স্বাধীনতার সালতামামি: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাড়ে সাত দশক

শুভাশিস মুখোপাধ্যায়

 


প্রাবন্ধিক, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, পরিবেশবিদ

 

 

 

১৯৪৭ থেকে নয় নয় করে কেটে গেল প্রায় ৭৪ বছর। এই বছরের আগস্ট মাস থেকে শুরু হবে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তির উৎসব। ব্রিটিশ শাসনের সময়ে প্রজা হিসেবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মতো বিষয়ে নীতি নির্ধারণের মতো জায়গায় আমরা ছিলাম না, তাই দেশের জনগণ আশা করেছিলেন যে ইংরাজ-বিবর্জিত ভারতের সব নীতিমালা আগের শাসকের নীতিমালা থেকে গুণগতভাবে আলাদা হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেই আশায় ছাই পড়েছে, বরং ইংরেজের এদেশ শোষণের স্বার্থে বানানো প্রায় সব আইনই এই দেশের শাসকরা প্রায় গোটাগুটি গ্রহণ করেছেন, ক্ষেত্রবিশেষে সেগুলিকে এই দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে আরও ধারালো করে তুলেছেন। আমরা দেখার চেষ্টা করি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমরা ১৯৪৭ বা তার ঠিক আগে থেকে কী পথ গ্রহণ করার কথা ভেবেছি বা গ্রহণ করেছি।

ইংরেজ শাসনে আমাদের দেশে যাঁরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চায় নিজের নিয়োজিত করেছিলেন, তাঁরা তাঁদের নিজস্ব চর্চার জগতে ইংরেজদের অতিক্রম করে যাওয়াটাকে আত্মমর্যাদার দ্যোতক হিসেবে ভাবতেন, ফলত বিজ্ঞান প্রযুক্তি চর্চার মাধ্যমে ভারতের অবদানকে বিশ্বের বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের কাছে তুলে ধরার বিষয়টিকে তাঁরা ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অংশ হিসেবে দেখতেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শেষ হল, তখন ভারতে প্রত্যক্ষ ইংরেজ শাসনের অবসান যে আসন্ন, সেই বার্তাটি অবিভক্ত ভারতের এলিটবৃন্দ, যারা ইংরেজের কাছ থেকে ভারতের শাসনভার গ্রহণে অতিমাত্রায় উৎসুক ছিল, তারা পেয়ে যায়। তখন থেকেই এই এলিটবৃন্দ চেয়েছিল সমঝোতার ভিত্তিতে প্রথমে ক্ষমতালাভ ও পরে শাসন চালিয়ে যাওয়া। তারা জাতীয়তাবাদী ধারণায় সম্পৃক্ত বিজ্ঞানীদের চেয়ে বিদেশে, বিশেষত ব্রিটেনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিজ্ঞানীদের দিয়ে ১৯৪৭-উত্তর ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিকটি বিন্যস্ত করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা জাতীয়তাবাদী ঘরানার একজন হওয়ায় তিনি বুঝেছিলেন একটি মুক্ত স্বাধীন দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কী অপরিসীম গুরুত্ব। ব্রিটিশের হাত থেকে দেশীয়দের হাতে ক্ষমতা আসতে পারে অনুমান করে তিনি ইংরেজ-বিবর্জিত ভারতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কীভাবে দেশ ও জাতি গঠনের কাজে লাগানো যেতে পারে, সেই বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত “সায়েন্স অ্যান্ড কালচার” পত্রিকার একেবারে প্রথম সংখ্যায় (জুন, ১৯৩৫) লিখেছিলেন:

“যেকোনও চিন্তাশীল মানুষের কাছে এটা স্পষ্ট যে আমাদের দেশ তার ইতিহাসের এক সঙ্কটকালীন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের প্রাচীন সভ্যতার ভিত্তির ওপর নির্ভর করে এক আধুনিক সভ্যতার বিন্যাসকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা হচ্ছে…। এই রকম এক মুহূর্তে আমাদের ভেবে দেখতে হবে আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কার ও উদ্ভাবনসমূহ আমাদের দেশের সামাজিক ও জাতীয় জীবনে কেমন প্রভাব ফেলবে। এই বিষয়টি নিয়ে সুচিন্তিত সিদ্ধান্তে আসার দরকার রয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, যদি বর্তমানকাল অতীতের সন্তান হয়, তাহলে একইরকমভাবে একথা সত্যি যে ভবিষ্যৎ হচ্ছে বর্তমানের সন্তান। আজকের প্রজন্ম তার নীতিমালা এবং কাজকর্মের মাধ্যমে আগামীদিনের রূপকে নির্ধারিত করে দেবে।”

বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার এই উক্তি যে কতখানি সত্যি, তা আজ আট দশক পরে প্রায় নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী বলেই প্রতিভাত হচ্ছে!

মেঘনাদ সাহা

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভবিষ্যতের ভারতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে কীভাবে দেশ গঠনের কাজে লাগানো যেতে পারে, তা নির্ধারণের জন্য জওহরলাল নেহেরুকে দায়িত্ব দেয়। নেহেরু এই কাজে বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাকে সেই পরিকল্পনাটি রচনার অনুরোধ জানান। বিজ্ঞানী সাহা ভারতের মতো বিশাল দেশে (তখনও পর্যন্ত কেউই জানত না যে এই পরিকল্পনা শেষ হওয়ার দু দশকেরও কম সময়ে ভারত বিভক্ত হয়ে যাবে) আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, খাদ্য, কৃষি, জলসম্পদ, মানব বিকাশসহ প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে জন-কেন্দ্রিক বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনার রূপরেখা তুলে আনেন। তাঁর মাথায় ছিল সোভিয়েতের আদর্শ, কিন্তু সেটিতে তিনি প্রচুর ভারতীয় উপাদান যোগ করে এক রূপায়ণযোগ্য পরিকল্পনা হাজির করেন।

কিন্তু এর পরপরই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগে এবং পশ্চিমি দেশগুলিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ভাবনায় এক বিরাট পরিবর্তন আসে। যুদ্ধরত প্রতিটি দেশ বুঝতে পারে যুদ্ধ জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় যুদ্ধাস্ত্র সহ যুদ্ধের পক্ষে সহায়ক প্রতিটি বিভাগে বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের প্রয়োজনীয়তা। বিজ্ঞান চর্চার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের পাশাপাশি ঘটে যায় তার সমরায়নও। ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে ভারতেও সেই ঢেউ-এর কম্পন এসে হাজির হয়। এই নিয়ে একাধিক কমিশন হয় ব্রিটেনের আমলা-বিজ্ঞানীদের নিয়ে, কিন্তু সিদ্ধান্ত হয় যে ব্রিটিশ উপনিবেশের কোনও “নেটিভ” বিজ্ঞানীকেই কী ব্রিটেনে, কী বিভিন্ন ব্রিটিশ উপনিবেশে এই যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সরাসরি সামিল করা হবে না। তবে ১৯৩৯ সালে দেশে ফিরে হোমি ভাবা যুদ্ধের কারণে আর বিদেশ যেতে পারেননি, তিনি চেয়েছিলেন ইংল্যান্ড ফিরে গিয়ে ইংল্যান্ডের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সামিল হবেন, কিন্তু অবস্থার বিপাকে তাঁর সেই ইচ্ছা পূরণ হয়নি। তবে মার্কিন যুদ্ধব্যবস্থার অঙ্গ হিসেবে ভাবার মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে গবেষণার কাজে অতি উচ্চতায় ভাসতে সক্ষম বেলুনের নকশা তিনি মার্কিন বিমানবাহিনির কাছে থেকে পেয়েছিলেন।

