন্তু মানুষ যেমন বাধ্য হয়ে এই বিকল্পকে গ্রহণ করেছে, তেমনি বামেদেরও পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। কারণ পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার ও তার প্রধান চালিকাশক্তি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) তথা সিপিআই (এম)-এর সেই ১৯৭৯ সাল থেকেই (নারকীয় মরিচঝাঁপি হত্যাকাণ্ড) স্খলনের শুরু। ১৯৭০ দশকে শিল্পায়নে যৌথ বিনিয়োগ নীতির বিরুদ্ধতার নীতি পরিত্যাগ করে সেই বুর্জোয়া নীতির কাছে আত্মসমর্পণ (যথা রমাপ্রসাদ গোষ্ঠীর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যৌথ ক্ষেত্রে হলদিতা পেট্রোকেমিক্যাল প্রকল্প গড়ার চুক্তি, যদিও গোয়েঙ্কারা তা থেকে নিজেদের বিযুক্ত করে, টাটারা আসে। তারাও চলে যায়। পরে পূর্ণ মালিকানা অনাবাসী ভারতীয় পূর্ণেন্দু চ্যটার্জির টিসিজি গোষ্ঠীর হাতে হস্তান্তর করে), নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুরে নয়া-উদারপন্থী পুঁজিবাদী শিল্পায়নের পথ— এ সবই বামফ্রন্টের বাম চরিত্রস্খলন আরও স্পষ্ট করে প্রতিফলিত করে।

সেই প্রেক্ষাপটেই মমতার আবির্ভাব, যা সরকারি বামেরা মেনে নিতে পারছে না। উদ্দেশ্যমূলকভাবে তারা কাল্পনিক কুৎসা করে চলেছিল, যেমন তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে নাকি বিজেপির তলায় তলায় বোঝাপড়া আছে। (সিপিআই-এমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের ভাষায় ‘মোদি-দিদি সেটিং’ অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী ও আরএসএস নেতা নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যুগলবন্দি) তারা একটি শব্দ বানিয়েছিল— ‘বিজেমূল’। ভোটের ফলাফলে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পরে সেই কুৎসিত শব্দটি আর উচ্চারণও করছে না।

সরকারি বামেদেরএকটা অপ্রিয় সত্য বলতে হচ্ছে। সারা দুনিয়ায় সরকারি মার্ক্সবাদীদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। ভারতে তার শুরু ১৯৮০-র দশকের শেষেই। দুই কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই ও সিপিআই-এম) মিলে ১০ শতাংশের কিছু ভোট পেয়েছিল ১৯৬৭ সালে। তারপর থেকে সেই শতাংশ কমেছে, এ নিয়ে একাধিক ইংরেজি কাগজে কয়েক বছর আগে লিখেছি। বারান্তরে এ নিয়ে আলোকপাত করার ইচ্ছে আছে। সরকারি বামেদের কি কোনও ভবিষ্যৎ আছে? অন্তত পশ্চিমবঙ্গে সে আশা দেখা যাচ্ছে না।

উল্টোদিকে দেখা যাচ্ছে, সিপিআই (এম), আরএসপি ও ফরোয়ার্ড ব্লক ১৫টি আসনে ভোট কেটে বিজেপিকে জিতিয়ে দিয়েছে। যেমন দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় গঙ্গারামপুরে সিপিআই (এম) এবং বালুরঘাট, তপন ও কুমারগঞ্জ আসনে আরএসপি প্রার্থী দিয়ে ভোট কেটে বিজেপিকে জিতিয়েছে ও তৃণমূল কংগ্রেসকে হারিয়েছে। ধুপগুড়ি, আসানসোল দক্ষিণ, আরামবাগ, পারা, রঘুনাথপুর, বড়জোড়া, শালতোড়া, প্রভৃতি আসন সিপিআই (এম)-এর জন্যেই বিজেপি জিততে পেরেছে। ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী দিয়ে ওন্দা ও জয়পুর আসন বিজেপি প্রার্থীর হাতে তুলে দিয়েছে। নচেৎ জয়পুর আসনটি পেত কংগ্রেস। আবার কংগ্রেসও বাঁকুড়া সহ তিনটি আসন বিজেপিকে জিতিয়েছে। এদের এই ‘ভোট-কাটুয়া’ ভূমিকা না থাকলে হিন্দু ফ্যাসিবাদীরা ৬০টি আসনও জিততে পারত না। নির্বাচন কমিশন ও কেন্দ্রীয় বাহিনির বেআইনি যোগসাজশে এরা বেশ কিছু আসন জিতেছে, সে সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। শুভেন্দু অধিকারীর নন্দীগ্রাম আসনে মমতা বন্দ্যোপাধায়কে যেভাবে হারানো হল এবং পুনর্গণনার দাবী নাকচ করা হল তাতে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আর শুভেন্দুবাবুও নীরব। মমতা বন্দ্যোপাধায়কে ৫০০০০ ভোটের ব্যবধানে হারানোর হুঙ্কার উবে গেছে। বলার কি কিছু আছে?

