রাজনীতির অনর্থনৈতিকতা

দেবকুমার সোম

 



কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

রাষ্ট্রনীতির সঙ্গে অর্থনীতির একটা সমানুপাতিক সমীকরণ রয়েছে। যাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষে থাকেন, তাঁদের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে হয় বিচক্ষণতার সঙ্গে। তাই দুনিয়ার প্রথম শ্রেণির অর্থনৈতিক দেশগুলোতে, বিশেষত যেখানে পোক্ত গণতন্ত্র রয়েছে, সে-সব দেশের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচকদের কাছে তাদের অর্থনৈতিক দিশা খোলসা করে জানাতে হয়। আমাদের উপমহাদেশের দুর্ভাগ্য এই যে, এখানে এমনটা হওয়ার নয়। বরং এখানে ভোট মানে পাইয়ে দেওয়ার প্রকাশ্য প্রতিযোগিতা। তার কারণ উপমহাদেশটা যখন ব্রিটিশরাজ ভাগ করে দেশীয়দের মধ্যে বেঁটে দিয়ে যায়, তখন অর্থনীতি নয়, বরং অনর্থনৈতিক বিষয়ই মুখ্য ছিল। এর কুপ্রভাবে আজকে পাকিস্তানের অর্থনীতি মৃতবৎসা। বর্তমান ভারতও সেই একই পথে হেঁটে চলেছে। সেদিন যেমন মুসলিম লিগ বিকল্প অর্থনীতির কথা ভাবেনি, তেমন হিন্দু মহাসভাও অর্থনীতিকে প্রাধান্য দেয়নি। আজকের ভারতে যেটুকু আর্থিক উন্নতি ঘটেছে মেনে নিতে দ্বিধা নেই তার কারণ কেন্দ্রে দীর্ঘকালীন কংগ্রেসি সরকার। ভারতীয় জনতা পার্টির জন্মকথা কমবেশি আমরা জানি। দ্বিজাতি তত্ত্বের কাঠামোর ভিত্তিতে তাদের বাড়বাড়ন্ত। সেখানে অর্থনীতির কোনও স্থান নেই।

আমাদের মূল আলোচনার আগে ওপরের কথাগুলো এই কারণে বলে নিতে চাইলাম যাতে আমরা মনে রাখতে পারি ‘হিন্দুত্ববাদ’ নামে ভজঘট একটা জার্গন রাষ্ট্রীয় শাসকেরা বারবার ব্যবহার করলেও, ‘হিন্দু অর্থনীতি’ নামে কোনও আইডিয়া তাঁদের মগজ থেকে আজও আবিষ্কার হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। আমরা এই নিবন্ধে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারে অর্থনীতির ব্যালেন্স শিট পর্যালোচনা করছি না। তার প্রেক্ষিত আলাদা। তার জন্য যোগ্য ব্যক্তির অভাব নেই। আমরা কেবলমাত্র সংসদের উভয় কক্ষে গত বর্ষাকালীন অধিবেশনে পাশ হওয়া অর্থ বিলগুলো নিয়ে কিছু কথা চালাচলি করতে চাই।

গত অধিবেশনে মোট সাতটি অর্থ বিল পেশ ও পাশ করা হয়েছে। তার মধ্যে রাজ্যসভায় দ্য অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন বিল ২০২১-এর ৩ ও ৪ নম্বর ধারা এখনও স্থগিত আছে। এই দুটো বিলের সঙ্গে সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষার সরাসরি কোনও যোগাযোগ নেই। মূলত সংবিধানের ১১৪(৩) ধারা অনুযায়ী এই দুই বিলের সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। বাকি যে পাঁচটা বিল পাশ হয়েছে সেগুলো হল:

  1. দ্য ইনসলভেন্সি এন্ড ব্যাঙ্করাপ্টসি‌ কোড (সংশোধন) বিল, ২০২১।
  2. দ্য জেনারেল ইন্সিওরেন্স বিজনেস (ন্যাশানালাইজেশন) সংশোধনী বিল, ২০২১।
  3. দ্য ডিপোজ়িট ইন্সিওরেন্স অন্ড ক্রেডিট গ্যারেন্টি করপোরেশন (সংশোধন) বিল, ২০২১।
  4. দ্য ট্যাক্সেশন‌্‌ ল (সংশোধন) বিল, ২০২১।
  5. দ্য ট্রাইবুনাল রিফর্মস‌্‌ বিল, ২০২১।