ভারতের সংবিধান সভার বিতর্ক চলার সময়ে, ১৯৪৮ সালে নেহেরু সেই বিতর্কে অংশ নিয়ে নিউক্লিয়ার শক্তি নিয়ে সওয়াল করতে গিয়ে বলেন যে এই আধুনিক প্রযুক্তিটি এমন যে তার মধ্যে অসামরিক এবং সামরিক অংশ আলাদা করা যায় না। তবে ভারত এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে শান্তির জন্য ব্যবহারেরই পক্ষপাতী। যদি প্রয়োজন হয়, তবে কোনও ব্যক্তির সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে নেয়, অবস্থা আমাদের যে দিকে ঠেলে দেবে, আমাদের সেই অভিমুখেই যাত্রা করতে হবে, যদি তার অভিমুখ সামরিক হয় আমাদের সেই দিকেই যাত্রা করতে হবে।

একথা সবাই জানে যে রাশিয়া, ফ্রান্স এবং চিন যখন তাদের নিজ নিজ নিউক্লিয়ার শক্তি উৎপাদনের গবেষণা ও প্রযুক্তি নিয়ে কাজ শুরু করেছিল, তখন তারা এই বিষয়ে সমস্ত কিছুই প্রথম থেকে নিজেদের মানবসম্পদ, প্রাকৃতিক রসদ, প্রযুক্তিগত ভিত্তি, এই সব থেকে শুরু করতে বাধ্য হয়। এর মূল কারণ ছিল চিন এবং সোভিয়েত রাশিয়া, বিশ্ব-রাজনীতিতে তখন যে ঠান্ডা যুদ্ধ চলছিল, সেখানে তারা মার্কিন দেশ, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের বিপ্রতীপ শিবিরে ছিল। ফ্রান্স কিন্তু যুদ্ধে ইংল্যান্ড ও মার্কিন দেশের সঙ্গে থাকলেও, নিউক্লিয়ার বোমা বানানোর প্রচেষ্টায় ইংল্যান্ডের মতো মার্কিন দেশের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধেনি বা তাকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। ভারতের ক্ষেত্রে বিষয়টা অন্য ছিল। বৃটেনের মাধ্যমে মার্কিন দেশ ভারতের থোরিয়ামের দিকে নজর দিয়েছিল এবং থোরিয়ামের বিনিময়ে ভারতকে নিউক্লিয়ার প্রযুক্তির একেবারে প্রথম প্রজন্মের বস্তুগুলি দিতে তাদের আপত্তি ছিল না। ভারতের জোরের এবং আত্মনির্ভরতার জায়গা ছিল এই বিষয়ের তাত্ত্বিক গবেষণা এবং সম্পূর্ণ নতুন এক পদ্ধতিতে ভারত সমসাময়িক নিউক্লিয়ার প্রযুক্তিতে পৌঁছনোর মতো অবস্থায় ছিল। বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা এই আত্মনির্ভরতার কথা বলতেন এবং সেটি নেহেরুর অপছন্দের বিষয় হওয়ায় তিনি এই গোটা কার্যক্রম থেকে মেঘনাদ সাহাকে বহিষ্কার করেন এবং টাটা গোষ্ঠীর আর্থিক মদতের কথা ভেবে বৃটেনে শিক্ষিত বিজ্ঞানী ভাবাকে তিনি এই বিষয়ে সর্বেসর্বা করে দেন।

ভাবা ভারতের এই আত্মনির্ভর পথকে পরিহার করে আবার সেই প্রাক-১৯৪৭ ব্রিটিশ নির্ভরতার পথ বেছে নিয়ে একটি তামাদি প্রযুক্তির “সুইমিং পুল” ধরনের গবেষণা-নিউক্লিয়ার চুল্লি বানানোর জন্য ব্রিটিশ বিজ্ঞানী কক্রফট-এর সহায়তায় তা ভারতে আমদানি করেন। এটা শুধু একটিমাত্র আমদানি নয়, এর মাধ্যমে আমাদের দেশে, সরকারি ছত্রচ্ছায়ার বাইরে যেসব মুক্ত গবেষণা সাহা-র নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল তাদের নিঃশব্দে মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে দেওয়া হয়। শুরু হয় আমদানি-ভিত্তিক গবেষণা, সরকারি আমলা বিজ্ঞানীরা ঘন ঘন বিদেশ যাওয়ার একটা রাস্তা তৈরি করে ফেলেন। এই বিষয়ে যাতে দক্ষ বিজ্ঞানী মহলে কোনও প্রশ্ন না ওঠে, তা নিশ্চিত করার জন্য নিউক্লিয়ার গবেষণার যাবতীয় দিক সমাজের মুক্ত পরিবেশে চর্চার পরিবর্তে তা ভারত সরকারের অধীনে, প্রতিরক্ষার আওতায় এনে তাকে গোপন গবেষণায় পর্যবসিত করা হয়, ঠিক নিউক্লিয়ার বোমা বানানোর ম্যানহাটন প্রকল্পের আদলে।

ব্রিটেন থেকে আমদানি করা এই নিউক্লিয়ার গবেষণা চুল্লিটির নাম ভারতীয় হওয়া ছাড়া (নাম ছিল অপ্সরা) আর কিছুই ভারতীয় ছিল না, ভারতীয় বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদরা এর টুকরো টুকরো যন্ত্রাংশ কেবল বোম্বাই-তে জুড়েছিলেন। এর জ্বালানি দণ্ড, সমস্ত যন্ত্রাংশ, জুড়ে তোলার নকশা, মায় যন্ত্রাংশগুলিকে জুড়ে তোলার বিশেষ ধরণের যন্ত্র, যেমন বিশেষ স্ক্রু ড্রাইভার, ঝাল দেওয়ার বিশেষ কায়দা, এ সবই এসেছিল ইংল্যান্ড থেকে! তবুও চাচা নেহেরু এবং ভারতের নিউক্লিয়ার সাম্রাজ্যের আমলা বিজ্ঞানীবৃন্দ এটিকে “দেশীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিরাট অর্জন” বলে প্রচার শুরু করে দেয়। ভাবা নিজেই কক্রফট-কে জানান যে এই “অর্জনে” কক্রফটের কৃতিত্বই সর্বাধিক, তাই ভাবা তাঁকে বলেন যে তিনি হয় লন্ডন বা প্যারিসে কক্রফটকে ডিনার খাওয়াবেন, অবশ্যই ভারতীয় জনগণের করের টাকায়! এই সময় থেকেই নিজের দেশের গবেষণার ভিত্তিতে নিউক্লিয়ার চুল্লি তৈরি করার পরিবর্তে বিদেশ থেকে গোটাগুটি প্রযুক্তি আমদানির দিকে ভারত সরকার ঝুঁকে পড়ে মুলত বোম্বের পার্সি আমলা বিজ্ঞানীদের প্ররোচনায়। নিজেদের দেশে, ভারতীয় বিজ্ঞানীদের চেষ্টায় ভারতের অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের খবরদারির বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে যে সব মুক্ত গবেষণা হয়েছিল, তাতে দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে এদেশের নিউক্লিয়ার চুল্লি বানানোর পরিকাঠামো তৈরি করা যেত, কিন্তু তাতে কাট-মানি বা বিদেশ ভ্রমণের এবং ডলার বা পাউন্ড রোজগারের সুযোগ আসত কমে। অতএব, আত্মনির্ভরতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে ভারত কানাডা, মার্কিন দেশ, ফ্রান্স ইত্যদি দেশ থেকে প্রায় বাতিল প্রযুক্তির নিউক্লিয়ার চুল্লি এবং তার জ্বালানি ও যন্ত্রাংশ নিয়মিত কেনার ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হয়ে পড়ে। টাটা ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর পরিবারের থেকেই পরপর কয়েকজন ভারতের অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান হওয়ায় (ভাবা, সরাভাই, শেঠনা) সাহার নির্দেশিত আত্মনির্ভরতা পরিপন্থী পথেই এই আধুনিক বিষয়ে ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণার দিশা নির্দেশিত হয়ে যায়।

