Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

শকুনের চোখের মতো লেন্স ও ভারতশ্মশান

চার্বাক মিত্র

 

রাজনৈতিক ভাষ্যকার

এই লেখা যখন লিখছি, তখনও মধ্যরাতের বোমা ফাটেনি।

মধ্যরাতের কথা বললেই নেহরুর সেই স্বাধীনতার ভাষণ অবধারিতভাবে মনে পড়বেই। বিশ্ব যখন নিদ্রামগন-এর রাবীন্দ্রিক অনুষঙ্গ যেন মিশেছিল সেই ভাষণে। পৃথিবী ঘুমিয়ে থাকার ভৌগোলিক মিথ্যের ভেতরেও যে কাব্য লুকিয়ে, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ভারতের স্বাধীনতার প্রতি তাঁর কথা নিবেদন করেছিলেন সেই কাব্যের মার্গ ধরে। তাই ভারত স্বাধীনতায় জেগে ওঠার জাতীয়তাবাদী রোমান্টিকতার হাতছানি আজও অটুট। কিন্তু কোন ভারতে সেই হাতছানি এসেছিল? বিভক্ত ভারত, ক্ষতবিক্ষত ভারত। তেভাগার ভারত, তেলেঙ্গানার ভারত।

স্বাধীনতার সাড়ে সাত দশক পেরিয়ে গিয়েছে। একটা অসুখ বিশ্বব্যবস্থার ইতিহাস পালটে দিয়েছে। যে ভারত গত শতাব্দীর শেষে বিশ্বায়নের জোয়ারে গা ভাসিয়েছিল, বিশ্বায়িত পৃথিবীর সঙ্কট সেই ভারতকেও স্পর্শ করেছে আপাদমস্তক। আর স্বাধীনতার মুক্তিবোধকে ছাপিয়ে যে ক্রান্তিকালের ঐতিহাসিকতা নেহরুর ভাষণকালে ভারতবর্ষের মানুষকে টান মেরেছিল, আজ সেই ঐতিহাসিকতার নতুন অধ্যায় তৈরি হচ্ছে। যুদ্ধ, দাঙ্গা, মন্বন্তর এসবই এদেশ দেখছে, অন্য আঙ্গিকে। আর এই অবস্থায় আরেকটা মধ্যরাত এসে দাঁড়িয়েছে ভারতের সামনে। এক রহস্যময় মধ্যরাত। এই মধ্যরাত নাকি ভারতের ইতিহাস পালটে দিতে পারে! বিষয়টা, পেগাস্যাস স্পাইওয়্যার। উচ্চস্তরের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, আরএসএস নেতাদের ফোনে আড়ি পেতে যেসব ‘বিস্ফোরক’ তথ্য পাওয়া গিয়েছে, তা নাকি আজ, ১৮ জুলাই রাত ১১:৫৯-এ ফাঁস হবে। যখন এই লেখা পড়বেন পাঠকরা, ততক্ষণে তাঁরা জেনে গিয়েছেন, আদৌ কোনও খেলা ঘুরল কি না। আমার মন বলছে, ঘুরবে না। ওয়াটারগেট বা পেন্টাগন পেপার্স জাতীয় কোনও কেলেঙ্কারির ছিটেফোঁটাও হবে না। উলটে ফোনে আড়ি পাতার অপরাধে আরও কয়েকডজন অ্যাকাডেমিক, শিক্ষক, উকিল এবং সমাজকর্মীকে গ্রেফতারের দরজা খুলে যাবে। কারণ, ২০১৯ থেকেই গুঞ্জন, পেগাস্যাসের সঙ্গে যুক্ত ভারতের বিরোধী বুদ্ধিজীবীরা। সোজা কথায়, ‘আরবান নকশাল’-রা। তবে ইতিমধ্যেই ‘গার্ডিয়ান’ জানিয়েছে, ভারতের ৪০ জন সাংবাদিকের ফোনে আড়ি পাতছে সরকার। যার মধ্যে সিদ্ধার্থ বরদারাজন আর পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা আছেন। এতে কি অন্তত সাংবাদিকমহলও কিছুটা নড়েচড়ে বসবে?

