একদিন দুপুরে

একদিন দুপুরে | প্রবুদ্ধ বাগচী

প্রবুদ্ধ বাগচী

 

ইনজেকশনটা দিয়ে, একবার প্রেশার মেপে তারপর আঙুলের ডগা থেকে এক ফোঁটা রক্ত নিল নার্স। যন্ত্রে সুগার টেস্ট করে দেখল। এরপর অল্পবয়সী নার্সটা বলল, দিদি, এবার ঘুমিয়ে পড়ুন। কোনও চিন্তা নেই, আপনি ভাল আছেন। পারিজাত একবার পাশ ফেরার চেষ্টা করল। অসম্ভব। তলপেটে স্টিচের ওপর প্রচণ্ড ব্যথা। বেডের দুদিকে রেলিং গুলো উঁচু করে তুলে দিয়ে মাথার দিকটাও একটু আরামদায়ক ভাবে অ্যাডজাস্ট করে দিল নার্সটা। বলল, পাশ ফেরার চেষ্টা করবেন না। স্টিচে ব্লিডিং হতে পারে। ঘুমিয়ে পড়ুন। আমি চারদিকে পর্দা টেনে দিচ্ছি। মাথার ওপরের সাদা জোরালো আলোটা নিভিয়ে, চারদিকের পর্দাগুলো টেনে দিয়ে বেশ একটা ঘরের মতো ব্যবস্থা করে দিয়ে নার্সটা চলে গেল।

অন্যসময় হলে হয়তো দুপুরের খাওয়ার পর একটু ঝিমুনিমতো আসে পারিজাতের। বিশেষ করে, মেয়েকে স্কুল থেকে নিয়ে এসে যখন দুপুরের খাওয়া সেরে নিজেও বুকুনের পাশে শুয়ে পড়ে, বেশিরভাগ দিনই ও ঘুমিয়ে পড়ে। সামান্য সময়ের ঘুম। পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার মধ্যে উঠে পড়তে হয়। আবার বুকুনকে নিয়ে সপ্তাহে তিনদিন টিউটরের বাড়ি ছোটা। কিন্তু হাসপাতালের এই পরিবেশে গত রাত থেকেই ওর চোখে একটুও ঘুম নেই।

হাসপাতালে যে অস্বাচ্ছন্দ্য কিছু আছে তা নয়। সম্পূর্ণ শীততাপ নিয়ন্ত্রিত আইসিইউ। সব মিলিয়ে বোধহয় দশ-বারোটা বেড আছে এখানে। প্রতিটাই আলাদা আলাদা একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ইউনিট। মাঝখানে গোল জায়গাটা ঘিরে নার্সদের বসার জায়গা। ডাক্তাররাও এসে ওইখানেই বসেন। ফাইল ক্যাবিনেট, কম্পিউটার, প্রিন্টার, জরুরি ওষুধপত্র রাখার আলমারি সুন্দরভাবে সাজানো। একদম কোণের দিকে টয়লেট। অবশ্য আইসিইউতে যারা নানা কারণে ভর্তি হয়ে আছে তাঁরা বেশিরভাগই শয্যাবন্দি। টয়লেটে যাওয়ার ক্ষমতা ও অনুমতি দুটোই তাঁদের নেই। আজ অবশ্য পারিজাতেরও একই অবস্থা। সদ্য হিস্টেরক্টমি হওয়া ওর আজ বিছানায় উঠে বসাই নিষেধ।

***

 

প্রায় অন্ধকার পর্দাটানা ঘেরাটোপে চুপ করে চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল পারিজাত। এখন দুপুর কটা? কাল সন্ধেবেলায় ও ভর্তি হয়েছিল হাসপাতালে। আজ সকালে ওর অপারেশন হয়েছে। বেডে দেওয়ার সময় আবছা চোখে দেখতে পেয়েছিল হিমাদ্রি আর বুকুনকে। আরও কিছু আত্মীয়স্বজন ছিল নিশ্চয়ই। পারিজাতের ভাই প্রমিত আসবে বলেছিল। হিমাদ্রির দু-একজন বন্ধুবান্ধবও থাকবে বলেছিল। তবে ট্রলি করে এত দ্রুত নিয়ে আসা হচ্ছিল পারিজাতকে যে মুখগুলো চিনে ওঠার আগেই সরে সরে যাচ্ছিল। তবে বিকেলে নিশ্চয়ই অনেকে আসবে। অবশ্য নার্সদের মুখে শুনছিল, এখানে রোগী প্রতি একজনের বেশি ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয় না। তাও দশ মিনিটের জন্য। ঘুমোতে পারলে শরীরটা একটু হাল্কা লাগত— কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না পারিজাতের। এতে শারীরিক কষ্টের বোধ যেন আরও বেড়ে যাচ্ছে। তলপেটে যন্ত্রণা হচ্ছে। একটু জল খেতে ইচ্ছে করছে। হাতের কাছে সুইচ টিপে নার্সকে ডাকবে নাকি? নাকি এখন থাক।

