Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ছায়াপাখি, নীল হ্রদের তীরে — পর্ব ৫

বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

পরিযায়ী পাখি

১.

শীতের বিকেল বড় ফাঁকির। এই যদি দুপুর, দ্যাখ না দ্যাখ সন্ধ্যে। আলো কমেছে কি কমেনি, দাঁত বের করা পিচের রাস্তায় হাতে গোনা লোক। আকাশে কুয়াশার সর জমছে।  হাওয়ায় ঠান্ডার কামড়, সঙ্গে কোক ওভেনের কালিমা। স্টিলসিটির বাতাস পাতায় সবুজের উল্লাস জাগতে দেয় না কখনওই। শীতের রিক্ততায় তাদের আরও দৈন্যদশা। তবু বিকেলের পড়ন্ত আলোর জাদুকাঠিতে সবই মায়াময়। স্তব্ধতা চিরে খেলার মাঠ থেকে ক্যাচ ধরার উল্লাস জেগে উঠছে মাঝে মাঝে। উঠোনে শুকনো পাতা মড়মড়িয়ে দৌড়ে গেল কেউ। হয়তো লেখিটা । বছর ঘুরলে মাধ্যমিক দেবে তবু বড় হল না! রেখার বিষন্ন ঠোঁটের কোণায় প্রথমার চাঁদের মত চিলতে হাসি ভেসে উঠল। জানালার কপাট বন্ধ করতে এসে গরাদে গাল চেপে দাঁড়িয়েছিল কতক্ষণ, কে জানে। গালের উপর দ্রুত গুটিয়ে আসা দিনের শেষ সূর্যের খেয়ালি তুলির টান। নাকের ফুলটা সেই আলো চুরি করে মাঝে মাঝেই ঝিলিক মারছিল। কিন্তু চোখের দু’কোল ছাপানো বিষাদকে আড়াল করতে পারেনি। শীতের শুকনো হাওয়ার মত থেকে থেকে এক একটা চিন্তা ধুলোর ঝড় তুলছে। হীরুটার কথাই ঘুরে ফিরে। তাদের সেই কচি বয়সের ভালবাসা। মুখচোরা ছেলেটা সোজাসুজি কোনওদিন বলতে পারেনি, কিন্তু রেখা অত বোকা নাকি, বুঝবে না? সেও তো হীরক অন্ত প্রাণ ছিল। মা-ও একটু আধটু বুঝত বোধহয়। শুধু জানত লেখি। যখন কুমিরডাঙ্গা খেলার বয়স গেল আর তারপর ওরা পাশের পাড়ায় উঠে এল, লেখিকে দিয়ে কায়দা করে ডাকিয়ে এনেছে হীরককে কতবার। বিশেষ করে খেলা দেখার জন্য। তখন টিভি নতুন, খুব কম বাড়িতেই আছে। রেখাদের বাড়িতে ছিল শুরুর থেকেই। দূরদর্শনে ক্রিকেট খেলা দেখাত। হীরক আসত দেখতে। ও কি ক্রিকেট দেখতেই শুধু আসত? ওর আর এক বন্ধুর বাড়িতেও তো টিভি ছিল। সেখানে কেন যেত না তাহলে? ক্রিকেট অত না বুঝলেও রেখা বসে খেলা দেখত হীরকের সঙ্গে। খুনশুটি করার জন্য। একবার সুনীল গাভাস্কারের সেঞ্চুরি হব হব, রেখা ফট করে টিভি বন্ধ করে দিল অনেক খেলা দেখেছিস, আয় এবার গল্প করি বলে। কি রেগে গেছিল! রাগ ভাঙ্গাতে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বুকে টেনে নিয়েছিল রেখা। সেদিন নিজেকে কেমন বড় বড় মনে হয়েছিল। আর মনে হয়েছিল এই ছেলেটা আমার, আমার ভালবাসা। হীরক ওর হাতটা টেনে নিয়ে আঙ্গুল নিয়ে খেলতে খেলতে ঠোঁটের কাছে নিয়ে এসেছিল, রেখার আঙ্গুলে পড়ছিল ওর গরম নিঃশ্বাস। হীরক ওর দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিল, ছুঁয়ে দিচ্ছিল যেন সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে। সে এক অদ্ভুত শিহরণ। চোখ বুজলে এখনও স্পষ্ট দেখতে পায় রেখা। অদ্ভুত লাগে। তবুও কেমন করে ওরা দূর থেকে দূরে ভেসে গেছিল। কেন তার কোনও কারণ খুঁজে পায় না রেখা।  তারপরে উপায় হয়নি যে আবার এক ঘাটে নোঙর করবে। কিন্তু কিসের থেকে কী হল  মরা গাঙ্গে আবার বান।  এখন এক মুহূর্ত ওর কথা না ভেবে থাকতে পারছে না। অথচ দেড় মাস হয়ে গেল, দেখা কেন কথা বলবারও কোনও উপায় নেই। সেই যে যাবার সঙ্গে সঙ্গে একটা চিঠি। ব্যাস তারপরে না খবর না কিচ্ছু। একবার ফোন করে যে কথা বলবে, ফোন কই। পাশের বাড়িতে গিয়ে তো আর ওর ফোন নেওয়া যায় না। কিন্তু দেড় মাস হয়ে গেছে আবার একটা চিঠি দেবে না?  তবে কেন চিঠিতে রোজ রোজ লিখবার প্রলোভন জাগানো? সেই  শুধু সাত তাড়াতাড়ি রাত জেগে উত্তর লিখেছিল। নতুন দেশে গিয়ে সবাইকে ভুলে গেল বুঝি। অভিমান জমার সঙ্গে সঙ্গে চিন্তাও। কিছু কি হল? অসুখ বিসুখ? কিংবা  রেখা কিছু একটা লিখেছে যাতে হীরু রাগ করেছে?  সাত পাঁচ ভাবনায় বুকটা তিরতির করে উঠল। ঘর-পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘে ডরায়। রেখার যে পেয়ে হারানোর কপাল। সাতপাঁচ ভেবে লেখিকে পাঠিয়েছিল হীরুদের বাড়ি। নিলীমামাসীর কাছ থেকে খোঁজ নিইয়েছে। ওরাও কোনও চিঠি পায়নি।

তবে পৌঁছানোর পর টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিল। তারপরে ফোন। এত নাকি ব্যস্ত, বাড়িতেও চিঠি লিখতে পারেনি। এর মধ্যেও রেখাকে যে চিঠি পাঠিয়েছিল, সেটাতেই মনের শান্তি। বিশাল লম্বা, অনেক না বলা কথা নিংড়ানো সেই চিঠি। বারবার করে পড়েছে। পড়তে পড়তে হেসেছে, কেঁদেছেও। যেসব কথা হীরু মুখে কখনও বলতে পারেনি, সেইসব উগড়ে দেওয়া চিঠি। এই চিঠি পাওয়ার আগে হীরুর মনে কোথায় তার জায়গা, কতটুকু তার মূল্য এসব কিছুই বুঝতে পারত না রেখা।

সেই কুমীরডাঙ্গা বয়সের চেনা তাদের। কিন্তু তবুও সত্যিকারের জানা হয়নি একে অপরকে। শুধু কিছু ঘটনাই সেই চেনা বেলার মাইল ফলক হয়ে মনে রয়ে গেছে। যেমন শীতকালে মাঠে তাঁবু খাটিয়ে ফিস্ট করার কথা। বেশিরভাগ রান্নাই এর-ওর বাড়ি থেকে নিয়ে আসা হত। ওরা নিজেরা হয়তো বানাল ভাত আর আলুভাজা বা ওইরকম সোজা কোনও কিছু। মা পই পই করে বলে দিয়েছিল বঁটি ধরতে জানিস না, তুই যেন আলু কাটার ধার দিয়েও যাবি না। কিন্তু রেখা ওটাই করল আর আঙ্গুল কাটল। রক্ত ঝরছিল। ওইটুকু মেয়ে তখন, তবু রেখার সহ্যশক্তি বেশ। একটুও কাঁদেনি। হীরু বেচারার চোখ ছলছল। বীরুদা কোথা থেকে সাদা ন্যাকড়া এনে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছিল চট করে। হীরুর এমন ভাব যেন নিজের আঙ্গুল কেটেছে। তর্জনী চেপে বসে রইল যতক্ষণ ব্যান্ডেজ বাঁধা না হয়। কি হাসি পেয়েছিল রেখার। আর তেমনি রাগ। কেন তুই এসে বেঁধে দিতে পারলি না? তখন কাঁচুমাচু মুখে বলেছিল, আমি তো কাপড় খুঁজে আনলাম। কিন্তু রক্ত দেখলে আমার কেমন করে। রেখা যখন বলেছিল জানিস লেখি হবার সময় মার শরীর থেকে কত রক্ত বেরিয়েছিল, আমার বাবা যদি তখন পালিয়ে যেত মা-র কী হত, হীরু বীরত্ব দেখিয়ে বলল, আমি তোকে ছেড়ে কখনও পালাব না। বলেই লজ্জা পেয়ে ছুট। এমন অনেক কথাই হয় ছোটবেলায়, সেটা কে ধরে বসে থেকে কি লাভ। তবু ওইসব স্মৃতিগুলো আজকাল মনের মধ্যে বেশি বেশি গুনগুনায়।  ডাকঘর নাটক করেছিল পাড়ার রবীন্দ্রজয়ন্তীতে। হীরু অমল আর রেখা সুধা। তখন ক্লাস সেভেন, না না এইট। নাটকে অমলকে জানালার পাশে বসিয়ে সুধা ফুল তুলতে চলে গেল। অমলের কি আকুতি, আমাকে ভুলে যাবে না? আমার নাম অমল। মনে থাকবে তোমার? সুধারূপী রেখা ফুলের সাজি তুলে চলে যেতে যেতে বলেছিল, না ভুলবো না, দেখো, মনে থাকবে। ভাবতে ভাবতে চোখে জল ভরে এল রেখার। ফিসফিস করে বলল, রেখা তোকে ভোলেনি হীরু। তুই বরং বারবার ভুলে চলে গেছিস।

যেবার কলকাতায় পড়ার সময় বন্ধুদের সঙ্গে রেখা গিয়েছিল যাদবপুরে সংস্কৃতিতে, হীরু কেমনধারা করল। এমনিতে বেশ আড্ডা জমেছিল। দুর্গাপুরের অনেক ছেলেমেয়ে ওখানে। মনীষকে চিনত, যদিও পছন্দ করত না রেখা। ওদের গানের কমপিটিশানে নাম দিয়েছিল রেখা। হীরু রেখাকে নিয়ে ক্যাম্পাস দেখাতে নিয়ে গেল। কিন্তু এমন কিছু কথা বলল রেখা কাঁদতে কাঁদতে পালিয়ে এল। যদি সত্যি ভালবাসত তারপর এতদিন কলকাতায় ছিল একবার খোঁজ নিয়ে দেখত না? আসলে শানুর ব্যাপারটা ওর মাথায় ঘুরছিল। কী শুনেছে, কী জেনেছে কে জানে। লোকে তো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলবেই। সেইজন্যে প্রথমেই সেই প্রশ্ন। না শানুর সঙ্গে কি হয়েছিল তো?। অ্যায়সান রাগ হয়েছিল রেখার। হ্যাঁ এটা ঠিক, সে শানুর দিকে ঝুঁকেছিল। কী করবে রেখা? ভালবাসার প্রতিফলন লাগে, অন্যদিক থেকে একটু সাড়া। হীরু ভাল বন্ধু ছিল, এমন গল্প তো হতই, খুনশুটিও। রেখা চাইত হীরু আরও কিছু বলুক। কিন্তু বলেনি তো কখনও। এর মধ্যে শানু এল। স্কুলে দেখেছে, মুখচেনা। এক বছরের সিনিয়ার। চিনত কিন্তু জানত না। তারপর স্কুল  ফাইনালে এমন রেজাল্ট! চারদিকে তখন ওকে নিয়ে একেবারে ধন্যি ধন্যি। এমন কপাল বাবার কাছে পড়তে এল। অবশ্য পরে শানু বলেছে রেখার জন্যেই নাকি পড়তে এসেছিল। তবুও তেমন বেশি কিছু কথা হত না। একদিন শানু এসে বসে আছে, বাবা তখনও কলেজ থেকে ফেরেনি। রেখা উঁকি মেরে দেখল ও একা। চান্স নিয়েছিল। জানতে চেয়েছিল স্কুল ফাইনালের হিস্ট্রির কোন নোটস আছে কিনা। এত ভাল যার রেজাল্ট, তার নোটস পেলে অর্ধেক কাজ হাসিল। ও দিতে চাইবে এমন ভরসা ছিল না। কিন্তু শানু এক কথায় মাথা হেলিয়ে হ্যাঁ। শুধু তাই নয় অন্য সাবজেক্টের নোটস লাগবে কিনা সেটাও জানতে চাইল। অমনিভাবেই কথা শুরু। তারপর নদীর ঢালের মত কথা গড়িয়ে গেল। শানু ঝপ করে জিজ্ঞেস করেছিল, মনে আছে রেখা অনেকদিন আগে প্রথম তোমাদের পাড়ায় এসে হীরুর বাড়িতে যেতে গিয়ে ভুল করে তোমাদের বাড়িতে ঢুকে গেছিলাম? রেখার বেশ মনে ছিল। কিন্তু জিভে কোন দুষ্ট সরস্বতী ভর করেছিল, দুম করে বলে দিল কই মনে পড়ছে না তো। ও কিন্তু এক্কেবারে দমেনি। একটা নিঃশব্দ হাসি বরং কচি গোঁফের আগায় ঝুলছিল। সেই হাসির রেশ নিয়েই বলল, আমার কিন্তু একদম ছবির মত মনে আছে। তুমি সেদিন একটা সবুজ কালো ছাপা স্কার্ট পরেছিলে, উপরে হলদে ম্যাগি হাতা জামা। দুটো বেনুনী সাপের মত তোমার কাঁধ ছাড়িয়ে ঝমঝমাচ্ছিল। রেলিং-এ হাত দিয়ে গম্ভীর মুখে বললে, হীরু এই বাড়িতে থাকে না। এটা বলার সময় এমন গাল ফুলাল, রেখা হেসে গড়িয়ে পড়ে আর কি। ধ্যাত, আমি অমন কোলাব্যাঙের মত গাল ফোলাই?