এই গুঞ্জন, সম্ভাবনার প্রসবযন্ত্রণা, চাপা উত্তেজনার মাঝেই জামিয়া নগরের শয়ে শয়ে মানুষ সন্ধেবেলায় নেমে এলেন রাস্তায়। কফিনবন্দি হয়ে তাঁর পাড়ায় ফিরলেন দানিশ সিদ্দিকি। মানুষের ঢল নামল। স্বরা ভাস্কর এই ছবি টুইট করেছেন, তলায় পরপর তিনটি কমেন্ট এসেছে। প্রত্যেকের নামের পাশে ভারতের পতাকা লটকানো। একজন করোনা পরিস্থিতিতে এত মানুষের ভিড় নিয়ে গম্ভীর কটাক্ষ ছুড়েছেন এবং দানিশের প্রতি ‘সলিডারিটি’ নিয়ে ঈষৎ খিল্লি ছুড়ে দিয়েছেন। বাকি দুজন তালিবানদের দোষ না দেওয়ার জন্য স্বরাকে ঠুকেছেন। একজন একটা ফোটোশপড ছবিতে রবিশ কুমারের মুখও ব্যবহার করেছেন, যেখানে রবিশ বলছেন, তালিবান মারেনি, বুলেট মেরেছে দানিশকে।

এই হল ভারতের এই সময়ের অন্যতম সেরা চিত্রসাংবাদিকের মৃত্যু বা হত্যার পর কিছু ভারতীয়ের প্রতিক্রিয়া।

দানিশ রয়টার্সের সাংবাদিক ছিলেন। এই রয়টার্সের চিত্রসাংবাদিক অর্ক দত্ত গুজরাট গণহত্যাকে লেন্সে ধরেছিলেন। রঘু রাইরা ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডির বীভৎসা তুলে ধরলেও শেষত তারা ফোটোগ্রাফার, কিন্তু এই মুহূর্তে এই দেশ যে ক্রান্তিকালের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, তার আসল ছবিগুলো, জ্যান্ত, রক্তমাংসের দগদগে ছবিগুলো তুলে আনছিলেন দানিশ। দানিশের তোলা রোহিঙ্গা সঙ্কটের ছবি চিত্রসাংবাদিকতার ক্লাসে ব্যবহৃত হবে আরও বহু বছর। কিন্তু দানিশের ওই ছবিগুলো নিয়ে পরে কথা বলা যাবে। আপাতত দানিশের তোলা কয়েকটা ছবির মাধ্যমে গত দেড় বছরের ভারতকে একবার ফিরে দেখা যাক।

সিএএ পাশ হয়ে গিয়েছে ভারতের সংসদে, ভারতীয় সংবিধানের সবচেয়ে কলঙ্কিত দিনটি পেরিয়ে গিয়েছে। দেশজুড়ে চলছে বিক্ষোভ। ছাত্ররা শামিল সেই বিক্ষোভে। এর মধ্যে জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে নজিরবিহীন হামলা চালাল গুন্ডাবাহিনী, সঙ্গে পুলিশ। ফেটে পড়ল দেশ। তার কিছুদিন পরেই জামিয়ায় নিষ্ক্রিয়, হোম মিনিস্ট্রির পোষা কুত্তার মতো পুলিশ ঠুটো হয়ে দাঁড়িয়ে, আর বন্দুক হাতে নিরস্ত্র ছাত্রদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে গোপাল, রাষ্ট্রীয় মস্তান। সে দেশদ্রোহীদের গুলি করে শায়েস্তা করতে চায়। পুলিশ নিরুদ্বেগ মজা দেখছে পেছনে দাঁড়িয়ে।

ছবি উঠে গেল দানিশের ক্যামেরায়।

শুধু বন্দুকধারী উগ্র জাতীয়তাবাদী জিঙ্গো নয়, তার পেছনে দাঁড়ানো সময়বিশেষে পেশিফোলানো পুলিশ… এই প্রেক্ষিতটুকু ছবিটার মানে পালটে দিল লহমায়। ছবিটা কথা বলল। সে কথা দেশজুড়ে শোনা গেল।

এর কিছুদিন পর। রাজধানীর বুকে হিন্দুত্বের জয়ধ্বনি তুলে কিছু ভারতীয় হিন্দু পিটিয়ে মারছেন ভারতীয় মুসলমান মহম্মদ জুবেইরকে। গণপিটুনির কাণ্ডারীদের চোখ দিয়ে দানিশের লেন্স দেখল মহম্মদকে। রক্তাক্ত, মাথা দু হাত দিয়ে ঢেকে রাখা ভারতবাসী মুসলমান মহম্মদ জুবেইর, যার নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছে রাষ্ট্র। সেই প্রশ্নের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিল মহম্মদ। তাকে দেখছে দানিশের লেন্স। তার শরীরে আর প্রতিরোধ নেই। আত্মরক্ষার আকুতি আছে। সমর্পণ আছে। দানিশের লেন্সে কোনও সহানুভূতি নেই। বরং দর্শককে দেখানো, দেখো, তোমার সহনাগরিককে তুমি আসলে এভাবে দেখো।