***

 

ঘেরা পর্দার ওপারে ভারি বুটের আওয়াজ। নার্সরাও বোধহয় নড়েচড়ে বসেছে। তারপর একটা বাজখাঁই গলা, কত নম্বরের পেশেন্ট? পারিজাতের বেডের ঠিক পাশের বেডের ঘেরাটোপের দিকে আওয়াজটা ঘুরে যায়। পেশেন্টকে পারিজাত চোখে দেখেনি ঠিকই, তবে কাল সন্ধে থেকেই নার্সদের মুখে মুখে শুনছে পেশেন্ট নাকি ক্রিটিক্যাল। দুপুরের খাওয়ার আগেও নার্সরা বলাবলি করছিল, কোনও এক বড় ডাক্তারবাবুকে নাকি খবর পাঠানো হয়েছে, উনি দুপুরের পরে আসবেন। তার মানে ইনিই সেই ডাক্তার নাকি? কথাবার্তার আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে পারিজাত। উনি নার্সদের কাছ থেকে পেশেন্টের নানা রিপোর্ট দেখতে চাইছেন। বোধহয় ওর সঙ্গে আরএমও দুজনও আছেন। একইরকম বাজখাঁই গলায় পেশেন্টকে জিজ্ঞাসা করলেন, লাস্ট ছ মাসের মধ্যে বাইরে কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন?

উত্তরটা শোনা গেল না। তবে আবার জোরালো গলা ডাক্তারের, মুম্বাইয়ে কতদিন ছিলেন?

এবারও উত্তর শোনা গেল না।

–ঠিক বলছেন তো? নাকি কিছু লুকোচ্ছেন? আমাদের কাছে কিছু লুকোবেন না কিন্তু। গমগম করছে ডাক্তারের কথা। দুপুরের নিঝুম আইসিইউ। বেশিরভাগ পেশেন্টই ঘুমিয়ে আছেন। আরও কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ চলল। তারপর ডাক্তারবাবু বোধহয় দুই আরএমও আর নার্সদের নিয়ে মাঝের গোল জায়গাটায় বসলেন বলে মনে হল।

পারিজাত শুনতে পাচ্ছে ডাক্তারের কথা। এটা দেখি, ওটা দেখি, এই ওষুধটা চেঞ্জ করে দিলাম। কাল সকালে আবার ব্লাড নেবেন আর সেই সঙ্গে এই নতুন ওষুধটা স্টার্ট করবেন। ভাল করে অবজার্ভ করবেন আর পারলে কাল একবার ডঃ সেনগুপ্তকে কল দিয়ে ইউরোলজিকাল পার্টটা চেক করিয়ে নেবেন। একের পর এক পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন ডাক্তার। পারিজাত কিছু দেখতে পাচ্ছে না কিন্তু বুঝতে পারছে ইনি বেশ বড়মাপের ডাক্তার। বাকিদের কথাবার্তায় একটা তটস্থ ভাব। সত্যি, এই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকলে অসুখ ছাড়া আর কিছু ভাবনায় থাকে না।

নিজের সারা শরীরটাও অচল। ডাক্তার বলে গেছেন চব্বিশ ঘণ্টা পরে কিছুটা নড়াচড়া করা যাবে। আসলে পেশেন্টের বাড়ির লোকেরা ভাবেন, আইসিইউ পরিচ্ছন্ন, উন্নত ধরনের যন্ত্রপাতি, ভাল পরিষেবা কিন্তু রোগটা যার হয় তার কাছে এগুলো নিতান্ত মূল্যহীন। যেমন এখন পারিজাতের তলপেটের স্টিচে দপদপ করে একটানা ব্যথা করছে। জোরালো গটমটে বুটের শব্দ তুলে ডাক্তারবাবুটি চলে গেলেন। তন্দ্রাহীন পারিজাত চোখ বন্ধ করে শুয়ে সব অনুভব করতে লাগল।

