ছায়াপাখি — দুই দিগন্ত, পর্ব ৯

বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

কলঘরের চিল

বহু বছর আগের নাবালক বিকেলগুলো ভাঙা কাঁচের মত চুরচুর হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল হীরকের চারপাশে। পা বাঁচানোর সন্তর্পণতায় দরজা খুলে কাঠের বারান্দায় বেরিয়ে এল হীরক। গাঢ় অন্ধকারে লতানো সময়ের দিনপঞ্জি জট ছাড়িয়ে হঠাৎই সমান্তরাল। ঘরের ভেতর থেকে ছিটকে আসা তিস্তার হাসির উচ্চতান কানে এলেও ভিতরে পৌঁছাচ্ছে না। ডেকের মধ্যে ইতস্তত ছড়ানো চেয়ার। ঝলসানো মুরগির গন্ধমাখা গ্রিল। করতালুর উত্তাপে জড়ানো চেনা জীবনের জলছবি। তবু যেন হীরকের মনে হল আর দু পা এগিয়ে ডেকের রেলিং ধরে দাঁড়ালেই পৌঁছে যাবে দুর্গাপুরের বারান্দায় শানুর মুখোমুখি।

ভেজা ঘাসের উপর দিয়ে দৌড়ে যাওয়া কাঠবেড়ালির অশরীরী পদক্ষেপ অথবা একেবারেই ভিতর থেকে উঠে আসা শব্দে আঙুল কেঁপে উঠে হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটা ছিটকে পড়ে ডেকে গড়াগড়ি খেল। এক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল আজ। হামাগুড়ি দিয়ে সিগারেট তুলতে গিয়ে ভেজা ডেকের আঠালো গন্ধে আচ্ছন্ন হল হীরক। এখনও বিশ্বাস করতে পারছিল না। মা যা বলল সেটা কি সত্যি? মিথ্যেই বা কেন হবে! সে তো বারবার জিজ্ঞেস করল। মা বলল, হ্যাঁ, তাই তো শুনলাম রে। শানুকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে।

পরমেশবাবু তো হাসপাতালে যাওয়ার পথেই— মা এরপরে ফোনের মধ্যেও গলাটা নিচু করেছিল অনাবশ্যক গোপনীয়তায়। তোর বাবা দেখতে গেছিল। শুনলাম সারা গা রক্তে ভাসছিল, মুখটা একেবারে থেঁতলে— মা গো! কী নৃশংস ভাবতে পারিস? পিশাচ, পিশাচ একেবারে!

–কাকুর ঘাটকাজ তাহলে কে করল? শানু ছিল? কথাগুলো হীরকের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল অনবধান যান্ত্রিকতায়। মন তখনও অবিশ্বাসের দূরত্ব পার হচ্ছে।
–ওই খুনিকে দিয়ে করাবে? পরমেশবাবুর আত্মার শান্তি হত তাতে? মনে হয় না সুতপা শানুকে বাবার কাজ করতে দিয়েছে বলে।

শানু ওর বাবাকে মেরে ফেলেছে? নিজের হাতে? কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না হীরক। কেন এরকম করলি শানু? কেন? অন্ধকার আকাশে তারা খোঁজার ব্যার্থ চেষ্টার মধ্যে অনিবার্য এই প্রশ্নটা মাথা চাড়া দিল।

শানু বলেছিল কিছু হলে আমাকে সামলাবি তো? ও যে এতবড় কিছু করে বসবে কী করে জানবে হীরক? জানলেই বা কী করত? রোজকার বেঁচে থাকা যখন একই গণ্ডিতে, ভাবনার আসাযাওয়া সুগম। তখন তার মধ্যে প্রতিদিনকার দেওয়ানেওয়া চলে। কিন্তু তারা যে দুই আকাশের পাখি। আস্তে আস্তে তার নিজের পুরনো জীবন, আগেকার যত চেনা লোক সবার জীবন নেহাতই কাগজের শেষের পাতার খবর হয়ে যাচ্ছে। পড়া যায়, উহু আহা চলতে পারে। পড়া হয়ে গেলে সেই কাগজ গুটিয়ে রেখে নিজের জীবনে ফিরেও যাওয়া যায় অবলীলায়।

