তারান্তিনো, সিজন দুই — এগারো

প্রিয়ক মিত্র

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

হাঁড়ি করে ধোঁয়াওঠা মুরগির মাংস রাখা হল বিলিতি ধাঁচের খাবার টেবিলে।

ঘরটা পেল্লায়। ঘরের একদিকে, যেখানে এতক্ষণ ফাদার ও মহেশ সেন বসে কথা বলছিলেন, সেটা একটা বিলিতি ধাঁচের বাহারি সোফা। সামনে একটা বড় গোল শ্বেতপাথরের টেবিল। সেই টেবিলের সামনেই জনার্দন সান্যাল গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, যখন তিনি ফাদারকে অভিযুক্ত করছিলেন।

সেই বাহারি সোফার দু ধারে দুটো পেল্লায় কেদারা। কাঠের তৈরি, ওপরে মখমলের গদি। এই দুটো কেদারার একটিতে বসেছিলেন সনাতন হাজরা, অন্যটিতে সেই বৃদ্ধ, যাকে একটু আগেই লতা চিনেছে সূর্যবাবু বলে। সূর্যবাবুর কেদারার পাশেই একটি বেতের মোড়া। যেটাতে হাত বাঁধা অবস্থায় বসিয়ে রাখা হয়েছে লতাকে।

আর পেছনে একটা বিশাল খাবার টেবিল, যার ওপারে দাঁড়িয়ে ছিল জয়চাঁদ।

এই ঘরে উনুনের ব্যবস্থা হালে করা, বোঝাই যায়, এমন ঘরে উনুনটা নেহাতই বেমানান।

শুধু উনুন নয়, বেমানান আরও অনেক কিছুই লাগছে সনাতনের। এবাড়িতে তার বহুদিন যাবৎ যাতায়াত।

এ বাড়ির দেখভালের দায়িত্বে যতদিন সরযূ ছিল, ওর জন্য এবাড়িতে মুরগি ঢুকতে পারেনি। সরযূ মরে গেছে। তাই এবাড়িতে মুরগি ঢুকেছে। সবই বোঝা যাচ্ছে। তাও কোথাও যেন খটকা!

সরযূ এর আগে একবার দেশে গিয়েছিল, মনে আছে সনাতন হাজরার। জজসাহেবের বিশ্বস্ত সরযূর নিয়ম যাতে একচুল এদিক-ওদিক না হয়, তার জন্য সবসময় সতর্ক ছিল কানাই, জগাই, হরগোপাল। এরা কেউই এখন নেই, কিন্তু এই জয়চাঁদকে বহাল করেছে কে? মৃত সরযূ বা কানাই-জগাই-হরগোপাল সকলে যে নিয়ম মেনে চলত, সেসব নিয়ম এ কিছুই মানে না। মুরগির মাংস তার মধ্যে একটা। দ্বিতীয় নিয়মভঙ্গ, অতিথিদের বাতাস না করা। টানা পাখাটি এখনও রয়েছে অথচ। তাও না হয় বোঝা গেল জয়চাঁদের বোধবুদ্ধির অভাব! লোকটা এমনিতেই একটু ইতরশ্রেণির। সভ্যতা, ভব্যতার অভাব আছে ওর।

কিন্তু যেটা এবাড়িতে ঢোকামাত্রই সনাতন হাজরাকে বিস্মিত করেছে, তা অন্য জিনিস।

দুর্গাদালানে একটা ছোট কালীমূর্তি রাখা! তার পুজোও হয়েছে।

কে এ জিনিস ঘটাতে পারে? জয়চাঁদ?

কোথা থেকে এসেছে এই লোকটি?

অনাদি চৌধুরী যখন জজসাহেবকে এ বাড়ি বেচেছিলেন, তাঁর এক এবং একটিমাত্র শর্ত ছিল— এবাড়িতে কোনও পুজোআচ্চা হবে না। দুর্গাপুজোর সেই অদ্ভুত ঘটনা এবং পুকুরে কালীমূর্তির ওই আশ্চর্য আবির্ভাবের পর অনাদি চৌধুরীর এই মতি হয়েছিল। জজসাহেব অনাদি চৌধুরীর এইসব গল্প বিশ্বাস করেননি মোটেই। তাছাড়া এই বাড়ির লেনদেন হয়েছিল অনাদির কলকাতার এক আত্মীয়র সূত্রে। এইসব শর্ত মানার দরকার ছিল না জজসাহেবের। কিন্তু অনাদির এই শর্ত ফেলতে পারেননি জজসাহেব। তাছাড়া পুজোআচ্চার দরকারই বা কী? দেবদ্বিজে বিশেষ ভক্তি নেই। তাই ও নিয়ে মাথা ঘামাননি জজসাহেব। বরং সরযূ কানাই জগাই আর হরগোপাল এই পুজো না করার আদেশ পালন করে এসেছে চিরকাল।

জজসাহেব কি জানেন জয়চাঁদের কীর্তি? সনাতন যতদূর জানে, জজসাহেবের মেজাজ অত্যন্ত কড়া!