***

 

সামান্য একটু চোখ লেগে গিয়েছিল পারিজাতের। কীসের যেন একটা অস্বস্তিকর শব্দের তোড়ে ঘুমের ঘোরটা ভেঙে গেল। গোটা আইসিইউ হলের সবাই এখন ঘুমে বা আবছায়া আচ্ছন্নে। সদ্য অপারেশন হয়ে আসা অনেকেরই এখনও আনাস্থেশিয়ার ঘোর কাটেনি। পারিজাত কান পেতে শোনার চেষ্টা করল। আসলে এটা চাপা গলায় কথা বলার শব্দ। সামনের গোল কেন্দ্রটায় সব নার্সরা একজায়গায় হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। মেয়েরা তো একসঙ্গে হলেই তড়বড়িয়ে কথা বলে। বলছেও তাই। কিন্তু টুকরো টুকরো কিছু কথা কানে আসতে পারিজাতের মনে হল, এটা ঠিক খোশগল্পের আড্ডা নয়। এখানকার সিনিয়র বয়স্ক নার্সটা বাকি জুনিয়রদের কিছু বোঝাচ্ছেন। আলোচনা করছেন। একটু আলাদা করে শোনার চেষ্টা করল পারিজাত।

আলোচনাটা আসলে ওই ক্রিটিক্যাল পেশেন্টকে ঘিরেই। পেশেন্টের ধরন একটু অন্যরকম। পারিজাত যেটুকু বুঝল, চাকরির সূত্রে লোকটিকে নানা জায়গায় ঘুরতে হয়। বিপত্তি সেখান থেকেই। ওষুধে ঠিকমতো সাড়া দিচ্ছে না দেখেই ডাক্তারের সন্দেহ হয়েছিল। এখন ডাক্তার সাসপেক্ট করছেন এটা এইচআইভি পজিটিভ কেস। বাইরে কোথাও গিয়ে বাধিয়ে এসেছে।

সিনিয়র নার্স নিচু গলায় বলছিল, আমরা কিন্তু এটা পাবলিক করতে পারব না। এটা তোদের বলে রাখলাম। কাল আবার ব্লাড টেস্টে যদি একই রিপোর্ট আসে তাই তোদের সাবধান করে দিচ্ছি। বাকি পেশেন্টদের ও কেউ কিন্তু এই খবর জানবে না।

একজন জুনিয়র নার্স বলল, মরণ নেই! বাড়িতে কি বউ-ছেলে-মেয়ে নেই?

সিনিয়র নার্স থামাল। ওসব কথা একদম বলবি না। আমরা তো সবই বুঝতে পারছি। কিন্তু এটা সরকারি অর্ডার। কোনওভাবেই তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। শেষপর্যন্ত ডাক্তার যা সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই ফাইনাল। আর এখানে কিন্তু অন্য পেশেন্ট আছে, তাঁরা যেন ঘুণাক্ষরেও টের না পায়। পারিজাত জেনে ফেলল। একটু ভয়ও পেল। এই রোগ কি ছোঁয়াচে? না বোধহয়। কাগজে-টিভিতে তো রোজই বিজ্ঞাপন দেয়। তবু ভয় পেল পারিজাত। গলাটা শুকিয়ে আসছে। একটু জল খেতে হবে। হাতড়ে হাতড়ে বেল বাজাল পারিজাত।

***

 

আবছায়া ঘোরের মধ্যে একটা নিয়ন্ত্রণহীন স্নায়বিক অবস্থা। ঠিক ঘুম নয়, একরকমের আচ্ছন্নতা। ঝিমমারা দুপুরের এই শীতল ঘর আর হঠাৎই থেমে যাওয়া নার্সদের নিজেদের কথা বলা। পারিজাত একটা আধো স্বপ্ন আর জাগরণের মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছিল। ডাক্তার বলেছিলেন অ্যানাস্থেশিয়ার প্রভাব আট-দশ ঘণ্টা থাকতে পারে। সেই হিসেব ধরলে এখন ঘণ্টা পাঁচেক পেরিয়েছে বোধহয়। পারিজাতের মনে পড়ছিল এক অচেতন মনের স্মৃতি, হয়তো বা নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