অপ্সরা নিউক্লিয়ার চুল্লি

কিন্তু বিষয়টা সম্পূর্ণ বিপরীত হতে পারত। এদেশের অনেক প্রতিভাবান বিজ্ঞানী তাঁদের অধীত বিদ্যাকে প্রয়োগ করে এদেশে নিউক্লিয়ার গবেষণার এক নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিলেন, বিদেশি প্রযুক্তির “কপি-পেস্ট” না করে বিকল্প এবং অধিকতর দক্ষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের উদ্ভাবিত এই সব প্রযুক্তিকে ভারতে উৎপাদনের কাজে না লাগিয়ে মূলত টাটা-র বিভিন্ন সংস্থার নামে আমদানি করার যে নীতি ১৯৪৭ সালের পরে নেহেরুর নেতৃত্বে ভারত সরকার গ্রহণ করে, পরবর্তী সব কটি সরকার (লাল বাহাদুর শাস্ত্রী, ইন্দিরা গান্ধি, রাজীব গান্ধি, চন্দ্রশেখর, আই কে গুজরাল, দেবগৌড়া, ভি পি সিং, নরসিমা রাও, অটলবিহারি বাজপেয়ি, মনমোহন সিং এবং নরেন্দ্র মোদি) সেই একই নীতি অনুসরণ করে চলেছেন। মনমোহন সিং-এর আমলে মার্কিন দেশের সঙ্গে ১২৩-নিউক্লিয়ার চুক্তি তো নিউক্লিয়ার গবেষণার ক্ষেত্রে আমাদের দেশের স্বকীয় উদ্যোগের বিরুদ্ধে চুক্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে অতঃপর আমরা মার্কিন দেশের চুল্লির গবেষণা-লব্ধ তথ্য কেবল বিশ্লেষণ করব! অটলবিহারি এবং মোদির আমলে কৃষি জ্ঞান উদ্যোগ নামক চুক্তির মাধমে আমরা আমাদের নিজস্ব গবেষণা-লব্ধ তত্ত্ব, তথ্য, পদ্ধতি, প্রক্রিয়া ও প্রণালী সমূহ মার্কিন দেশকে দিয়ে দেওয়ার বিষয়ে দায়বদ্ধ হয়ে গিয়েছি। নিউক্লিয়ার জ্বালানির জোগান অব্যাহত রাখার চুক্তি করে আমরা আমাদের নিউক্লিয়ার বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্র, গভীরতা, ব্যাপ্তি এবং উদ্ভাবনের দিকগুলিকে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছি; আমাদের দেশে বসে, আমাদের বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদের দ্বারা যে কোনও নতুন উদ্ভাবন ও আবিষ্কার আগে আমাদের মার্কিন দেশের অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনকে দিয়ে দিতে হবে, তারা সেগুলি পেটেন্ট করবে, তারপর আমরা বিদেশি মুদ্রায় আমাদের তৈরি জিনিস মার্কিন দেশ থেকে কিনব। আমরা দেখেছি দেশের হ্যাল বা হিন্দুস্থান অ্যারোনোটিকস-এর কাছে প্রযুক্তি থাকা সত্ত্বেও আমরা বেশি দাম দিয়ে ফ্রান্সের রাফাল বিমান কিনেছি, আমাদের দেশে আমরা ক্রায়ো মোটর বানানো সত্ত্বেও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার জন্য সেই মোটর আমরা ২০২৮ পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারব না। ইতোমধ্যে মার্কিন দেশ, আমাদের প্রযুক্তিবিদদের নিজেদের দেশে ভাড়া করে নিয়ে গিয়ে আমাদের বানানো ক্রায়ো মোটরের প্রযুক্তির দু ধাপ ওপরের প্রযুক্তিতে পৌঁছে গেছে, ফলে ২০২৮ সালের পরে আমাদের দেশকে আমাদের দেশের প্রযুক্তিই বেশি দাম দিয়ে কিনতে হবে। গত ৭৪ বছর ধরে আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদদের স্বপ্ন ও আত্মত্যাগের বিষয়টির অমর্যাদা করে আত্মনির্ভরতার প্রশ্নে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি এবং যা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তাতে এই আত্মমর্যাদাবোধ বিসর্জনের মাত্রা আরও বাড়তেই থাকবে।

