স্বাধীন ভারত কোনও এক দূরতর দ্বীপ

চার্বাক মিত্র

 

রাজনৈতিক ভাষ্যকার, পেশায় করণিক

একটা প্রজন্ম যখন জন্ম নিচ্ছে, বা নেবে নেবে করছে, তখন একটা মসজিদ উপড়ে দেওয়া হল মাটি থেকে, যার প্রভাব ভারতের রাজনীতিতে থেকে যাবে পরের দুই থেকে তিনটি দশক। যখন তারা জন্মে গেছে, হামাগুড়ি দেবে বলে ঠিক করছে, তখন গ্যাট চুক্তি সাক্ষর হয়ে গেল, অর্থনীতির সঙ্গে পালটাতে শুরু করল সমাজছক। নয়ের দশকের এই দুই বদল আত্মস্থ করতে সময় লেগেছিল ভারতবাসীর, অন্তত শূন্য দশকের শুরু অবধি। আর মিলেনিয়াল প্রজন্মর সে অর্থে জ্ঞানগম্যিই হল তখন, ফলে তারা চিনতেই শুরু করল সেই বিশ্বায়িত, ক্রিকেটসর্বস্ব, ‘মিশন কাশ্মির’-এর ভারত, কার্গিল, ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর এবং গুজরাত গণহত্যার ভারত।

জগজিৎ সিং গান গাইছেন, প্রেক্ষাগৃহ কানায় কানায় পূর্ণ। জগজিৎ সিং গাইছেন, ‘হোশওয়ালো কা খবর ক্যা, জিন্দেগি কেয়া চিজ হ‍্যায়’। শান্ত শ্রোতা, নিবিড় শ্রোতা ন মিনিট ধরে শুনছে সেই গান। ইউটিউবে এই ভিডিও দেখতে দেখতে এক দাদা এই সেদিন প্রশ্ন করল, এই শ্রোতা, এই দেশের মানুষ কোথায় গেল? জরুরি প্রশ্ন। সত্যিই, সেই শ্রোতা আজ আর নেই। থাকার কথাও নয়। কিন্তু ছিল কবে? এই ভিডিও কবেকার? নয়ের দশকের শেষ বা প্রথম দশকের গোড়ার। ১৯৯৭ সালে দুটো খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর, এবং নেতাজির শতবর্ষ। অর্ধশতক পেরিয়ে আসা একটা স্বাধীন দেশ তখনও হজম করছিল ভারত নামের একটি মণ্ডকে, যে ভারত মুক্ত, ধ্বস্ত, বিভক্ত, রক্তাক্ত। মুখার্জি কমিশন থেকে গুমনামি বাবা, বালক ব্রহ্মচারী হয়ে নেতাজির অন্তর্ধান তখন মিথ এবং আশা-বেদনার এক অন্য সমষ্টিগত অচেতনের দ্যোতক, যেখানে ব্যক্তি নেতাজির থেকেও বেশি জরুরি ছিল আজাদ হিন্দ ফৌজের ব্যর্থতা, এক অন্য স্বাধীনতার আখ্যান হারিয়ে যাওয়ার মর্মযন্ত্রণা। শুধু এই সালটিকে ভরকেন্দ্র করলে বোঝা যাবে, ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’, দেশভাগ, কলোনির চাপা রক্তছাপ, শরণার্থীর ঢেউ, গান্ধিহত্যা থেকে খাদ্য আন্দোলন, জরুরি অবস্থা থেকে নকশাল অভ্যুত্থান, ইন্দিরা-রাজীব হত্যা থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী স্রোত— এই নানা প্রতিতরঙ্গের ভেতর দিয়ে নতুন দেশের চেতনা তখনও প্রোথিত ছিল।

 

সেই নতুন দেশ খুব তাড়াতাড়ি পুরনো হলো। বহু বছরের প্রতিবেশীর শত্রুতা, দাঙ্গা, ধর্মীয় বিশ্বাসঘাত এবং সন্ত্রাসের কাড়ানাকাড়ায় আন্দোলিত হল মূলধারার গণমাধ্যম। এবং একটা প্রজন্ম বড় হল মূলত রাজনীতির ঘাঁতঘোঁত সম্পর্কে অসচেতন হয়ে, একটু একটু দেশপ্রেম, অনেকটা নব‍্য পুঁজির আকর্ষণ নিয়ে বেড়ে উঠতে উঠতে, একরাশ চয়েজ এবং নিত‍্যনতুন নিও লিবারাল পণ্যমুখরতায় বাঁচতে বাঁচতে হঠাৎ ‘আওয়াজ তোলা’-র অঙ্গীকার করতে শিখল এই প্রজন্মই। ২০১২ সালটা খুব জরুরি ছিল এইদিক থেকে। নির্ভয়ার ধর্ষণকাণ্ড সেই প্রথম ঝড় তুলল দেশের মহাতারকাদের নিজস্ব ব্লগে। অমিতাভ বচ্চন তাঁর ব্লগে ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের দাবি তুললেন ধর্ষকদের। রাজধানীর রাস্তা স্তব্ধ হয়ে গেল তরুণদের ভিড়ে।