কিন্তু শুনে রেখার ভালও লাগছিল। সেটা মুখ দিয়ে বেরিয়েই গেল, বাব্বা এতসব তোমার মনে আছে? হবে না কেন, স্কুল ফাইনালে স্ট্যান্ড করা ছেলে, স্মৃতিধর।

শানু মোটেই লজ্জা পেল না। যেন ওই প্রশংসাটুকু ওর প্রাপ্য। ওইটুকু ছেলে, বেশ গুছিয়ে কথা বলছিল। আসলে কিছু কিছু ঘটনা এমন হয় ভুলে গেলে জীবনেরই কোনও মানে থাকে না। তাছাড়া তোমার বলার মধ্যে যে কী ছিল। আমার মনে হল যেন কেউ টুংটাং করে পিয়ানো বাজাল। অথচ তোমার চোখে বেশ বিরক্তি। তা সত্ত্বেও তোমার গলা অমনি মিষ্টি। রবীন্দ্রজয়ন্তীতে তোমার গান শুনেও বুঝেছি। তারপরেই টপ করে বলল, আমাকে একটা গান শোনাবে একদিন?

শুনতে শুনতে কেমন গা শিরশির করে উঠছিল রেখার। সে তো তখন কিশোরীই। তবু হাল যেন পরাণ পিরীতি লাগি থির নাহি বাঁধে। এই ছেলেটা এমনভাবে তার প্রতিটা শব্দকে মনে রেখেছে! তার পোশাক, তার দাঁড়ানো, তার কথা বলা কিচ্ছু ভোলেনি? এই কি তাহলে ভালবাসা? শানুর কথা বলা, প্রতিটা শব্দে এক ধরনের গভীরতার প্রকাশ পাচ্ছিল যেটা পনেরো বছরের রেখাকে একেবারে উড়িয়ে নিয়ে গেল। তখনও জীবনে কীই বা দেখেছে। তার আগে কোনওদিন এমনভাবে বুক কাঁপেনি। শরীরের প্রতিটা রোমকূপে ভাল লাগার বিস্ফোরণ ঘটছিল। অস্ফূটে জিজ্ঞেস করেছিল, এত কিছু মনে করে রেখেছ? কেন শানু? সেদিন বাবা এসে গেল ঠিক সেই সময়েই। কিন্তু পরের দিন হিস্ট্রির নোটস হাত বদলের সময় উত্তর এসেছিল একটা চিরকুটের মাধ্যমে। ওতে শানুর লেখা একটা কবিতা। এখন আর তার কথা মনে নেই, কিন্তু কতবার যে উল্টেপাল্টে পড়েছিল। তার জন্য, শুধু তার কথা মনে করে একটা কবিতা লেখা হতে পারে! সেদিন সন্ধ্যেবেলায় অনেকক্ষণ হারমোনিয়াম নিয়ে বসেছিল রেখা। গাইছিল রবি ঠাকুরের প্রেম পর্যায়ের গানগুলো একটার পর একটা। মা কি জানবে কী এর উৎস। খুব খুশি ছিল মেয়ে এতক্ষণ ধরে গলা সাধছে বলে। আজ বড় ভাল গাইছিলি রেখা। রোজ এমন কেন প্রাণ দিয়ে গাস না রে?

এইভাবে যে সম্পর্কের চড়াই দেওয়া হল, তার ঘুড়ি আকাশে পতপত করে উড়তে থাকল খুব শিগগিরি। না ঘুড়ি না, পায়রা। ঝটাপট করে ডানা ঝাপটে দুটো লক্কা পায়রার মত ওরা আকাশে খেলে বেড়াচ্ছিল।  শানু এরপর যেন ইচ্ছা করেই একটু আগে আগে এসে যেত। রেখাও অপেক্ষায় থাকত। কথা বলার জন্য। মার চোখ এড়িয়ে কোন কাজের অছিলায় পড়ানোর ঘরে ঢুকে কথা বলে নিত। কিন্তু সত্যিই কি মা কিছু জানত না? না কি জেনেও প্রশ্রয় দিয়েছে! শত হলেও শানুর তখন খুব নাম, স্কুল ফাইনালে স্ট্যান্ড করা ছেলে, বাবা নামজাদা প্রফেসার। না করার কোনও কারণ ছিল না। অথচ কদিন আগে কথায় কথায় চিরাচরিত ছেলেঘটিত সাবধানবানী দিতে দিতে আলটপকা মা বলল শানুকে নিয়ে ঘটনাটা ভুলে যাওনি নিশ্চয়। আমি যদি সঙ্গে সঙ্গে দিদির ওখানে পাঠিয়ে না দিতাম তোমার বদনাম হতে পারত। রেখার চোখের কোলে জল দেখে সঙ্গে সঙ্গে যদিও কাছে টেনে নিয়েছে মাধুরী। ভেবো না আমি তোমাকে কোনও দোষ দিচ্ছি। ভুল করতে যাচ্ছিলে, কিন্তু করোনি। ঠিক সময়ে ফিরে এসেছো। না হলে ওর সব কিছুর জন্যে তোমারই নাম খারাপ হত। সবাই তোমার দিকে আঙ্গুল দেখাত। তুমি তখন কলকাতায়, কানাঘুষো হয়েছে কিন্তু কারও মুখ দিয়ে কোনও কথা বের হয়নি। অন্তত সামনাসামনি।

শানুর কাছ থেকে ফিরে কি এসেছিল রেখা? সে তো ফেরেনি। বরং শানুই দূরে সরে গেছে। যেমন ঝপ করে একদিন কাছে এসেছিল, তেমনি কোনও কারণ না জানিয়েই হঠাৎ দূরে চলে গেল। অথচ এমন তো হবার কথা ছিল না। শুধু বাড়িতে নয়, মাকে লুকিয়ে বাড়ির বাইরে দেখা করছিল। স্কুল পালিয়ে লাভ স্টোরি সিনেমাটা দেখতে গেছিল দুজনে। দুবার। অন্ধকারে হাতে হাত রেখে বসে থাকার কি শিহরণ। শানুর সাইকেলে চেপে গড় জঙ্গলে ঘুরতে গেছিল একদিন। কত কথা হল সেদিন, রেখার চারপাশে একটা স্বপ্নের মায়াজাল বোনা হচ্ছিল যেন। এর মধ্যে শানু একটু বেশি সাহসী হয়ে রেখাকে চুমু খেতে গেছিল। মা ছোটবেলা থেকে পাখিপড়া করেছে একটা কুমারী মেয়ের কেন সব ব্যাপারে সাবধান থাকা উচিত। কোনও ছেলেকে খুব ভাল লাগলেও না। সেই সময়ে সেটাই মাথায় এসেছিল রেখার। শানুকে দুহাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছিল। একদম যেন রিফ্লেক্স অ্যাকশান। অথচ শানু যখন দুহাতে ওকে জাপ্টে ধরেছিল ওর তো ভালই লাগছিল। মেয়েদের শরীরে একটি অন্তঃসলিলা নদী আছে, তাতে বান ডেকেছিল। সত্যি ভালবেসেছিল রেখা শানুকে। শানুর বাইরের আমি কি হনু রে আস্তরণ ভেদ করে ওর একাকীত্ব, খাঁচায় আটকানো পাখির ছটফটানি ছুঁতে পেরেছিল রেখা। ওর চঞ্চল ভাবুক মন রেখার ছায়ায় স্থিরতা পাচ্ছিল।

কিন্তু সেই যে সেদিন গড় জঙ্গল থেকে ফিরল, ব্যাস। আর কোনওদিন কথা হল না। এমন কি বাপির কাছে পড়তে আসাই বন্ধ করে দিল। শুধু তাই নয় কোথাও তাকে দেখলেই দূর দিয়ে চলে যেত। শুধু একটা চুমু ফিরিয়ে দিয়েছে বলে, ব্যাস! এটা কি শানুর ইগো? এত অহংকার? এটা রেখার কাছে একটা অজানা রহস্যই রয়ে গেছিল, থাকবে সারা জীবন। বন্ধু মিতালিকে পাঠিয়েছিল শানুর কাছে জানার জন্য কি হয়েছে। শানু নাকি রেখার সম্বন্ধে যা তা বলেছে। সে নাকি খারাপ, অনেক ছেলের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করেছে এইসব। রেগে গিয়ে রেখা নিজেই শানুর মুখোমুখি হয়েছিল। কিন্তু ওকে দেখেই শানু কেমন পালাতে চাইল। বলল কোনও কথা বলতে চায় না ব্যাস! ওকে যেন বিরক্ত না করে।  কি বয়স তখন রেখার। সত্যি বলতে সেটাই সত্যিকারের প্রথম প্রেম, প্রথম স্পর্শ। কান্নায় গলা বুজে গেছিল। তবু কোনওমতে শানুর কাছে যাবার চেষ্টা করেছিল। কে দেখছে, কী ভাবছে তার পরোয়া না করে। অথচ শানু! কেমন অদ্ভুতভাবে তাকাল, কিন্তু একটুও গলল না। কেমন নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে বলেছিল, যা হয়েছে ভুলে যা রেখা, মনে কর আমাদের কোনওদিন দেখাই হয়নি। এত সহজ ওমনিভাবে পাশ কাটিয়ে যাওয়া? একদম বুঝতে পারেনি রেখা। তার তো বুক ভেঙ্গে চুরচুর হয়ে গেছে। ভাবলে এখনও কান্না পেয়ে যায়।

দুর্গাপুর ছোট জায়গা। কথাগুলো ছড়াতে শুরু করেছিল। সন্ধ্যাবেলা একদল ছেলে একদিন সাইকেল করে শানু শানু বলে টিটকিরি দিতে দিতে বাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেল। শীতের স্তব্ধ রাতে হায়নার হাসির মত গায়ে কাঁটা দেওয়া সেই উচ্চকিত পরিহাস। মা খুব ভয় পেয়েছিল। একা নিয়ে বসিয়ে অনেক জেরা করেছিল রেখাকে। কিছু বলেছে, কিছু বলেনি। টেন পাশ করতেই কলকাতায় মাসীর বাড়ি পাঠিয়ে দিল। মাসী যে স্কুলে পড়ায় সেখানে। কো-এড নয়, গার্লস স্কুল। তবু শানুর খবর পেয়েছিল। পতনের খবরও তো মুখরোচক। ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলতে লোকে ছাড়ে না। দুর্গাপুরের বাইরে থেকেও জানত কথা কেমন কাপাসতুলোর মত দূর দূর ছড়িয়ে যায়। যেমন তাদের কথা ছড়িয়েছিল। শানুর জন্যে কষ্ট হত। ওর কাছে এত আঘাত পাবার পরেও। তাই মনে মনেও বলতে পারেনি, বেশ হয়েছে, যেমন আমাকে বিনা দোষে কষ্ট দিয়েছ, তার শাস্তি! শাস্তিটা যেন একটু বেশিই পেয়ে গেল শানু। বড্ড বেশি। রেখার মাঝে মাঝে মনে হয় এর জন্য রেখাও কি কোনওভাবে দায়ী? যতদিন ওদের সম্পর্ক ছিল, শানু পড়াশোনায় নিশ্চয় পিছিয়ে গেছে। ইলেভেন টুয়েলভের পড়ার যা চাপ, তারপর আই আই টি কি জয়েন্ট এন্ট্রান্স। এটা ভাবলেই রেখা শিউরে ওঠে। এমনভাবে একটা ছেলের জীবন নষ্ট যদি তার দোষে হয়, কিছুতেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না রেখা। মাঝে মাঝে ভেবেছে এই দুঃসময়ে গিয়ে ওর পাশে দাঁড়ায়, হাত ধরে বলে আমি আছিরে শানু। কিন্তু হয়নি। এক তো কলকাতায় থেকে পড়ত, দুর্গাপুরে কয়দিনই বা আসত। মা-ও চায়নি রেখা আবার ওই দিকে এগোক। তাছাড়া সেই সময়টা শানুর বেশ বাড়াবাড়ি চলছিল। বাড়ি থেকে ওকে বেরোতে দিত না। শুধু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া ছাড়া। কীভাবে, কোন দাবিতে ওই অবস্থায় যাবে রেখা?

কী হয়েছে রে রেখা?  ওভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? মাধুরী যেতে যেতে জানলার গরাদ ধরে দাঁড়ানো রেখাকে দেখে থমকে গেল। কাছে এসে মেয়ের কাঁধে আলগা করে হাত রাখল। হীরুর কথা মনে পড়ছে? ওর কাছ থেকে আর কোনও চিঠি পেলি?

