Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

চাঁদ, তারা, ফুল, পাখি

চাঁদ, তারা, ফুল, পাখি -- অলোকপর্ণা

অলোকপর্ণা

 

 

জুতোচোরের লেখা কবিতা

শীত এমন, যে হাড়ে মজ্জায় গেঁথে যায়। আর ভোলা যায় না। হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকের মতো সঙ্গে সঙ্গে চলে। ছায়ার চেয়েও অতিরিক্ত লেপ্টে জড়িয়ে থাকে। নাছোড়। হাত থেকে বারবার ঝাড়লেও যেতে চায় না। কে যেন পিছে লেলিয়ে দিয়েছে এমন শীত। এমনই শীত করে রূপার যখন তার মনে পড়ে, গোল্ডি তাকে একদিন মেরে ফেলবে। একেবারে মেরে ফেলবে। কোনও দয়া দেখাবে না। যেভাবে মানুষ কাঁচালঙ্কা থেকে লঙ্কার বোঁটা ছিঁড়ে ফেলে, অথবা বাবল র‍্যাপ ফাটিয়ে ফেলে, অথবা পার্কের বেঞ্চে বসার আগে যেভাবে হাত দিয়ে ধুলো ঝাড়ে, তেমন নির্বিকার অনায়াস এবং চিরায়ত পন্থায় গোল্ডি রূপাকে মেরে ফেলবে সেইদিন। যখন কিছু করার থাকে না, রূপা চুপ করে বসে গোল্ডির ওই জলের মতো মুখ মনে করে, আর, যেন সেই মুখ মনে করার স্পর্ধা দেখে, এক কোপে গোল্ডি ওর ধর থেকে মাথা আলাদা করে দেয়। রূপার ঘাড় থেকে মাথাটা টুক করে পিছলে পড়ে, যেন ফুল, এতকাল ফুটে ছিল, সবে মূর্ছা গেছে। রূপার ঘাড় থেকে মাথাটা মাটিতে ঝরে পড়ে ড্রপ খায় না, বরং একটাকার কয়েনের মতো টলমল করে করে স্তব্ধ হয়ে যায়। রূপা চোখ বুজে দেখতে পায়, তার নিজস্ব কাটা মুন্ডু চুপ করে গোল্ডির হাতে ধরা শাণিত তরোয়ালের দিকে চেয়ে আছে। কিঞ্চিৎ ঈর্ষিত।

মাথা চুলকাতে চুলকাতে রূপা মুড়ি খায়। একটা কাক আসছে আজকাল। রূপা তাকে দেখে দেখে এখন এমন দক্ষ যে হাজার কাকের বৈঠকে সে এই বিশেষ মুড়িখেকো কাককে আলাদা করতে পারবে। কেউ কেউ পারে। কেউ কেউ যেমন সেলাই পারে, পারে উল বুনতে, বাগান করতে, কবিতা, গদ্য, গল্প লিখতে, স্মৃতি রোমন্থন করতে, তেমন অবলীলায় রূপা কাকের একান্নবর্তী পরিবার থেকে কাককে আলাদা করে নিতে পারে। কাকটা আসে, রূপা মেঝেতে মুড়ি ছড়িয়ে দেয়, কাক খায়, কাক উড়ে যায়।