মাথাটা ঝিমঝিম করছিল হীরকের। সারা সন্ধ্যা থম মেরে বসে রইল। বিছানায় এসেও মাথা থেকে চিন্তাটা সরাতে পারল না। অদূরে বাঁক নেওয়া ইন্টারস্টেট ধরে নিস্ফল গর্জনে ছুটে যাচ্ছে কোনও নিঃসঙ্গ গাড়ি। মাঝেমাঝে পাশের বাড়ির কুকুরটার ডাক বাতাস চিড়ছে। হাওয়ায় পেকানের পাতাগুলোয় শাড়ির মাড় ভাঙার মত খসখস আওয়াজ। নিস্তব্ধ রাতের গোপন শব্দ বুকে নিয়ে হীরক এক রাতজাগা পাখি।

বিছানায় জেগে থাকা একেবারে নিঃশব্দ হয় না। ঘুম জড়ানো গলায় জিনি জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার এরকম ছটফট করছ কেন? ঘুমাতে দেবে না নাকি?

হীরক অন্য পাশ ফিরল।

–আজকাল বিছানায় এত লাফালাফি করো কেন বলো তো? সারারাত বিছানায় এপাশ ওপাশ করছ। জিনির গলার স্বর স্পষ্টতা পাচ্ছিল। কিছু হয়েছে?

অন্ধকার না থাকলে এই নিস্তব্ধ উত্তর সম্ভব হত না।

–অফিসে? দুর্গাপুরে?

কিছু গোপন ক্ষত ব্যান্ডেজের আড়ালে লুকিয়ে রাখতে হয়, না হলে জামাকাপড়ের ঘষায় জ্বালা করে। সেই সন্তর্পণ সাবধানতায় শানুর কথা এড়িয়ে গেল হীরকে। জিনি জানে শানুকে। ঘটনাটা জিনিকে বলতে পারত, বলবেও পরে। কিন্তু এখন বলতে ইচ্ছা করল না। এভাবে অনেক না বলা কথা জমছে হীরকের বুকে। হয়তো হীরকের বলার মধ্যে সেই কষ্টকে ভাষা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট শব্দের পুঁজি নেই। মুখের না বলা কথাগুলো রংতুলিতে ফোটানো বরং অনেক সহজ। এটা মনে হতেই বিছানায় উঠে বসল হীরক।

–কী হল বললে না তো?

হীরকের মনে হল এখুনি উত্তর না দিলে জিনি একদম জেগে যাবে, বিছানায় উঠে বসবে। তাড়াতাড়ি করে বলল, না তো কিছু হয়নি। পাবলো বলছিল একটা নতুন এগজিবিশানের কথা। তার থিমটা নিয়ে ভাবনা ঘুরছে মাথায়।

জিনির গলায় বিরক্তির হাত ধরে ঘুম ফিরে আসছিল। তুমি কি নিজেকে পুরোদস্তুর শিল্পী বানিয়ে তবে ছাড়বে? কালকে কাজের দিন, সেই হিসেব আছে?

আর উত্তর দেওয়ার দরকার হবে না। হীরককে নিজের ভাবনায় ছেড়ে রেখে জিনি এবার ঘুমিয়ে পড়বে। হীরক খাট থেকে কার্পেটে পা রাখল নিঃশব্দে। ঘরে আলো না জ্বললেও বারান্দা থেকে একটা আলোর রেখা ঘরে চলকে পড়ছিল। কোথাও ধাক্কা না খেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বেসমেন্টে নেমে এল হীরক। বুকের মধ্যে এত কথা বিজবিজ করে উঠল আজ, কারও সঙ্গে শেয়ার করতে পারলে ভালো হত। এমনি কত কথা শুধু বুকের গভীরে পাথরের মত চেপে রয়েছে। ছোটবেলায় মা বলত, কাউকে বলতে না পারলে জলের কাছে গিয়ে বলবি, সব দোষ কেটে যাবে। হীরকদের দুর্গাপুরের বাড়িতে বাথরুমের একদিকে ছিল সিমেন্টে বাঁধানো চৌবাচ্চা। গরমের সময় জলের সমস্যা থাকত, সকালবেলায় টাইমের জল ভরে রাখা হত। একবার, তখন হীরকের বয়েস হবে বছর আটেক। নীলিমা হীরককে বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল ম্যাচ দেখতে যেতে দেয়নি এই রাগে সেই চৌবাচ্চা ভরা জলে পেচ্ছাপ করে দেয়। বাথরুমে একটা ছোট জানালা ছিল, একটু উঁচুতে। জানালার অন্যপাশে পায়রা বাসা বেঁধেছিল। গোলা পায়রা। হলুদ বুটি চোখে হীরকের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিল। একমাত্র সাক্ষী। আরও বেলায় কলের জল সরু সুতোর মত হয়ে গেলে, সন্ধ্যামাসি চৌবাচ্চা থেকে জল এনে বাসন মেজেছিল। সেদিকে চেয়ে চেয়ে হীরকের চোখের সামনে দিনের আলো মরে যাচ্ছিল। সন্ধ্যামাসি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, কী হল হীরু সোনা, বিকেলবেলায় খেলতে যাবে না আজ? হীরক কাউকে বলতে পারেনি। পরের দিন চিনুর ভয়ানক পেটখারাপ হল। পেচ্ছাপের জলে মাজা বাসনে খেয়েই এরকম হয়েছে, এই ভাবনাটা বেশ কয়েকদিন হীরককে তাড়া করে বেরিয়েছে। কোনও প্রমাণ নেই, কেউ জানে না। নিজের এই জানাটাকে নিয়ে তড়পেছিল বেশ কদিন। কষ্ট ভাগ করে নিতে না পারাটা বড় যাতনার। চৌবাচ্চার জলে রেখেছিল তার স্বীকারোক্তি।

