Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

…মধ্যিখানে চর

সত্যব্রত ঘোষ

 



গদ্যকার, প্রাবন্ধিক, চলচ্চিত্রবেত্তা

 

 

 

এলিপসিস৷ শব্দটি সেই তিনটি বিন্দুকে বোঝায় যা বাক্যের শেষে, মধ্যিখানে অথবা গোড়ায় বসিয়ে কিছু কথাকে উহ্য রাখতে পারেন লেখক৷ ওই তিনটি বিন্দুর দ্যোতনাও কম নয়। তবে সৌরভ ষড়ঙ্গীর ছবির নামের গোড়ায় যে এলিপসিস, তা আসলে আমাদের সবারই অল্পবিস্তর জানা। ভারত ও বাংলাদেশ বিভাজনের থেকে যে আর্থ-সামাজিক সঙ্কট এবং ভূ-রাজনীতির উদ্ভব, ছবির নামকরণে এলিপসিস ব্যবহার করে সেই আন্তর্জাতিক সমস্যাকে প্রেক্ষাপটে রেখে সৌরভ তাঁর ছবিতে গ্রন্থন করেছেন দেশহীন কিছু কিশোর-কিশোরী ও তাদের পরিবারের যাপনচিত্র। এই মাসের ৯ তারিখ অবধি নন্দন ২-এ তথ্যচিত্রটি প্রদর্শনের সময়ে দর্শকদের উৎসাহ ছিল লক্ষ্যণীয়।

সৌরভের ছবির এক চরিত্র রুবেল। চরবাসী এই কিশোরের জবানিকে নেপথ্যভাষ্যে ব্যবহার করেছেন সৌরভ: “সীমান্ত দাঁড়িয়ে থাকে, কিন্তু নদী চলতেই থাকে।” সত্যিই তো। চরের জন্ম দেয় নদীই৷ যখন তার স্বাভাবিক গতিপথকে সরকারি প্রযুক্তিবিদরা নিজের নিয়ন্ত্রনে আনবার জন্যে বদ্ধপরিকর৷ ১৯৪৮ সালে ভাকরা-নাঙ্গাল বাঁধ নির্মাণের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে জহরলাল নেহেরু বলেছিলেন, “বাঁধগুলি আধুনিক ভারতের মন্দির।” নেহেরুর সেই উক্তিটিকে সৌরভ তাঁর ছবির মুখবন্ধ হিসেবে ব্যবহার করেছেন৷ নদীর গতিপথকে মানুষের ইচ্ছামতো চালিত করলে তা মানুষেরই সর্বনাশের কারণ হয়৷ নদীবিশেষজ্ঞ কপিল ভট্টাচার্যের বহুপঠিত বইটিতে বাঁধ নির্মাণের এই ভয়াবহ দিকটির বিষয়ে আমরা অনেকেই অবহিত হয়েছিলাম। নর্মদা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে মন্দিরের এই রূপকটিকে আমরা তখন বিপ্রতীপেই দেখছিলাম৷ তিন দশক অতিক্রান্ত হবার পরেও দেখছি৷ আমরা তটস্থও হই, যখন দেখি কর্পোরেটদের বাঁধ নির্মাণের আবদারে এখনও সরকারের সায় আছে। পরিবেশবিদরাও জানেন যে এযাবৎ কর্পোরেটরা যতটুকু প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে, তা মূলত স্থানীয় মানুষদের সংগঠিত আন্দোলনের কারণেই। তাতে অবশ্য বাঁধ তৈরিতে সরকারের রীতিনীতিতে বিশেষ ফারাক ঘটেনি।

গঙ্গার বুকে জেগে ওঠা যে চরটিকে নিয়ে সৌরভের এই ছবি তাতে মালদা জেলায় ফারাক্কা বাঁধের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। গঙ্গা-পদ্মার বিভাজন চিহ্নিতকারী ফারাক্কা প্রকল্পের মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে জল কূটনীতি দিনে দিনে যত সক্রিয় হয়েছে, ততই বিধ্বংসী হয়েছে গঙ্গার গতিধারা। তার প্রচণ্ড স্রোতে অনবরত ভূমিক্ষয় তো হয়েছেই। পাশাপাশি, বাংলাদেশে জল সরবরাহে কড়াকড়ি হওয়ায় দুই দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের দরিদ্র কৃষকদের জীবনও হয়েছে চুড়ান্ত বিপন্ন। নিজেদের জমি ও ঠিকানা হারিয়ে এই পরিবারগুলির আশ্রয়স্থল হয়েছে এই চর। সব খুইয়ে চরে আশ্রয় নেওয়া মানুষগুলির দিনান্তযাপনের মর্মস্পর্শী এক আখ্যান সৌরভের এই ছবি।

