অলোকপর্ণা
ড়াজু অবশেষে জয়াবৌদির বিছানায় গিয়েই পড়ল। ইচ্ছে যে খুব ছিল তা নয়। তবু এসে পড়ল যখন, চোখ পিটপিট করে জয়াবৌদিদের সিলিং-এর কারুকাজ দেখতে পেল ও। কাঠের ফলস সিলিং-এ ময়ূরের লেজ রাজুর দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে। উপর থেকে সেই চোখ যা দেখতে পাচ্ছে তা হল জয়াবৌদি খুব সওয়ার হয়ে উঠেছে, আওয়াজ হচ্ছে খপ খপ, খপ খপা খপ, খপ খপ, খপাখপখপ। কিন্তু ধুলো উড়ছে না। রাজু চোখ পিটপিট করে ময়ূরের লেজ দেখছে। তবে কেবল ময়ূরের লেজ না, ময়ূরের লেজ আর রাজুর দৃষ্টিপথে জয়াবৌদির মাইদুটো অনধিকার প্রবেশ করছে থেকে থেকে। একটু ঝোলা, তবে দেখতে ভালোই। অতটা বড় নয় যে রাজুর দম বন্ধ হয়ে আসবে চোষার সময়, আবার মুঠো আলগা হবে এমন ক্ষণিকও না। মাইদ্বয় জেগে আছে। রাজু দেখছে ময়ূরের লেজ। ময়ূরের লেজ দেখছে রাজুকে। দুধদুটো কী দেখছে?
রাজু গলা তুলে নিজের মাথার পিছনটা দেখে নিল একবার। জয়াবৌদিদের ঘরের পর্দা, ক্যাডমিয়াম হলুদ। দোদুল্যমান রাজুর চোখে পর্দা টলে উঠল বলে সে বুঝে পেল না, কে দোলাচ্ছে পর্দা, জয়াবৌদির নিচে পেষাই হতে থাকা রাজুর দৃষ্টি না বাইরের বাতাস। বাইরের বাতাস যদি বা হয়, তবে আরামের ফুরসৎ আছে। হতদ্যোম মাইদ্বয় পর্দার হলুদ চাখছে।
দূরে কোথাও এই নিশুতে পাখি ডেকে উঠল।
অগ্রহায়ণের পূর্ণিমাচাঁদ আকাশ খামচে উঠে এসেছে আজ। এতটা আলো যে পথভ্রষ্ট হতে হয়। বিপথগামী পাখি উত্তরের আশায় আকাশের দিকে চেয়ে ডেকে উঠল হঠাৎ, সাড়া পাবে না জেনেও।
–কবি হয়ে গেলাম নাকি বে!
জয়াবৌদির তলায় পড়ে থাকা রাজুর বেশ আমোদ হল একথা ভেবে।
রাজু এবার একটু ভাল করে জয়াবৌদির বুকের দিকে তাকাল। ময়দার মত, অথবা ময়দাই। তার উপর কফি দুটো বোঁটা। হাত বাড়িয়ে ডানদিকেরটা ছুঁয়ে দেখল রাজু একবার। একটু টিপেও দিল। জয়াবৌদিদের এতে তেজ বাড়ে। কোনও প্রভেদ নেই এতে।
হেমা, রেখা, জয়া আর সুষমা।
সবার পছন্দ নিরমা।
রাজুর মাথার ভিতরের নিরমার গানের তালে এখন জয়াবৌদি দুলছে, রাজুকে দোলানোর চেষ্টা করছে।
জয়াকে প্রথম দেখিয়েছিল বিন্নু। “ডবকা” অনস্বীকার্য। অথচ কোথায় কী! ড়াজু এখন চেয়ে চেয়ে জয়াবৌদিকে ভেদ করে ওপাশের দেওয়াল দেখতে পাচ্ছে, ফিনফিনে ট্রান্সপারেন্ট পলিথিন প্যাকেটের মতো। জয়াবৌদির কলিজা, ঘিলু, মজ্জা, পেশি সব আলগা হয়ে থকথক করছে, লাফাচ্ছে রাজুর উপর চড়ে। হঠাৎ উড়ে এসে রাজুর ঠোঁট কামড়ে দিয়ে গেল জয়া। এতক্ষণে কিছু বোধ হল যেন। জিভ দিয়ে চেটে দেখল রাজু, বেশ টক, জ্বালা করছে অল্প। বেদনা, এই বোধই বা কম কী! অন্তত খালিহাতে রাজুকে ফিরে যেতে হবে না আজ রাতে। ধীরে ধীরে গলি দিয়ে ঠোঁটে কামড়ের টিপসই নিয়ে রাজু ফিরে যাবে বাড়ি।
বাইরে কল কল করে অ্যাম্বুলেন্স বয়ে গেল একটা।
দুটো ঊরু দিয়ে পেড়ে ফেলছে জয়া রাজুকে।
রাজু সেই ঊরুতে হাত রাখল।
এত শীতল যে হাত পুড়ে যায়…
এমন শৈত্য, মনে হয় যেন মানুষটা মরে গেছে অনেক ঘন্টা আগে, অথবা মানুষটা নেইই, কেবল অবয়ব রাজুর উপর চড়ে টগবগ করছে। জয়াবৌদির চোখদুটো দেখার চেষ্টা করল রাজু। আধবোজা চোখে রাজুটা রাজু না বিন্নু না তপন না কিশোর, জয়াবৌদি এখন আর কিছুই জানে না। শুধু জানে, আজ রাতে কেউ অন্তত এসে পড়েছে তার দুইপায়ের মাঝে। কেউ অন্তত থাকছে আজ রাতে।
ড়াজু হাত বাড়িয়ে উত্তাপ খোঁজে জয়াবৌদির বিছানায়। বৌদির নাইটিটা হাতে আসে। সেটাও বাঁড়া ম্যাদা মেরে আছে।
অথচ তপন একবার একেই বলেছিল, “ডাঁশা!”