না মা, আর তো পাইনি। অনেক চেষ্টা করেও গলার ভেজা ভাবটা ঢাকতে পারল না রেখা।

একি কাঁদছিস কেন বোকা মেয়ে? অত দূর পড়তে গেছে, রোজ রোজ কি চিঠি আসবে নাকি? বলতে বলতে মেয়ের চুলে আঙ্গুল চালায় মাধুরী। চুলটা তোর বড্ড রুক্ষ হয়ে গেছে রেখা। আমি রিঠা ভিজিয়ে দিচ্ছি। কাল ভাল করে রিঠা দিয়ে মাথা ঘসবি তো।

কেন মা? শ্যাম্পু করলে কেমন শাইন আসে, রিঠাতে অমন হয় না। কালকে অনুরাধার বিয়েতে যাওয়ার আছে।

সে চাইলে শেষে শ্যাম্পু দিও। কিন্তু রিঠা দিয়ে চুল ঘষলে চুলের গোড়া শক্ত হয়। এই দ্যাখ তোর চুলে আঙ্গুল দিলাম আর কতগুলো চুল হাতে এসে গেল। এমন চুলের ঢাল তোর, ভাল করে যত্ন না করলে হয় মা? ফ্যাশান ফ্যাশানের জায়গায়, যত্ন না করলে ভগবানের দান বেশিদিন রাখা যায় না।

ছোটবেলা থেকে মাধুরী বুঝিয়েছে সুন্দর দেখতে জন্মেছ সেটা ভাল কথা। কিন্তু নিজেকে সুন্দর রাখতেও হয়। তার মানেই দামী দামী স্নো পাউডার ঘষা নয়। রোজ নিয়ম করে দই হলুদ বাটিতে করে দিত মাধুরী স্নান করার সময় মুখে গায়ে মাখার জন্য। রিঠা দিয়ে চুল ঘষা তো আছেই, সপ্তাহে দুদিন ভাল করে তেল দিয়ে টেনে বেঁধে বেড়া বিনুনী করে দিত। বলত অত স্টাইলে দরকার নেই রোজ। একটু গেঁয়ো লাগলে না হয় দুদিন, কিন্তু চুলের জন্য আরাম।

স্কুলে থাকতে মাঝে মাঝে মাকে লুকিয়ে মুখে মেকআপ করে, ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে আয়নায় নিজেকে অনেকভাবে দেখত রেখা। ভাল লাগত, নিজের রূপ সম্বন্ধে সচেতনতা বাড়ছিল। মা দেখলে রেগে যেত খুব। সেই এক কথা, বড় হও তখন মেকআপ করো, লিপস্টিক লাগাও কিচ্ছু বলবো না। কিন্তু এই বয়েসে কারুর বিয়ে বাড়ি ছাড়া একদম নয়। তবু কী করত না একদম? করত, লুকিয়ে লুকিয়ে।  রেখার খুব ইচ্ছা ছিল সিনেমায় একবার ট্রাই করবে। মাসির বাড়ি টালিগঞ্জে, সামনেই স্টুডিওপাড়া। মাসির বাড়িতে থাকতে পাশ দিয়ে যেত আর লোভ হত একবার ঢুকে দেখে কীভাবে সুযোগ পাওয়া যায়।

কিন্তু ভাবনাই সার। মাকে বলতে মা এমন না না করে উঠেছিল। সুন্দর দেখতে হলেই বুঝি সিনেমায় নেবে ধেই ধেই করে নাচতে হবে? শুনলে তোমার বাবার হার্ট অ্যাটাক হবে। মনে রেখো, সৌন্দর্যের একটা শক্তি আছে। শুভশক্তি। রূপ যেমন বাইরের, তেমনি ভিতরেরও। তোমার মুখ যদি ছবি হয়, আত্মা তার উপর আলো ছড়িয়ে তার সৌন্দর্যকে পরিপূর্ণতা দেয়। এইসব কথা বোঝানোর সময় মা রেখাকে তুমি করে বলে। গম্ভীর মুখে। কেন কে জানে! লেখা মায়ের কান বাঁচিয়ে বলে সারদা মায়ের বানী। যদিও ওদের দুই বোনের কারও সাহস হবে না সামনে এই কথা বলতে। মার মতে সৌন্দর্যের একটা উদ্দেশ্য আছে, দায়িত্বও। তার সঙ্গে সাবধানতারও দরকার। তুমি যেখানে দাঁড়াবে সৌন্দর্যের ছটায় চারদিক আলোকিত করবে। কিন্তু আলোর দোষ কী জানো তো? আলো দেখে শ্যামাপোকারা ঝাঁপ দিয়ে এসে পড়ে। কালীপূজায় রাস্তার টিউবলাইটগুলোর কী অবস্থা হয় দেখেছো তো? সাদা আলোর উপরে রাশি রাশি শ্যামাপোকা লেপটে কালো করে দেয়। অনেক ছেলে তোমাকে দেখবে, না পাওয়ার গ্লানিতে পিছনে টিটকিরি দিতে পারে। কপাল খারাপ হলে জোঁকের মত লাগবে। সেসব থেকে বাঁচার দায়িত্ব নিজের। কোনও ছেলে কিছু বলল এসে, বদনামটা কিন্তু তোমার গায়েই লাগবে। পুরুষ মানুষের গায়ে কোনও কাদা লাগে না। তাই নিজেকে এসবের থেকে বাঁচিয়ে রাখাটা তোমার কাজ।

সেটাই তো করে এসেছে রেখা চিরদিন।

 

 

হীরক হাসপাতালের বেডে শুয়ে ভাবছিল। আসলে ভাবনা ছাড়া তার এখন কিছু করবারও নেই। নতুন দেশে এসে কোথাও পৌঁছানোর আগেই হাসপাতালে। দুটো হাতই ভেঙ্গেছে। বাঁ হাতের কবজি। ডান হাতের কনুই, দুটো আঙ্গুলও। ডান পা-টা ট্র্যাকশান দিয়ে ঝোলানো। মাথায় নটা সেলাই। মার্কিন মুলুকে তার সুস্বাগতম এমনিভাবেই হয়েছে। সবাই বলছে খুব কমের উপর দিয়ে গিয়েছে। এরকম অ্যাক্সিডেন্টে সিটবেল্ট না লাগিয়ে প্রাণে বাঁচার কথা নয়। তার সঙ্গীসাথীরাও অল্পবিস্তর জখম হয়েছে। পিছনের  সিটে বেল্ট লাগানো বাধ্যতামূলক নয়। ভাগ্যক্রমে বিজু সিটবেল্টেই ছিল। অ্যাকসিডেন্টের সঙ্গে সঙ্গে হীরক অচেতন, তাই কীভাবে কী হল কিছুই জানে না। জ্ঞান ফিরে নিজেকে হাসপাতালেই পেয়েছে। বিজুকে জিজ্ঞেস করেছিল, গাড়ি উল্টানোর পর কী হল রে বিজু? তখনও মোটে দুদিন হয়েছে। ভাল করে ঘোর কাটেনি। সেদিন প্রথম বিছানার মাথার দিকটা উঁচু করে তুলে দিয়েছে। বিজু উদ্বিগ্ন মুখে তার মাথার ব্যান্ডেজের চাপ বাঁধা রক্তের পরিমাপ যাচাই করছিল। অসুস্থ লোককে যতটা শক্তভাবে না করা যায় সেই ভঙ্গীতে বলেছিল, সেসব শুনে কী করবি বল তো হীরু? ডাক্তার তোকে বেশি কথা বলতে বারণ করেছে এখন। তাই একদম চুপ। আরও কিছু বলতে গেছিল তখন সেই পরিচিত মাস্টারি ভঙ্গিতে ওর ঠোঁটের উপর তর্জনী রেখে চুপ করাল।

বিজুর কপালেও দুটো সেলাই পড়েছে, আর বাঁ হাতের কড়ে আঙ্গুলে প্লাস্টার। হীরকের যা হয়েছে তার তুলনায় তুচ্ছ। মনের জোরও সাঙ্ঘাতিক। রোজ দুবেলা তার জন্য খাবার বানিয়ে আসছে। বলেছে সদ্য এসেই এখানকার খাবার তোর ভাল নাও লাগতে পারে। বরং আমার বানানো ডাল ভাত বেশি ভালো লাগবে। জোর ফিরে পেতে খাওয়াটা ঠিকঠাক হওয়া দরকার। না বলার মত জোর হীরকের ছিল না। কিন্তু দুদিন বাদে আবার একই প্রশ্ন রেখেছিল বিজুর কাছে। জানতে আগ্রহ হয় না? তার জীবনের এত বড় একটা অভিজ্ঞতা, ভাল করে বরফ দেখার আগেই বরফে গাড়ি উল্টে জখম। গল্পটা তো জানা দরকার। সেদিন আমি অজ্ঞান হবার পর কী হয়েছিল রে বিজু? বলবি না?

এতদিনে হীরক একটু সুস্থ হয়েছে। তাই বিজু আরও সহজে রাগ দেখাতে পারছিল। ভ্রুকুটি করে বলল, কী হবে রে জেনে? অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, হাসপাতালে এসেছিস। এর মধ্যে এত গল্প কোথায়? রাধাও ছিল। ও স্যোৎসাহে বলল, বিজু কেন বলতে চায় না জানিস? ও নিজেও যে পটকে গেছিল। জ্ঞান ছিল নাকি! একমাত্র আমিই একটু বেটার ছিলাম। শুধু গাড়ি উল্টানোয় ত্রিভঙ্গ মুরারী অবস্থা। বলতে বলতে রাধা ভঙ্গীটা দেখিয়েও দিল।

হাসতে গিয়ে হীরক দেখল মুখে এখনও ব্যাথা, হাসি বেরোল না। কিন্তু তাতে রাধা দমল না মোটেই। দরজা খুলে বেরোনোটা মুশকিল হয়েছিল। অবশ্য রাধাকৃষ্ণনের খেলোয়াড়ি চেহারা। তাই নিজেকে বাঁকিয়ে চুরিয়ে বের হয়। রাধা গর্বের সঙ্গে বলছিল, আমার পায়ে একটু লেগেছিল, তাতে কিছু নয়। রণধীর কোঁ কোঁ করছিল। পিছনের সীটে দেখলাম তোমরা দুজনেই আউট। আর চারদিকে চাপ চাপ রক্ত। এদিকে রাস্তা খুব শুনশান। আর কোনও গাড়িও নেই। ভাবছি কী করি।

বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে বলছিল। বিজু থামিয়ে দিল। রাধা, অত নাটকীয় করার কিছু নেই। এমনিতেই ওর স্নায়ু এখন দুর্বল। যদি বলতেই হয় রঙ চড়িয়ে বলিস না। তার চাইতে আমিই বলছি। আমি মোটেই অজ্ঞান হইনি। প্রথম শকে মোশনলেস হয়ে পড়েছিলাম। তারপর দেখি রাধা কী করবে বুঝতে পারছে না। আমি জানতাম ফ্রি ওয়েতে এক মাইল পর পর এমারজেন্সী কলবক্স থাকে। ডাইরেক্ট এমারজেন্সী লাইন। আমি রাধাকে পাঠালাম সেখান থেকে পুলিশকে ফোন করতে।

এরপর একটু সদয় হল বিজু। মুচকি হেসে বলল, রাধা বেচারা ল্যাংচাচ্ছিল। ওর মধ্যেই মুরগী দৌড়ের মত কল বক্সের খোঁজে গেল। কত দূরে গিয়ে পেয়েছিলি রাধা?

এমন কিছু দূর নয়, তিনশো ফিটের মত। বিজু আগেরবার তার গল্প বলায় বাধা দেওয়ায় রাধা শুধু তথ্য সরবরাহ করেই ক্ষান্ত রইল। না হলে বলত কীভাবে বরফে পিচ্ছিল পথে নিজেকে টানতে টানতে ওই দূরত্ব অতিক্রম করেছিল। একবার আছাড়ও খেয়েছে।

বলার দায়িত্ব এবার বিজুই নিল। রাধা ফেরার আগেই দুটো গাড়ি এসে পড়েছিল। আমাদের দেখে থেমে গেল। এখানকার লোকের এই গুণটা খুব। ওদের সাহায্যে আমিও বেরিয়ে এলাম। রনবীরের চোটের থেকেও বেশি ছিল শক। আর তুই তো অচেতন। তাই ওরা ডাক্তারের অপেক্ষা করছিল। এখানে এসব ব্যাপারে খুব প্রম্প্ট।  ফোন করার দশ মিনিটের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স হাজির। পুলিশের গাড়িও পেছন পেছন।

বিজুর কাছে শুনে হীরকের অবাক লেগেছে। এত তাড়াতাড়ি এই সমস্ত বোধহয় এই দেশেই সম্ভব। তবে যে শুনেছি এখানে মেডিক্যাল সিস্টেম বাজে। ইন্সিওরেন্স কার্ড না থাকলে ডাক্তারের কাছে পৌঁছানো যায় না?

ফিক করে হাসল বিজু। শুয়ে হাসপাতালে ঢুকলে এরা কিছু দেখতে চায় না রে, প্রথমে ট্রিটমেন্ট, তারপরে কাগজ। কিন্তু তুই যদি হেঁটে ঢুকিস কিংবা হুইলচেয়ারে, রিসেপসান থেকে বেশিদূর যেতে পারবি না ইন্সিওরেন্স ছাড়া।

তার মানে আমাকে কি টাকা দিতে হবে না? হীরক এমনভাবে বলল যেন ওর কাছে টাকা আছে কত। মাত্র তিরিশ ডলার পকেটে নিয়ে এসেছে, এর বেশি আনবে কেমন করে।

দেখছি কী হয়। এসব এখন আমাদের উপর ছেড়ে দে তো। তোর কাজ সুস্থ হয়ে ওঠা, নিজের পায়ে দাঁড়ানো। তুই শুধু সেইটা ভাব।

অনেকক্ষণ কথা বলে ক্লান্ত লাগছিল। চোখ বুজেছিল হীরক। বিজু তো আগে থেকেই বন্ধু। কিন্তু রাধা, রণধীর ছাড়াও তার নতুন ক্লাসের কয়েকজন সহপাঠী হবে যারা তারাও সবাই বারবার করে আসছে, খোঁজ নিচ্ছে। হাসপাতালটাও ক্যাম্পাসের অঙ্গ। ইউনিভারসিটির মেডিক্যাল স্কুলের সঙ্গে। তাই ওদের জন্য পায়ে হাঁটা পথ। তবুও, এরকম সবাই কী করে? নতুন দেশে বন্ধুত্বের বাঁধন তৈরি হচ্ছে ভাল।

বিজুরা সবাই মরমে মরে আছে। অভ্যর্থনা করে নিয়ে আসতে গিয়ে এমন বিপদের মধ্যে ফেলে দিল। বিজু নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছিল না। কী দরকার ছিল রণধীরকে এমন টীজ করার? রণধীর গাড়ি চালাচ্ছিল, তাই দোষটা তারই বেশি। বরফের রাস্তায় এমন অন্যমনস্ক হওয়া সাজে না। সেও বারবার ক্ষমা চেয়েছে হীরকের কাছে। রণধীরের গাড়ির বেশ ভালো রকমের ক্ষতি হয়েছে। সারানো যায়, কিন্তু বেচারার এখুনি অত পয়সা নেই।

দুর্ঘটনা তো কারও হাতে নেই। সেটাই বুঝিয়েছে ওদের হীরক। দুমাস এইভাবে পড়ে থাকতে হবে। কলেজের শুরুটা এইভাবে পিছিয়ে গেল এসব নিয়ে তার চিন্তা নেই এমন নয়। ডিন ভদ্রলোক ভালো। এসে একবার দেখা করে গেছেন। বলেছেন সুস্থ হলে মেক আপ করে নিতে পারবে। না হলে স্প্রিং টার্মে শুরু করতে পারে।