প্রায় পচিশ বছর তো হবেই। তখন কত বয়স হবে পারিজাতের— মেরেকেটে কুড়ি-একুশ। রানিগঞ্জে ওটাই তখন সবচেয়ে ভাল কলেজ। পারিজাত ওখানেই পড়ত। আর সেখানেই আলাপ হয়েছিল তার সঙ্গে। পারিজাতের বাবা কোল ইন্ডিয়ার বড় চাকুরে। আর ওদের ছিল জমজমাট ব্যাবসা। প্রথমের দিকে পারিজাত ওকে ঠিক কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। ওদের পরিবারে কো-এডুকেশন কলেজে পড়তে আসা কোনও খুব একটা নিষিদ্ধ ব্যাপার মোটেও নয়। তাছাড়া পারিজাতের বাবা মোটেও রক্ষণশীল ছিলেন না। শীতকালে সন্ধের দিকে অফিস থেকে ফিরে বাড়ির সামনের লনে নেট টাঙিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলতেন প্রতিবেশী সহকর্মীদের সঙ্গে, পারিজাতও তাতে অংশ নিত। রানিগঞ্জের হাড়কাঁপানো শীতে ব্যাডমিন্টন কর্কের এপার-ওপার দৌড়ে চলা আর স্ম্যাশ, চাপ মারার উত্তেজনায় বাবা আর মেয়ের শরীর ভিজে যেত ঘামে। আর ঘামেভেজা ফুলস্লিভ গেঞ্জির ভিতর উদ্ধত হয়ে উঠত পারিজাতের সদ্য উত্থিত পাহাড়ি বুকের আদল। মাঝে মাঝে ওর মা এটা লক্ষ করতেন। বলতেন, অনেক খেলা হয়েছে এবার উঠে আয়, জামাকাপড় চেঞ্জ করে নে।

সেই ছেলেটার সঙ্গে একদিন ক্লাসে গল্প করছিল ব্যাডমিন্টন খেলার। ও বলেছিল, আমায় খেলতে নেবে?

পারিজাত বলেছিল, স্বচ্ছন্দে। সন্ধের দিকে চলে এসো। তবে আমার বাবার সঙ্গে সিঙ্গলহ্যান্ডে তুমি পারবে না!

সে কিন্তু আসেনি। এল অন্য একদিন দুপুরে। সেদিন কী কারণে যেন কলেজ দুপুরেই ছুটি হয়ে গিয়েছিল।

সে বলল, এখনই বাড়ি যাবে? চলো একটু গল্প করা যাক।

পারিজাত এই প্রস্তাবে কিছু মনে করেনি। জিজ্ঞাসা করেছিল, বসবে কোথায়?

সে বলল, আমাদের বাড়ি যাবে?

পারিজাত বলেছিল, না না, তার কী দরকার? এই কলেজেরই আশেপাশে কোথাও…

সে বলল, একটু বাদে যে দারোয়ান কলেজের গেট বন্ধ করে দেবে।

চিন্তায় পড়ল পারিজাত। তাই তো, এটা ভেবে দেখা হয়নি।

সে বলল, তোমাদের বাড়ি চলো না?

পারিজাত এককথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল সেদিন। আর কলেজের সামনে থেকে অটোয় উঠেই ওর মনে পড়ল, এই রে, বাড়ি তো আজ ফাঁকা! মা গেছে এক মামার ছেলের বিয়েতে। বাবা অফিসে। রান্নার মাসি দুবেলার রান্না করে রেখে চলে গেছে সকালবেলাতেই। তখনও ও আর বাবা বাড়িতেই ছিল। তাহলে! অটো তখন অনেকটা চলে এসেছে!

পরের মুহূর্তেই পারিজাত ভাবল কী আর হবে! সে তো ওর কলেজের বন্ধু। আর এখন মাঝপথে এসে এই ফিরে যাওয়ার কথাটা কি বলা যায় নাকি? ও যদি কিছু ভাবে! এইসব দোলাচলের মধ্যেই অটো এগিয়ে চলছিল নিজের গতিতে। বাড়ির স্টপেজে এসে থেমেও গেল। নেমে পড়ল ওরা দুজন।

গেটের তালা খুলতেই সে জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার, মাসিমা কোথায়?

পারিজাত একটু চুপ করে থাকল।

সে আবার প্রশ্ন করল, কী হল? কিছু বলছ না?