বিজেপির তাবড় নেতা, অর্থবল, লোকবলের বিরুদ্ধে ‘একাই একশো’ হয়ে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধায় প্রমাণ করলেন ‘জো জিতা য়োহি সিকান্দার। কিন্তু আত্মসন্তুষ্টির অবকাশ নেই, কারণ এই রাজ্যে এখন একমাত্র বিরোধী দল বিজেপি। ভাঙরে সংযুক্ত মোর্চার একমাত্র বিধায়ক মহম্মদ নওশাদ সিদ্দিকি জিতেছেন রাষ্ট্রীয় সেকুলার মজলিশ পার্টির টিকিটে। তাঁকে বামপন্থী বলা যায় না। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় একজন বিধায়কও বাম বা কংগ্রেস দল-প্রতিনিধি না৷ সিপিআই(এম)-এর দুই প্রাক্তন মন্ত্রী সখেদে দল-নেতৃত্বের সমালোচনা করেছেন। কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন “মানুষ ধরে নিয়েছিল তৃণমূল ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীদের আটকাতে পারবে। আমরা ভুল করেছি। এর তথ্যনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করতে হবে।” অশোক ভট্টাচার্য বলেছেন, তাদের জাত-কুল সবই গিয়েছে। “কেউ বলছেন সিদ্দিকীর সঙ্গে জোট করায় হিন্দু ভোট সরেছে। সেটা শিলিগুড়িতে হতে পারে। কিন্তু চোপড়াতে সংখ্যালঘু ভোটও আমরা পাইনি। তৃণমূল পেয়েছে।” সিপিআই (এম)-এর একদা প্রবল প্রতাপশালী রাজ্য সংগঠন এখন টলমল করছে। অন্য শরিক বাম দলগুলি কোমাচ্ছন্ন।

নির্বাচনী রাজনীতিতে জয়-পরাজয় দুটোই পালা করে আসে। জনভিত্তিসম্পন্ন দলগুলো ক্ষমতা হারিয়ে আবার তা ফিরেও পায়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট ২০১১ সালের বিপর্যয়ের পর দ্বিতীয় অবস্থানও ধরে রাখতে পারছে না। রাজ্যের রাজনৈতিক পরিসরেই ক্রমে তারা তাৎপর্যহীন হয়ে পড়ছে। যত নির্বাচন আসছে, তাদের অবক্ষয় উৎকট হয়ে উঠছে।

এদিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসের বিজয় ম্লান করতে উদ্যত হয়ে উঠেছে হিন্দু ফ্যাসিবাদী বিজেপি ও আরএসএস। তারা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস বাঁধাতে উদ্যত। এদের মদত দিচ্ছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। নির্বাচনী প্রচারে হিন্দির ব্যবহার, নানা এলাকায় উত্তরপ্রদেশ, বিহার প্রভৃতি রাজ্য থেকে মারকুটেদের আনা হয়েছিল। এরা ভেবেছিল ২০০ আসন জিতবে (যদিও ভেতরের খবর পার্টিনেতাদের প্রত্যাশা ছিল ১১০/১২০ আসনে জিতবে ও গোটা ৫০ তৃণমূল নিধায়ক কিনে নেওয়া হবে), আর তারপরে সেই মারকুটেরা সন্ত্রাস ছড়াবে। তা যখন হল না, ত্রখন উত্তেজনা ছড়াতেই নতুন সরকার শপথ গ্রহণের পরের দিন তদন্তের জন্য এক অ্যাডিশনাল সেক্রেটারির নেতৃত্বে একটি টিম পাঠিয়ে দেওয়া হল। মোদিজি কথা বলছেন রাজ্যপাল ধনখড়ের সঙ্গে, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে নয়। এ নয় যে শাসক দলের মধ্যেও সন্ত্রাসী নেই। কিন্তু বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, জাতীয় নেতা রাহুল সিনহা ও রাজ্য নেতা সায়ন্তন বসুর প্রকাশ্য হিংসার উস্কানি অন্য ইঙ্গিত দিচ্ছে। সেটা হিন্দু ফ্যাসিবাদের প্রতিধ্বনি।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4651 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. IN KERALA, CONGRESS IS AGAINST CPM! IN WEST BENGAL, CONGRESS IS A FRIEND OF CPM!! LEADING CONGRESS LEADER LIKE RAHUL GANDHI OR PRIYANKA GANDHI DID’T SPARE TIME IN BENGAL, THEY WERE BUSY IN ASSAM !!! BY ALLIANCE WITH ISF, LEFT PARTY TRIED TO GAIN MUSLIM VOTES, STUPIDITY, NOTHING ELSE!1 I FEEL, THERE IS NO “”SACCHHA””COMMUNIST PARTY BORN IN INDIA TILL NOW !!!

আপনার মতামত...