এখানে দেশের মত নিয়ম নয়। অনেক ফ্লেক্সিবল। তাছাড়া হীরকের ব্যাপারটা ইউনিক, দুর্ভাগ্যজনক। সেই সহানুভূতিটা থাকবে। তার এখন চিন্তা চিঠি লিখতে পারছে না বলে। বাড়িতে এই দুর্ঘটনার কথা চেপে গেছে একদম। কী লাভ? জানলে সবাই খামোখা দুশ্চিন্তা করবে। কিছু করতে তো পারবে না। তবে খুব বেশিদিন চিঠি না লিখলে সন্দেহ করতে পারে। একবার ভেবেছিল বিজুকে দিয়ে লেখাবে। সে বলবে আর বিজু লিখে দেবে। কিন্তু হাতের লেখা মিলাবে কী করে? তাই সেই পথে আর যায়নি। দুর্ঘটনার দুইদিন বাদে বিজু একটু সুস্থ হতেই একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়েছে। রিচড সেফলি। অন্তত পৌঁছ সংবাদটা গেছে। এরপর দুই সপ্তাহ  নিশ্চিন্ত, তার আগে কোনও চিঠি পাওয়ার তো কথা নয়। দুই সপ্তাহ পার করে ফোন করেছিল। ততদিনে প্রথম দিককার ড্রাউসিনেসটা কেটে গেছে। শুরুতে জেট ল্যাগ ছিল।  পেইন কিলারের জন্য কথাবার্তায় শিথিলতা। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে যেন সব। এমন একটা শক। ভাবনাগুলো তালগোল পাকানো। এই সময় ঘুমিয়েছে প্রচুর। ধীরে ধীরে একটু স্বাভাবিক হতে ফোন করার কথা ভেবেছিল।

তবে ফোন করার কিছু কম হ্যাপা নয়। নিজের বাড়িতে ফোন নেই। ভাগ্যক্রমে পাশের বাড়িতে ফোন আছে। সেখানেই ট্র্যাঙ্ক কল বুক করা হল। দুই সপ্তাহের মাথায় ওকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে হাসপাতালের ফোনের কাছে নিয়ে গেল। ফোনে কথা বলতে বলতে হীরক মনশ্চক্ষে দেখতে পাচ্ছিল রায়কাকুদের বাড়ির ফোন ঘিরে বাবা, মা, রূপাদের জড়ো হওয়া। অ্যাকসিডেন্টের কথা কিছুই জানায়নি। বাবা বারবার বলেছে ফোনে পয়সা খরচ না করে সব কিছু গুছিয়ে চিঠিতে লিখতে। নতুন দেশের কথা তার কাছ থেকে শোনার জন্য বিমলের খুব আগ্রহ। পড়াশোনা কেমন হচ্ছে, সে মানিয়ে নিতে পারছে কিনা এইসব। মা জানতে চায় সে কী খাচ্ছে, থাকার জায়গা কেমন। হীরক কী বলবে? কত আর গল্প বানানো যায়! কিন্তু পরস্পরের গলা শুনতে পাওয়ার মধ্যে এক ধরনের নিশ্চিন্ততা আছে। এই কদিন বিছানায় শুয়ে থেকে কপালে যে হাতের স্পর্শ খুঁজছিল, মার গলায় যেন সেটাই পেয়ে গেল। কিন্তু তার বাইরে কিছু জানানোর নেই। জানাতে চায় না। অন্ধকারে এসে নেবেছিল এই দেশে। তারপর রাস্তায় আধঘণ্টায় যেটুকু দেখা। অচেতন অবস্থায় অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢুকে পড়েছে হাসপাতালের মধ্যে, বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগসূত্র বিচ্ছিন্ন করে। কিন্তু এসব কথা বাবা মাকে এখুনি বলা যাবে না। ওদের ভাবনা বাড়ানোর কোনও ইচ্ছা হীরকের নেই। সেইজন্য তিন মিনিটের ফোন কলে কোনওমতে তানা নানা করে কাটিয়ে দিয়েছে। বলেছে একটু ধাতস্থ হয়ে বড় করে চিঠি লিখবে। তাছাড়া ফোনের পয়সাই বা হীরকের কাছে কোথায়! বেশ খরচ। প্রতি মিনিটে আড়াই ডলার। সে তিরিশ ডলার পকেটে করে এসেছিল। এখন বিজু, রণধীর ওরাই দিচ্ছে। সে বারবার না করেছে। কিন্তু বিজু বলেছে, চুপ। একটু অন্তত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে দে। এর উপর বাড়িতে মিথ্যে কথা বলতে হচ্ছে বলে মরমে মরে যায় হীরক। কিন্তু অনেক ভেবে দেখেছে এটাই ঠিক। পরে সুস্থ হলে না হয় সব খুলে বলা যাবে। বাবা মা ঠিক বুঝবে।

বন্ধুদের পয়সায় বাড়িতে ফোন করা যায়। কিন্তু রেখাকে নয়। ওকে চিঠি লিখবার কথা ছিল, সেটাও লিখতে পারছে না। সেটা ভেবেই বিষন্ন হয়ে যাচ্ছিল হীরক। বাইরের প্রকৃতিও ভাবুক করে দেওয়ার মত। হীরকের বেড ঠিক জানালার পাশে। তাকালেই দেখা যায় সাদা বরফে আচ্ছন্ন পৃথিবী। বেশিরভাগ দিনেই টুপটুপ করে বরফ পড়ছে। কোনও কোনওদিন রোদ ঝলমলে থাকে। সেদিন এই বরফের আস্তরণে সূর্যের আলো ঠিকরে হীরের দ্যুতির মত উজ্জ্বল হয়ে ওঠে দিকদিগন্ত। কিন্তু অধিকাংশ সময়েই আকাশ মেঘলা। সেই শীতল ধূসরতা প্রতিফলিত হচ্ছে চতুর্দিকে। জানালা দিয়ে দেখতে পাওয়া গাছগুলোর কোনওটাতেই একগাছি পাতাও নেই। ন্যাড়া গাছগুলোর ডালের উপরটা বরফে ঢাকা। আর নিচ থেকে টপটপ করে বরফগলা জল পড়ে, কিংবা পড়তে পড়তে বরফ হয়ে ঝুলছে। সমস্ত মিলে একটা অদ্ভুত শব্দহীন নির্জনতায় ঢেকে আছে চরাচর।

নার্স চেক আপ করতে আসায় ভাবনার সুতো ছিঁড়ল। এখানে হসপিটালের নার্সরা অসম্ভব ভালো। ষ্টীল প্ল্যান্টের হাসপাতালে বিমলের অ্যাপেন্ডিসাইটিস অপারেশানের সময় দেখেছে তা যেমন অপরিচ্ছন্ন, তেমনি নার্সদের দুর্ব্যবহার। অন্তত রোগীর প্রতি এমন সহানুভূতি কখনও দেখেনি। বিজু অবশ্য বলল, সবই টাকা রে হীরু। এখানে নার্সের স্যালারি যথেষ্ট ভাল, রেস্পেক্টেবল প্রফেসান। ডাক্তারের চাইতে কিছু কম সম্মানের নয়। সুতরাং পার্থক্য তো হবেই। সেটাই কী শুধু? হীরক জানে না। কিন্তু যে তিনজন নার্সকে দেখেছে সবাই খুব হাসি মুখ, কাজ করতে করতেই টুকটাক গল্প করে, হীরকের খোঁজ নেয়। তবে তার মধ্যে এখন যে নার্স এসেছে জুলি, সে সবচেয়ে ভাল। একটু বয়স্ক, দেখতে নীলিমার বয়সী। কিন্তু আসলে আরও বড়। নতুন দেশে আসার প্রথম দিনেই তার এমন দুর্ঘটনা হয়েছে জেনে অবধি জুলি যেন নার্স কম, আর মা বেশি হওয়ার চেষ্টা করেছে। হয়তো নিজের ছেলের কথা মনে করে। যদিও ওর ছেলে নোয়াম হীরকের থেকে বছর পাঁচেকের বড়। এতদিন নাকি মায়ের সঙ্গেই থাকত। এখন শিকাগো চলে গেছে। শুনে হীরক একটু অবাক হয়েছিল, তবে যে শুনেছে এখানে ছেলে মেয়েরা আঠেরো পেরোলেই আর বাবা মায়ের সঙ্গে থাকে না! জুলির ছেলেও নাকি হাইস্কুল পাশ করেই বাড়ি ছেড়েছিল। ফ্লিন্টে জিএমের প্ল্যান্টে চাকরি নিয়েছিল। কিন্তু এক বছর বাদে মায়ের সঙ্গে ফিরে আসে। কেউ কেউ এই নিয়ে কথা বলে। কিন্তু জুলি কাজ করতে করতে থেমে হাত উলটেছে। তাতে আমার কী যায় আসে। ও কলেজে পড়বে, টাকা জমাতে হবে। শুধু শুধু রেন্ট না গুনে আমার খালি বেসমেন্টে যদি থাকে কার কী বলার আছে? আমার ওয়াক ইন বেসমেন্ট, আলাদা দরজা, রান্নার জায়গাও আছে। তাহলে অন্য বাড়িতে কেন যাবে? হীরক এতেও অবাক। একসঙ্গে থাকবে যদি বেসমেন্টে কেন? ঘরে কেন নয়? জানা গেল এক বাড়িতে থাকলেও প্রাইভেসি তো রাখতেই হবে। বন্ধু বান্ধব, বিশেষত গার্লফ্রেন্ড কখন আসছে, কখন যাচ্ছে এসব বাবা মায়ের জানার কী দরকার! তবে গুস্তাভ মানে নোয়ামের বাবার আপত্তি থাকলেও, জুলি মাঝে মাঝেই রান্না করে খাবার ছেলের জন্য পাঠিয়ে দিত। যত শুনেছে তত অবাক হয়েছে হীরক। ভাবছে মা তার জন্য খাবার পাঠালে, বিমল যদি আপত্তি করত তাহলে কেমন ধুন্ধুমার হত বাড়িতে। বাধো বাধো ঠেকলেও প্রশ্ন না করে পারেনি হীরক। নোয়ামের বাবা কি কোনও কারণে ছেলের উপর রেগে ছিল? শুনে জুলি একটু সময় থেমে ছিল। কীভাবে বোঝাবে ভাবছিল। আসলে তা নয় বুঝলে। আমরা তো তিনজনে মিলে সানডে লাঞ্চ করতাম। নোয়ামকে ওর বাবা খুব ভালবাসে। কিন্তু চায়না ইজি লাইফে অভ্যস্ত হয়ে যাক। বড় হয়েছে, নিজেরটা নিজে করে নেওয়াটা তো দরকার।

হীরক তখন জুলিকে বলল তার নিজের বাড়িতে সে যদি আলাদা রান্না করে খায় তাহলে সেটা বাবা মায়ের কাছে একটা বিশাল অপমানের ব্যাপার হবে। বাবা মা হয়তো ওর সঙ্গে কথাবার্তাই বন্ধ করে দেবে। সেদিন আর কোনও কথা হয়নি। আজ টেম্পারেচার নিতে নিতে জুলি বলল তার এক বন্ধুর মুখে শুনেছে ইন্ডিয়ায় নাকি অনেক বাড়িতে কুড়ি পঁচিশ জন করেও থাকে, সব কাজিন মিলে। সেটা কি সত্যি? মুখে থার্মোমিটার ছিল, তাই মাথা হেলিয়ে জানাল সেটা ঠিক।

এবার জুলির চোখ কপালে। ঝগড়া হয় না?

হয়, কিন্তু দরকারে পাশেও থাকে। বলতে বলতেই ভাবছিল তারা নিজেরাও তো আলাদা ছিল, জ্যেঠুদের সঙ্গে নয়। তবে সেটা বিমলের চাকরির কারণে। ওর দুই জ্যেঠু তো একসঙ্গেই আছে সাবেক বাড়িতে।

সব দেশের মধ্যে কতরকমের পার্থক্য থাকে। আমি একবার তোমাদের দেশ দেখতে যাবো।

আমাকে বোলো, আমি তোমাকে সব ব্যবস্থা করে দেবো। স্যোৎসাহে বলেছিল হীরক।

আরে আগে তো নিজে উঠে দাঁড়াও। তবে হীরক, নামটা জুলির মুখে অদ্ভুত শোনায় বেশ, ঠিক যেন he rock, তোমার হয়তো হাসপাতালে আর থাকতে হবে না। নিজের সরঞ্জাম গুছাতে গুছাতে বলল, তোমার চার্ট খুব স্টেবল। আমি ডাক্তার উইল্কিন্সকে বলবো।

তাই হল। তিন সপ্তাহ হাসপাতালে থেকে নিজের বাসস্থানে আসার অনুমতি পাওয়া গেল। তার জায়গা মিলেছিল নর্থউড অ্যাপার্টমেন্টে। দুটো বেডরুম। অন্য বেডরুম রাধাকৃষ্ণনের। ও যদিও সিনিয়ার। কিন্তু ওর রুমমেট বিয়ে করে ফ্যামিলি অ্যাপার্টমেন্টে চলে গেছে। রাধা এক ঘরের অ্যাপার্টমেন্টে যেতে চাইছিল না, খরচ বেশি। বিজুর মাধ্যমেই এই যোগাযোগ হয়েছিল আসার আগেই। দুজনের জন্যেই সুবিধা। তবে রাধা শাকাহারী, তামিল খাবার বানাবে। তেঁতুলগোলা খাওয়ার ব্যাপারে বাঙালিদের একটু ভয় আছে এমনিতেই। সুতরাং নিজের নিজের খাবার আলাদা বানিয়ে নিতে হবে। এখন বিজু ওকে খাবার দিয়ে যাবে যতদিন ও সুস্থ না হয়। কিন্তু প্রথম দিন আসতেই রাধা ওকে এক কাপ ওর দেশের কফি বানিয়ে খাওয়াল। ঠান্ডার মধ্যে গরম কফি তো ভাল লাগবেই। কিন্তু এটা কলকাতায় খাওয়া কফির মত নয়। আরও কড়া, কিন্তু খেতে ভাল। রাধা বলল ফিল্টার কফি। তবে জানিয়ে রাখল রোজ বানিয়ে খাওয়াবে না, এটা শুধু প্রথম দিনের অভ্যর্থনা। এই ফিল্টার কফির সরঞ্জাম দেশ থেকে আনা, টিপে টিপে খরচ করতে হয়। হীরক চা পাতা সঙ্গে এনেছে। কিন্তু হাত ঠিক না হওয়া অবধি বানানো মুশকিল। রাধাকে বলতে ও অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে সেই দায়িত্ব নিয়ে নিল। বলল চা আমি খাই না, বানাতেও পারি না। তোমার চা পাতা তুমি নিজের কাছে রেখে দাও। আমি একটা টিব্যাগের প্যাকেট নিয়ে আসব। গরম জল করে চুবিয়ে দেওয়া, সেটা আমি পারব।