তালিকা দেখে বোঝা যাচ্ছে কোনওটাই মূল বিল নয়। সবকটাই সংশোধনী বিল (এমনকি রিফর্ম শব্দটাও তেমন গোছের)। অর্থাৎ আগে এই আইনগুলো দেশে ছিল। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার গত আট বছর ধরে যা করে আসছে, বিশেষ এক শ্রেণির কর্পোরেটের সুবিধার জন্য দেশের প্রতিষ্ঠিত আর মান্য আইনগুলোকে সংশোধন করছে। এখানেও ব্যাপারটা তাই। প্রশ্ন হল কী সংশোধন করছে? পুরোন আইনকে কি সমকালীন এবং আরও দৃঢ় করার জন্য এই সংশোধন? না এর পেছনে সরকারের অন্য কোনও উদ্দেশ্য রয়েছে? আমরা সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজব।

আমাদের দেশে শুরুর সময় থেকেই সব কেন্দ্রীয় সরকার চেয়েছে আইনের রক্ষাকবচ যেন তাদের হাতে থাকে। সরকার যেন তার সাংবিধানিক দায় ও দায়িত্ব পালন করার ক্ষেত্রে রক্ষাকবচগুলোকে ব্যবহার করতে পারে। এর সাথে এটাও আমাদের দেশের রাজনীতিতে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যে, আইনব্যবস্থাকে সমকালীন করে তোলার জন্য সময়াসময় তাকে সংশোধন করা। গত সত্তর বছর ধরে বিভিন্ন সরকার তার নিজ গোষ্ঠীর প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে চেয়ে অনেক সময় অর্থনৈতিক আইনগুলোর অপব্যবহার ঘটিয়েছে। এর ফলে আয়ের অসমতা যেমন বেড়েছে, তেমন বেড়েছে কালো টাকার অর্থনীতি। আর সেই অর্থনীতিকে টিঁকিয়ে রাখতে সরকার আরও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছে। রাষ্ট্রনীতির ঘটেছে দুর্বৃত্তায়ন। আজ এসব কোনও নতুন কথা নয়। বরং নতুন যে প্রসঙ্গটা আমাদের সামনে বারবার ঘুরেফিরে আসছে, তা হল রক্ষাকবচ। বর্তমান সরকার সুচতুরভাবে এক-একটা শক্তিশালী আইনের সংশোধনী এনে সংবিধান যে রক্ষাকবচ সরকারকে দিয়েছে, সেই রক্ষাকবচ খুলে দিচ্ছে। ফলে আইনের মূল স্পিরিট বা উদ্দেশ্য সুরক্ষিত থাকছে না। সরকার কেন করছে? তার বহু অপব্যাখ্যা সরকারের বিভিন্ন মাধ্যম (মিডিয়া সহ) দেশবাসীকে দিচ্ছে। আর এসব ব্যাখ্যা তারা যতই দিচ্ছে, ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে যাঁরা বর্তমানে দেশের অর্থনীতির নিয়ন্তা, তাঁর হয় অর্থনীতির ক খ বোঝেন না, অথবা বুঝেও কোনও এক ভয়ানক ষড়যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে সমগ্র দেশের অর্থনীতিটা তুলে দিতে চাইছেন বিশেষ কয়েকটা বণিক পরিবারের হাতে। যাঁদের নেই কোনও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা। যাঁদের নেই ভোটারদের তুষ্ট করার বিন্দুমাত্র দায় বা দায়িত্ব। মুনাফার জন্য তাঁরা যেমন মুফতে ইন্টারনেট পরিষেবা দিতে পারেন, তেমনই দরকার পড়লে মুনাফায় না পোষালে জনপ্রিয় পরিষেবার গণেশ উলটে দিতে পারেন। আমরা সদ্য পাশ হওয়া বিলগুলো নিয়ে সামান্য আলোচনা করব, তার আগে সাম্প্রতিক দুটো ঘটনা পাঠককে মনে করিয়ে দিতে চাই।