আদৌ জয়চাঁদকে এবাড়িতে জজসাহেবই বহাল করেছেন তো?

 

–প্রমথরঞ্জন চায় আমরা ওই ঠিকানায় গিয়ে পৌঁছই। কেন?

বিড়বিড় করে বলল অন্যমনস্ক গোবিন্দরাম।

গোবিন্দরাম দুঁদে গোয়েন্দা। আশ্চর্য এক আত্মবিশ্বাস তার মধ্যে কাজ করে বেশিরভাগ সময়। তার এতটা অন্যমনস্ক হয়ে থাকা খুব স্বাভাবিক নয়। অন্তত শাজাহান এই তদন্তের বেশিরভাগ সময়টা তাকে আত্মবিশ্বাসের শিখরে থাকতেই দেখেছে।

কিন্তু একটা বিষয় ভাবাচ্ছে গোবিন্দরামকে। শাজাহানকেও যে তা কিছুটা ভাবাচ্ছে না তা নয়।

অনাদি চৌধুরীর বাড়িতে এর আগে প্রমথরঞ্জন এসেছে কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। যদি এসে থাকে, তাহলে পথনির্দেশ লাগবে কেন? যদি না এসে থাকে, তাহলে পথনির্দেশ সে ফেলে রেখে আসবে কেন? যদি কাগজ দেখে সে পথনির্দেশ বুঝেও থাকে, তাহলেও এমন প্রমাণ ফেলে রেখে সে ঘটনাস্থল ছাড়বে কেন? আর যদি এসে থাকে, তাহলে পথনির্দেশ তার লাগবে কেন?

এর একটাই মানে দাঁড়ায়। যা গোবিন্দরাম বলছে।

কেন প্রমথরঞ্জন চায়, যে এই ঠিকানা ধরে পুলিশ সেখানে গিয়ে পৌঁছোক?

সে নিজে ওখানে গিয়ে থাকলে পুলিশকে পিছু ধাওয়া করতে দিচ্ছে কেন?

এ কেমন খেলা?

না কি এটা কোনও ফাঁদ?

–আর একটা প্রশ্ন নিয়েও আমরা ভাবছি না শাজাহান।

শাজাহান তাকাল গোবিন্দরামের দিকে।

–ও বাড়িতে কেন যাবে প্রমথরঞ্জন?

শাজাহান চুপ। একথা তার মাথাতেই আসেনি। স্বদেশিদের গন্তব্য যদি ওই বাড়িই হয়, তাহলে একই বাড়িতে প্রমথরঞ্জন কেন যাচ্ছে? দুপক্ষের মধ্যে কি কোনও যোগাযোগ আছে তাহলে? ভুলে গেলে চলবে না স্বদেশিদের সঙ্গেই পালিয়েছিল প্রমথরঞ্জন।

কথাটা পাড়তেই চিকচিক করে উঠল গোবিন্দরামের চোখ।

–কত বড় রাসকেল!

শাজাহান আন্দাজ করছে গোবিন্দরামের মাথায় কী খেলছে! বিষয়টা যে তারও একদম মনে হয়নি তা নয়।

জেল পালানোর পর স্বদেশিদের খোঁজ চলছিল গোপনে‌। মাথার দাম ঘোষণা করেনি সরকার। কারণ তাহলেই সতর্ক হয়ে যেতে পারত স্বদেশিরা। হতেই পারত, ওরা পুলিশের গতিবিধি ধরে ফেলত। তাই উডপেকের বুদ্ধিতে খবরটা চেপে যাওয়া হয়েছে। এমন ভাব করা হয়েছে, যেন পুলিশ এ ব্যাপারে মাথাই ঘামাচ্ছে না। পলাতক সূর্য মিত্র ও অন্যান্য স্বদেশিদের ধরে লাভ নেই শুধু, এর পেছনের আসল মাথা কে, সেটা জানতে হবে। সন্দেহ করা হয়, সে কোনও একজন মিশনারি সাহেব। জাতে ফরাসি।

কিন্তু একথা ঠিক, যে প্রমথরঞ্জন যদি স্বদেশিদের ধরিয়ে দেয়, তাহলে তার অপরাধ মাফ হয়ে যেতে পারে। অথবা পুলিশ তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারে।

কিন্তু স্বদেশিরা এ বাড়িতে আসবে, এ কথা জানল কী করে প্রমথরঞ্জন? জেলে কি ওরা এ বিষয়ে আলোচনা করেছিল?