হুইলচেয়ারে বসেছিল হীরক। কফি নিয়ে টেবিলে গিয়ে কাগজ টেনে বসল। রাধার কাছ থেকে পেন চেয়ে নিয়েছিল। দেখবে যদি কিছু লেখা যায়। ডান হাতের আঙ্গুল সব জোড়া করে প্লাস্টার। বাঁ হাতের আঙ্গুল খোলা, কিন্তু কব্জিতে প্লাস্টার। কাগজে কয়েকটা আঁচড় টানল। সোজা লাইন টানা যাচ্ছে, কিন্তু প্যাঁচ মারা যাবে না। বাংলায় লেখা অসম্ভব। ইংরাজীতে রেখার নাম লিখল। বড় বড় করে। ঠিক যেন স্লেটে জীবনের প্রথম শব্দ লিখছে। R –এর প্যাঁচটা হল না। তাই ছোট হাতের r লিখল। একটা লাইন লিখল rekha i love you. ইংরাজীতে অত কিছু লেখার অভ্যাস নেই। বিশেষ করে মনের কথা। কীভাবে লিখবে ভাবছিল। ওর অ্যাকসিডেন্টের কথা কি জানাবে? মনে হচ্ছিল রেখা জানলে ওর কথা ভাববে বেশি বেশি করে, এতে যেন –  না থাক, কী দরকার ভেবে থেমে গেল হীরক। ওর চিন্তা বাড়িয়ে কাজ কী।

 

বাবা রিটায়ার করার আগে আগে যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারিস হীরু। ছোটবেলা থেকে শুনে শুনে হীরকের কানে গেঁথে গেছে। নীলিমার চাওয়াগুলো বরাবরই এক্তিয়ারের সীমানায়। বড় ছেলের কাছে এইটুকুই আশা রেখেছে শুধু।

আজ এতদিন বাদে যখন  প্লাস্টার কেটে আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছে, সেই কথাটা মনে করে হেসে ফেলল হীরক। এই নিয়ে তবে তার তিন নম্বর বার নিজের পায়ে দাঁড়ানো। একদম ছোটবেলায় যখন হামাগুড়ি দিতে দিতে একদিন উঠে দাঁড়িয়ে টলমল পায়ে হাঁটা শুরু করেছিল কেমন লেগেছিল কে জানে। হিন্দুস্তান মোটর্সে চাকরি পাওয়ার উচ্ছাস স্পষ্ট মনে আছে। আজ আবার সেই অভিজ্ঞতা, অনেকটা।

প্রথমবার যখন প্লাস্টার খুলে উঠে দাঁড়িয়েছিল, মাথাটা কেমন ঘুরে গেছিল হীরকের। একটা টলমল ভাব। ডান পাটাও নিজের উপর ভরসা রাখতে পারছিল না। অনেকদিন প্লাস্টারে থাকায় মাসলগুলো দুর্বল, পাটাও যেন সামান্য সরু। এই অবস্থায় ফিজিওথেরাপিস্টের হাত ধরে কয়েক পা হেঁটেছিল প্রথমে। হাতও ভাল করে ধরতে পারছিল না। আঙ্গুলগুলো আড়ষ্ট। কত রকমের এক্সারসাইজ যে করতে দিয়েছে! বিছানায় শুয়ে শুয়ে তাই আঙ্গুলে মুঠো পাকাচ্ছিল আর খুলছিল। মনে হয় এবার ভাল করে কলম ধরতে পারবে। গতকাল চিঠি লিখতে শুরু করেছিল। কিন্তু কয়েক লাইন লেখার পরেই আঙ্গুল এমন টনটন করতে শুরু করল!

কালকে ঘরের মধ্যে ফিরে বেশ কয়েকবার পায়চারি করেছে। আর মাথা ঘোরেনি। বিজু এখন কদিন ফিজিওর কাছে নিয়ে যাবে কলেজ থেকে ফিরে। মেয়েটা অনেক করছে। এখানে পড়ার খুব চাপ, যাদবপুরের মত হইহই করে কাটিয়ে দেওয়া যায় না। প্রচুর অ্যাসাইনমেন্ট যেটা কারও কাছ থেকে চোতা মেরে নামানো যায় না। বেশিরভাগই হাতেকলমে করে দেখার, বই থেকে টুকেও হবে না। তাই অনেক রাত অবধি পড়াশোনা চলে। যেমন রাধাকেও দেখছে। সেটা কি শুধু ভারতীয়রাই করে, না কি আমেরিকানরাও। রাধা বলল, সবাই করে। তবে আমাদের দেশিয়দের মধ্যে একটু বেশি। আমরা অনেক বেশি কমপিটিটিভ কি না। তাছাড়া কিই-বা উপায়! আমাদের তো ভিসার রঙ বদলাতে হবে। বিজুর কাছে শুনেছে শুধু ইন্ডিয়ানরা নয়। আফ্রিকান বিশেষ করে নাইজেরিয়ান, এছাড়া ইরান, ইজিপ্ট থেকে আসা ছেলেমেয়েরা আর আজকাল আসছে চাইনিজ – সবাই ওই ভিসার দিকে চোখ রেখে লড়তে থাকে। এমনিতেই এখানকার সিস্টেমটা এমন তোকে সবসময় এনগেজড থাকতে হবে। সত্যেনদার ক্যান্টিনে বসে রইলাম আর অন্যের কাছ থেকে নোটস নিয়ে মাগিং করে উগড়ে দিলাম সেটা হবার জো নেই। হীরক ভেবেছে তাহলে মনীষ কীভাবে সামলাচ্ছে কে জানে। ও তো টেক্সাস টেকে। আসলে মানুষ অভ্যাসের দাস। জলে পড়লে ঠিক সাঁতরে বেরিয়ে যাবে। এখন তাকে নিজের কথা ভাবতে হবে। দেড়মাস বরবাদ হয়েছে, কীভাবে আবার সব কিছু ঠিকঠাক জায়গায় পৌঁছাবে জানে না। সবার আগে ডিনের অফিসে গিয়ে ফর্মালিটিগুলো সামলাতে হবে। কীভাবে ক্লাস শুরু করবে সেগুলোও ঠিক হওয়া চাই। ডিন লোকটার নামটা খুব কঠিন – কিস্টোপানাইডিটিস অ্যাসিয়ান্থস, আদতে লোকটা ভাল। হাসপাতালে দেখা করতে এসেছিল, রোগা ঢ্যাঙ্গা, কাঁচা পাকা চুল , মুখ ভরা হাসি। আমাকে সাকিস বলে ডাকতে পারো বলায় একটু নিশ্চিন্তি। তাছাড়া বলে গেছিল কোনও চিন্তা নেই, আগে নিজেকে সুস্থ করো, তারপর আমরা আছি। তারপর দেখা করবে সাবজেক্টের প্রেফেসারদের সঙ্গে। বিছানায় শুয়ে এইসবই ভাবছিল। জানালা দিয়ে রোদের টুকরো ছিটকে ঢুকছে ঘরে। যেন ডাকছে হীরককে, আয় আয় বলে।

আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে জানালার কাছে গেল হীরক। এখন ফেব্রুয়ারি। ফুটপাথে জায়গায় জায়গায় বরফের চাঁই। গত দুই মাস ধরে জানালা দিয়ে সারাদিন তুষারাপাত দেখেছে। কখনও পায়রার পালকের মত ভাসতে ভাসতে নেবে আসা বরফ। কিংবা সাদা বৃষ্টির মত। ছোটবেলায় দুর্গাপুরে কখনও কখনও শিলাবৃষ্টি হয়েছে। হীরক রূপা আর চিনুর সঙ্গে সেই সময় বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে শিলা কুড়াতো। জিভের তলায় রেখে অনুভব করত বরফের শীতলতা। এবার বরফ খেয়ে দেখবে কেমন লাগে। বিজু বলেছে জমে থাকা বরফ না খেতে। যখন পড়ছে সেই সময় অঞ্জলি পেতে ধরতে হবে। আজ বরফ পড়ছে না। বেশিরভাগ দিনেই মেঘ আর কুয়াশায় ছেয়ে থাকে চারদিক। আজ নয়। ঝকঝকে রোদ জমে থাকা বরফে পিছলে পড়ে চকমকাচ্ছে। রাস্তা ভেজা কিন্তু মাঝখানে বরফ নেই। ওগুলো পরিষ্কার করে রাস্তার দুধারে ঠেলে দেওয়া। হীরকের একবার বাইরে যেতে খুব লোভ হল। এতদিন হল এই দেশে এসেছে এখনও বাইরের তাজা হাওয়ায় প্রাণভরে শ্বাস নেওয়া হয়নি। বিজু, রাধা দুজনেই বারবার না করেছে। এখনও পায়ে জোর ফিরে আসেনি। তাছাড়া বরফ জমে জমে জায়গায় জায়গায় ব্ল্যাক আইস হয়ে গেছে। অনেকসময় বোঝা যায় না, মাটির উপর একটা পাতলা আস্তরণ পড়ে থাকে। একবার পা পরে গেলে আর টাল সামলানো যায় না। প্রথম এসে বিজু একবার নাকি ব্ল্যাক আইসে আছাড় খেয়েছিল। হীরকের পায়ের এই অবস্থায় সেরকম কিছু হলে গুরুতর ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু রোদের হাতছানিও উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। শীতের সকালে পিঠে রোদ মেখে শতরঞ্চি বিছিয়ে বাড়ির ছাদে বসে রুটি খেজুরি গুড় খাওয়ার স্মৃতি ছলকে উঠছিল হীরকের মনে। ঠিক করল একটু বেরোবে। বেশিদূর কোথাও যাবে না মোটেই। মেন দরজাস খুলে বেরিয়ে পোর্টিকোর উপর কিছুক্ষণ দাঁড়াবে না হয়। লক্ষ্য করে দেখল রাস্তা দিয়ে যে কয়েকজন হেঁটে কিংবা সাইকেলে যাচ্ছিল সবার পরনে দু তিনটে শীতের পোশাকের আস্তরণ। সবার উপরে লম্বা ওভারকোট। মাথায় টুপি কিংবা মাফলার দিয়ে সারা মাথা মুখ ঢাকা। তার মানে রোদ থাকলেও ঠান্ডা একদম কম না। এ মোটেই তার দুর্গাপুর কি হিন্দমোটরের শীত নয়। তাপমাত্রা কত কে জানে! এখানে আবার ফারেনহাইটের স্কেল। ওরা বলে লো থারটি কি টোয়েন্টি, হীরককে মনে মনে ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে বদলে নিতে হয়। ঠিক ডলার আর টাকার কনভারসনের মত। তখন কুড়ি ডিগ্রীটা মাইনাস পাঁচে পৌঁছে গিয়ে মনে কাঁপুনি জাগায়। তারপর নাকি ঠাণ্ডা হাওয়া চললে থার্মোমিটারে যেমনই দেখাক, ঠান্ডার বোধটা আরও দশ ডিগ্রী নীচে নেবে যায়।

কিন্তু এসব কোনও ভাবনাই হীরককে দমাতে পারল না। এতদিন বিছানায় পড়ে থেকে আর বন্ধ ঘরের নিস্তব্ধতায় গুমরানো মন ডানা ঝাপ্টাচ্ছিল। বাইরের আলো বাতাস কোলাহল মানুষের চলাচল তার মনে যে উষ্ণতা এনে দেবে তাই দিয়েই লড়বে এই ঠান্ডার সঙ্গে। সমস্ত সাবধানতাকে হাওয়ায় ভাসিয়ে হীরক বেরোবার জন্য তৈরি হল। সেই প্রসেসটাও খুব সময় সাপেক্ষ। হাত পায়ের আড়ষ্টতা যায়নি। আস্তে আস্তে কটস উলের ইনার পড়ল, উপরে এবং নিচে। তার উপরে প্যান্ট চাপাতে গিয়ে দেখল বেশ টাইট হচ্ছে। এদেশে এসে শুয়ে শুয়ে মোটা হয়ে গেছে নাকি? দেশে থাকতে চিজ খেত না মোটেই। এখানে রোজ ব্রেকফাস্টে স্যান্ডউইচ খাচ্ছে পাউরুটির ভিতর চিজ দিয়ে। কোমরটা তাই বেড়ে গেছে এই কদিনেই। কোনওমতে প্যান্ট পরা হলে তারপর জামা, সোয়েটার। সবার উপরে জ্যাকেট। আয়নায় নিজেকে দেখল বেশ একটা মোটাসোটা পেঙ্গুইনের চেহারা হয়েছে। দেশে কোনওদিন মাফলার গলায় নি। মায়ের হাজার অনুরোধেও। আজ ভাল করে মাফলার জড়াল। জুতো পড়ে যখন রাস্তায় পৌছাল মনে হচ্ছিল যেন দুটো হীরকের সমান ওজন টেনে নিয়ে চলেছে। শীত আছে, কিন্তু ভালবেসে ফেলার মত শীত। কেন যে ওরা এতো আহা উঁহু করে? রাশি রাশি বরফ ছড়িয়ে আছে পায়েসের মত, তার উপরে রোদের ঝলকানি রাংতা দিয়ে মুড়ে রেখেছে। হীরক মিশিগানকে ভালবেসে ফেলল।

