Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মেলা বই, কিছু না মেলা সমীকরণ

অম্লানকুসুম চক্রবর্তী






লেখক প্রাবন্ধিক, গল্পকার

 

 

সংগঠিত খুচরো বিপনি, অর্থাৎ রিটেল স্টোর বলে আমরা যা জানি, তাতে সাজানো সামগ্রী আমআদমি ‘খাচ্ছে’ কতটা জানার জন্য দুটো অঙ্ক আছে। এক, এনওবি। মানে হল, নাম্বার অফ বিলস্। দুই, এবিভি। এর অর্থ হল, অ্যাভারেজ বিল ভ্যালু। সোজা কথায়, এর থেকে জানা যায়, যত লোক সুসজ্জিত আউটলেটে আসছেন কিংবা বাহারি শপিং পোর্টালে ঘোরাফেরা করছেন, তার কত অংশ কিনছেন। শুধু কটা বিল হচ্ছে তা দেখলেই এক্সেলের জিমনাস্টিক শেষ হয়ে যায় না, এর সঙ্গে যা দেখা দরকার তা হল, প্রতিটি বিলের গড় ভ্যালু কত হচ্ছে। বিলের গড় অঙ্কের সঙ্গে বিলের সংখ্যা গুণ করলে মোট বিক্রির পরিমাণ জানতে পারা যায়। যে কোনও সংগঠিত বিপনি যখন কোনও বিশেষ পার্বনের বাজেট বানায়, তখন এই এনওবি এবং এবিভি—দুটোরই কত বৃদ্ধি হতে পারে তা নিয়ে মাথা ঘামায়।

কলকাতা বইমেলার এক নামজাদা প্রকাশক এমন কিছু তথ্য উগরে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বিদেশি জার্নাল থেকে রিটেল দুনিয়ার এই খুঁটিনাটি জানতে পেরে তিনি, যাকে বলে, বেশ এক্সাইটেড ছিলেন। তবে এই উত্তেজনা স্থায়ী হয়নি বেশিক্ষণ। ক্লান্ত স্বরে যা বললেন তা একেবারে মোক্ষম। ‘শহর মফস্বলের আনাচে কানাচে এত খাদ্যমেলা করার পরে কলকাতা বইমেলা করার আর কি দরকার আছে বুঝি না। মনপসন্দ্ খাবার খাওয়ার জন্য তো সুইগি-জোমাটোও আছে। এতটা পথ পেরিয়ে বইমেলা আসার দরকারটা কি!’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই যে রিটেল দুনিয়ার এতরকমের তথ্য দিলেন, অঙ্কের ফর্মুলা দিলেন, বইমেলাকে কেন্দ্র করে আমাদের এমন কোনও হিসেবনিকেশ আছে নাকি?’ উনি ঠোঁট উল্টে বললেন, ‘এমন তথ্য যেন না রাখে কেউ। ষদি রাখত, আমাদের লজ্জায় মুখ দেখানোর জায়গা থাকত না ভাই। বৃথা এই আয়োজন। সব মিছে। ইকো পার্ক, নিকো পার্কের মতো এ খালি দিনবারোর বই পার্ক। শীতের দুপুরে আউটিংযাপনের আরেক আয়োজন। ব্যস, এ ছাড়া আর কিছু নয়।’

গত বছরের বাতিল হওয়া বই উৎসব ফের ফিরে আসার খবর পাওয়ার পরে লোকজনের আনন্দের সীমা নেই। কলেজের বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে যে হোয়্যাটসঅ্যাপ গ্রুপটা আছে, তাতে পপকর্ন তৈরির মেশিনের মতো কিছু বার্তা উথলে পড়ল সম্প্রতি।

-ইয়েস, ইয়েস। বইমেলা ইজ ব্যাক। লাস্ট টু লাস্ট ইয়ার চ্যানেল এক্সের (নাম পরিবর্তিত) স্টলের অন্তাক্ষরীটায় একটা ফ্যাব প্রাইজ জিতেছিলাম রে। এ বছর আবার হবে।

