Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বদল

বদল | সোমা বন্দ্যোপাধ্যায়

সোমা বন্দ্যোপাধ্যায়

 

বছরখানেক আগে ইমন কথা দিয়েছিল বিলাবলকে তার সঙ্গে কখনও পলাশ দেখতে যাবে। সারাবছরের ঘোড়দৌড়ের মধ্যেও সে কথা ভোলেনি ইমন। আজকাল মাঝেমধ্যেই ব্যাগ গুছিয়ে এদিকসেদিক বেরিয়ে পড়ে ওরা। কখনও জঙ্গল, কখনও নদী, কখনও পাহাড়, কখনও বা নিতান্তই কেজো কোনও কারণে। বেড়ানোর আদর্শ সঙ্গী ওরা। বেড়ানোটাকে প্রাধান্য দিয়ে অনেক অস্বাচ্ছন্দকে অনায়াসে উড়িয়ে দিতে পারে এমনই সুন্দর বোঝাপড়া ওদের।

সেদিন সকালে হাঁটতে হাঁটতে ফিরোজা বেগমের গান শুনছিল ইমন। মধুর স্বর আর নিখুঁত গায়কিতে গাওয়া গান—

মনের রং লেগেছে
বনের পলাশ জবা অশোকে
রঙের ঘোর জেগেছে
পারুল কনক চাঁপার চোখে

ইমনের মনটা কেমন চঞ্চল হয়ে উঠল। মনে পড়ে গেল বিলাবলের সঙ্গে পলাশ দেখতে যাওয়ার কথা। চট করে ফোন করে ফেলল বিলাবলকে—

চলো পলাশ দেখতে যাবে!

বিলাবল এককথায় রাজি। বেরিয়ে পড়ল দুজনে হারা উদ্দেশ্যে। বিলাবল প্রকৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠা অমৃতের কন্যা। পলাশ, শিমুল, জারুল, ছাতিম, আমলকির মধ্যেই তার বড় হয়ে ওঠা। ইমনের বড় হওয়াটা ইটকাঠের খটখটে শহরে না হলেও ঠিক ওইরকম নয়। কিন্তু সে আদ্যন্ত প্রকৃতিমনা। যখন যেটুকু সুযোগ পেয়েছে কেজো জীবনের গণ্ডি টপকে পালিয়ে গেছে প্রকৃতির বৈচিত্র‍্যের সন্ধানে। ঘর থেকে বেশ অনেক দূরের পাহাড় পর্বত একটুআধটু দেখা হলেও ঘরের খুব কাছের প্রাকৃতিক সম্পদ অনেকটাই অদেখা থেকে গিয়েছে ইমনের। আজকাল আর পাহাড়ে বিশেষ যাওয়া হয় না তার। অতিমারির উৎপাতে প্রায় বছর দুয়েক তো কোথাও যাওয়ার কথা ভাবাই হয়নি। কিছুটা বেড়ে যাওয়া বয়স আর কিছুটা পাহাড়ে চড়ার অনভ্যাস সব মিলে একটু মনোবলের ঘাটতিও অনুভব করে ইমন। পাহাড়ি বসন্তের রোডোডেনড্রন সে দেখেছে, স্বচ্ছল সহকর্মীদের মুখে চেরিফুল ফোটা দেখতে জাপান যাওয়ার গল্পও শুনেছে ইমন। কিন্তু দেখা হয়ে ওঠেনি বাঁকুড়া পুরুলিয়ার রুক্ষ প্রান্তরে পলাশের আগুনে সৌন্দর্য।

স্বপ্নের আবির চোখে লাগিয়ে গাড়িতে চড়ে বসল দুটোতে। সকালের ঘুমজড়ানো আবেশ কাটার আগেই ওরা ছাড়িয়ে গেল শহরের সীমান্ত। খোশমেজাজে গল্প জুড়েছে দুজনে। গাড়ির অডিও সিস্টেমে চলছে বিলাবলের কণ্ঠের মধুঝরানো গান—

এসো এসো আমার ঘরে এসো আমার ঘরে
বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছ অন্তরে।

দেখতে দেখতে শহর থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে ওরা। হাইওয়ে ধরে হু হু করে ছুটে চলেছে ওদের গাড়িটা। মখমলের মতো রাস্তার দুধারে ছোট ছোট গাছগুলো ফুলের ভারে নুয়ে পড়েছে। সারি সারি করবীগাছে নানা রঙের ফুল। লাল, গোলাপী, সাদা। রুক্ষ রাস্তার দুধারে যেন ফুলের রংমিলান্তি খেলা। দেখতে দেখতে হাইওয়ে ছেড়ে, দামোদর পেরিয়ে ওরা ধরল জঙ্গলের সরু রাস্তা। দুধারের শালবন আর তার বুক চিরে কালো মোটা সাপের মতো পিচের রাস্তা। এমন জঙ্গলের রাস্তায় এরা দুজনেই বেশ কয়েকবার গিয়েছে কিন্তু এবারের যাওয়াটা একটু অন্যরকম। হাজার হাজার শালগাছের ডাল ভরে গিয়েছে সদ্যোজাত নরম কচিপাতায়। মাঝ-আকাশের সূর্যের প্রচণ্ড তেজ কি অবলীলায় শোষণ করে নিচ্ছে তারা। সারা জঙ্গলে ছড়িয়ে পড়ছে তারুণ্যের আভা। বয়ে আনছে নববসন্তের বার্তা। মাটিতে ছড়িয়ে আছে খসে পড়া জীর্ণ পাতার স্তূপ। হালকা হাওয়ায় ঘূর্ণির মতো ঘুরতে ঘুরতে ওরা যেন বলে চলে— এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে গেলাম আমরা।