যে প্রবণতাগুলির কথা আমরা নিউক্লিয়ার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বললাম, অন্যান্য ক্ষেত্রে যে তার ব্যতিক্রম ঘটেছে এমনটা নয়। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অন্য একটি ক্ষেত্র হল মহাকাশ গবেষণা, যেখানে ভারতীয় বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের মতোই সামনের সারিতে থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন। নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যেমন টাটা পরিবারের হোমি ভাবাকে নেহেরু সাহার বদলে বেছে নিয়েছিলেন, মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে তেমনি নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের একগুচ্ছ প্রতিভাবান বিজ্ঞানীদের সম্মিলিত প্রজ্ঞাকে উপেক্ষা করে বেছে নেন সেই টাটা পরিবারের বিজ্ঞানী বিক্রম সারাভাইকে, টাটা ট্রাস্ট এবং ভারত সরকারের অর্থানুকূল্যে টাটাদের ব্যবসায়িক কেন্দ্র, আমেদাবাদ শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি, সময়টা ১৯৪৭ সাল। এই প্রতিষ্ঠানটি ক্রমে ক্রমে ভারতের অলিখিত “অসামরিক মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্র” হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সারাভাইদের ছিল ভেষজের ব্যবসা, নানা সূত্রে তারা ব্রিটিশ এবং তাদের হাত ধরে মার্কিন দেশের সঙ্গে নানান ব্যবসায়িক স্বার্থে সংযুক্ত ছিল। যুদ্ধের হাত ধরে, নিউক্লিয়ার প্রযুক্তির মতোই কেবল তাত্ত্বিক জ্ঞানচর্চার আঙিনা ছাড়িয়ে মহাকাশ গবেষণাও ক্ষেপণাস্ত্র বা মিসাইল গবেষণার রাস্তা নিয়েছে। ইংরেজ সরকার কখনওই ভুলতে পারেনি যে, “উন্নত দেশ” ইংল্যান্ডকে প্রযুক্তিতে হারিয়ে দিয়ে সেই কবেই টিপু সুলতান রকেট ক্ষেপণ করে যুদ্ধে জাঁদরেল ইংরেজ সেনাধ্যক্ষদের নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিলেন। সারাভাই চাইছিলেন বিদেশি প্রভাব ও হস্তক্ষেপ এড়িয়ে ভারতের মহাকাশ গবেষণাকে আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে। মার্কিন দেশ যেমন নিউক্লিয়ার গবেষণায় জার্মানি, জাপান বা ইটালির থেকে এগিয়েছিল, কিন্তু ক্ষেপণাস্ত্র গবেষণায় তারা জার্মানির থেকে তো নিশ্চয়ই কয়েক যোজন পেছিয়ে ছিল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মার্কিন দেশ জার্মানির ভি-১ এবং ভি-২ ক্ষেপণাস্ত্রের নকশা, বেশ কিছু অর্ধনির্মিত এই জাতের ক্ষেপণাস্ত্র নিজের দেশে নিয়ে যায়। কিন্তু তাদের দেশে এই বিষয়ে একেবারেই দক্ষ বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ ছিলেন না। তাই জার্মানির নাৎসি সমর্থক ক্ষেপণাস্ত্র-বিশেষজ্ঞ যে সব বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের যুদ্ধাপরাধী বলে আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে বিচার চলছিল, তাদেরকে মার্কিন সৈন্যবাহিনি জার্মানির কারাগার থেকে ছিনতাই করে মার্কিন দেশে নিয়ে আসে। এইরকম একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানীর ঘনিষ্ঠ নাৎসি যোগাযোগ সম্প্রতি জনসমক্ষে এসেছে। যে সংস্থা থেকে মার্কিন দেশের সিআইএ-র জন্ম হয়েছে, সেই সংস্থাটি “অপারেশন পেপারক্লিপ” নামে একটি গোপন সামরিক তৎপরতা মারফৎ ১৬০০ জন জার্মান বিজ্ঞানী ও তাদের পরিবারবর্গকে মার্কিন দেশে নিয়ে আসে। এঁদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত রকেটবিজ্ঞানী ওয়ার্নার ফন ব্রাউন, যিনি জার্মানির পেনামুন্ডাতে ভি-২ মিসাইল বানানোর কাজে সাফল্য পেয়েছিলেন। এই রকেটটিকে এখন পৃথিবীর প্রথম ব্যালিস্টিক মিসাইল হিসেবে ধরা হয়। মার্কিন দেশে এসে বিজ্ঞানী ব্রাউন সেই দেশের সামরিক বাহিনির গবেষণা সংস্থা, অপারেশনস ডিভিশন, মার্কিন সৈন্যবাহিনির ব্যালিস্টিক মিসাইল এজেন্সির ডিরেক্টর পদ অলঙ্কৃত করেন। ইনি কট্টর নাৎসি সমর্থক ছিলেন, এসএস বাহিনির উচ্চপদে ছিলেন এবং শেষ দিন পর্যন্ত নাৎসি পার্টির প্রতি নিষ্ঠাবান ছিলেন। ইনি মার্কিন দেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ, জুপিটার-সি-র সফল উৎক্ষেপণের অন্যতম মুখ্য স্থপতি, মার্কিন দেশের চন্দ্রাভিযানের পেছনে বিজ্ঞানী ব্রাউনের কৃতিত্ব সর্বাধিক।

নাৎসি বিজ্ঞানীরা মহাকাশ গবেষণার সঙ্গে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে মিসাইলের আন্তঃসম্পর্ক প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন।

১৯৫৮ সালের মে ১। ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ভারতের যাবতীয় প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত মৌলিক ও ফলিত গবেষণা সংহত করার অভিপ্রায়ে ডিফেন্স রিসার্চ অর্গানাইজেশান তৈরি করে এবং সেই সংগঠনের সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনির টেকনিক্যাল ডেভেলপমেন্ট এস্টাব্লিশমেন্ট, ডিরেক্টরেট অফ টেকনিক্যাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড প্রোডাকশানকে একই ছাতার তলায় এনে একটিমাত্র কেন্দ্রীভূত প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা গঠন করে। এই সিদ্ধান্তের পেছেনে ব্রিটিশ এবং মার্কিন পরামর্শদাতাদের প্রত্যক্ষ মদত ছিল। এই নতুন সংস্থার নাম হয় ডিআরডিও। ১৯৫৮ সালের শেষে এসে দেখা গেল, ভারতীয় বিজ্ঞানীদের কৃতিত্বে গবেষণার অগ্রগতি হয়েছে চিত্তাকর্ষক, এখন এই সব গবেষণালব্ধ ফলকে ফলিত দিকে এবং প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিতে পরিবর্তিত করা যাবে না। জার্মান প্রযুক্তি কব্জা করার পর মার্কিন দেশ জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে প্রকাশ্যে মিসাইল গবেষণায় অনেক বিধিনিষেধ আরোপ করে, তাই পৃথিবীর কোনও দেশই, একমাত্র মার্কিন দেশ ছাড়া, কেউই আর প্রকাশ্যে মিসাইল গবেষণা চালাতে পারেনি। কিন্তু “মহাকাশ গবেষণা”-র নামে সেই মিসাইল গবেষণার অনেক কিছুই করা সম্ভব, যেগুলি জাতিসংঘ নির্দেশিত নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে না। আমেদাবাদের যে ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবোরেটরির কথা আমরা আগে উল্লেখ করেছি, সেই সংস্থাটিকে ভারতের পরমাণু মন্ত্রকের আওতায় এনে একটি স্বশাসিত সংস্থার স্তরে উন্নীত করে এই সংস্থার মাধ্যমে ভারতের “মহাকাশ গবেষণা”-র পরিচালনা চলে ১৯৬১ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত। ভারত-চিন সীমান্ত সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে ভারতে মিসাইল গবেষণা ভারতের সেনাবাহিনির কাছে অগ্রাধিকার পায়। তখন এই বিষয়ে গবেষণার জন্য প্রয়োজন হয় এমন সমস্ত প্রযুক্তির, যেগুলি আপাতদৃষ্টিতে মহাকাশবিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণাতে কাজে লাগে, কিন্তু এই প্রযুক্তির চরিত্রই এমন যে তার সামান্য পরিবর্তন করলেই সেগুলিকে মিসাইল গবেষণার প্রযুক্তির জন্য ব্যবহার করা যায়। এদের বলে দ্বৈত চরিত্রের প্রযুক্তি, এগুলি জাতিসংঘ মারফৎ আন্তর্জাতিক নজরদারি ব্যবস্থার আওতায় আসে না। আবহাওয়া বিজ্ঞানের গবেষণার প্রযুক্তিও এই ধরণের দ্বৈত প্রযুক্তি। এই দ্বৈত প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে ভারত তার নিজস্ব গবেষণার ফলকে নিজস্ব প্রযুক্তিতে পরিবর্তিত করার আত্মনির্ভর পথটি অনেকাংশে পরিহার করে সেই আমদানিভিত্তিক গবেষণার দিকে ঝুঁকে পড়ে। এর ফল দাঁড়ায় যে নিজস্ব রকেট প্রযুক্তি হাতে থাকা সত্ত্বেও ভারত বিদেশ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র কিনে সেটির “রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং” করে ক্ষেপণাস্ত্র বানানোর রাস্তা নেয় এবং এই উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে সবচেয়ে সরল প্রযুক্তির রাশিয়ান মিসাইল, এমএ-২ কেনা সাব্যস্ত হয়। নিজস্ব প্রযুক্তিকে দূরে সরিয়ে রেখে অনেকটা পেছিয়ে থাকা মিসাইল প্রযুক্তির “রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং” করে ভারত তার রোহিনী-৭৫ সাউন্ডিং রকেট উৎক্ষেপণ করে নভেম্বর ২০, ১৯৬৭। ভারতের “মিসাইল ম্যান”, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম অবশ্য প্রকাশ্যেই ঘোষণা করে দেন যে মহাকাশ গবেষণার জন্য ভারত যে রোহিনী রকেট বানিয়েছে, সেই রকেটের ইঞ্জিন ও তরল জ্বালানি ভারত এখন তার ক্ষেপণাস্ত্র, “পৃথ্বী”-তে ব্যবহার করবে। মনে রাখতে হবে, ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থার বিজ্ঞানীরা নিজস্ব চেষ্টায় ও উদ্ভাবনী শক্তি প্রয়োগ করে যে তরল জ্বালানি ও ইঞ্জিন বানিয়েছিলেন, তা “রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিং” করে বানানো জ্বালানি ও ইঞ্জিনের চেয়ে উৎকৃষ্ট হওয়া সত্ত্বেও ভারত সরকার সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করেনি।