আজ মনে হচ্ছিল শানুর জন্যে কষ্টটা ইজেলের সঙ্গে শেয়ার করতে পারলে হয়তো লাঘব হবে। সেই ভাবনা বুকে নিয়ে ফাঁকা ইজেল আরে রঙের ভাণ্ডার সাজিয়ে বসল হীরক। কিন্তু কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছিল না। শূন্য চোখে সাদা ইজেলের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করল হীরক, আমরা বড় কেন হয়ে যাই রে শানু?

ইজেল কোনও উত্তর দিল না। কিন্তু ইজেলকেই মনের কথা বলতে শুরু করল হীরক। ছোটবেলার কথা, শানুর কথা। মনে আছে তোর তেরো বছরের জন্মদিনে? তোর জন্মদিনে ধুমধাম হত বেশ, তুই এইসব ব্যাপারে আলাদা ছিলি আমাদের চেয়ে। তোর জন্মদিনে বন্ধুবান্ধবদের ডাকা হত, তোর মাসিরা আসত কখনও। কেক কাটা হত। বেলুন ঝুলত। সেবার বেলুন ছিল না, কারণ তুই বড় হয়ে গেছিস। কিন্তু তুই বললি ধুর, ঘুম থেকে উঠে দেখলাম কালকের চেয়ে আলাদা কিছু হল না। টিনএজার ব্যাপারটা আমাদের সময়ে তেমন কিছু বড় ব্যাপার তো ছিল না। সবার মধ্যে এমনি এমনি বড় হয়ে যেতাম। তুই আমার কানে কানে বললি— কারণ ওখানে আরও অনেকে ছিল— আমি তেরো হওয়ার আগেই বড় হয়ে গেছি, আমারটা দাঁড়ায়, তোর? তোর মা সেই সময়েই হীরক কেক খেয়েছিস বলে এসে পড়েছিল, ভালো করে হাসতেও পারিনি।

হীরক যখন বলতে শুরু করেছিল, তখন ফিসফিস করে বলছিল। শেষ করার সময় দেখল কথাগুলো ধ্বনি খুঁজে পেয়েছে। রংও। এর মধ্যেই বেশ কয়েকটা রং চাপিয়েছে ইজেলে। সাধারণত খুব উজ্জ্বল রঙের ছবি আঁকে হীরক। কিন্তু আজ চাপিয়েছে গাঢ় নীল, বেগুনী, লাল আর অনেক কালো। এটাও একটা এক্সপেরিমেন্ট। কে জানে এর থেকে কী ছবি তৈরি হয়ে যায়। একটা ভাবনা তৈরি হচ্ছে, কিন্তু সেটাকে ব্যবচ্ছেদ করতে চাইল না এখুনি, স্বতঃস্ফূর্তভাবে কী বেরিয়ে আসে সেটা দেখতে চায়। কিন্তু যাই আঁকুক জানে শানুই হবে তার কেন্দ্রবিন্দু। গল্প বলতে বলতে আঁকা এই ছবি কি তাহলে কোনও গল্প বলবে? শানুর জীবনের। অন্তত একটা রাফ আউটপুট যদি বেরোয়, স্কেচ, পরে সেটা নিয়ে বড় করে কাজ করবে।