রাজীব গান্ধির সময় স্যাম পিত্রোদা ভারতের টেলিকমিউনিকেশনে এক রকম বিপ্লব এনে ছিলেন। তার সুফল ভারতের অর্থনীতি পেয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, যেখানে সরকারের অংশীদারিত্ব আছে, সেখানকার সার্বিক অবস্থা বহুকাল খারাপ। রাজীব গান্ধির সময় থেকে এই সংস্থাগুলোর পুনর্বাসন ব্যবস্থা শুরু হয়। সেখানে ডিফেন্স, রেলওয়ে, অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস বা স্টিল-ইস্পাতের মতো সংস্থাগুলোকে সাদা হাতির তকমা দিলেও, তাদের খোলনলচে বদলে দেওয়া হয়নি। এর জন্য বহু বাধা সরকারপক্ষকে সইতে হয়েছিল। এবং সেদিন কংগ্রেসের নির্বাচনে হারার অন্যতম কারণ ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে প্রাইভেট কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ফেলায়। এর ফলে ভারত টেলিফোন ভেঙে বিএসএনএল হয়েছে। তারপর প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর সঙ্গে এঁটে উঠতে না পেরে সংস্থার অবস্থা হয়েছে মরণাপন্ন। ঠিক এই সময় বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার রিলায়েন্সকে ফোর-জি চালু করার ক্ষমতা দিয়ে দেয়। যুদ্ধে জেতার জন্য কলাকৌশলের চেয়ে বেশি দরকার আধুনিক সমরাস্ত্র। যে কারণে পানিপথের যুদ্ধে বাবরের কাছে ইব্রাহিম লোদির পরাজয় ঘটে। প্রায় মুফতে ফোর-জি টেকনোলজি নিয়ে এসে রিলায়েন্স দেশ থেকে সব প্রতিযোগীদের নিমেষে হটিয়ে দিল। তারপর? এখন তাদেরই রাজ। তারা যে মূল্য ধার্য করবে, যে শর্ত দেবে, গ্রাহককে তা মেনে নিতে হবে। এভাবেই তো নীলকরেরা নীলের চাষ শুরু করিয়ে শেষে আমাদের দেশের অর্থনীতিকে ধুলিসাৎ করে দিয়েছিল।

দ্বিতীয় ঘটনা ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণ। ১৯৯০ দশকে হষর্দ মেটার শেয়ার কেলেঙ্কারির পরে তদনীন্তন কেন্দ্রীয় সরকার রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গর্ভনর মোইদাভোলু নরসিংহমের নেতৃত্বে ব্যাঙ্ক সংস্করণ কমিটি গঠন করে। সেই কমিটির সুপারিশ মেনে পরবর্তী প্রায় পঁচিশ বছরে দেশে ব্যাঙ্কশিল্পের খোলনোলচে বদলে যায়। নিউ জেনারেশন প্রাইভেট ব্যাঙ্ক আসে। আসে বিদেশি ব্যাঙ্ক। কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অবস্থার উন্নতি হয়। এরপর আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্কিং পরিষদের (BASEL) প্রস্তাব অনুযায়ী ব্যাঙ্কের মূলধন কাঠামো যুগোপযোগী করা হয়। অথচ, মূল যে অসুখ, অর্থাৎ ব্যাঙ্ক পরিচালনায় সরকারের খবরদারি আর তার ফলে অযোগ্য, অপরাধমনস্ক কর্মচারীদের কর্তা বানিয়ে দেওয়ার প্রবণতা কোনও সরকারই তা বন্ধ করে না। বরং ব্যাঙ্কগুলোকে নিজস্ব রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার রেওয়াজ় হয়ে উঠল। চিট ফান্ড ব্যবসায় কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলো রইল ঠুঁটো জগন্নাথ। এর ফলে ব্যাঙ্কশিল্পে দুরবস্থা আরও শোচনীয় হল। কর্মী নিয়োগ বন্ধ হল। মূলধনের অভাবে ব্যাঙ্কগুলো মৃত্যুশয্যা নিল। এরপর ২০১৪ সালে কংগ্রেস সরকারের শেষ পর্যায় পি জে নায়েকের নেতৃত্বে ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণ কমিটি তৈরি হল। যা বাস্তবায়িত করতে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার কালবিলম্ব করেনি। সাপে ছোবল মেরেছে গোড়ালিতে আর আমাদের সরকার মাথায় তাগা বেঁধে সাপের বিষ যাতে রক্তে না ছড়িয়ে যায় সেই ব্যবস্থা নিল।