-তুই কিন্তু এসএলআরটা নিয়ে যাবি এবারে। এটা মাস্ট। থিম কান্ট্রির স্টলের সামনে প্রটুর ফটো এলিমেন্ট থাকে। মোবাইলের সেলফি ইজ নট এনাফ। পনেরো কুড়িটা ছবি তুলে নেব। সারা বছরের ডিপি হয়ে যাবে।

-আরে কয়েকটা স্টল আছে দেখেছিস? দেওয়ালটা পুরো ক্লাসিক বইয়ের প্রচ্ছদ দিয়ে করে। ওর সামনে পোট্রেট মোডে ছবি তুললেও অসাম হবে। পুরো ব্যাপারটায় একটা এথনিক এথনিক লুক আসে।

-কাশ্মীর থেকে ওই চা-ওয়ালাটা কি এবার আসবে রে? এনি ইনফো? চা-টা কিন্তু অসাধারণ বানায়। এবার তিন কাপ খাব।

-শুধু চা চা করলে হবে বস? চল্, এবার লাঞ্চটা বুক ফেয়ারেই করি।

-আমার কিন্তু টি শার্ট মাস্ট। ঠিক করেছি, এবার কালোর উপরে সাদা স্কেচ দিয়ে পোট্রেট আঁকাব। অদ্ভুত ভাল আঁকার হাত রে ছেলেগুলোর।

-হোয়্যাট অ্যাবাউট এ ক্যালেন্ডার? একটু বেশি মাল্লু ফেললে আরামসে করে দেবে, উইথ নিজের হাতে আঁকা ছবি।

বইমেলা নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা ক্রমশ এভাবেই এগোতে থাকে। তালে তাল দিয়েছিলাম আমিও। আমি জানি, দুবছরের উপোস ভাঙার পর বইমেলা যাওয়া নিয়ে যে অজস্র আলোচনা চলছে কয়েক হাজার হোয়্যাটসঅ্যাপ গ্রুপে, বিশ্বজুড়ে, তাদের থিম সঙ্গীত এমনই। বারো দিনের বই উৎসবকে আমরা এভাবেই বরণ করে নিয়েছি। কথাপ্রসঙ্গে ওই প্রকাশক যোগ করেছিলেন, ‘বইমেলা যাওয়ার উপকারিতা হিসেবে যদি গোটাদশেক বুলেট পয়েন্ট কাউকে আওড়াতে বলা যায়, তার মধ্যে নটি পয়েন্টের সঙ্গেই বইয়ের কোনও যোগ নেই।’

ফেসবুকে মাসখানেক আগে একজনকে প্রশ্ন করতে দেখেছিলাম, ‘গত বছর না-বইয়ের যে যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়েছি, তা পূরণ করার জন্য এবার কি ডবল বইমেলা?’ অতিমারিকে ভাল করে যোঝার জন্য এবার প্রশাসন বেশি কিছু বিধির কথা হেঁকেছেন। বাস্তবে কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন থেকে গেলেও একথা বলা যায়, অতিমারির মধ্যে কোভিড বিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে প্রশাসনের আধিকারিকরা কোনও ঝুঁকি নিতে চান না, স্বাভাবিকভাবেই। মাস্ক ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারবেন না বইমেলায়। অন্যবারের তুলনায় মেলা হবে আরও খোলামেলা। পাঁচতারা ফ্ল্যাটের বিজ্ঞাপন যেমন প্রকৃতির মধ্যে থেকে সাধপূরণের কথা বলে, আরও বেশি ওপেন স্পেসের কথা বলে গর্ব ভরে, এ বারের বইমেলাও তেমন উন্মুক্ত জায়গা উপহার দেবে বলে মনে করা হচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে কঠোরভাবে। নিয়মের রুলবুক আরও জানান দিচ্ছে, বইবিক্রেতাদের জন্য দুটি ডোজের টিকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ইতিমধ্যেই। মেলার দিন যত এগোবে, ওমিক্রন তার কালো রঙের চুমকি বসানো পেখম আরও যত মেলে ধরবে, বইমেলার বিধির খাতায় পয়েন্টের সংখ্যা বাড়বে—এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