ইজেলের সঙ্গে গল্প চালু রাখল হীরক।

তোদের কেকটা খুব ভালো হয়েছিল সেবার শানু। আমি এরকম ভালো কেক তার আগে কোনদিন খাইনি। মাথা নীচু করে খাচ্ছিলাম, ছায়া পড়ল। চোখ তুলে দেখি তোর বাবা। তোর বাবাকে আমার একটু ভয় ভয় করত কেমন। আমাকে কোনওদিন বকেছে এরকম নয় কিন্তু। হয়তো কাকুর গলার স্বরের জন্য, বজ্রগম্ভীর। কেমন লাগছে কেকটা হীরক? শানুর মাসি কলকাতা থেকে এনেছে, ফ্লুরিজের কেক। খাও, এদেশে এত ভালো কেক খুব কম জায়গায় পাওয়া যায়। ভালো কথাই বলেছিল, খারাপ কিছু না। কিন্তু কাকু যতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল আমি খেতে পারছিলাম না কিছুতেই।

জানিস শানু, তোর জন্মদিনে কেক হত তো, আমার জন্মদিনে পায়েস। একটা মজার কথা মনে পড়ল। তুই তো জন্মদিনে অনেক রকম উপহার পেলি সেদিন। আমাদের জন্মদিনের উপহার নিয়ে একেক বছরে মায়ের একেকটা প্রোজেক্ট থাকত। সেই বছরে প্রোজেক্ট ছিল স্টীলের থালা। আমাদের সবার জন্মদিনে একেকটা করে স্টিলের থালা কেনা হচ্ছিল। আমার শুভ অন্নপ্রাশনের পেতলের থালাটা ট্রাঙ্কে ঢুকে গেল। আচ্ছা, আমাদের পুরনো বয়সগুলো কি এমনি কোনও বাক্সে ঢুকে যায় শানু? পঁয়ত্রিশের নিচে চৌত্রিশ, তার নিচে তেত্রিশ, সার সার দিয়ে সাজানো থাকে কোথাও? সুযোগ পেলেই বর্তমানে নাক বাড়ায়?

চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। নিস্তব্ধ রাত্রি ভেঙে ভেঙে ববের কুকুর জানান দিচ্ছে, না হলে সব চুপ। একটু বাদে আবার নিজের গলা শুনতে পেল হীরক। কে জানে তুই হয়তো এখন জেলে। ওখানে কি তোকে মারধোর করে শানু? ইন্ডিয়ার জেলগুলোতে কোনও নিয়মকানুন মানে নাকি! তোর কি ওখানে ভয় করে? একা লাগে? তোর কি এখন ভয় লাগলে মায়ের কোলে বসে সান্ত্বনা পেতে ইচ্ছা করে যেন তুই এখন পাঁচ? দ্যাখ না আমার এখন কাঁদতে ইচ্ছে করছে শানু গলা ছেড়ে, যেন আমি তিন বছরের ছেলেটা, পঁয়ত্রিশ বছরের নই। আমি এখানে তোর ছবি আঁকব বলে ব্রাশ হাতে বসে আছি, আর তেরো বছরের আমাদের কথা ভেবে দুঃখরা কেমন পঁয়ত্রিশ বছরের আমার চোখ ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। হীরকের শরীরের মধ্যে একটা কাঁপুনি হচ্ছিল, গলার ভিতর বন্য জন্তুর মত কিছু আওয়াজ ধাক্কা দিচ্ছিল যেটা থামানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল হীরক। সারা শরীর কাঁপছিল এমন যে রঙে চুবানো ব্রাশটা হাত থেকে থপ করে ইজেলের উপর পড়ে ধাক্কা খেতে খেতে এবড়োখেবড়ো লম্বা দাগ টেনে মাটিতে পড়ে গেল।

ইজেলে তেরো বছরের শানু শুয়ে ছিল। এতক্ষণ মন দিয়ে হীরকের কথা শুনছিল যেন। এবার বলল, তুই বয়স বাড়ার কথা বলছিলি হীরক। আমরা বড় হই, তখন গাছের মত আমাদের ভিতরেও কি রিং আঁকা হতে থাকে? কী থাকে রে হীরু সেই একেকটা রিঙে?