পারিজাত ততক্ষণে সদর দরজার ল্যাচে চাবি ঢোকাচ্ছে। আলতো করে বলল, মা নেই।

–কোথায়?
–একটা বিয়েবাড়ি গেছে। আমি আর বাবা আছি।

সে চুপ করে গেল। ততক্ষণে ওরা দুজনে বাইরের ঘরের সোফায় বসেছে।

পারিজাত বলল, চা-কফি একটু কিছু করে আনি?

সে বলল, দরকার নেই। আমরা তো গল্প করতে এসেছি। ওসব পরে হলেও চলবে।

***

 

সেই পচিশ বছর আগের দুপুরে সে কিন্তু কথা রাখেনি। পারিজাত ঠিক এতটার জন্য প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু ঝিমমারা একটা দুপুর। ফাঁকা বাড়ি। দুটি গনগনে যুবক-যুবতী। সে কিছুটা সুযোগ বুঝে জোর খাটিয়েছিল। পারিজাত পছন্দ করেনি। সব মিটে যাওয়ার পর সে বলেছিল, কই চা করলে না!

পারিজাত পুড়ে যাচ্ছিল ভিতরে ভিতরে। কথাটার জবাব দেয়নি। কিছুক্ষণের জন্য তৈরি হয়েছিল নীরবতা। তারপর বলেছিল, আর ইচ্ছে করছে না। বাইরে কোথাও খেয়ে নিও।

আবারও খানিকটা নীরবতা। তারপর সে নিজে থেকে উঠে চলে গিয়েছিল। পারিজাত তাকে আর গেট অবধি এগিয়ে দিতেও যায়নি।

তারপরেও কলেজে গেছে পারিজাত। তার সঙ্গে আর কোনওদিন কথা বলেনি। সেও বলেনি। কিন্তু এই দুঃস্বপ্নের স্মৃতি কখনও কাউকে বলতে পারেনি পারিজাত।

***

 

এর বছর দুয়েক পরে হিমাদ্রির সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয় পারিজাতের। গোপন একটা ভয় তখন গ্রাস করেছিল ওকে। হিমাদ্রি যদি টের পায়। প্রথম মিলনের পর রক্তের দাগই নাকি… অথচ সে প্রমাণ তো ইতিমধ্যেই… বিয়ের আগে মাঝেমাঝেই শিউরে উঠত পারিজাত। না, তেমন কিছুই ঘটেনি। হিমাদ্রি ওসব নিয়ে মাথা ঘামায়নি কোনওদিন। কিন্তু আজ এত বছরের গোপন সেই সত্য পারিজাত বহন করছে মনের গভীরে। বিয়ের পর পর হিমাদ্রির সঙ্গে যখন ওইসব ঘটত গোপনে একটা ভয় কাজ করত পারিজাতের মনে। এত বছর পর এখন সেসব আর অবশিষ্ট নেই।

তবু কেন আজ হাসপাতালের বেডে শুয়ে আচমকা মনে পড়ে গেল সেই কথা? ধড়মড় করে আধোজাগরণে আচ্ছন্নতা থেকে উঠে বসতে চাইল পারিজাত। সঙ্গে সঙ্গে তলপেটে প্রবল ব্যথা। খেয়াল ছিল না। ওর তো এখন উঠে বসা বারণ। নিতান্তই সংক্ষিপ্ত একটু ঘুম তবু সময়ের অনেকটা ওপার থেকে সে যেন ঘুরে এল সদ্য। স্থানকালপাত্রের সম্বিত ছিল না।

পারিজাত আর্তনাদ করে উঠল, ওহ!

ছুটে এল নার্স। পর্দাঘেরা স্তিমিত আলোর ঘেরাটোপে নার্সের দিকে তাকিয়ে আবার সব মনে পড়ে গেল। ওর তো আজ বেশি নড়াচড়া বারণ।

নার্স মেয়েটা বলল, ম্যাডাম, এনি প্রবলেম?

পারিজাত বলল, না, কিছু না। একটু চোখ লেগে গিয়েছিল আর কি!

নার্স বলল, সে তো ভালই। যত ঘুমিয়ে থাকবেন তত তাড়াতাড়ি সেরে উঠবেন। বিকেলের চা খাওয়ার সময় হয়ে আসছে। চা খাবেন তো?

পারিজাত মাথা নাড়ল।

পরম যত্নে মেয়েটি বলল, চা আসুক, আমি আপনাকে খাইয়ে দিয়ে যাব। আপনি আজ নিজে খেতে পারবেন না।

পারিজাত একটু চুপ করে থেকে বলল, পর্দাগুলো এবার সরিয়ে দিন।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...