একমাত্র এই মেলার মধ্যে বই বই গন্ধ থাকার কারণে বহু মানুষ গত বছরও ভেবেছিলেন, আর যা কিছু হয় হোক, বইমেলা উদযাপিত হবে বুক ফুলিয়ে। তবে গত বছরের ৫ই জানুয়ারি গিল্ডের কর্তাব্যক্তিরা এই আশায় জল ঢেলে দেন। জানিয়ে দেওয়া হয়, মেলা হচ্ছে না। তবে মানুষের আশার মধ্যেও হয়তো শেষ হয়ে হইল না শেষের মতো একটা ফ্লেভার মিশে থাকে। অনেকের আশা ছিল, করোনার গ্রাফ একটু পড়লেই ফের বই দিয়ে সেজে উঠবে সল্টলেকের সেন্ট্রাল পার্ক। এদিক ওদিক থেকে রব ওঠে, জানুয়ারির বাতিল হওয়া বইমেলা অনুষ্ঠিত হবে জুলাইয়ে। সেই সম্ভাবনাও বাতিল হয়ে যায় শেষ পর্যন্ত। তবে এ বছর আর মানুষকে হতাশ করতে চাননি গিল্ড কতৃপক্ষ। আপাতত, তাই সাজো সাজো রব।

সত্যিই বই প্রীতি আছে যাঁদের, তাঁরা কোনওকালেই অবশ্য বইমেলাকে মক্কা হিসেবে দেখেন না। গিল্ডের ঘোষণার পরে তাঁদের মধ্যে অনেকেই কিছু অপ্রিয় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছেন। বইমেলার স্টলের সংখ্যা কমার কোনও সম্ভাবনা নেই—এমনটাই জানিয়েছেন গিল্ডের কর্তাব্যক্তিরা। তবে আরও বেশি উন্মুক্ত জায়গা উপহার দেওয়ার জন্য স্টলের ভিতরের জায়গা কমানো হচ্ছে। সত্যি মিথ্যে জানা নেই, তবে শোনা যাচ্ছে, এবার অধিকাংশ স্টলেরই ভিতরে ঢোকার তেমন কোনও সুযোগ থাকবে না। ক্রেতারা দোকানের সামনে দাঁড়াবেন, টেলিস্কোপিক চোখ দিয়ে গর্ভগৃহে তাকের উপরে রাখা বইগুলো স্ক্যান করে দেখবেন, পছন্দের বইয়ের নাম বলবেন, বই নেবেন, টাকা মেটাবেন, চলে যাবেন। অর্থাৎ, স্টলের মধ্যে ঘোরাঘুরি করে, বই নেড়েচেড়ে দেখার সুযোগ এবার থাকবে তুলনামূলকভাবে অনেক কম। অনেকে বলছেন, কলকাতা বইমেলার অগ্নিপরীক্ষা হবে এবারই। নতুন ধাঁচে এবং নয়া নিয়মে স্টলগুলো সেজে ওঠার পরে কত বইপ্রেমীকে টানতে পারে তা পরখ করে নেওয়ার সুযোগ করে দেবে এ বছরের বইমেলা।

আমার পরিচিত এক রসিক অধ্যাপক বলছিলেন, ‘বইমেলার আসল দূষণ নিয়ে সুভাষবাবুরা একবারের জন্যেও মামলা করার কথা ভাবেন না। আসল দূষণ কি জানো ভাই? পিলপিল করে ধেয়ে আসা, গলা অবধি খেয়েদেয়ে, একটাও বই না কিনে জাস্ট ভেগে যাওয়া মানুষ। ওরা মানুষ নয়, পঙ্গপালের দল।’ দেখতে পাচ্ছি, ওই অধ্যাপকের কথার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে আরও বহু খুঁতখুঁতে মানুষের দাবি। বইমেলার ভালমন্দ নিয়ে যাঁরা মাথা ঘামান, তাঁরা বলছেন, খাবারের স্টলগুলোর স্কোয়ার ফিট কমছে কি না তা নিয়ে কোনও স্বচ্ছ ধারণা মিলল না গিল্ডের ঘোষণায়। লেখাটি সম্পাদকমশাইয়ের কাছে পাঠানো অবধি এই নিয়ে কোনও খবর পাইনি এখনও। খুঁতখুঁতে মানুষরা অন্তত এবার খাবারের স্টল কমানোর দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। তাঁদের দাবি, রাশি রাশি খাবারের স্টলের সংখ্যা না কমালে বইয়ের বিপণিগুলোর জন্য হয়তো আরও জায়গা উন্মুক্ত থাকত। একই দোষে দুষছেন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের স্টলকেও। তাদের স্কোয়ার ফিট কমছে কি? উত্তর মেলেনি।