আজ মিথিলা কাজে যায়নি। মিথিলার সাইকেলটার রং আকাশি। রূপার ভালো লাগে আকাশি যেকোনও কিছু। মানুষের পায়খানা বা মানুষের কফও যদি আকাশি রঙের হত, রূপার তা ভালো লাগত। রূপা মিথিলার সাইকেলটা দেখে আর ভাবে সাইকেলের হাতলে, রডে, প্যাডেলে, সিটে, চেইনে, বাস্কেটে, বেলে, স্পোকে কামড়ে দেবে। কড়মড় করে আকাশি রঙের সাইকেল একদিন খেয়ে ফেলবে রূপা। খাওয়া হয়ে গেলে স্পোক দিয়ে দাঁত খুঁচিয়ে দাঁতে আটকে থাকা সাইকেলের মাংস বের করে আনবে। মাঝেমাঝে মিথিলার অনুমতি নিয়ে রূপা এই ধান্দাতেই সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যায়।
যশোর রোড পার করে গঙ্গানগরের দিকে ধেয়ে যায় মিথিলার আকাশি সাইকেল। রূপা জানে, পঞ্চাশ বছর আগে এইখানে এইসব রাস্তা ছিল না। বাবা গল্প করে, আগে শিয়াল ডাকত। রূপা শিয়াল দেখেনি টিভিতে ছাড়া। কমলা রঙের শিয়ালের কথা ভেবে আগুন মনে হয়। ভয় করে না, গরম লাগে। সাইকেলের প্যাডেল চাপতে চাপতে রূপা এখন হাঁপাচ্ছে। পঞ্চাশ বছর পর এইখানে এখন কাঁটাতার দেওয়া দেড় মানুষ সমান উঁচু পাঁচিল। তার ওপারে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে। রূপা ইটের গাদায় চড়ে চুপ করে বসে আকাশ কাঁদানো প্লেন দেখে। প্লেনের কুট্টি কুট্টি জানালা দরজা। সেখান থেকে যে কেউ রূপার দিকে এই মুহূর্তে তাকিয়ে থাকতে পারে। অজানা আনন্দে রূপার গায়ের লোম খাঁড়া হয়ে যায়। অজানা আতঙ্কে রোমের মেক্সিকান ওয়েভ তার পিঠ বেয়ে পাছায় নেমে যায়। রূপা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে নেয় আকাশি রঙের সাইকেল ঠিক আছে কি না।

এরকম ভয় আগে হয়েছিল যেদিন রূপার চটি চুরি হয়ে গেল। দক্ষিণ কলকাতার এক নামজাদা সভায় সবাই সিঙারার মতো মুখ করে মাথা নাড়ছে, রূপাও তখন সিঙারা। লাল টক মিষ্টি চাটনিবিহীন— শুষ্ক। সভা শেষে করমর্দন। পৃথিবীর সব সিঙারা এক হও। বাইরে বেরিয়ে এদিকওদিক তলাশ করে রূপা সিদ্ধান্তে পৌঁছোয়, তার জুতো চুরি গেছে। আর সঙ্গে সঙ্গে রূপার পিঠ বেয়ে লোমের মেক্সিকান ওয়েভ…

রূপা জানে, চুরি করতে গিয়ে হিসেব কষে সবসময় দুপাটি জুতো একসঙ্গে চুরি করে বলে, জুতোচোর কক্ষনও কবিতা লিখতে পারবে না।

 

মে মাসের বরফ

মিথিলা বিরক্ত হয় যখন রূপা তার সাইকেল ধার চায়। কারণ সাইকেল নিয়ে রূপা কোনও কাজে যায় না সে জানে। অহেতুক তার সাইকেল নিয়ে রানওয়ের ধারে বসে থাকা মিথিলার পছন্দ নয়। তার নিজের পয়সায় কেনা সাইকেল রূপা বারবার ধার চাইলে মিথিলার পেট গুরগুর করে। পৃথিবীর তাবর সব বেলুন ফট ফট করে ফাটিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়, মুখ থেকে মাটিতে ছুড়ে ফেলা পৃথিবীর সমস্ত সিগারেটের পাছার আগুন পা দিয়ে পিষে পিষে দিতে ইচ্ছে করে, কিন্তু মিথিলা না করতে পারে না। তার চোখের সামনে দিয়ে তার সবুজ সাইকেল নিয়ে রূপা গঙ্গানগরের দিকে চলে যায়। ঘন্টাখানেক সেখানেই পড়ে থাকে। তারপর একসময় কাজের ফাঁকে মিথিলা দেখে সাইকেলটা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে তাদের বারান্দায়। সাইকেল ফেরত দেওয়ার সময় রূপা মিথিলাকে কখনও ডাকে না। নিঃশব্দে দিয়ে চলে যায়। একবার থ্যাঙ্ক ইউও বলে না। অবশ্য বলবেই বা কেন, রূপার তো কোনও কাজে সুরাহা করে না সাইকেলটা। সাইকেল ধার নিয়ে রূপার কোনও লাভ হয় না। তবু রূপা নেয়। আর মিথিলা দেয়। বিউটিশিয়ান কোর্স করার পর দুই মাস লেগেছিল মিথিলার এই সাইকেল কিনতে। নাহলে পায়ে হেঁটে বিলকান্দা থেকে সাহারা ঘোষপাড়া অঞ্চল টহল দেওয়ার পর রাতে বাড়ি ফিরে মিথিলার আর খাবার বানাতে ইচ্ছে হত না। জল মুড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ত। দুমাস পর একদিন রাত দশটার সময় বাড়ি ফেরার অন্ধকার পথে কুকুর কামড়াল।