সরকার-বিরোধিতার ব‍্যাপক ঢেউ উঠছে সে-সময়। সেই একই সময় লোকপাল বিল আন্দোলনেরও। আন্না হাজারে তখন নতুন গান্ধি। কেজরিওয়াল থেকে প্রশান্ত ভূষণ হয়ে রামদেব, কে না ছিলেন সেই রেড কার্পেট পাতা দুর্নীতিবিরোধী জেহাদে। এসএমএস বিপ্লব ছড়িয়ে দেওয়া চলল এই সংক্রান্ত সচেতনতা বাড়াতে। এবং যা খুব আগ্রহব‍্যঞ্জক, এর বেশ কিছু বছর আগে দেশ কাঁপিয়েছিল তাজ-ওবেরয়ের ভয়াবহ সন্ত্রাস। সেই সময় অরাজনৈতিক তারুণ্য ফুঁসছিল সরকারের বিরুদ্ধে। তাদের ভাষ‍্য তখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু ভাষ্য ঢাকা পড়ে মোমবাতি মিছিলে। রাজকুমার গুপ্তার জরুরি ছবি ‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’ চিনিয়ে দিয়েছিল মোমবাতি হাতে নীরব প্রতিবাদে সামিল হওয়া সেই প্রজন্মকে। তারা জানত, দীর্ঘদিন স্বাধীন হয়ে যাওয়া দেশের সব ব‍্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। থিতু থাকার সময় নেই।

কেন তারা এমন ভাবছে? দু-একটি ঘটনায় মাত্র? না। এই শতকের নির্মমতম, ভয়াবহতম রিসেশনের ধাক্কাও ততদিনে লেগেছে। ওয়াল স্ট্রিটে দেখা যাচ্ছে আলতো চিড়। ফলে গোলকায়নের দেখানো স্বপ্ন বিপন্নতার মুখে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছে তখন। সেই সময় স্বাধীন দেশের অন্যতম শিউরে দেওয়া ধর্ষণ, টুজি-কমনওয়েলথ-এর মতো মারাত্মক দুর্নীতির বদ হাওয়া এই প্রজন্মকে ডিস্টার্ব করছে। বিব্রত করছে। কী করবে তখন তারা? তারা ওই গোলকায়নের দেখানো পথেই প্রতিবাদ করবে।

হ্যাঁ, এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন উঠবেই, বোফর্স যখন ঘটেছিল, তহেলকার হাত ধরে বঙ্গারু লক্ষ্মণকে যখন প্রকাশ‍্যে ঘুষ নিতে দেখা গেল, তখন এমনটা হল না কেন? কারণ, তখনও দেশ ছিল একটি সামগ্রিক স্বপ্নের আঁতুড়। দেশ যখন গ্লোবাল ভিলেজের টুকরোমাত্র, তখন কীভাবে সেই স্বপ্নের বুনন ঘটবে? সেই স্বপ্ন ততদিনে মিশে গেছে ধূসরতায়।

 

আর এখান থেকেই ধীরে ধীরে তৈরি হল আজকের ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’-এর প্লট। নতুন দেশ, নতুন ভারতের আখ‍্যান স্বাধীনতার পর থেকে তৈরি করার দরকারই হয়নি। কারণ এক শতাব্দীরও কম বয়সি স্বাধীন দেশ তখনও বৃদ্ধ, বস্তাপচা হয়নি একচুলও। এবার সেই দেশের হাড়পাঁজর, কোঁচকানো চামড়া নিয়ে সচেতন হয়ে পড়ল নতুন প্রজন্ম। তারা চাইছিল, স্বাধীন ভারতের এক অন‍্যতর চেহারা। ‘আচ্ছে দিন’-এর ভারত যা তুলে ধরল। বিদ্বেষ নির্মাণ, শত্রুপক্ষ নির্মাণের তৎপরবর্তী গতিবাঁক নিয়ে কিছু বলবে না এই লেখা, কারণ তা এখনও দৃশ্যের জন্ম হওয়ার পর্যায়ে। সোশ্যাল মিডিয়ার বাড়বাড়ন্ত, আইটি সেলের নিরন্তর চলচ্ছবি যে জম্বি-ভারতের নির্মাণে হাত লাগাল, স্বাধীনতার মেরামতের নাম করে ইতিহাসের গঠনতন্ত্রে যে অবনির্মাণ ঘটাল, তা স্বাধীনতা দিবসের দিন মাইক বাজানো, ক্রিকেট-ফুটবল ম্যাচ এবং রক্তদান শিবিরের চেয়ে বৃহত্তর। সেজন্যই হর ঘর তিরঙ্গা প্রকল্পে কর্পোরেট সংস্থা সেলস টার্গেট স্থির করে দেয়। অন্তত দশটা করে পতাকা না বেচলে চাকরি যাওয়ার ভয় আছে যার, সে কি উমর খলিদ থেকে ভারভারা রাও, কাউকে তার কমরেড বলে ভাববে? সে জানে, নতুন ভারতে রোবট হতে হবে।

নেহরুকে নাকি কোনও এক কিশোর স্বাধীনতার কিছুদিন পরেই আঙুল তুলে প্রশ্ন করেছিল, আপনি যে বলেছিলেন, স্বাধীন ভারতে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হবে, কী হল সেই প্রতিশ্রুতির? নেহরু তার চোখে চোখ রেখে বলেন, গণতন্ত্র আছে বলেই একজন কিশোর প্রধানমন্ত্রীর দিকে আঙুল তুলে প্রশ্ন করতে পারে। এই উন্নাসিকতার মূলে ছিল গণতন্ত্রের অহমিকা। আজ সেই অহমিকা শূন্যগর্ভ কামানের গোলামাত্র। আজ গণতন্ত্র কতটা তামাশার, তা সেই কিশোরও জানে। আজ প্রধানমন্ত্রীও জানেন, ওই আঙুল তার দিকে ওঠার আগেই দাফন হয়ে যাবে। নিমেষেই।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...