আমাদের তেরো বছরের রিংটাতে কী ছিল রে শানু? কোন ছবি? কোন স্মৃতি? হ্যাঁ হ্যাঁ, একটা তো মনে আছে। বলতে বলতে হীরকের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। আমি আর তুই সোনার কেল্লা দেখতে গেছিলাম একসঙ্গে? মনে আছে তোর? তুই তখন এইটে, আমি সেভেন। দুর্গাপুর টকিজে। সেই প্রথম বাড়ির লোকের সঙ্গে ছাড়া সিনেমা দেখতে যাওয়া। ফেলুদার গাড়ির টায়ার একগাদা কাঁচের মধ্যে পড়ে এক্কেবারে ফেঁসে গেছে। রাস্তার মাঝখানে আটকে গেছে ওরা। এমন সময় দূর থেকে ট্রেনের আলো। তুই উত্তেজনায় উবু হয়ে সামনের সিটের পিছনে ঝুঁকে পড়েছিস। কিন্তু আমি আর পারছিলাম না। আমার পেট ফেটে যাচ্ছিল। পায়খানা চেপে বসেছিলাম সেই যখন কামু মুখার্জি ট্রেনের কামরায় লালমোহনকে ম্যাজিক দেখাচ্ছিল। আমি তখন থেকে মনে মনে আওড়াচ্ছিলাম ভ্যানিশ! ভ্যানিশ! কিন্তু চাপ বেড়েই যাচ্ছিল। আমি আর পারছিলাম না, কিন্তু এমন অবস্থা যে একা একা তখন হেঁটে যাওয়ারও অবস্থা নেই, একটু এদিক ওদিক হলেই প্যান্টে হয়ে যাবে। আমি তোর কানে ফিসফিস করে বললাম, শানু আমার সঙ্গে বাইরে চল। তুই অবাক হয়ে বললি, কেন রে ভয় লাগছে নাকি? না রে পায়খানা যাব, আমাকে ধরে নিয়ে চল। এখুনি হয়ে যাবে। তুই খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলি এক সেকেন্ড। তারপর আমার হাত ধরে টান দিলি। আমরা উঠতেই পিছন থেকে, এই খোকা বসে পড়ো ধ্বনি। আমরা সবার চেঁচামেচি অগ্রাহ্য করে সিট ছেড়ে বাইরের দরজার খোঁজে এগিয়ে গেলাম। তুই পুরো সময়টা আমার হাত ধরে ছিলি। যখন ফিরে এলাম তখন সিনেমা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। কান্নার গমকে তুলি ধরা হাত কাঁপছিল হীরকের। আমি কেন তোর হাত ছেড়ে দিলাম শানু।

ইজেলে শুয়ে থাকা শানু বলল, আমার অনেকগুলো রিং হারিয়ে গেছে হীরু। আমার প্রতিটা দিন যেন ঠিক আরেকটা দিনের মত। লেপ্টে থাকে একে অপরের সঙ্গে। একটা বছরের সঙ্গে অন্য বছর আলাদা করা যায় না। আমি যদি গাছ হতাম তাহলে আমার ভিতরে বোধহয় রিং আঁকা বন্ধ হয়ে যেত।

এভাবে বলিস না শানু। এখনও অনেক সময় সামনে। আমি আসব তোর কাছে। আমরা আবার চপ্পল বদলে নেব, পড়ে নেব দুই হাতে। আমরা দুজনে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাব মাছের বাজার। আমরা উলটোমুখে দৌড়াতে গিয়ে ছেতরে পড়ে যাব, আবার সোজা মুখে দৌড়াতে দৌড়াতে হাত ধরব। আমি গাছের ভিতর থেকে আওয়াজ পেলে গর্তে হাত ঢুকিয়ে দেব কারণ তুই বলেছিলি আমি নাকি ভয় পাব। তোয়াক্কা না করা হাসি হাসতে হাসতে স্কুলের স্বরস্বতী ঠাকুরের বুকে হাত বুলিয়ে তুই বলবি মেয়েদের বুক এর থেকে অনেক নরম হয়, আমি জানি। আমরা লাল হলুদ কাঠি আইসক্রিম খেতে খেতে রাস্তা জয় করার ভঙ্গিতে হাঁটব। তোর মনে পড়ে একদিন ওরকমই আঙুলের ফাঁক দিয়ে বরফ গলে গলে ঝরে যাচ্ছে, তুই বললি আমরা ভাই হলে খুব মজা হত। না রে? আমি বললাম পাগল, তোর বাবার হাতে মার খাওয়ার জন্য? তোর চোখটা উদাস হয়ে গেছিল। মনকেমন করা গলায় বললি, ভাগাভাগি হয়ে যেত না তাহলে?