একটা ইঞ্জেকশনের দাম তিনশো টাকা।

মিথিলাকে সাইকেলের দোকানে নিয়ে গিয়ে তার বর কুন্তল দেখেশুনে এই সবুজ সাইকেল বেছে দিল। পাঁচ মাসে বারোশো টাকা দিয়ে দিয়ে সাইকেল এখন মিথিলার। তারপর এক ছুটির দিনে রূপা এসে আবদার জানাল সাইকেল নিয়ে ঘুরতে বেরোবে, আবার ফেরত দিয়ে যাবে। সেই শুরু। মিথিলার ছুটির দিনগুলোয় রূপা গঙ্গানগর যায়। মিথিলা টগবগ করতে করতে ঘরের কাজ সারে। মেয়ের মাথার চুল আঁচড়াতে গিয়ে হেঁচকা চিরুনি চালায়, মেয়েটা কেঁদে ওঠে। মিথিলার বর ঘরে থাকলে এতে বিরক্ত হয়। মেয়ের কান্নায় মিথিলার রাগ আরও বাড়ে। মেয়েটা দিন দিন ছিঁচকাঁদুনে হচ্ছে। দু ঘা দিতে মন চায়, কিন্তু কুন্তলের কথা ভেবে মিথিলা আত্মসম্বরণ করে। রাতে ঘরের দরজা দেওয়ার আগে মিথিলা একবার সাইকেলটার কাছে আসে। সাইকেলের সবুজ হাতল, সবুজ পাদানি, সবুজ সিট, সবুজ বাস্কেট, সবুজ স্পোক, সবুজ চেইন, সবুজ ব্রেক, স্টিলের বেল— সবেতে হাত বোলায়। সাইকেলটা ঠান্ডা হয়ে থাকে। মিথিলাও স্তিমিত হয়। মিথিলা জানে রূপা সবুজ সাইকেলকে আকাশি দেখে। আর আকাশি রূপার সবথেকে প্রিয় রং। মে মাসের সেই রাতে মিথিলা হঠাৎই ঠিক করে, পুজোর বোনাস পেলে সাইকেলটাকে মেরুন রং করে নেবে। এই উপায় মিথিলাকে আরাম দেয়, আক্রমণাত্মক করে। সেই রাতে, দরজা বন্ধ করে মিথিলা বিছানায় গিয়ে কুন্তলের সঙ্গে তুমুল মিলিত হয়। সাইকেলে রং করার সিদ্ধান্তের ক্রূরতায় সে একসময় কুন্তলের গলায় সজোরে দাঁত বসিয়ে দেয়। সে রাতে, একেক সময় কুন্তল নয়, সাইকেলটার সঙ্গেই মিলিত হল মিথিলা। সাইকেলের শান্ত ঠান্ডা রড বেয়ে ষড়যন্ত্রী মাকড়সার মতো মিথিলা উপরের দিকে উঠতে থাকল। তাদের মেয়ে মাঝরাতে ঘুম চোখে দেখল তার বাবার সঙ্গে বিছানায় একটা জ্যন্ত মাকড়সা মোচ্ছবে রত। ভয় পেয়ে শিশুটি বিছানা ভিজিয়ে ফেললেও কারও হুঁশ ফিরল না। অগত্যা মেয়েটা আরও চেপে চোখ বুজে বিছানায় পড়ে রইল।

কুন্তলকে এরপর তিনদিন গলায় মাফলার পেঁচিয়ে ডিউটিতে যেতে হয়েছিল। সেই মে মাসে।