দ্য ইনসলভেন্সি এন্ড ব্যাঙ্করাপ্টসি‌ কোড (সংশোধন) বিল, ২০২১: মূল আইন ২০১৬ সালের। সেই আইন পাশের সময় অর্থমন্ত্রী ছিলেন অরুণ জেটলি। আর্থিক মন্দার (বাহ্যিক এবং আভ্যন্তরীণ) কারণে যদি কোনও ক্ষুদ্র কিংবা মাঝারি শিল্প উঠে যায়, তাহলে সরকারি প্যাকেজে সর্বাধিক এক কোটি টাকার রিলিফের ব্যবস্থা এই বিলে হয়েছে। এখন সমস্যা হল অধিকাংশ ক্ষুদ্র কিংবা মাঝারি শিল্প পারিবারিক অংশীদারিত্বে চলে। ফলে ব্যবসার সমস্ত মুনাফা পরিবারের হাতেই থেকে যায়। বহু সময় দেখা যায় পরিবারে পুরুষ সদস্য থাকা সত্ত্বেও কোম্পানির ডিরেক্টর বোর্ডে পরিবারের বৃদ্ধ আর মহিলারা রয়েছেন। কারণ খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে পরিবারের পুরুষদের নাম ব্যাঙ্কের ঋণখেলাপির তালিকায় রয়েছে। এই প্যাকেজ মূলত স্বভাব-ঋণখেলাপি ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বাড়াবে।

দ্য জেনারেল ইন্সিওরেন্স বিজনেস (ন্যাশানালাইজেশন) সংশোধনী বিল, ২০২১: ১৯৭২ সালে ইন্দিরা গান্ধি আরও অনেক সংস্থার সঙ্গে সাধারণ বিমা ব্যবসাকেও রাষ্টায়ত্ত করেছিলেন। কারণ সাধারণ বিমা প্রকল্প সামাজিক ছাতার মতো। বর্ষাকালে ছাতা ছাড়া রাস্তায় বের হলে বৃষ্টিতে যেমন ভেজার সম্ভাবনা থাকে, ঠিক তেমন ভূমিকা সাধারণ বিমার। এই বিমার সঙ্গে সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক বেঁচে থাকার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন কোভিড পরিস্থিতির পরে চিকিৎসা বিমার খরচ কেমন আকাশচুম্বী হয়েছে। সরকার নতুন যে বিল এনেছে, তাতে ইচ্ছে করলে সরকার সাধারণ বিমাশিল্প থেকে নিজের অংশীদারী সম্পূর্ণ তুলে নিতে পারে। অর্থাৎ যা বিরোধীরা বলছেন, বেচে দিতে পারে। আর সরকার যদি কোনও সংস্থা বেচে দিয়ে তার দায় ঝেড়ে ফেলে, তাহলে বাজার অর্থনীতির সূত্রগুলো থেকে আমরা বুঝতেই পারছি ভবিষ্যতে রিলায়েন্স জিও সিমের মতো সাধারণ বিমাশিল্পও হয়ে যাবে একচেটিয়া কোনও বিশেষ এক পরিবারের কুক্ষিগত।

দ্য ডিপোজ়িট ইন্সিওরেন্স অন্ড ক্রেডিট গ্যারেন্টি করপোরেশন (সংশোধন) বিল, ২০২১: ১৯৬১ সালে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের আওতায় DICGC চালু হয়। এটি একটি কর্পোরেশন। যেখানে প্রতিটা বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ককে তার আমানতের একটা নির্দিষ্ট অঙ্ক কর্পোরেশনের কাছে বিমার প্রিমিয়াম হিসাবে গচ্ছিত রাখতে হয়। মূল আইনে আমানতের পাশাপাশি ব্যাঙ্কের মোট ঋণের ওপরও প্রিমিয়াম দিতে বলা আছে। এটি একটা বিশেষ রক্ষাকবচ। ব্যাঙ্ক এবং তার আমানতকারীর জন্য। মূল আইনে বলা আছে যদি কোনও কারণে কোনও ব্যাঙ্কের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায় (সে কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্ক, গ্রামীণ ব্যাঙ্ক কিংবা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক যাইহোক), তবে আমানতকারী পিছু কর্পোরেশন একটা নির্দিষ্ট টাকা দেবে। আগের আইনে এই টাকার সর্বাধিক অঙ্ক ছিল এক লাখ আর তা পাওয়ার সময়সীমা ছিল দীর্ঘকালীন। তবে উল্লেখ থাক ব্যাঙ্কশিল্পের জাতীয়করণের পরে দেশের কোনও বড় ব্যাঙ্ক উঠে যায়নি। যখনই ব্যাঙ্কের বিপদঘন্টা বেজেছে, সরকার দায়িত্ব নিয়ে সেই ব্যাঙ্ককে অন্য ব্যাঙ্কের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। এমনকি সিকিমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী নরবাহাদুর সিং ভাণ্ডারির তৈরি ‘সিকিম ব্যাঙ্ক’ আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে ডুবতে বসলে তদনীন্তন কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রাইভেট ব্যাঙ্ককে ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে তাকে উদ্ধার করেছিল।