সবুজের বৈচিত্র্য দেখতে দেখতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছে ইমন আর বিলাবল। শাল মহুয়ার জঙ্গলের সবুজ একটু পাতলা হতেই চোখ জুড়িয়ে দেয় এক মাঠ ধান। সবুজের সৌন্দর্য চোখ থেকে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই একটা দুটো করে গাছের মাথায় উঁকি দিতে দেখা গেল ওদের স্বপ্নসুন্দরীকে। বহুকাঙ্খিত সেই পলাশ। ইমনের পলাশ দেখা বলতে সরস্বতীপূজার সময় বাজার থেকে কিনে আনা আধশুকনো ফুল, কখনও বা কুঁড়ি। আর কলকাতার রাস্তায় হাতে গোনা দু-একটা গাছের মগডালে ফুটে থাকা দু-একটা গোছা। এবার বিলাবলের সঙ্গে বেড়াতে এসে ইমনের পলাশ দেখার সাধ মেটার একটা সুযোগ এসেছে। জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দুপাশে রুক্ষ মাটিতে আচমকা এক শূন্যতা নেমে আসে। শস্যশ্যামলা ক্ষেতগুলো হঠাৎ কেমন যেন তার রূপ বদলে ফেলেছে। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ধানক্ষেতের জায়গা দখল করেছে কাঁকুড়ে মাটির ছোট বড় স্তূপ আর দৃষ্টিবৃত্তের সীমানায় দাঁড়িয়ে আছে ছোট বড় অনেক টিলা। প্রত্যেকটারই একটা পোশাকি নাম আছে, যা শুধু স্থানীয় মানুষরাই বলতে পারে। এই কাঁকুড়ে মাটির স্তূপের পাশ থেকে হঠাৎ উঁকি মারল ছোট্ট কয়েকটি গাছ। অঙ্গে তার একটাও পাতা নেই। কে যেন পরম যত্নে নরম ফুলের আগুনরঙা পাপড়ি দিয়ে মুড়ে দিয়েছে তার সব ডালপালা। সমস্ত শরীরে লাল আবির মেখে দু হাত আকাশের দিকে তুলে সে যেন গনগনে সূর্যের কাছে পাঠাচ্ছে তার আবির্ভাবের সুসংবাদ। পলাশ। ইমনের স্বপ্নের পলাশ। যেদিকে তাকায় সেইদিকে সমস্ত উঁচু নীচু গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে রাশি রাশি ফুলের থোকায় ঢেকে থাকা পলাশ। জঙ্গলে যেন নতুন প্রাণের আগুন জ্বালিয়েছে প্রকৃতি। গোটা রুক্ষ মালভূমি অঞ্চল, গ্রীষ্মের দাবদাহে জর্জরিত হওয়ার আগে লাজুক নববধূর মতো শিহরিত হচ্ছে পলাশফুলের রক্তিম চুম্বনে।

এক ঝটকায় ইমনের বয়স কয়েক বছর কমে যায়। চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা এত পলাশ আর তার বসন্তলীলা দেখে কেমন যেন ছেলেমানুষের মতো করতে থাকে। বিলাবলের হাত ধরে টানাটানি করে আর চতুর্দিকে ছড়িয়ে থাকা গাছগুলো দেখাতে থাকে। মাঝেমাঝে উলটো দিকে তাকিয়ে থাকা বিলাবলের চিবুক ধরে ঘুরিয়ে দেয় তার ঘাড়টা। বেচারা ব্যথা পেল কিনা সে খেয়ালও থাকে না— “ওই দেখো ওই দিকে দেখো। ওই দূরের জঙ্গলটা দেখো, এই রাস্তার ধারের পরপর গাছগুলো দেখো।” ইমনের পাগলামি দেখে মনে মনে হাসে বিলাবল। হয়তোবা ভাবে এই বুড়ো বয়সে এরকম ছেলেমানুষি শোভা পায় না। ইমন কোনও কিছু মাথায় নেয় না। থেকে থেকে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে পড়ে মাঝরাস্তায়। ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবির সংখ্যার কোনও সীমাবদ্ধতা নেই। ক্ষণে ক্ষণে গর্জে ওঠে ইমনের ক্যামেরা— খটাস। হালকা হাওয়ায় প্রদীপের শিখার মতো নড়াচড়া করতে থাকা পলাশের পাপড়িগুলো স্থির হয়ে যায় ক্যামেরার ক্যানভাসে। ছোট একটা গাছের গোড়া থেকে একমুঠো তাজা ঝরে পড়া পলাশ কুড়িয়ে আনে ইমন। অঞ্জলি ভরে দেয় বিলাবলের হাতে। ইমনের গালে পলাশের পাপড়ি ঘষে দেয় বিলাবল। ইমনের মুখে ছড়িয়ে পড়ে পলাশের সতেজ সৌরভ।