‘আখ্যান’ শব্দটি এখানে সজ্ঞানে ব্যবহৃত৷ কারণ, ভারতে বাণিজ্যিক অর্থে চলচ্চিত্রের প্রতি সাধারণ মানসিকতা আজও মেরুকৃত৷ কাহিনিচিত্ররা যেভাবে দর্শকদের কৃপাধন্য হয়ে এসেছে, ‘তথ্যচিত্র’ সেই অর্থে কখনওই সাধারণ ভারতীয় দর্শকদের আনুকূল্য পায়নি। তথ্যচিত্রের প্রতি এই নির্বিকার নিরাসক্তি গড়ে ওঠবার নেপথ্যে সরকার পরিচালিত ‘ফিল্মস ডিভিশন’-এর দায় তো রয়েই যায়। অনেকেরই মনে থাকবে, গত শতাব্দীর সাত ও আট দশকে প্রেক্ষাগৃহে প্রতিটি শো-এর আগে ‘ফিল্মস ডিভিশন’ নির্মিত তথ্যচিত্র অথবা নিউজ রিল দেখানোর প্রথা ছিল। সরকারি নিয়ম অনুসরণ করে প্রেক্ষাগৃহের আলো না নিভিয়েই প্রজেকশনিস্ট এই কুৎসিত ছবিগুলির প্রেক্ষণ শুরু করতেন। প্রচারসর্বস্ব এই ছবিগুলি দেখার প্রতিক্রিয়ায় অধৈর্য দর্শকদের রাগ ও বিরক্তি ছাড়া অন্য কোনও অনুভূতির জন্ম হয়েছে বলে জানা যায়নি। প্রজেকশনিস্ট তাই ছবিগুলি শুরু করেই থামিয়ে দিতেন। তারপরে প্রেক্ষাগৃহের আলো নিভত এবং পর্দায় ভেসে উঠত কাহিনিচিত্রের সেন্সর সার্টিফিকেট। তখন শোনা যেত প্রেক্ষাগৃহে উপস্থিত দর্শকদের স্বস্তির নিশ্বাস।

হয়তো তথ্যচিত্রের নামে অকথ্য সেই জগাখিচুড়ি দেখার স্মৃতি, অথবা ‘ছবি’র চেয়ে ‘বই’এর প্রতি আকর্ষণকে নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ও বাণিজ্যিক প্রাধান্য দেওয়া, অথবা সমকালীন রূঢ় বাস্তব থেকে পলায়নমুখী একটি মাধ্যমের বিনোদনকেন্দ্রিক আড়ম্বরকেই ‘সিনেমা’ হিসেবে উদযাপন করা— কারণ যাই হোক না কেন, তথ্যচিত্র নির্মাণ এবং স্থানীয় প্রেক্ষাগৃহগুলিতে টিকিট বিক্রি করে তথ্যচিত্র প্রদর্শনের অনীহা স্পষ্ট। অথচ, সেই ১৯২২ সালে আমেরিকায় রবার্ট ফ্লহার্টি-র ‘নানুক অফ দ্য নর্থ’ অথবা ১৯২৯-এ সোভিয়েত ইউনিয়নে জিগা ভের্তভের তৈরি ‘ম্যান উইথ আ মুভি ক্যামেরা’ অথবা ইংল্যান্ডে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময়ে জন গ্রিয়ারসন-এর নেতৃত্বে তথ্যচিত্রকারদের প্রয়াসগুলির আবেদন কিন্তু আন্তজার্তিক দর্শকসাধারণের কাছে আজও অটুট।

যাই হোক, তথ্যচিত্র এবং কাহিনিচিত্রের মধ্যে যে বিভাজনরেখাটুকু রয়েছে, বিভিন্ন চিত্রপরিচালক তা মুছে দিতে সচেষ্ট। যার একটি উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে সৌরভ ষড়ঙ্গীর আলোচ্য এই ছবিটিকে ধরাই যায়৷ গল্প বলা বা না বলাকেই সাধারণত দুই ধরনের সিনেমার ফারাক হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়ে থাকে। এখানে বলা প্রয়োজন, কাহিনিচিত্রের ক্ষেত্রে চিত্রগ্রহণের আগেই চিত্রনাট্যে লেখা দস্তুর। যেখানে ঘটনাবৃত্তান্ত, তাদের ক্রম এবং সংলাপ হিসেবে চরিত্রদের কথা বলা বা প্রতিক্রিয়া দেওয়া প্রায়শই নির্দিষ্ট। ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে, তথ্যচিত্রের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে ঘটে যাওয়া ঘটনাসমূহের যে গ্রন্থন, তার বিন্যাস কিন্তু ঘটে চিত্রগ্রহণের পর— চিত্র সম্পাদনার নিভৃত সময়ে৷ সৌরভ ষড়ঙ্গীর ছবিটির ক্ষেত্রে যা অবশ্যই লক্ষ্যণীয়, তা হল বেশ কিছু বছর সযত্নে অল্প অল্প করে এই চরের মানুষদের জীবনযাত্রাকে নিবিড় দৃষ্টিতে ক্যামেরাবন্দি করছিলেন তিনি। তারপরে সঞ্চিত এই চিত্র-উপাদানগুলিকে সুঠাম এক কাঠামোয় সমাহিত করে তিনি আসলে চরটিতে বসবাসকারী তিনটি প্রজন্মের বেঁচে থাকার এক অনন্য গল্পই বললেন৷