রোহিনী-৭৫

এরপর ভারত মহাশূন্যে পাড়ি দেওয়ার প্রকল্প হাতে নেয়, যেগুলিকে আমরা চন্দ্রায়ন-১ এবং ২ এবং মঙ্গলগ্রহে পাঠানোর মহাকাশযান বলে জানি। আমরা যেন একথা ভুলে না যাই যে মার্কিন দেশের অ্যাপোলো মিশন, যা চাঁদে পাড়ি দেওয়ার কথা বলে শুরু হয়েছিল, সেই প্রযুক্তিই পরে আন্তঃমহাদেশীয় ব্যাকিস্টক মিসাইল প্রযুক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। রাশিয়ার লুনা প্রকল্পের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ভারতও কি তবে সেই একই পথের পথিক হতে চলেছে? ২০১১ সালের ১১ জুন, ভারতের সেই সময়ের চিফ এয়ারমার্শাল পি ভি নায়েকের এই উক্তিটি প্রনিধানযোগ্য। তিনি হিন্দুস্তান টাইমসকে জানান, “ভারতের যেহেতু এখন মহাকাশযান প্রকল্প সফলতার মুখ দেখেছে, আমাদের তাই আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে মন দিতে হবে।“

আমাদের দেশের আধুনিক বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রগুলি চরম গোপনীয়তার আড়ালে থেকে গেছে। এই থেকে সন্দেহ হয় যে এইসব গবেষণার নামে হয়ত অনেক অনৈতিক এবং জনবিরোধী কাজ হয়ে থাকে। আমরা দেখছি যে, যে সব গবেষণায় বেআইনি, দুর্নৈতিকভাবে অর্জিত অর্থের লেনদেন রয়েছে, আমাদের কর্তাব্যক্তিদের সেই সব গবেষণাক্ষেত্রের দিকেই উৎসাহ বেশি। এর মধ্যে অন্যতম হল যুদ্ধাস্ত্র গবেষণা। এই জাতীয় ক্ষেত্রের গবেষণাগুলি জনকল্যাণমূলক গবেষণা খাতের টাকা গিলে খায় আর এই জাতীয় গবেষণা দেশকে আত্মনির্ভর করার বদলে পরনির্ভর করে তোলে। খুবই পরিতাপের বিষয় যে ক্ষুদিরাম-কানাইলাল-ভগৎ সিং-রাজগুরু-সুখদেব সহ আরও অসংখ্য পরিচিত নামের এবং নাম-না-জানা যে অসংখ্য দেশপ্রেমিকরা আমাদের আত্মনির্ভর জাতি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন, সেই ঘটনাকে স্মরণ করে আজ সেই যাত্রাপথের ৭৫ বছরের শুরুতে আমাদের বলতেই হচ্ছে যে অন্তত বিজ্ঞান-প্রযুক্তির মতো অশেষ জনকল্যাণকারী বিভাগে আমরা আত্মনির্ভরতার বিপরীতে পরাধীন অবস্থার চেয়েও বেশি পরনির্ভরতাকে নীতি হিসেবে চয়ন করেছি।

আমাদের কৃষি গবেষণা, জলসম্পদ ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা, পরিবহন গবেষণা, সব কিছুতেই আমাদের আত্মনির্ভতার পরিবর্তে পরনির্ভরতার প্রবণতা প্রকট। কৃষির ক্ষেত্রে আমরা দেশীয় গবেষণাকে অগ্রাধিকার না দিয়ে মার্কিন দেশের পরামর্শকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছি। এই বিষয়ে একটু বিস্তৃত বলার অবকাশ রয়েছে।

আসন্ন ক্ষমতা হস্তান্তরের পর ভারতের রাজনীতি-অর্থনীতি কেমন দিশায় গড়ে তোলা দরকার, সেই মর্মে ১৯৪৪ সালেই ভারতের দুই মুখ্য শিল্প গোষ্ঠী, টাটা এবং বিড়লা পরিবার দুজনে একত্রে “বোম্বে” পরিকল্পনা বা টাটা-বিড়লা পরিকল্পনা কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দের কাছে পেশ করে। সেখানে বড় ব্যবসাকে স্বাধীন ভারতের কী দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ, ভারতের আর্থিক পরিকল্পনা কেমন হলে তা বড় ব্যবসা এবং ভারী শিল্পের সহায়ক হতে পারে, সেই মর্মে স্পষ্ট সুপারিশ করা হয়। ১৯৪৭-এর আগস্ট মাসের পর ভারতে সোভিয়েট রাশিয়ার আর্থিক পরিকল্পনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশের ধারণা অনুসারে ও নেতৃত্বে ভারত সরকার পাঁচশালা পরিকল্পনার সূচনা করে। দেশের মানুষের তখন স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা একেবারে তুঙ্গে, তারা ধরে নিয়েছিল যে স্বাধীনতার প্রাক্কালে নেহেরু বর্ণিত “মহাকালের সঙ্গে বোঝাপড়া” করা হবে ঔপনিবেশিক রীতিনীতির সঙ্গে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাহারযোগ্য বিচ্ছেদ ঘটিয়ে।