বর্তমান সংশোধিত আইনে বলা হয়েছে আমানতকারী এক লাখ টাকার বদলে সর্বাধিক পাঁচ লাখ টাকা পাবে। আর তা মিটিয়ে দেওয়া হবে ব্যাঙ্কের ব্যবসা ডোবার নব্বই দিনের মধ্যে। এখন কথা হল এর মধ্যে দিয়ে সরকার তার দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলল। এখন থেকে কোনও ব্যাঙ্ক ডুবে গেলে সরকার আমানতকারীর কোনও দায় আর নেবে না। এখন প্রশ্ন হল ব্যাঙ্ক ডুববে কেন? আজকের দিনে ব্যাঙ্ক যেমন ঋণখেলাপের কারণে ডুবে যায়, তেমন প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে না পেরেও তাদের লালবাতি জ্বলে। যেমন আমাদের রাজ্যের কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্কগুলোর মর্মান্তিক দশা। পুঁজির অভাবে আজ এই ব্যাঙ্কগুলো প্রাইভেট ব্যাঙ্কগুলোর কাছে প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছে। দক্ষিণ ভারতের বহু পুরনো আমলের প্রাইভেট ব্যাঙ্ক আছে, যাদের অবস্থাও মৃতপ্রায়। এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিম্ন আয়ের মানুষ তাঁদের আমানত রাখেন। তাঁদের জন্য সরকারের কোনও দায় আর থাকছে না।

চতুর্থ এবং পঞ্চম সংশোধনী বিল দুটো মূলত কেঁচে গণ্ডুষ হওয়া। চতুর্থ বিল প্রণব মুখোপাধ্যায় অর্থমন্ত্রী থাকার সময়কার আইন। যা ছিল অযৌক্তিক। ইন্টারন্যাশান্যাল ট্রাইবুনালে এই আইনের ফলে ভারত সরকারকে যথেষ্ট তিরস্কৃত হতে হয়েছে। ফলে পুনর্মুষিক ভবঃ। পঞ্চম বিলটির সঙ্গে আম আদমির প্রত্যক্ষ কোনও সম্পর্ক নেই। ফলে এখানে আলোচনা বাতুলতা।

আর্থিক বিলগুলোর এই সংশোধনীর মধ্যে সবচেয়ে হন্তারক বিল দুটি। যে দুটির সঙ্গে সাধারণ মানুষের প্রত্যক্ষ আর্থিক সম্পর্ক। নির্বাচনে সরকার যা প্রতিশ্রুতিই দিয়ে থাক, গত আট বছরে একটার পর একটা অর্থ বিল সংশোধন করে কেন্দ্র সরকার দেশের আর্থিক দায় থেকে যেমন নিজেদের হাত ঝেড়ে ফেলছে, ঠিক তেমনই কড়গোনা কযেকটি বিশেষ কর্পোরেট পরিবারের হাতে দেশের মানুষের আর্থিক অবস্থা ছেড়ে দিয়ে মানুষগুলোকে ঔপনিবেশিক যুগের আর্থিক শোষণের সময়ে ফিরিয়ে দিচ্ছে। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে যারা দেশের স্বাধীনতা চেয়েছিল, তাদের কাছে থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা আর যাইহোক বুদ্ধিমত্তা নয়।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...