করোনা ততদিনে আছড়ে পড়েছে ভারতকে। তখনও ব্যাপারটা নেহাত খেলা। লকডাউন-লকডাউন খেলা। কোয়ারেন্টিন-কোয়ারেন্টিন খেলা। খেলার সুরতাল কেটে গেল হঠাৎ। দেখা গেল, দেশের নানা প্রান্ত থেকে ভুখা, অভিবাসী শ্রমিকরা ঘরে ফিরছেন। দেশভাগের এত বছর পর আবার ছিন্নমূল মানুষের হাঁটা। শুধু এবারটা ফাঁকা রাজপথ ধরে। মানুষ যখন ঘরে, তখনই মানুষ হাঁটছে। ট্রেনে, ট্রাকে চাপা পড়ে মরছে অকিঞ্চিৎকরভাবে। এক বাবার কাঁধে বসে তার সন্তান, বাবার মুখে ক্লান্তি। বাবা হাঁটছে। ছবি তুললেন দানিশ। যেন ওই ঘরছাড়া শ্রমিকের কাঁধে বসে উত্তরকালের ভারতবর্ষ। যেদিকে মুখ করে হাঁটছিল জামলো মকদমের মতো অস‌ংখ্য ভারতবাসী, তার উলটোদিকে দাঁড়িয়ে একবার আসল ভারতবর্ষকে চিনে নিতে চাইলেন দানিশ।

বছরও ঘুরল না। দানিশের লেন্স এবার হয়ে উঠল চিল-শকুনের চোখ। তা ধরে ফেলল দেশজোড়া শ্মশান ও শান্তিকল্যাণের ছবি। কোভিড দ্বিতীয় তরঙ্গের মৃত্যুমিছিল শিকারির চোখে দেখল সেই ছবির দর্শক। দেখল, আগুন জ্বলছে কোথাও, কোথাও তা নেভা। এই মর্মান্তিক মৃত্যুময়তার নেপথ্যে খল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রাষ্ট্রের উদাসীনতা। মানুষের মেনে নেওয়ার অভ্যেস। দানিশ চিলের চোখ দিয়ে নগ্ন করলেন একুশ শতকের ভারতকে। সাড়ে সাত দশকের প্রৌঢ় স্বাধীন ভারতকে।

আজকের ভারতের নীরবতা আসলে ওই শ্মশানের মতোই। সব আগুন আস্তে আস্তে নিভে যাচ্ছে। আজকের ভারত শকুনের চোখে দেখছে দেশের শ্মশানকে। স্ট্যান স্বামীর মতো কেউ কেউ নীরব থাকতে চাননি। কিন্তু দানিশ বলেছিলেন, তিনি সাধারণ মানুষের জন্য ছবি তোলেন। তাই ফাদার স্বামীর মতো ব্যতিক্রমী চোখ তিনি ধার করেননি, হত্যাকারী, শীতল, নিস্পৃহ, আক্রমণকারী, আক্রান্ত— এই সাধারণ ভারতবাসীর চোখ ধার করেছিলেন তিনি।

পুনশ্চ: শেষে একটা ফুট কাটি। ওয়েব সিরিজ হলে, রাষ্ট্র একটু বুদ্ধিমান হত। যে দেশীয় সাংবাদিকের তোলা ছবি বিশ্বের সামনে পুরুষকারে ফুলে ওঠা সরকারের মুখ পোড়াচ্ছে, সেই সাংবাদিককে দেশের বাইরে যুদ্ধক্ষেত্রে মেরে ফেলার সুযোগ সেই রাষ্ট্র ছাড়ত না‌। যেখানে আবার তালিবানরা আছে। এ তো সুবর্ণ সুযোগ বলা চলে।

না না, আমরা মোটেই ভাবছি না বিষয়টা ওয়েব সিরিজের মতো। বাস্তবের ডিসক্লেমারেই বলা, ওয়েব সিরিজের চরিত্রের সঙ্গে তার কোনও মিল নেই।