রাস্তায় কখনওই ভিড় দেখেনি। এই দুপুরে আরও কম।  এখানে কোনও বাস নেই। শুধু গাড়ি, অথবা সাইকেল। সাইকেল সকালের দিকে বেশি। অনেক স্টুডেন্ট সাইকেলেই ক্লাসে যায়। কিংবা হেঁটে। তখন এই রকম ধড়াচুড়ো পরে ছেলেমেয়েদের দৌড়ে যেতেও দেখেছে। অনেক বেশি স্বাস্থ্যসচেতন বোধহয় এরা। এখন তাড়া নেই। রাস্তায় আওয়াজ একদম কম। দুই একটা করে গাড়ি সাঁই সাঁই চলে যাচ্ছে, তার যেটুকু আওয়াজ। হর্নের আওয়াজে অভ্যস্ত কানে এই নিস্তব্ধতা সইয়ে নিতে সময় লাগবে। শব্দ শুধু হাওয়ার। সব সময়েই কেমন একটা শনশন করে বইছে। সমস্ত ঢাকা থাকলেও গালটা খোলা। নাকটা লাইট হাউসের মত জেগে আছে। হাওয়ার ধাক্কায় গালের চামড়া কেঁদে কেঁদে উঠছিল। ঠোঁটে ভেসলিন দিয়ে বেরোতে হত। অনভ্যাস। ভুল করে গ্লাভসটাও পড়া হয়নি হীরকের। আঙ্গুলগুলো অসাড় হয়ে যাচ্ছিল ঠান্ডায়। চট করে দুই পকেটে হাত ঢুকাতেই কি আরাম। সাবধানে পা ফেলে হীরক নিজের বাড়িটার দিকে তাকাল। ছতলা উঁচু লাল ইটের বাড়ি। বছর পঞ্চাশ বয়স হবেই এই বাড়ির। যেদিকে তাকায় নতুন ধরনের বাড়ি আর স্থাপত্য তাদের চার্চ রোডের দুধারে। সামনেই ফার্স্ট কনগ্রেগেশনাল চার্চ। এমন কিছু বড় নয়। আস্তে আস্তে নর্থ ইউনিভার্সিটি অ্যাভেনিউয়ের দিকে হাঁটতে শুরু করল হীরক। এখানে হাওয়ার গন্ধটা একদম আলাদা। গন্ধটাকে মনে মনে একটা জায়গা দিতে চাইছিল হীরক। কচি ঘাসের গন্ধ? না, ঘাস আর কোথায় এই রাস্তায়। অনেকটা সুইমিং পুলের মত গন্ধটা। নাকের যা অবস্থা, তার গন্ধ নেবার ক্ষমতা এই শৈত্যপ্রবাহ অকেজো করে দিয়েছে পুরোপুরি। একবার জিভ বের করে হাওয়ার স্বাদ নিতে চাইল হীরক। সঙ্গে সঙ্গে জিভ ঠান্ডায় অসাড়। নেহাত চশমা পরা আছে তাই চোখে সরাসরি ঠান্ডা হাওয়া ঢুকতে পারছে না। হীরকের মনে হল তার পঞ্চইন্দ্রিয়ের মধ্যে এখন চোখটাই শুধু কাজের। তাই দুচোখ মেলে দুপাশের বাড়িঘরগুলো বোঝার চেষ্টা জুড়ল।

নর্থ ইউনিভারসিটি অ্যাভেনিউয়ের উপর একটার পর একটা চমকপ্রদ বাড়ি। দেখেই মনে হচ্ছে একেকটা একেক যুগের- স্থাপত্যের বৈচিত্রে নিজেদের স্বতন্ত্র উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। স্থাপত্যবিদ্যার ঐতিহাসিক হিসাবনিকাশ হীরক জানে না। তাই তার পক্ষে বলা মুশকিল কোনটা আগে আর কোনটা পরের সময়ের। মিশিগান ইউনিয়নের তিনতলা বিল্ডিংটা তাদের নর্থউডের মতই ইঁটের ধাপে ধাপে সাজানো। কিন্তু এর একেকটা হলদে রঙের জানালা বিশাল। তাছাড়া বাড়িটার মাঝখানের অংশটা আরও তলা দুয়েক উঠে ধাপে ধাপে সরু হয়ে চুড়ায় গিয়ে মিলেছে। যেন একটা প্রাসাদ।

রাস্তার অন্যদিকে মিউজিয়াম অব আর্ট অবশ্য আরও প্রাসাদোপম। বালি পাথরের পুরো বাইরেটা। এই ঠান্ডায় একজন কুকুর হাঁটাতে বেরিয়েছে। বিশাল লোমওয়ালা কুকুর, মনে হয় বরফ খুব উপভোগ করছে। বাঁদিকে পড়ল নিউবেরী হল, বড় বড় করে লেখা দেখে বুঝল। এখানেই বিজু থাকে, বলেছিল। এটায় শুধু মেয়েরাই থাকে। বাড়িটাকে দেখেই হীরকের মনে পড়ল গ্রিমস ব্রাদার্সের ফেয়ারী টেলসের বইয়ের ছবি, ঠিক ওরকম সময়ের বাড়ি যেন। বরফে ঢাকা এই রাস্তায় দুধারে ছবিতে দেখা বাড়িগুলোকে প্রাণ পেতে দেখে এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল হীরকের। সে যেন একটা ছবির মধ্যে ঢুকে গেছে। এক সম্পূর্ণ অন্য জগত। অন্য রকমের ঘরবাড়ি। পাতাহীন নির্জন গাছগুলো অচেনা। এরকম অনেকেই তো বিদেশে এসেছে, এই রাস্তায় প্রথম হেঁটেছে। তবু এই আবিষ্কারের আনন্দ তার নিজের, ব্যাক্তিগত, প্রথম। এক অদ্ভুত অনুভূতিতে মন কানায় কানায় ভরে উঠছিল। জয়ের আনন্দ, প্রাপ্তির সুখ কিংবা নতুনত্বের চমক- কি সে অনুভূতি হীরক জানে না। শুধু জানে এই দিনটা, এই বরফাকীর্ণ শহরের নির্জন রাস্তায় নিজেকে খুঁজে পেতে পেতে যে স্মৃতি আজ রচিত হচ্ছে, সেটা কোনওদিন ভুলতে পারবে না। লোভীর মত এই সকালের রঙ-রূপ-গন্ধ আহরণ করছিল হীরক।

হাঁটতে হাঁটতে ডাউনটাউনে পৌঁছে গেল। এই শব্দটা এখানে এসে খুব শুনছে হীরক। বিজুকে জিজ্ঞেস করতে বলেছিল – That’s the most happening place in a city.  তাহলে কলকাতার ডাউনটাউন কোনটা? পার্ক স্ট্রীট? দুর্গাপুরের সিটি সেন্টারটা কি ডাউনটাউন? অ্যান আরবার শহর দৈর্ঘ্যে প্রস্থে কলকাতা কেন দুর্গাপুরের থেকেও অনেক অনেক ছোট। ইউনিভার্সিটি টাউন। তাই ডাউনটাউন ইউনিভার্সিটিকে ঘিরেই। অসংখ্য খাবার জায়গা। কফি শপ। পাব। বার অ্যান্ড গ্রিল। ইটালিয়ান, চাইনিজ, জাপানিজ, থাই। ইন্ডিয়ান কিছু দেখল না। তাদের সারা দুর্গাপুর ঘুরে যতগুলো রেস্তোঁরা পাবে তার অনেক বেশি এই একটা রাস্তায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই কি তাহলে বাইরেই খায়? না হলে চলে কী করে? কিরোপ্যাক্টিক শপ। বিজু বলছিল তার কোনও পার্মানেন্ট পেইন হলে এখানে নিয়ে আসবে। অনেক জামাকাপড়ের দোকান। সব কটারই বাইরে কোনও না কোনও সেলের খবর। এটা কি এখানে সেলের সীজন? দেশে যেমন চৈত্রের সেল? হীরক বুঝতে পারছিল তার জীবন এখন নতুন ক্যালেন্ডার, সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া দৈনন্দিন জীবনের রুটিন ধরে চলবে। একটা আনন্দের আবেগের সঙ্গে সঙ্গে ভয়ের শিহরণ চারিয়ে গেল শরীরে। পারবে তো মানিয়ে নিতে? এই প্রবাস, এই শহর, এই যাপন কি বদল আনবে তার জীবনে, মননে, সম্পর্কে! রেখার ভাল লাগবে তো এই দেশ, এই পরিবেশ? তার একার ভাল লাগার থেকেও এখন দুজনের ভাল লাগার প্রয়োজনটা অনুভব করে ভালবাসাময় সুখ ছড়িয়ে পড়ল শরীরে।

কতটা হেঁটেছে বুঝতে পারছে না হীরক। এক কিলোমিটার কিংবা তারও বেশি। নতুন দেখার আনন্দে হাঁটছিল। বুঝতে পারেনি। এখন পা আর নিতে পারছে না। ভার হয়ে গেছে খুব। কোথাও বসতে না পারলে বুঝি পড়েই যাবে। সামনেই স্টারবাক্স, কফির দোকান। নাম শোনা। কফি খাওয়ার অত অভ্যাস নেই। কিন্তু মনে হল যদি ভিতরে বসার জায়গা থাকে একটু পায়ের আরাম হবে। একটু গরম কফি পেলে শরীরে উষ্ণতা ফিরে পেতে পারে কিছুটা। তার সামান্যই মূলধন। অন্তত একটা কফি তো কিনতে পারবে এই ভরসায় ঢুকে পড়ল হীরক।

দোকানে ঢুকে দেখল অনেকেই কফি নিয়ে বসে আছে। কেউ একা, কফি খেতে খেতে বই পড়ছে। দু-তিনজন মিলেও বসেছে। কিন্তু তারা যেমন ক্যান্টিনে চা নিয়ে আড্ডা দিত সেরকম শব্দ নেই। বেশিরভাগ স্টুডেন্ট বলে মনে হল। এখানে কি কলেজের মধ্যে ক্যান্টিন নেই? কাউন্টারে গিয়ে আগে কিনে তারপর বসতে হয়। দেওয়ালে টাঙ্গানো লিস্টে চোখ ফেলল। ক্যাপুচিনো, লাতে এমনই কতসব নাম পেরিয়ে কফি দেখতে পেল। প্রত্যেকটার আবার তিনটে করে সাইজ। টল, গ্র্যান্ডে, ভেন্টি – এগুলোর কী মানে জানে না হীরক। দাম দেখে মনে হল টলটাই সবচেয়ে ছোট। তাও এক ডলার বাইশ সেন্ট। মনে মনে হিসেব করল প্রায় তেত্রিশ টাকা। পিলে চমকে উঠল। এতো? পঞ্চাশ পয়সায় এক গ্লাস চা খেয়েছে, কফি খেয়েছে এক টাকায়। এতো তার সারা মাসের কফির খরচ একবারে। বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। শুধু বসার জন্য অত খরচ করা যাবে না। পায়ে পায়ে আবার বাইরে বেরিয়ে এল।

এবার পায়ে ব্যাথা করছে। হেঁটে ফিরতে পারবে তো? ডান পায়ে আর চাপ দেওয়া যাবে না। একটু ভয় করছিল হীরকের। বিজু বারবার বারণ করেছিল, ওর কথা না শুনে এতদূর চলে আসা ঠিক হয়নি। নতুন জায়গা আবিষ্কারের আনন্দ সরে গিয়ে এখন ফিরে যাবার মানসিক চাপ আঁকড়ে ধরছিল। রাস্তায় আছে কিছু লোক। পাশ দিয়ে যাবার সময় হেসে তাকাচ্ছে, হ্যালো বলছে কেউ কেউ। কিন্তু সে যদি এখন রাস্তায় পড়ে যায় কেউ কি সাহায্য করতে ছুটে আসবে? ডান পায়ের হাঁটুতে একদম সুচের মত বিঁধছে যেন। মুখ বিকৃত করে এক পা এক পা ফেলে এগিয়ে চলল হীরক। অভিবাসী জীবনে শুধু নতুন পাওয়ার আনন্দ নেই, নিজের লড়াই একলা লড়ার মনের জোর থাকতে হয়। এই কদিনে অনেক পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে গেছে হীরক। কিন্তু সব সময় হাত বাড়ালেই বন্ধু ছিল। আজ একা। মনের জোর আনার জন্য গুনগুন করে গাইতে শুরু করল কদম কদম বাড়ায়ে যা, খুশিকে গীত গায়ে যা। দুঃখের মধ্যেও হাসি পেল হীরকের। কিন্তু এই গানটার বেশি লাইন জানে না। তার চেয়ে গাওয়া যাক যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে একলা চলো রে, একলা চলো, একলা চলো একলা চলো রে।

কিন্তু শরীরে জোর না থাকলে, শুধু গান গেয়ে কি আর এগোনো যায়? পা-টা কেমন যেন মোমের মত গলে যাচ্ছে। আঁকাবাঁকা পায়ে হাঁটছিল হীরক। এমন সময় পাশ দিয়ে হনহন করে হেঁটে যাওয়া একটা ছেলে ওকে দেখে হঠাৎ থমকে গেল। খুব লম্বা, কালো, দশাসই চেহারার ছেলেটা। মুখটা কোমল, না হলে লোক বলাই ঠিক হত। Are you good, bro?  ওর অ্যাক্সেন্ট অন্যরকম, মোটামুটি আন্দাজে মাথা নাড়ল হীরক।

Need any help?  You Indian?  Umich student?  ছেলেটা সত্যিই সাহায্য করতে চায়। ওর ইংরাজিও এমন কিছু উঁচু দরের নয়। সেই ভরসায় নিজের কষ্টের কথা বলল হীরক।

আরে, তুমিই সেই স্টুডেন্ট যার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল? বড় বড় দাঁতে মাড়ি দেখিয়ে হাসল ছেলেটা। তোমার কথা শুনেছি। এবার হাত বাড়িয়ে দিল ছেলেটা। I’m Oyo, from Nigeria.

ওর অতবড় হাতের মধ্যে নিজের হাতটা হারিয়ে গেছিল হীরকের। কোনওমতে বলল, I’m Hirak. Glad to meet you.

Hero? You are a hero!  আবার হাসল ছেলেটা। গোলাপি মাড়ি দেখিয়ে। কিন্তু এখন তুমি এভাবে আর হেঁটো না। তোমার নর্থউড অ্যাপার্টমেন্ট এখনও আধা মাইল দূরে। আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি।

কিন্তু কীভাবে? অয়ো নিজেও তো হেঁটেই যাচ্ছে। হীরক কিছু বোঝার আগেই অয়ো ওকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল। Don’t worry, you will be fine.