কিন্তু আশাভঙ্গের শুরু একেবারেই প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়ে যায়। ভারতের আর্থিক বিকাশ ও তার প্রবৃদ্ধির মাপকাঠি কেমন হবে, সে সব জানা-বোঝা-নির্ণয়ের জন্য ডাক পড়ে মার্কিন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়, এমআইটি-র, আর তাদের সুপারিশেই হয়তো বা সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ল ফোর্ড ফাউন্ডেশান। যে স্বাধিকার এবং অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের জন্য ১৯৪৭ সালের আগের ১৯০ বছর অগণিত স্বাধীনতাপ্রেমী মানুষ আত্মাহুতি দিন, তাঁদের স্বপ্নকে ছুঁড়ে ফেলে দি্যে স্বাধীন ভারতের সরকার স্বাধীনতার প্রথম বছগুলিতেই দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েই মার্কিন হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দিলেন। মার্কিন দেশের সঙ্গে এই জাতীয় সমঝোতা সম্পন্ন হওয়ার পর পরই প্রধানমন্ত্রী নেহেরু বিবৃতি দিয়ে বললেন, এখন থেকে বেশ কিছু বছর ভারতের যোজনা পর্ষদকে মার্কিন সেনেটের এক উপাংশ হিসেবে গণ্য করতে হবে। এই সমঝোতার ফলে ভারতের কৃষিক্ষেত্রটি সর্বপ্রথম তার স্বাধীন বিকাশের অধিকার হারায়।

নেহেরু এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেস দ্রুত অনুধাবন করে যে ভারতের মতো দেশে সংসদীয় পথে রাজনীতি পরিচালিত করতে পারার গুরুত্ব কতখানি এবং সেই জাতীয় রাজনীতিতে টিঁকে থাকতে হলে রাজনীতিকদের তার নিজ নিজ নির্বাচনী ক্ষেত্রকে কেমনভাবে “যত্ন” করতে হবে। ফোর্ড ফাউন্ডেশনের এবং এমআইটি-র পরামর্শে নেহেরু এই দুই সংস্থাকে তাদের নানা ধরনের অপ্রমাণিত কৃষিপ্রযুক্তি নিয়ে ভারতের চাষের জমিতে সেগুলির “ফিল্ড ট্রায়াল” করার ব্যবস্থায় রাজি হয়ে যান। স্বভাবতই তিনি প্রথমে তাঁর নির্বাচনী ক্ষেত্রের অন্তর্গত এটাওয়া-কে বেছে নেন। কৃষিক্ষেত্রে এই মার্কিন আবাহনের দীর্ঘকালীন প্রেক্ষিতে ফল হয়েছে মারাত্মক, সেদিনের সেই ছোট নীতিগত সিদ্ধান্তের ফলে আজকে আমরা দিল্লি সীমান্তে দলে দলে কৃষকর বিক্ষোভে ফেটে পড়তে দেখছি! যেসব অপ্রমাণিত কৃষিপ্রযুক্তি নিয়ে মার্কিন দেশ ভারতের মাটিতে পরীক্ষানিরীক্ষা চালাচ্ছিল, মাঠস্তরে সেই প্রযুক্তির রূপায়ণ একেবারেই সফল হয়নি, কিন্তু অনেকগুলি মার্কিন বহুজাতিক সংস্থা এই প্রযুক্তির পেছনে অনেক টাকা লগ্নি করে বসে আছে। এদের চাপে ফোর্ড ফাউন্ডেশান ভারতে সেইসব ব্যর্থ প্রযুক্তি চালান করে দেওয়ার জন্য এক দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প বা “প্যাকেজ” হাজির করে। এই প্যাকেজের প্রথম অংশ ছিল, চলমান কৃষি গবেষণাগারের মাধ্যমে ভারতের কৃষিক্ষেত্রের উর্বরতা পরিমাপ করা, এর জন্য একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, জেনারেটর সহ বিরাট গাড়িতে মাটির উর্বরতা মাপার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সাহায্যে চটজলদি তা করা যেত। এই গাড়িটি একটি চাষের জমির আশপাশ থেকে অন্য চাষের জমির আশপাশে দাঁড়িয়ে থেকে কৃষকদের জমি থেকে মাটির নমুনা তুলে তা পরীক্ষা করে দিত। পরে ভারত সরকার মার্কিন সংস্থার কাছ থেকে এই রকম বহু “মোবাইল সয়েল ফার্টিলিটি ডিটেকশান ল্যাবরেটরি” বিদেশি মুদ্রা ব্যয় করে খরিদ করে। এইভাবে মার্কিন দেশের পরামর্শদাতাদের প্ররোচনায় এবং দেশের স্বাধীন বিজ্ঞানীদের উপদেশ উপেক্ষা করে ভারতের কৃষিক্ষেত্রের স্বাধীনতা বিসর্জনের প্রথম অঙ্কের নাটকের সমাপ্তি ঘটে।

মোবাইল সয়েল ফার্টিলিটি ডিটেকশান ল্যাবরেটরি

মার্কিন দেশের প্রস্তাবিত প্যাকেজটিতে ভারতের কর্তাব্যক্তিদের আপত্তির বদলে অতি উৎসাহের কথা টের পেয়ে মার্কিন প্রশাসন হাল ধরে। ঠিক যেমন এক সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ভারতের শাসনভার এক সময়ে ইংল্যান্ডের মহারানি অধিগ্রহণ করেন, সেই একই কায়দায় এমআইটি ফোর্ড ফাউন্ডেশানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানের পরিবর্তে এখন সেই ভার নেয় মার্কিন দেশের টেকনিক্যাল কো-অপারেশন মিশন। এরপর ফোর্ড ফাউন্ডেশন প্যাকেজের আরও বহুমুখী এবং আর্থিক দিক থেকে মার্কিন সংস্থাগুলির কাছে আরও লাভজনক দ্বিতীয় প্রকল্পটি রূপায়ণের জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ করে। মাটির উর্বরতা মাপার যে মোবাইল পরীক্ষাগারগুলি ভারত কিনেছিল, সেগুলি চালানোর জন্য দক্ষ টেকনিশিয়ান এবং তথ্য বিশ্লেষণের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানের বিজ্ঞানীদের সংখ্যা তখন ভারতে বেশি ছিল না। মার্কিন দেশ বলে যে, যে সব কোম্পানি ভারতকে এই সব যন্ত্র বেচেছে, সামান্য অর্থের বিনিময়ে তারা ভারতের টেকনিক্যাল স্টাফ এবং বিজ্ঞানীদের এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দেওয়ানোর ব্যবস্থা করে দেবে। এই শিক্ষা সম্পূর্ণ হলে তখন এই পরীক্ষাগার ব্যবহার করে সারা ভারতের প্রতিটি চাষের জমির উর্বরতা মেপে ভারতের কৃষিজমির এক উৎকৃষ্ট উর্বরতা মানচিত্র নির্মাণ সম্ভব হবে এবং বছর বছর উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ অনুমান করার কাজটিও অনেক বাস্তবসম্মত হবে।

সবই ঠিক ছিল, কিন্তু গোলমালটা লুকিয়েছিল একেবারে গোড়াতে। যে ধরনের যন্ত্র দিয়ে ভারতের মাটির উর্বরতা মাপার চেষ্টা চলছিল, সেই ধরনের যন্ত্রের যা দক্ষতা, সূক্ষ্মভাবে মাপার ক্ষমতা, তা ঠিক হয়েছিল যথাক্রমে কানাডা এবং মালয়েশিয়ার জমির মাটিকে আদর্শ ধরে নিয়ে আর সেই দুই দেশের চাষের জমির মাটির সঙ্গে ভারতের চাষের জমির মাটির চরিত্রের আসমান-জমিন ফারাক না হলেও একতলা আর ১০০ তলার ফারাক ছিল আর ফসলের জন্য সেই ফারাককে আসমান-জমিন ফারাক বলেই কৃষিবিজ্ঞানীরা মেনে থাকেন!