এখন এত ভাবার সময় নেই। পর্দা সরিয়ে গাড়োয়ানকে জোরে গাড়ি হাঁকাতে বলল গোবিন্দরাম।

তারা জানেই না, কত বড় কাকতাল ঘটে রয়েছে আজ রাতের চিত্রনাট্যে।

 

–তাহলে আপনিই হরিধন হাজরার নাতি, যে ঠগিদের চোরাই মাল লুকিয়ে রেখেছিল, সে জিনিস কি এখনও আছে আপনার কাছে?

খাকি উর্দির ওপরের চামড়ার বেল্টের ভেতর বুড়ো আঙুল চালাতে চালাতে বলল জনার্দন সান্যাল।

একবার শান্তভাবে জনার্দনের ওপর আপাদমস্তক চোখ চালাল সনাতন হাজরা। এরম উত্তেজিত পুলিশ দারোগা জীবনে কম দেখেনি সনাতন। আর এই প্রশ্নও জীবনে সে কম শোনেনি। একটু আগে ফাদারকে পাকড়াও করার যে ব্যর্থ চেষ্টা জনার্দন করেছে, তা দেখেই সে এর মুরোদ বুঝে গেছে। এই ফাদার যে এই স্বদেশিদের সঙ্গেই, এমনকী, এদের পান্ডা হলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই— তা সনাতন হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। কিন্তু তা বলে এমন কাঁচা কাজ কেউ করে! এখন ফাদারকে গ্রেফতার করে কী প্রমাণ করবে এই জনার্দন? ভাবটা এমন, যে বাঘ মেরেছি।

মহেশ সেন যথেষ্ট বিরক্ত এব‌ং গম্ভীর হয়েছিলেন ফাদারের ঘটনায়। তিনি এখনও বিশ্বাস করছেন, ফাদার এসবে জড়িত নন। এবার সনাতনের ওপর আক্রমণটা তিনি নিতে পারলেন না‌। সনাতন মুখ খোলার আগেই তিনি বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন, ‘কর্নেল স্লিম্যান ওঁর ঠাকুরদাকে কী লিখেছিল সে বিষয়ে কোনও ধারণা আছে আপনার? যদি ওর ঠাকুরদা সত্যিই এই ক্রাইম করতেন, তাহলে কর্নেল ও কথা লিখতেন?’

–ঠগিদের শায়েস্তা করার পেছনে পুলিশ বিভাগের হাজারেরও বেশি কর্মচারীর অবদান রয়েছে। আপনি সত্যি বিশ্বাস করেন মিস্টার সেন যে স্লিম্যান বেছে বেছে হরিধনকে ও চিঠি লিখেছেন? কেন? হরিধনের কী এমন অ্যাচিভমেন্ট? সে নেহাতই একটা হাবিলদার!
–সেই চিঠি আমি নিজে দেখেছি!

গম্ভীরভাবে বললেন মহেশ সেন। গলায় রাগের গনগনে ভাব স্পষ্ট।

–শুনেছি ওই চিঠি বাংলায় লেখা। স্যর উইলিয়ামের সেরেস্তার কোনও কর্মচারী বাংলায় লিখে দিয়েছিলেন ওই চিঠি। বাংলায় চিঠি তো যে কেউ লিখতে পারে মিস্টার সেন। হরিধনও পারেন।

মুচকি হাসলেন সনাতন। মহেশ সেনও মিটিমিটি হাসছেন।

–এতে হাসির কী হল? চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন জনার্দন সান্যাল।
–সেই চিঠি কি আপনি দেখেছেন? মহেশবাবু দেখেছেন।
–দেখে কী হবে? কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন জনার্দন।
–ওই চিঠিতে স্লিম্যান সাহেবের হাতে লেখা ইংরেজিটাও রয়েছে এক পিঠে। আর বাংলা লেখাটার নিচে তার আপিসের সিলমোহর।

মহেশ সেন মাথা নেড়ে সায় দিলেন।

জনার্দন সিঁটিয়ে গেল বিস্ময়ে।

ইতিমধ্যে কলাপাতায় সকলের খাবার সাজিয়ে সামনে এনে রাখল জয়চাঁদ।

তারপর হঠাৎ লতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আহা রে দিদির তো হাতে বেড়ি। খাবার খাবে কী করে?’