বইমেলার মধ্যে অ-বই সম্পর্কিত স্টলগুলো নিয়ে অনেকের মতো আমার মনেও হিজিবিজবিজ প্রশ্ন জাগে। জনপ্রিয় ধারাবাহিকের লাস্যময়ী অভিনেত্রী যখন মাইক্রোফোন হাতে আধা বাংলা আধা ইংরিজিতে ভুলভাল বকেন, ন্যাকামি করেন প্রকাশ্যে, তখন তাঁকে মেলার ম্যাপ হাতে ধরিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, এইগুলো হল এক্সিট গেট। এক্ষুণি বেরিয়ে যান। টিভি চ্যানেলের স্টলের পাশে আড়াল হয়ে যাওয়া, মূলত প্রবন্ধের বই করা এক প্রকাশককে গত বইমেলায় চোখ মুছতে দেখেছিলাম। মেলা যখন শেষের পথে, স্টলে আসা লোকদের হাত জোড় করে বলছিলেন, ‘ওই চ্যানেলের দোকানগুলোই আসল বইমেলা দাদা। আমার এই গরিব স্টলে এসে আর কী হবে!’ দিনের পর দিন ধাক্কা খেতে খেতে হয়তো ওই প্রকাশকের মতিবিভ্রম হয়েছিল। প্রতিবারের মতো এমন ঘটনা যে এবারও ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কই?

জানা গিয়েছে, বারবার স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিস্কার করা এবং মাস্ক পরা নিয়ে সাবধানবাণীতে ছেয়ে ফেলা হবে মেলাপ্রাঙ্গন। এক ছোট প্রকাশককে এ প্রসঙ্গে বলতে শুনেছিলাম, ‘এর সিকিভাগও যদি বই কেনা নিয়ে গিল্ড প্রচার করত, তাতে লাভ হত আমাদের। যে আনন্দ নিয়ে যত মানুষ ড্রামস্টিক চিবোন, তার দশ শতাংশ লোকও যদি বই কিনতেন, বই কেনাটাকেই মুখ্য অ্যাজেন্ডা করে যদি তাঁরা মেলায় আসতেন, বহু ছোট-মাঝারি প্রকাশকদের মুখে হাসি ফুটত।’ শূন্য চোখে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। ফের বললেন, ‘এই অতিমারি কিন্তু একটা সুযোগ করে দিয়েছিল। বইয়ের সঙ্গে বিশুদ্ধ বন্ধুত্ব করার সুযোগ। আমরা তা হেলায় হারালাম।’

বাহারি শপিং মলগুলোতে দেখেছি, খালি হাতে বেরনো লোকদের দিকে মলের প্রহরীরা, সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা ইউনিফর্ম পরা রক্ষীরা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁদের চোখের তারার প্রশ্নগুলো বলে, ফোকটে ঘুরে গেলে এতক্ষণ। কিছু কিনলে কোথায়? বইমেলার স্টলগুলোর দায়িত্বেও যাঁরা নিয়োজিত হবেন এবার থেকে, তাঁদের চোখেও এমন প্রশ্ন কিলবিল করা জরুরি। বইমেলা যে শুধু শীতের রোদ পোহানোর আহ্লাদের থেকে একটু হলেও বড়, আমরা বুঝলে তা আখেরে আমাদেরই লাভ। লাভ প্রকাশনা শিল্পের। বইমেলায় বইয়ের দোকানে যে বিলগুলো হবে, তার সংখ্যা বাড়ুক। বিলের অঙ্কে একটু হলেও দ্যুতি খেলুক। এক্সেলের সেলস রিপোর্টগুলো মুড়ে যাক কচি কলাপাতার রঙে।

বিজনেস রিপোর্টে এই রঙের একটাই মানে। গ্রোথ।