এই নিম্নমানের যন্ত্র দিয়ে মাপজোক করে ভারতের চাষের জমির মাটির নমুনা নিয়ে জমির উর্বরতার মানচিত্র তৈরির কাজ চলতে থাকে। তিন বছর পরে দেখা যায় যে এই সব মাপজোকের মধ্যে তেমন সমতা নেই, সমান সূক্ষ্মতায় সেগুলির পরিমাপও করা যায়নি, রাশিবিজ্ঞান মতে এই তথ্য থেকে কাজের কোনও কিছু বের করা কার্যত অসম্ভব।

যে সব বিজ্ঞানী এবং টেকনিশিয়ানরা বিভিন্ন মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সব যন্ত্রপাতি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের বোঝানো হয়েছিল যে এই ট্রেনিং ম্যানুয়ালে বিভিন্ন মাপজোকের যে মান লেখা আছে, তাই দেখে বুঝতে হবে কোন কোন নমুনায় কী কী “মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট” কম হয়ে গেছে এবং সেই “দোষ” শোধরানোর উপায় কী! তাদের আশা মতো এই সব প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এলিটবৃন্দ বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করে সরকারকে বোঝায় যে ভারতের মাটির উর্বরতা কমেছে ভয়াবহভাবে, কিছু একটা না করলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই ভারত আবার সেই “ছিয়াত্তরের মন্বন্তর”-এর যুগে ফিরে যাবে! অতঃপর মার্কিন প্যাকেজের তৃতীয় স্তরটি শুরু হয়ে গেল। এইসব বিজ্ঞানীরা নিদান দিলেন যে এই “মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট” ঘাটতি “পূরণের জন্য” প্রয়োজন জমিতে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করা। ব্যস, অমনি আমাদের দেশে চলে আসা চাষিদের পরম্পরাগত প্রজ্ঞা, দেশীয় বিজ্ঞানীদের বিকল্প এবং সস্তা নিদান আবারও উপেক্ষিত হল এবং প্রথমে আমদের কর্তারা মার্কিন দেশ থেকে বিপুল পরিমাণে রাসায়নিক সার আমদানি শুরু করলেন এবং পরে দেশীয় বিজ্ঞানীদের বাদ দিয়ে বিদেশি পরামর্শদাতা এবং মার্কিন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষিবিজ্ঞানীদের সহায়তায় এদেশে বিদেশি প্রযুক্তিতে রাসায়নিক সার কারখানা শুরু করলেন। এদেশের কৃষিবিজ্ঞানীদের একাংশের মত ছিল যে এই প্রক্রিয়ায় মাটির উর্বরতা বৃদ্ধির পরিবর্তে দীর্ঘকালীন প্রেক্ষিতে তা মাটির উর্বরতা কমিয়ে দেবে। পৃথিবীর যে যে দেশে এই মার্কিন প্যাকেজের অনুশীলন হয়েছে, আজ তিন দশক পরে দেখা যাচ্ছে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের অনুমান কতটা নির্ভুল ছিল। এই বিষয়ে কৃষিবিজ্ঞানী ডঃ বিনোদ শা খুবই তীব্র ভাষায় এই প্যাকেজের ক্ষতিকর দিক নিয়ে সরব হন। ভারত সরকারের আমলাবৃন্দ ডঃ শাহকে সবদিক থেকে নাস্তানাবুদ করে তোলে, নানারকম অভিযোগ করে, বদলি করে, তাঁর পাসপোর্ট আটক করে, তাঁকে বিজ্ঞানীদের সম্মেলনে গবেষণাপত্র পড়ার অনুমতি না দিয়ে চূড়ান্ত হেনস্থা করে। অবশেষে অবসাদগ্রস্ত অবস্থায় তিনি ১৯৭২ সালে আত্মহননের পথ বেছে নেন। এরকম ঘটনা আরও অনেক বিজ্ঞানীর ক্ষেত্রেই ঘটেছে।

ডঃ বিনোদ শা

এই পুরো প্যাকেজটিকে আজ আমরা “সবুজ বিপ্লব” বলে চিনেছি। উচ্চফলনশীল বীজ, তার জন্য প্রয়োজনীয় জল সরবরাহের জন্য ডিজেল পাম্পসেট, ফল বাড়ানোর জন্য বিপুল পরিমাণে রাসায়নিক সার, ক্ষেতের পোকা মারার জন্য কীটনাশক— এই বিপুল আয়োজন নিয়ে এই প্যাকেজ, এর প্রতিটি স্তরে আজকের ভারতে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিগুলি একচেটিয়া আধিপত্য। আমরা দেখেছি এই কীটনাশক তৈরি ফাঁদে পা দিয়ে কেমনভাবে ভুপাল শহরে কীটনাশক কারখানার বিষবাষ্পে এক রাতে কমবেশি ১৫ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে বলে ভারত সরকার স্বীকার করেছে!

এত কিছু করেও ভারতের কৃষিক্ষেত্রটিকে পুরোপুরি বিদেশি কব্জায় নিয়ে যাওয়া যায়নি। স্বাধীনতার ৭৫ বছরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এদেশের কর্তাব্যক্তিরা এগ্রিকালচারাল নলেজ ইনিশিয়েটভ বা কৃষি জ্ঞান উদ্যোগ নামক একটি ভারী মোড়কে সেই কাজটি সম্পন্ন করেছেন গত এক দশক ধরে। এই জ্ঞান উদ্যোগের মাধ্যমে ভারত সরকার পুনরায় মার্কিন সহায়তায় দেশীয় প্রযুক্তি, দেশীয় বিজ্ঞানীদের পরিবর্তে বিদেশি সংস্থার মাধ্যমে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ শিথিল করে দিয়ে কৃষি ও ব্যাপক অর্থে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, অনুসারী দ্রব্য সংক্রান্ত গবেষণা, জৈব প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ পরিকল্পনার জন্য একগুচ্ছ মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় ও মার্কিন বহুজাতিক সংস্থার অধীনে কাজ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং সেই দিকে গত আট বছরে কাজ শুরু হয়ে গেছে। আজকের নয়া কৃষি বিল, নয়া শিক্ষানীতি সেই জ্ঞান উদ্যোগ রূপায়ণের একটি বড় ধাপ। ভারতের কৃষি মন্ত্রকের কিছু বিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদ এই উদ্যোগের ফলে ভারত কী পেল তার একটা হিসেব কষেছেন, সময়কাল ২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল। (এই “দোষ”-এর শাস্তি হিসেবে এই গোষ্ঠীর বিভিন্ন ব্যক্তিকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অন্যান্য কাজে নিযুক্ত করে তাঁদের সম্মিলিত উদ্যোগকে ধাক্কা হিয়ে সেটিকে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে, ফলত এই বিষয়ে আর কোনও সরকারি সমীক্ষা নেই!)