কী সেই গল্প? গঙ্গার গতিপথ বদলানোর কারণে স্থানীয় দরিদ্র কৃষকদের শেষ অবলম্বন চাষের জমিটুকুও নদীগর্ভে হারিয়ে যাওয়ার গল্প; সেই অভাবী জনসম্প্রদায়ের উত্তরপুরুষ রুবেন আর সফিদের ছোট কাঁধগুলিতে পারিবারিক দায়ভার বহনের গল্প; রুবেন আর সফির মায়েদের অপেক্ষমাণ অবয়বে মঙ্গলকামনার গল্প; স্বামী সন্তানদের নিয়ে সুখে থাকার স্বপ্ন নিভে আসার গল্প; অনিশ্চয়তা আর অসহায়তার মাঝেও লড়ে যাওয়ার গল্প; উপার্জনের নিমিত্তে শীত-বর্ষা-গ্রীষ্ম নির্বিশেষে সীমান্তরক্ষা বাহিনির সঙ্গে সংঘাত আর আপসের গল্প। আর গল্প সেই রাষ্ট্রব্যবস্থার, যা বন্যা, সাইক্লোন, ভূমিকম্পে ত্রাণ বিলিতে তৎপর হলেও নদীর উথাল স্রোতে ভূমিক্ষয়ে পীড়িত মানুষদের প্রতি নির্বিকারত্বের পরম্পরাকে রক্ষা করে চলেছে মানবিকতার তোয়াক্কা না করেই৷

সংবাদ ও তথ্য পরিবেশনের দুরত্ব অতিক্রম করে ‘…মধ্যিখানে চর’-এর আখ্যান দর্শকদের এই লড়াকু মানুষগুলির সান্নিধ্যে নিয়ে যায়৷ শৈশব হারানো যে কিশোর ও কিশোরীরা সেই চরে সুরক্ষা খোঁজার প্রাণান্তকর প্রয়াসে লিপ্ত দুই দেশের সীমারেখাকেই নিজেদের শরীরে ঘাম দিয়ে মুছে দিতে শিখেছে, তাদের সঙ্গে সখ্যতা হয় আমাদের। আমরা দেখি, বৃষ্টিঘন ঝড়ের রাতে নদী যখন উথাল-পাথাল, ক্লান্তিভরা শরীর নিয়ে ঘুমোচ্ছে তারা।

পুনশ্চ: নন্দনে টিকিট কিনে দর্শকরা এর আগে সাগ্নিক চট্টোপাধ্যায় নির্মিত ‘ফেলুদা ৫০’ বড় পর্দায় দেখতে এসেছিলেন। সময়ের বেশ বড় ব্যবধানের পর আবার দর্শকরা সৌরভের ‘…মধ্যিখানে চর’ দেখতে এলেন। যদিও এক্ষেত্রে ছবিটির আবেদন আগেরটি থেকে একেবারেই আলাদা। যাই হোক, তথ্যচিত্রের প্রতি সাধারণ দর্শকদের আগ্রহ বৃদ্ধিতে নন্দন-এর ভূমিকায় ইতিবাচক একটি আবহাওয়া তৈরির নেপথ্যে সৌরভ ষড়ঙ্গী এবং দুই বাংলার কতিপয় চলচ্চিত্রপ্রেমী ও নির্মাতাদের দীর্ঘ অনলস প্রচেষ্টা সার্থক করার জন্যে নন্দন পরিচালন কমিটিকেও ধন্যবাদ। আশা করা যায়, ‘…মধ্যিখানে চর’ প্রদর্শনের পর সময়ের ব্যবধান কমিয়ে যেন পরবর্তী দিনে নতুন চিত্রকারদের স্বতঃপ্রণোদিত প্রয়াসগুলির প্রদর্শনের মাধ্যমে দর্শকসাধারণের চিত্রভাষার জগৎ আরও সমৃদ্ধ করে নন্দন।