রাজু হাতড়ায়, সাদা পাতার মতো ফিনকি দিয়ে উড়ছে জয়ারানি সরখেল। একটা ফোঁটা কালি নেই তাতে যেখানে হাত রেখে বলা যাবে, কিছু অন্তত দাগ কেটেছিল কোনওদিন।
রাজুর ছোটভাই চাগিয়ে থাকে নিয়মমাফিক। ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে রাজু চোখ পিটপিট করে ময়ূরের পালকের দিকে চেয়ে অপেক্ষা করে জয়ার ফুরিয়ে যাওয়ার।
পাশের ঘর থেকে চিৎকার করে বৌদির বর হঠাৎ ডেকে ওঠে, “ছিপখান তিন দার/ তিনজন মাল্লা!”
এটার কথাও বিন্নুরা রাজুকে জানিয়েছিল। বিন্নুর নাকি বিচি শাল্টে গেছিল হট করে বৌদির বরের ডাক শুনে। জয়ার বরের নাম যেন কী? ড়াজু ভুলে গেছে। তবু আজ যখন রুটি কিনতে গিয়ে জয়াবৌদি রাজুর হাতে বুক ঘষছিল, রাজু কৌতুকে সাড়া দিয়ে ফেলেছে।
এখন জোর পাল্লা দিচ্ছে পাশের ঘরে জয়াবৌদির বর আর জয়াবৌদি নিজেও। নাক সুড়সুড় করে উঠল রাজুর। হাত বাড়িয়ে জয়াবৌদির নাইটিটা নিজের গলার উপর ফেলে দিল সে উষ্ণতার আশায়। আর অপেক্ষা করল খেল খতম হয় কখন।
অ্যাম্বুলেন্স কাকে নিতে এসেছিল কে জানে— জয়ার পাছায় হাত রেখে রাজু যাবতীয় সম্ভাবনা ওলটপালট করে— সুতনুর বউয়ের কিডনি স্টোন ধরা পড়েছে, বলছিল গত রবিবার…
অনেক ডাক সেরে জয়াবৌদি নিভে আসে একসময়। রাজু উঠে পাজামা আর গেঞ্জি খুঁজে বের করে মেঝে থেকে। মহিলা এখন বিছানায় এলো হয়ে পড়ে আছে। ভেবে দেখল রাজু— এত ঠান্ডা দেহ সে আগে ধরেনি। এত ঠান্ডা যে রাজুর কোথাও কোনওকিছু জ্বলেনি, ধুনকিও ওঠেনি আজ। ভুরু কুঁচকে সে বোঝার চেষ্টা করে ডাঁশামো। একগাদা ছাই পড়ে আছে বিছানায়। একগাদা ছাই রাজুর সারাগায়ে লেগে।
দুই.
রাস্তায় বেরিয়ে রাজু দেখল খুব ভিড়। দমকলের লাল গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে বিন্নুর দোকানের কাছেই। ভিড় হতে খুঁজেপেতে তপনকে আবিষ্কার করা গেল।
–আমি ভাবলাম অ্যাম্বুলেন্স!
–আরে কে যেন তোষক ফেলে গেছিল নর্দমার পাশে, আর এত শুকনো পাতা হয়েছে এখন, বিন্নু ফোন করে ডেকে দেখাল আগুন নিভছে না।
–বিড়িটা কে ফেলেছিল? তুই? না বিন্নু?
–কেউ একটা হবে।
রাস্তার আগুনের পাশে এসে দাঁড়ায় রাজু। দুই হাত মেলে ধরে আগুনের দিকে। সারা গা ভরে উত্তাপ টেনে নিতে থাকে। চোখ বুজে আসে তার আরামে, গায়ে লাগা ছাই ঝেরে ফেলতে ফেলতে মুখ হতে এতক্ষণ পর নির্গত হয় একটামাত্র “আহ!”
আরে বাহ! চমৎকার লেখা।
হীরক সেনগুপ্ত