এই সময়কালে ভারত সরকার কৃষি বিষয়ক গবেষণাখাতে প্রতি বছর ব্যয় করেছে বছর পিছু ১০০০ কোটি টাকা। এই টাকায় মার্কিন বহুজাতিক সংস্থা, ভারতের গবেষণাগারে, ভারতীয় বিজ্ঞানীদের দিয়ে, ভারতের বিজ্ঞান পরিকাঠামো ব্যবহার করে তিনটি পেটেন্ট স্বত্ত্ব পেয়েছে, গোটা চারেক আবেদন বিবেচনাধীন ছিল। এই মেধাস্বত্ত্বের জন্য তারা এক পয়সাও লগ্নি করেনি, কিন্তু পেটেন্ট-এর দাবিদার তারা একাই, ভারত সরকারের বা ভারতীয় বিজ্ঞানীদের এই বিষয়ে কোনও ভাগিদারিত্ব নেই! গত আট বছরে ভারত সরকারকে জ্ঞান উদ্যোগ চুক্তির জন্য বাধ্যতামূলকভাবে বছরে ১১ কোটি মেট্রিক টন গম আমদানি করতে হয়েছে মার্কিন সংস্থা ড্যানিয়েল আর্চার মিডল্যান্ড সংস্থা থেকে, যে সংস্থা মার্কিন দিক থেকে এই জ্ঞান উদ্যোগের “পার্টনার”। এর ফলে পাঞ্জাব রাজ্যটি থেকে সারা দেশে গম রপ্তানি কমেছে ৩৩ শতাংশ। তাই এ কথা মোটেই বিস্ময়ের নয় যে আজ দিল্লি সীমান্তে পাঞ্জাবের সব বর্গের কৃষকরা কৃষিপণ্যের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের দাবিতে অনড় অবস্থান নিয়েছেন!

আরও আছে। জৈব প্রযুক্তিজাত বিটি বেগুন ছাড়াও আমরা আর যেসব সবজি সারা বছর ধরে খাই, এমন আরও ৭০টি সবজি নিয়ে ভারতীয় অর্থ ধ্বংস করে আর একটি “পার্টনার”, মনসান্টো সংস্থা গবেষণা চালাচ্ছে। চুক্তি মতে এই গবেষণার যাবতীয় মেধাস্বত্ত্বের অধিকারী হবে এই বহুজাতিক সংস্থাটি, সেই প্রযুক্তি বাজারের দরে কেনার ব্যাপারে ভারত কিছুটা অগ্রাধিকার পাবে! এই হল কৃষিক্ষেত্রে আমাদের আমাদের আত্মনির্ভরতার কাহিনি!

ফোর্ড ফাউন্ডেশন যখন আমাদের দেশে নতুন করে কৃষিকে বিন্যস্ত করার নিদান দেয়, তখনই আমাদের দেশে বড় ড্যাম, বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, ব্যারেজ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি রূপায়ণের প্রস্তাব দেয়। একে একে এসে হাজির হয় ভাকরা-নাঙ্গাল, ইন্দিরা ক্যানেল, বর্গি ড্যাম, নর্মদা ড্যাম, টেহরি ড্যাম সহ আরও হরেক কিসিমের ড্যাম; প্রায় সর্বত্র বিশ্বব্যাঙ্ক, আন্তর্জাতিক অর্থকোষ, বেসরকারি ঠিকাদার এবং বিদেশি পরামর্শদাতা। ফলে আমরা দেখেছি নর্মদা প্রকল্পের জন্য প্রায় ৫ হাজার গ্রাম এখনই অধিবাসীশূন্য, যে পরিমাণ জমি সেচের আওতায় আসবে বলে এত আয়োজন করে ড্যাম নির্মাণ, ড্যামের ৮৭ শতাংশ নির্মিত হওয়ার পরও মাত্র ১১ শতাংশ জমি সেচের আওতায় এসেছে, এই ১১ শতাংশের ৯৫ শতাংশই শুখা তালুকে নয়। উত্তরাখন্ড এবং হিমাচল প্রদেশের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলির জন্য সেই রাজ্যগুলির দুর্দশা কহতব্য নয়। এখনও, এই জুলাই মাসে ধরমশালাতে কী বিপুল জলোচ্ছ্বাস চলছে, অন্তর্জালে তার ভয়াবহ চিত্র প্রতিদিন দেখা যাচ্ছে। মেঘনাদ সাহা বা প্রযুক্তিবিদ কপিল ভট্টাচার্য বিদেশি সহায়তার দামোদর ব্যারাজ প্রকল্পের কী দূর্দশা হতে পারে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে সে বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, যা আজ অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে। কিন্তু তবুও মেঘনাদ সাহাকে এই বিষয়ে কোনও ভাবেই যুক্ত করা হয়নি, আর কপিল ভট্টাচার্যের কপালে জুটেছিল পাকিস্তানের গুপ্তচরের দুর্নাম!

মাদ্রাজ, যা আজকের চেন্নাই শহর, সেখানে ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়াররা অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে শহরের প্রান্তের জলাভূমি বুজিয়ে দিয়ে, দূরের নদী থেকে কৃত্রিম পদ্ধতিতে অনেক বাঁধ ও জলাধারের সমাহার ঘটিয়ে একটি “আধুনিক” শহরের পত্তন ঘটালেন। আর পাশের রাজ্য মহীশূরে দেশীয় রাজার অধীনে, প্রযুক্তিবিদ বিশ্বেশ্বরাইয়া সিমেন্টের অনুপস্থিতিতে লোকবিজ্ঞানের পরম্পরাগত জ্ঞান ও স্থানীয় কারিগরদের দিয়ে দীর্ঘ এক বাঁধ বানালেন গত শতকের তিরিশের দশকে, যা আজও বহাল থেকে তার কাজের ৮০ শতাংশ করে চলেছে, যেকোনও “আধুনিক” বাঁধের চেয়ে তার আয়ু অনেক বেশি। অন্যদিকে, তামিলনাড়ুর শহর চেন্নাই, বছর বছর বন্যার কবলে বেহাল, পানীয় জলের হাহাকার, কেরল আর কর্নাটক সরকার রেলগাড়ি করে পানীয় জলের জোগান দিয়ে বন্যার সময় এবং অন্যান্য সময়ে রাজ্যটিকে পরিব্যাপ্ত খরার হাত থেকে বাঁচাচ্ছে। এতদসত্ত্বেও আমাদের কর্তাব্যক্তিরা বিশ্বব্যাঙ্কের পরামর্শদাতাদের মহাজ্ঞানী ব্রহ্মার আসনে বসিয়ে গঙ্গা, সিন্ধু, নর্মদা, কাবেরী, ব্রহ্মপুত্রর দেশ ভারতের জন্য টেমসের, সাইনের মতো খালের দেশের প্রযুক্তিকে আমাদের দেশের মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশের জন্য সুপ্রযুক্ত বলে মনে করছেন। হায় রে আমাদের আত্মনির্ভরতা আর স্বাধীনতা!

বিশ্বেশ্বরাইয়া

স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে লাল কেল্লার মাথায় যখন এই সব কর্তাব্যক্তিরা গুরুগম্ভীর বক্তব্য সহযোগে তেরঙা পতাকা উত্তোলন করবেন আর তাদের বিদূষকবৃন্দ যখন হাততালিতে আকাশ নিনাদিত করবেন, তখন কি আমাদের মনে পড়বে বসন্ত বিশ্বাসের কথা, চন্দ্রশেখর আজাদের কথা, যতীন দাসের কথা, যাঁরা মনেপ্রাণে এক স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে, আত্মনির্ভর জাতির, এক মাথা উঁচু করে স্বাধীনতার কথা বলার হিম্মত দেখিয়েছিলেন। ৭৫ বছরের মোচ্ছবে এই প্রতারিতদের হবে না নিমন্ত্রণ?

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...