পায়ে এতো যন্ত্রণা হচ্ছিল যে না বলার অহমিকা ছিল না আর হীরকের। অয়োকে মনে হচ্ছিল কিংকং। লম্বায় প্রায় সাতফুট হবে হয়তো। অনায়াসে তার বাঙালি দেহখানি কোলে তুলে লম্বা লম্বা পায়ে এগিয়ে চলেছে। মনেই হচ্ছে না ওর কোনও কষ্ট হচ্ছে বলে। বরং নিজের কথা বলতে বলতে হাঁটছিল। অয়ো নিজেও নতুন, তবে ছয়মাস হয়ে গেছে। নাইজেরিয়া থেকে ইন্টারন্যাশানাল স্টুডেন্ট হিসেবে এসেছে পিএইচডি করতে।  এইভাবেই নতুন দেশে এসে প্রথম বন্ধুত্ব হল ভারতীয় নয় এমন একজনের সঙ্গে।

এটাও তার প্রথম দিনের একটা বড় প্রাপ্তি। ভাবছিল হীরক।
 

 ৪  

এখানে সবকিছু তোর উপরে, খাটতে হবে। যদি এক্সট্রা ক্রেডিট নিয়ে নিতে পারিস তাহলে হারানো সময় ফিরে পাবি। বিজু উৎসাহ দিয়ে বলছিল।

হারানো সময় কি আর ফেরে রে বিজু!

প্যানপ্যানানি ছাড়ত। Show some positive energy! হীরকের শুকনো হাসি দেখে নিজেকে চট করে সামলিয়ে নিল বিজু। সরি রে, তোর ব্যাপারটা ইউনিক, আমার হলে আমিও মেনে নিতে পারতাম না। তবে দ্যাখ তুই কেমন এদেশের হেলথ ফেসিলিটিগুলো সব জেনে গেলি, বল। আমরা যে কবে এইসব জানতে পারব! বলে ছদ্ম-দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাওয়াটা হালকা করতে চাইছিল বিজু।

ফিক করে হেসে ফেলল হীরক। তুই সব কিছুতেই একটা পজিটিভ দিক খুঁজে পাস কেমন করে বিজু?

পেতে হয়রে। আমি তো আর হীরেমানিক নই, আমি যে পান্না। পান্নাবাইদের অনেক কান্না জমিয়ে রেখে এগোতে হয়।

কি সেন্টুমার্কা কথা বলছিস আজ। দিনদিন ফেমিনিস্ট হয়ে যাচ্ছিস।

ফেমিনিস্ট তো তারা যারা সমস্ত মেয়েদের হয়ে কথা বলার হিম্মত রাখে। আমি তো শুধু নিজের লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছি। বিজুর কথায় ধীরে ধীরে উত্তাপ বাড়ছিল। ভেবেছিলাম মার্কিন দেশে বুঝি মেয়েরা সমানে সমানে, দিন দিন সেই ভুল ভাঙছে।

হীরকের দৃষ্টিকোণ একটু অন্যরকম। মনে আছে মেয়ে হবার জন্য বিজু কিরকম প্রফেসার থেকে ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট সবার কাছে বেশি বেশি হেল্প পেত। তাই বলতে ছাড়ল না। শুধু লড়াইয়ের কথা বলছিস? আর এক্সট্রা সুবিধাগুলো? মনে আছে সুবীর ধর তোকে কেমন বেশি নম্বর দেওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকত?

দেয়নি তো। কারণ আমি ওর চুতিয়াপনাকে প্রশ্রয় দিইনি কখনও। মনে রাখবি এইসব দিতে চাওয়া লোকগুলো কিছু নিতেও চায়। সেটা আর একটা লড়াই।

সুবীর ধর নয় মাগিবাজ ছিল, আমরা সবাই জানতাম। কিন্তু সকলে কি আর ওরকম?

আচ্ছা হীরক, একটা ক্লাসে যখন চল্লিশটা ছেলে থাকে আর একটা কি দুটো মেয়ে তখন ওই চল্লিশ জোড়া চোখের সামনে কেমন লাগতে পারে বুঝিস? যারা তুই কোনওভাবে ছড়ালে, টিটকিরি দেবার জন্য মুখিয়ে আছে। তুইও দিয়েছিস একসময়।

এটা বাড়াবাড়ি বিজু, আমরা তোর বন্ধু ছিলাম না?

সেটা পরে, শুরুতে নয়। আমার মনে আছে ফার্স্ট ইয়ারের শুরুর দিকে একদিন আমার পিরিয়ডস হয়ে গেল, সালোয়ারে দাগ লেগেছিল। আমি বেঞ্চ থেকে উঠলেই চারদিকে ফিসফাস, গুজগুজ। মুখে বলতে কি হয়? সারাদিন আমার উপর দিয়ে কি চাপ যে গেছিল। বলতে বলতে বিজুর মুখের রেখাগুলো দানা বাঁধছিল। তখন আমার সদ্য আঠেরো, মেয়েদের স্কুল থেকে এসেছি। তোদের বয়েজ ক্লাবের ফাকড আপ অ্যাটিচুড দেখলে একেবার গা জ্বলে যেত।

হীরক দেখল বিজু বেশ তেতে গেছে। মুখে খই ফুটছে। নাকের পাটা ফুলে গেছে। এক্কেবারে একটা রাগী বেড়ালের মত লাগছে। সাদা পতাকা ওড়ানোর ভঙ্গিতে বলল, আমরা এত খারাপ যদি আমাদের সঙ্গে তোর এত প্যালি হল কেমন করে বিজুদিদি?

তোদের ভাষায় খিস্তি দেওয়া শিখলাম, সিঁড়িতে বসে একসঙ্গে বিড়ি খেলাম, ছেলেদের সঙ্গে টক্কর মেরে ছেলে হলাম। না হলে চার বছর কাটাতাম কেমন করে?

তার মানে আমাদের সঙ্গে তোর ভাল লাগত না একদম। ভান করতিস। অথচ আমি তোকে সব সময়ে খুব কাছের বন্ধু হিসাবেই ভেবেছি।

ঠোঁট ফোলাস না, তোর মতন বন্ধু কটা আছে মানিক আমার। হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে দুই হাতে হীরকের চুলের গোছা ধরে টান দিল বিজু। আঁতকে লাফিয়ে ওঠে হীরক, আরে আরে করছিস কী? এতো ফিজিক্যাল টর্চার।

না, আমি তোর বুদ্ধির গোড়া ধরে টেনে দিলাম শুধু। একবার বল, আমাকে কেন একটা ছেলে হয়ে মিশতে হল, তবে এন্ট্রি পেতে হল তোদের ঠেকে?

বড্ড চাপ নিচ্ছিস। একটু মিশিগানের আবহাওয়া নিয়ে কথা বলি এবার?

এস্কেপিস্ট কোথাকার। মুখের রেখা ভাঙতে ভাঙতে বলল বিজু। জানালার কাছে গিয়ে রাস্তায় উঁকি দিল। বেশ রোদ আজ, রাস্তায় ঘ্যামা ভিড় হয়েছে কিন্তু।

প্রথমে এসেই হীরক শীতের মরণ কামড় পেয়েছিল, এখন কম। এখানকার হিসেবে শীতকাল চলে গেছে। কিন্তু এপ্রিল মাসের ঠান্ডাও কলকাতার হিসাবে ডিসেম্বারের শীত। বরফ আর পড়বে না এবছর। ক্রমে ক্রমে দিন বড় হচ্ছে আর আকাশ রোদ ঝলমলে। গাছে পাতা আসতে শুরু করেছে। বরফের আবরণ সরিয়ে ঘাস উঁকি মারছে সর্বত্র। শীতকালে সোয়েটার আর কোটের তিন-চার আস্তরণ শরীরকে ন্যুব্জ করে রাখে। সেইসব ধড়াচূড়া ছেড়ে এখন হালকা জ্যাকেট। নির্ভার শরীরে উৎফুল্ল ভাব। শীতঘুম থেকে জেগে উঠে ডাউনটাউন সরগরম। রাস্তায় লোক চলাচল বেড়েছে। বিজু বলেছিল শীতের পর এখানে যখন রোদ ওঠে, বরফ গলে তখন এখানকার লোকের আনন্দটা আমিও বুঝতে পারি আজকাল। এ এক অদ্ভুত মুক্তির আনন্দ। আরও কদিন বাদে দেখবি সব্বাই পথে বেরিয়ে পড়েছে, কেউ ঘরে থাকতে চাইবে না আর।

কিন্তু যে ভিড় কলকাতায় দেখে হীরক অভ্যস্ত তার সিকিভাগও নয়। এটাকে ভিড় বলিস তুই?

এই দেশে আসার আগে হীরকের কাছে অ্যামেরিকা ছিল নিউ ইয়র্ক, শিকাগো আর ডালাসের মত ব্যস্ত শহর। সিনেমায় আর টিভিতে যেইটুকু দেখা। তার সঙ্গে মেলাতে পারছে না মোটেই। বিজুকে সেটা বলতে হো হো করে হাসল। আচ্ছা, তোকে এখনও কোন অ্যামেরিকান জিজ্ঞেস করেছে ভারতের রাস্তায় হাতি চলে কিনা? কিংবা তুই কি গরুর গাড়ি করে স্কুলে যেতিস?

না। মাথা নেড়েছিল হীরক। তবে অনেকেই অবাক হয় আমরা ইংরাজিতেই পড়াশোনা করেছি, এই ভাষায় এতটা সড়গড় বলে।

এই রকমই হয়। নিউ ইয়র্কের স্ট্যাচু অব লিবার্টি তোর কাছে অ্যামেরিকার সিম্বল ছিল, অ্যামেরিকার সব রাস্তা ভাবছিস হলিউড বুলেভার্ডের মত হবে। রাস্তায় হরিণ আর হাঁস হেঁটে বেড়ানো আমেরিকার সঙ্গে মেলাতে পারছিস না। তেমনি এদের কাছে ইন্ডিয়া মানে গরু, হাতি আর খাটো ধুতি পরা গান্ধী। অনেক তো সেইটুকুও জানে না আর ভাবে আমরা পকেটে সাপ নিয়ে ঘুরে বেড়াই।

ধ্যাৎ, তোর না বাড়াবাড়ি বিজু। আমাকে এমন কেউ বলেনি।

বলবে। দোষের কিছু নেই। এক্সপোজার কোথায়? আসলে আমাদের কন্টেক্সট আলাদা। যেভাবে বেড়ে উঠেছি দেখার ভঙ্গিটাও তেমনি হয়েছে। কালচার শক কাটিয়ে উঠলে দেখবি সেই মানুষ। গায়ের চামড়ার রঙ যেমনই হোক চিমটি কাটলে একই রকম ব্যাথা লাগে।

বিজুর এই দেশে দেড় বছর। হীরক বুঝতে চেষ্টা করছিল বিজুর পরিবর্তনটা। বাইরেরটা সহজে চোখে পড়ে। ওয়েস্টার্ন পোশাক কলেজেও পড়ত, জিনস প্রায় দিনই। কিন্তু উজ্জ্বল লাল নীল রঙের জামা এখন আর পরতে দেখে না। সব বাদামী আর ছেয়ে রঙের। রানিং শু পড়ে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ে দৌড়তে। সে যখন বিছানায় লটকে ছিল স্কি করতে গেছিল মিশিগানের অদূরে মাউন্ট ব্রাইটনে।

পারলি? জিজ্ঞেস করেছিল হীরক।

চেষ্টা করতে দোষ কি। দু-একবার আছাড় খেয়েছি, ঘাড় না ভাঙলেই হল। এই দেশে যখন থাকব আর বছরে চারমাস বরফের তলায় তখন নিজেকে সড়গড় করে নেওয়াই ভাল।

বিজুর গলায় ভবিষ্যতের এমন নিশ্চিত ম্যাপের ইঙ্গিত শুনে অবাক হয় না হীরক। বিজু বরাবরই লক্ষ্যে স্থির, চিন্তায় পরিপাটি। শীতকালে স্কি করলি তাহলে গরমে কি করবি?

এখানে পড়ার যা চাপ, অত বেশি কিছু করার সময় কোথায় বল। তবে গত সামারে কর্ন ডিটাসেলিং করতে গেছিলাম। হেবি পয়সা দেয়।

সেটা আবার কী রে?

ক্ষেত ঘুরে ঘুরে ভুট্টার ছুন্নত করি, ক্রস পলিনেশানের জন্য। খ্যাক খ্যাক করে হাসল বিজু। ওর মুখে কোন কথা আটকায় না। একমাস করেছিলাম। হাতের ছালা উঠে গেছিল। পয়সা জমাচ্ছি, গলফ খেলা শিখতে যাব।

মনীষ তো শুনেছি খেলে।

বিজু হাসল। মনীষ অনেকরকম লাইন করেছে ওখানে, দিনু ভাইয়ের সঙ্গে সবজি বেচে পয়সা কামাচ্ছে। ও তো খেলবেই। তবে আমরা ইন্ডিয়া যাওয়ার আগে মনীষ এখানে আসবে। ওকে নিয়ে ভুট্টা ক্ষেতে কাজে যাব ভেবেছি। ওকেও একটু হাট্টাকাট্টা বানাতে হবে। তাছাড়া বিয়ের আগে পকেটে দু পয়সা আসবে।

অগাস্ট মাসে মনীষ আর বিজুর বিয়ে। ইন্ডিয়াতে গিয়ে। সেই কথা ভেবে হীরক হেসে বলল, বিয়ের আগে রোদে কাজ করে মুখ পোড়াবি?