–কী হচ্ছেটা কী বলো তো? পায়ে আওয়াজ তুলে ঢুকল জিনি। তুমি রাত্রে না ঘুমিয়ে কী করছ এসব? কার সঙ্গে কথা বলছ?

হীরক আস্তে আস্তে মুখ তুলে তাকাল, কিন্তু সেই চোখের দৃষ্টি রাস্তা পার করা গরুর কৌতূহলহীন চাহনির মত।

জিনি বিরক্ত হল, উত্তর দিচ্ছ না কেন বলো তো?

–ছবি আঁকছি।
–অফিস আছে, আমারও দোকান খুলতে হবে নটায়। এদিকে সারা রাত না ঘুমিয়ে বেসমেন্টে বসে আছ। কী হয়েছে? আমাকে বললে কি অসুবিধা আছে কোনও? জিনির গলা উত্তোরত্তর বাড়ছিল। কথা ছুড়ছে এমন পাথরের থেকে ভারী।
–তোমার শানুর কথাটা মনে আছে?
–যে ছেলেটা পাগল? কেন নতুন করে কিছু হয়েছে আবার?

শানুর কথা বলতে গিয়েও গিলে নিল হীরক। নতুন করে কিছু কি হওয়ার আছে আর, জানি না জিনি।

–কিছু তো একটা হয়েছে। বলো শুনি।

জিনির গলায় সমবেদনার ছোঁয়া হীরকের মনের মধ্যে গুমড়ানো কথাটা বের করে আনল। থেমে থেমে বলল, শানু ওর বাবাকে মেরে ফেলেছে।

–অ্যাঁ! আঁতকে উঠল জিনি। এ কী কথা বলছ? একেবারে? মার্ডার?

মার্ডার কথাটা কানে খট করে লাগল হীরকের। যদিও শব্দে ভুল নেই কোনও। সত্যিই তো, শানু তো এখন মার্ডারার।

কিছুক্ষণ চুপচাপ, তারপর সময়ের তাড়া ফিরে এল জিনির গলায়। তুমি এখান থেকে কী করতে পারবে বলো তো? একটা লাইফ ওয়েস্ট হয়ে গেছে, বুঝতে পারছি। কিন্তু— বলতে বলতে জিনির চোখ পড়ল ইজেলে। সেই ঘটনার ছবি আঁকছ বুঝি?

দু পা এগিয়ে ভালো করে দেখল। এ কী ধরনের ছবি, এত অন্ধকার— ভালো করে দেখাও যাচ্ছে না। ও মা, তুমি তো বললে শানু ওর বাবাকে মেরেছে। এখানে তো একটা বাচ্চা ছেলে মাটিতে পড়ে আছে। তার উপরে দুটো ছায়া! লোকগুলো কোথায় হীরক?

–আমি নিজেও জানি না কী এঁকেছি। এটা স্কেচ। পরে ফাইনাল পেন্টিং-এর সময়ে ঠিক করে নেব।
–যাই আঁকো, তার একটা মানে থাকবে না? জিনির সহানুভূতি খুব দ্রুত বিরক্তিতে বদলে যাচ্ছিল। আমি উপরে যাচ্ছি। আর যেন ডাকতে না হয়। এসে শুয়ে পড়ো, একটু বাদেই ভোর হবে। প্লিজ, পাগল খুনি বন্ধুর কথা ভেবে নিজেও পাগল হওয়ার চেষ্টা কোরো না।

হীরক উঠে দাঁড়িয়েছিল। যদিও চোখ এখনো ইজেলেই। বোঝার চেষ্টা করছিল ইজেল কী গল্প বলতে চাইছে, কোন ছবি আঁকিয়ে নিয়েছে তাকে দিয়ে।

বেশ অন্ধকার পুরো ছবিটাই। শুধু তেরছা একটা আধা হলুদ আলোর রেখা এসে কিছুটা দেখাতে পেরেছে শুয়ে থাকা ছেলেটাকে। ফাইনাল পেন্টিঙে আলোর মাপটা বাড়াতে হবে। আবছা আলোমাখা ছেলেটার কোঁকড়া চুল, উজিয়ে ওঠা নাক— শানুর মতই। সেই মাটিতে পড়ে থাকা চেহারার উপর দিয়ে আড়াআড়ি দুটো ছায়া চলে গেছে।

একটা ছোট, একটা বড়। মানুষগুলোকে ছবিতে দেখা যাচ্ছে না।

চেয়ারে আবার ধপ করে বসে পড়ল হীরক।

 

(প্রথম খণ্ড সমাপ্ত)

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...