আড়চোখে জয়চাঁদের দিকে তাকাল সনাতন। দরদ উথলে পড়ছে। কেন? জয়চাঁদও কি এদের দলের লোক? লতার পাশের বৃদ্ধটির মুখ ফোটেনি এতক্ষণ। তার খাওয়া লক্ষ করল সনাতন। বৃদ্ধ মানুষ এত জোর দিয়ে খেতেই পারে না। এ নিশ্চিত ছদ্মবেশ।

কে এই লোকটা?

জনার্দন খেঁকিয়ে উঠল এর মাঝেই।

–তোমাকে কে ভাবতে বলেছে ওকে নিয়ে! এত পিরিত কীসের!

সনাতনের অপমানের শোধ সে তুলল জয়চাঁদের ওপর ঝাল মিটিয়ে।

–আহা গো! দিদি কি তা বলে খাবেন না?

জয়চাঁদের শান্ত উত্তর।

–না খেয়ে থাকুক!

আবারও খেঁকিয়ে উঠল জনার্দন।

জয়চাঁদের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। সনাতনের চোখ এড়াল না।

মহেশ সেন এবার মুখ খুললেন।

–না খাইয়ে রাখা যাবে না। জয়চাঁদ, তুমি এক কাজ করো। তুমি ওকে খাইয়ে দাও।

তার পাকড়াও করা আসামীকে নিয়ে জনার্দন নিদান দেবে, এটা সহ্য করতে পারলেন না মহেশ।

জনার্দন আর কথা বলল না। খাওয়া শুরু করল চুপচাপ। লতার খিদেতেষ্টা কিছু ছিল না একটু আগে অবধি। সে অন্নগ্রহণ করবেই না ভেবেছিল আর। কিন্তু সূর্যবাবুকে দেখে সে ভরসা পাচ্ছে এখন। তাই জয়চাঁদের খাইয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সে আপত্তি করল না।

–যদি সত্যিই আমার ঠাকুরদা ঠগিদের চোরাই সম্পত্তি হাতিয়ে থাকেন, তাহলে আমাকে এখনও এই কাজ করতে হত না জনার্দনবাবু। আমরা সাতপুরুষ পায়ের ওপর পা তুলে খেতাম। আর হাবিলদার হলেও আমার ঠাকুরদা এক দুর্দমনীয় ঠগির দলকে যেভাবে শায়েস্তা করেছিলেন, ততটা বোধহয় আপনার সাহসেও কুলোত না জনার্দনবাবু।

সনাতনের গা চিড়বিড় করছিল, অপমানটা ফিরিয়ে না দিলে চলছিল না।

জনার্দন জ্বলে উঠল। সে রক্ত জল করা চাহনি নিক্ষেপ করল সনাতনের ওপর। তারপর হঠাৎ শান্ত হয়ে বলল, ‘আমি তো শুনেছি সেই আংটি এখনও আপনারা রেখে দিয়েছেন, বেচে দেননি।’

জনশ্রুতি এক ভয়ঙ্কর জিনিস। একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে একটা জনশ্রুতি প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাহিত হতে পারে। বুঝল সনাতন।

হেসে বলল, ‘আংটির কথাও আপনি জানেন দেখছি।’

এই জনশ্রুতি আগেও শুনেছেন মহেশ। তিনি নিস্পৃহ‍। ফাদার অনেকক্ষণ ধরেই চুপ করে আছেন। বাকি কেউই রা কাড়ল না।

শুধু লতার মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল।

আংটি!

যে আভা সে একটু আগে সনাতনের খড়মের তলায় দেখেছে, তা তাহলে ওই আংটির আভা?

তার চিন্তায় ছেদ পড়ল এক বিকট চিৎকারে।

মহেশ সেন।

খেতে খেতে হঠাৎ তাঁর বমি উঠে এসেছে। মুখ চেপে ঘরের বাইরে বেরলেন তিনি, দ্রুতগতিতে।

–সাহেবকে কলঘরে নিয়ে যাও, এক্ষুনি! হুকুম দিল সনাতন।

জয়চাঁদ লতাকে খাওয়ানো থামিয়ে পিছু নিল মহেশ সেনের।

 

(আবার আগামী সংখ্যায়)

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...