এতগুলো গোমড়ামুখো দিনের পর এমন ফটফটে রোদ। তার একটু ছোঁয়া তো চাই। এখানে দেখবি সব লোকজন ছুটির দিনে সকাল থেকে মাঠে ঘাটে কিংবা বীচে গিয়ে বসে থাকে। পার্কে দৌড়াচ্ছে, জলে ঝাঁপাঝাঁপি করছে, বেরিয়ে পড়ছে ক্যাম্পিঙ্গে। ঠিক যেন সারা বছরের জন্য মনে রোদ জমিয়ে নিচ্ছে।

তাহলে ভুট্টা ক্ষেতে আমাকেও নিয়ে চল।

বললাম না, খুব খাটনির, হাওয়া খাওয়ার জায়গা নয় মোটেই। বারো ঘণ্টা মাঠে চক্কর মারতে হলে না ফেটে যাবে তোর! পা নিতে পারবে না।

বুঝেছি। ভুট্টা ক্ষেতে তুই আর মনীষ হাত ধরাধরি করে প্রেম করবি। মাঝে মাঝে ভুট্টার মাথা কেঁপে উঠলে বুঝব কেষ্ট লীলা চলছে।

ওসব হিন্দি সিনেমায় সরষে ক্ষেতে হয় মনা। ভূট্টা গাছের পাতার ধার তো দেখোনি, ফালা ফালা করে দেবে। তাছাড়া নিজের নরম বিছানা থাকতে আমি কেন মনীষের সঙ্গে মাঠেঘাটে গড়াগড়ি খাব বলতো?

তখন না হয় মনীষের সঙ্গেই যাস। বরং চল না আমরাও কোথাও যাই আজ। রোদ বিলোতে মিশিগান যখন এতই চিপ্পুস, আজকের দিনটা ছাড়ি কেন?

আমার এই উইকএন্ডে প্রচুর অ্যাসাইনমেন্ট। তুই রাধার সঙ্গে যা না। সে মাল কোথায়?

আজ তামিল নিউ ইয়ার, এখানকার সাউথ ইন্ডিয়ান কমিউনিটিতে বিশাল হইচই আজ। সেখানেই সকাল থেকে পাতা পাড়তে চলে গেছে। আচ্ছা তার মানে তো বাংলা নববর্ষও এক দুদিনের মধ্যেই। হয় না এখানে?

হয় নিশ্চয়ই কিছু, আমার অত পুরকি নেই।

কেন, চিনিস না কাউকে?

চিনি দুই একজনকে। দুর্গাপূজায় একদিন গেছিলামও, কিন্তু তেমন জমল না। ছেলেরা একদিকে, মেয়েরা অন্যদিকে। শাড়ি গয়নার গল্পে মন মজল না। তুই এক কাজ কর। হুরনে গিয়ে কায়াক চালিয়ে আয়। পানসি চালাবার মজা পাবি।

হীরক উৎসাহে লাফিয়ে উঠল। আমি তো বাইতে পারি না, তুই চল না।

হুপ খাওয়াস না, আমি যাব না, তাছাড়া – একটু কিন্তু কিন্তু করে বলেই ফেলল বিজু অস্ফূটে। আমার না ভয় করে। আসলে তুই আসতেই আমার জন্য এত বড় অ্যাকসিডেন্ট হল। এরপর জলে নাবাই, আর তোকে নদীর জলে উল্টে ফেলি।  কথা শেষ না করেই ম্লান হাসল বিজু। ঠোঁটজোড়া বেঁকে যাচ্ছিল কান্নার দমকে। ফিসফিস করে বলছিল বিজু, আমার এত গিলটি লাগে রে হীরু, তোর এত বড় ক্ষতি করে দিলাম আমি এদেশে আসতে না আসতেই।

এটা আবার কি ক্যাচাইন! এই তো এতক্ষণ তেজিয়াল নারী হয়ে আমায় দম দিচ্ছিলি। এখন আবার ফ্যাঁচফ্যাঁচ কেন? ব্যস্ত হয়ে পড়ল হীরক।

বিজুর অনুশোচনা জেনুইন। হীরক আবহাওয়া হালকা করার চেষ্টা করল। যে বাঁশ দেবার সে উপর থেকে দিচ্ছে। তুই সেখানে কী করবি, বল তো? আমি বিন্দাস, ভগাদাকে বলে দিয়েছি। প্যান্ট খুলে দাঁড়িয়ে আছি, দে কত ঢুকাবি আছোলা বাঁশ। হীরক দে প্রস্তুত।

হীরকের বলার ভঙ্গিতে কিছু ছিল বিজু ফিক করে হেসে ফেলল। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখের কোলের জমা জলটা টেনে দিল। তুই সত্যিই আমাকে মনে মনে খিস্তি করিস না বল?

কখনও ভাবিনি এরকম করে। জোরে জোরে মাথা নাড়ল হীরক। কীভাবে প্রমান করি বল? তোকে ছুঁয়ে বলবো?

যেখানে সেখানে ছুঁয়ে দিস না, মনীষ বিট্রেড ফিল করবে। তার বদলে একটা সিগারেট দে, ফুঁকেই ঝটপট কাটবো। আজ এত অ্যাসাইনমেন্ট আছে না, এক্ষুনি শুরু না করলে পরে ফাটবে।

বিজুকে নর্মাল হতে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল হীরক। দুটো সিগারেট থেকে ধোঁয়া বেরিয়ে এবার মিশে যাচ্ছিল একসঙ্গে।

বিজু কিছুতেই বেরোল না। সিগারেট টেনেই ফিরে গেল ওর অ্যাসাইনমেন্টের দুনিয়ায়। কিন্তু লোক জোগাড় হয়ে গেল। অ্যালান, ওর গার্লফ্রেন্ড সু আর  অয়ো। অ্যালানের গাড়িতে করে ওরা চলল অ্যাগ্রো পার্ক। কি ভিড়! গাড়ি পার্ক করার জায়গা পাওয়া যায় না। হুরন নদীর বুকে ততক্ষণে কত যে পানসি ভেসেছে! কদিন আগেও নদীর জল ছিল বরফ, ফটফটে সাদা। রাস্তায় কিছু কিছু জায়গায় বরফের স্তূপ গলতে হয়তো এখনও সময় লাগবে, কিন্তু হুরনের জল এখন টলটল করে বইছে। আঙ্গুল ডুবিয়ে দেখল, কনকনে ঠান্ডা। হাঙরের কামড়ের মত।

কায়াক তো নেবে, কিন্তু চালাবে কে? হীরকের নৌকা বাওয়ার কোন অভিজ্ঞতা নেই। অয়োরও নয়।

You guys don’t have rivers down your place? অ্যালান খুব অবাক হয়েছিল। ও মিশিগানের ছেলে। ঠান্ডায় যেমন কাত হয় না, গরমে জলে নৌকা বাওয়াতেও ওস্তাদ। কায়াক চালাচ্ছে মিডল স্কুল থেকে। সু  ফ্লোরিডার মেয়ে। সেও ভালই চালায়।

নদী আছে অ্যালান, কিন্তু সে সব বিশাল নদী। হীরক দামোদরের কথা ভাবছিল। ওখানে কে ডিঙ্গি চালাতে যাবে। নৌকা চলে, তার জন্য চাই ওস্তাদ মাঝি।

অয়ো সাদা দাঁত বের করে হাসল। আমাদের নদী নাইজার, সেখানে অনেকে কায়াক চালায়। আমার সুযোগ হয়নি। তবে একটু দেখিয়ে দিলেই আমি পারব মনে হয়। এমন কিছু কঠিন বলে মনে হচ্ছে না।

অ্যালান আর সু একসঙ্গে যেতে চায়। ঠিক হল প্রথম কিছুক্ষণ অ্যালান হীরককে তালিম দেবে, সু অয়োকে। তারপর ওরা একটাতে  চলে যাবে, হীরক আর অয়ো অন্যটায়। চালাতে গিয়ে দেখল এমন কিছু কঠিন নয়। একটাই ভয় যদি উল্টে পড়ে কী হবে, সাঁতার তো জানে না। সু বলল, কোনও অসুবিধা নেই। আমরা কাছাকাছি থাকব।

সেটা অবশ্য খুব একটা ভরসার নয়। কারণ কায়াকে উঠেই সু লম্বা হয়ে অ্যালানের কোলে আর সে ব্যাটাও ঘনঘন ঝুঁকে পড়ে এত আদর আর চুমুর ঘটা শুরু করল, ওদের কায়াক উল্টে না যায় সেই চিন্তা বরং বেশি হচ্ছিল হীরকের। হীরকের পানসিতে কোনও অসুবিধে হল না। অয়ো বেশ তাগড়াই ছেলে। একবার দেখে নিলে এসব চালানো ওর কাছে নস্যি। শেষের দিকে হীরকও বেশ খানিকক্ষণ চালাল। খুব ভাল লাগছিল। নদীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, চারদিকে আরও কত লোকজন। হাসি হুল্লোড় মজা। এই কমাস ওর মনের উপর একটা ভারী পাথর চেপে আছে। অন্তত কিছুটা হালকা লাগছিল আজ, হাওয়া বাতাস খেলছিল মনে। নতুন দেশের নতুন বন্ধু, আড্ডার ভঙ্গীটা আলাদা। বেশ একটা উত্তেজনা মনে।

পরদিন ফোনে বাড়িতে কথা বলছিল। কায়াক চালানোর কথা শুনে বাবা খুব খুশি। ছোটবেলায় দেশের বাড়িতে বর্ষায় জলে থইথই, ভেলা চালিয়ে স্কুলে গেছি। এদেশে এসে এমন সুযোগ আর কোথায়!

এইসব নানা কথা বললেও হীরক বলেনি তার অ্যাকসিডেন্টের কথা। এখন সেরে গেছে, তবুও। বরং সে যে কত ভাল আছে সেটাই জানাতে চায়। কী লাভ চিন্তা বাড়িয়ে। এতদিন ফোন করলেও বলার মত কিছু ছিল না। বাইরে না বেরোলে আর এখানকার কথা কি বলতে পারে। আজ সুযোগ পেয়ে গুছিয়ে বলছিল। শুধু কায়াক বাওয়ার কথা নয়, তার নতুন পাওয়া বিদেশি বন্ধুদের কথাও। মার শুধু প্রশ্ন, খাচ্ছিস তো ঠিক করে।

হীরক দুর্গাপুরের খবর চাইছিল। আসলে খবর চাই রেখার, কিন্তু সরাসরি কীভাবে জিজ্ঞেস করা যায় বুঝতে পারছে না। এতদিন এসেছে ওর কাছ থেকে কোনও খবর নেই। শুধু একবার তার চিঠির উত্তর এসেছিল শুরুতে। তারপর সব চুপ। রেখা কি তাকে ভুলে গেল? কেমন আছে মা সবাই? আমার কোনও বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়?

শানু এসেছিল একদিন। তোর অ্যাড্রেস চাইছিল। আমি দিইনি। হীরককে নিশ্চিন্ত করার ভঙ্গীতে বলল নিলীমা।

কেন? দাওনি কেন?

তোর কি মাথা খারাপ? ওই পাগলকে তোর ঠিকানা দেব আমি? কখন কী বলে মাথার ঠিক নেই কোনও। বলছিল ও নাকি অ্যামেরিকা আসতে চায়। বোঝ একবার কান্ড। একবার এসে তোর ঘাড়ে চেপে বসলে তুই কী করবি?

শানু অ্যামেরিকায় জন্মেছে, সেই সূত্রে এই দেশের সিটিজেন। আসতেই পারে। কিন্তু হীরকের নিজের কোনও ঠিকঠিকানা নেই, ও এখন এসবের মধ্যে জড়াতে পারে না। দাওনি ভালই করেছো। আর কেউ মা? আর কারো খবর জানো।

নীলিমা চুপ করে গেল।  ছেলেটা এত দূরে থাকে। কারও খারাপ খবর পেলেই বা কী করবে? আসতে তো পারবে না। নীলিমার নিজেরই তো জ্বর গত তিনদিন, জানতে দিয়েছে ছেলেকে?

হীরক বেশি জোর করল না। যদি সামনের দু-এক সপ্তাহে কোনও চিঠি না আসে, বাড়িতেই জিজ্ঞেস করবে রেখার কথা। চিনুকে দিয়ে খবর নেওয়াবে। বাড়িতে বুঝতে পারবে। পারুক। কদিন বাদে এই নিয়ে তো কথা বলতেই হবে। বাবা মা আগে থেকে আঁচ করতে পারলেই ভাল। তাছাড়া রেখা তো কোনও ফেলনা কেউ নয়, মা বাবার আপত্তি থাকার কথা নয়।

এমনি কথাবার্তা চলতে থাকে হীরকের মনে। ভালবাসার এক তীব্র বেদনা আছে। ভালবাসার মানুষকে কাছে পাওয়ার প্রবল আকর্ষণ। এই অনুভূতি এমন করে আগে কখনও পায়নি হীরক। রেখাকে মনে মনে ভালবেসেছে সারা জীবন। কিন্তু একবার সেই ভালবাসার প্রত্যুত্তর পাওয়ার পরে দুটি মানুষের মধ্যে যে সেতু তৈরি হয় তাতে প্রতিদিনকার পদচিহ্ন খুব জরুরি। দূরত্ব মানুষকে এমন হাহাকার এনে দিতে পারে হীরক কোনওদিন বোঝেনি। বাবা মাকে ভালবাসে সে। তাদের থেকে দূরে থেকেছে। মন কেমন করেছে, মেঘলা হয়েছে অন্তস্থল। কিন্তু এমন ঝড় ওঠেনি। দিনের প্রতিটা মুহূর্তে এমন করে ঢুকে পড়েনি অন্য আরেকজনের নিস্তব্ধ উপস্থিতি। ছোঁয়া যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায় সর্বক্ষণ। সেদিন বাড়িতে যখন লোকজন এল এতো, চিনু ছবি তুলেছিল এক রোল। আসার সময় হীরককে একটা অ্যালবাম বানিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। তার মধ্যে রেখার দুটো ছবি আছে। একটা সবার সঙ্গে, আর একটা গান করার সময়। সেটা একার। ভাগ্যিস! এই ছবিগুলো না থাকলে শুধু কল্পনাতেই মূর্তি গড়তে হত। রোজ একবার করে সেই ছবি বের করে হীরক। ছবিতে রেখার গালে হাত বুলিয়ে স্পর্শ খোঁজে। এই স্পর্শসুখ ওর আসা একমাত্র চিঠিটা থেকেও পায়। বেড সাইড টেবিলের ড্রয়ারে রাখা থাকে সবসময়। রাত্রে একবার না পড়ে ঘুম হয় না। যদিও প্রায় মুখস্ত হয়ে গেছে, তবু চিঠিটা চোখের সামনে মেলে ধরে প্রতিটা অক্ষর থেকে রেখার হাতের ছোঁয়া খোঁজে হীরক।

 

[ক্রমশ]