পলাশ, শিমুল, বোগনবেলিয়ার দোলখেলা দেখতে দেখতে ওরা এসে পৌঁছায় মুরাড্ডি বাঁধের একদম ধারে একটা মনোরম নিরিবিলি রিসর্টে। সে রিসর্টের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে আছে ছোট বড় অসংখ্য পলাশগাছ। মুরাড্ডি বাঁধ বড়ন্তির বিলের উপর তৈরি একটি ছোট বাঁধ। বড়ন্তি বিলের পেট চিরে দাঁড়িয়ে আছে ছোট বড় বেশ কয়েকটা টিলা। এই টিলার পিছনে সূর্যের অস্ত যাওয়া এই জায়গার মুখ্য আকর্ষণ। বিলের ধারে উঁচু রাস্তায় দাঁড়িয়ে, রাঙা হয়ে যাওয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে ওরা দুজন। বিলের জলে কোমল সূর্যের জলছবি। অস্তরাগের তুলিতে সমস্ত আকাশে লালের আঁচড় আর তার মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে রক্তিম বনপলাশের পদাবলির মোহময় সুর। যেন রাজযোটক।

পরদিন ভোর না হতেই বেরিয়ে পড়েছে ইমন। পায়ে পায়ে ঢুকে পড়েছে বড়ন্তি গ্রামে। গ্রামের রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে একটা মাটির বাড়ির দেওয়ালে অন্য এক গ্রামের নাম দেখতে পায় সে। খুব পরিচিত এক গ্রামের নাম। মধুকুন্ডা। খোঁজ নিয়ে জানতে পারে বড়ন্তী থেকে মধুকুন্ডার দূরত্ব মাত্র সাত কিলোমিটার। ইমনের মনে ভিড় করে আসে প্রায় তিরিশ বছর আগেকার স্মৃতি। তখন ইমন উচ্ছ্বল কিশোরী। জীবনে প্রথম গ্রামের মধ্যে থেকে গ্রাম দেখেছিল সে। আদিবাসী গ্রাম। মাটিতে নাক ঠেকিয়ে শুঁকেছিল সোঁদা মাটির গন্ধ। রুক্ষ মালভুমির জীবনযাত্রার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়েছিল তার। বইতে পড়া ‘আদিবাসী’র সঙ্গে দেখা হয়েছিল সামনাসামনি। চোখ মেলে দেখেছিল ‘আদিবাসী’রা তার থেকে আলাদা কিছু নয়। এক দঙ্গল সহপাঠীর সঙ্গে কাটানো বেশ অনেকগুলো দিনের কথা আবছা আবছা মনে পড়ে ইমনের। মনে পড়ে ফুলমণি মারান্ডির কথা, বলাই হেমব্রমের কথা। মনে পড়ে খালি গায়ে ধুলো মেখে আপনমনে বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো একদল শিশুর কথা। মনে পড়ে দারিদ্রে জর্জরিত বেশ কয়েকটি পরিবারের কথা যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। কে জানে আজ কেমন আছে সেই মানুষগুলো! এখন নাকি অনেক উন্নয়ন হয়েছে এইসব এলাকার সব জনপদে। এসেছে অনেক পরিবর্তন। বড়ন্তির মতো গ্রামে নাকি এখন উন্নয়নের বাড়বাড়ন্ত।

বড়ন্তির অলিগলিতে ঘুরে বেড়ায় ইমন। খুঁজে বেড়ায় পরিবর্তনের ছোঁয়া। হ্যাঁ পরিবর্তন সত্যিই এসেছে। এখন আর খালিগায়ে বনেবাদাড়ে বাচ্ছাগুলো ঘুরে বেড়ায় না। তারা ইস্কুল যায়। পড়াশোনা যাই হোক না কেন একবেলার খাওয়া তো জুটে যায়। তাই বা কম কিসে! আগেরদিন সূর্যাস্ত দেখতে গিয়ে নাছোড়বান্দা একটি মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ইমনের। পলাশফুলের মালা গেঁথেছে সে। ইমনকে কিনতেই হবে। গাছের ফুল গাছে অথবা মাটিতে ঝরে থাকতে দেখতেই পছন্দ করে ইমন। ফুলের মালা গলায় বা মাথায় পরে বনকুমারী হওয়া তার একেবারেই পছন্দ নয়। কোনওরকমে তখনকার মতো ছাড়া পায় সে। পরের দিন গ্রামে গিয়ে দেখে মাথায় একটা ভারী ঘড়া ভর্তি জল নিয়ে আসছে সেই মেয়েটি।

–কি রে আজ মালা গাঁথবি না?
–গাঁথব বটে! ভাইটো ফুলটো লিয়ে আসুক তারপর গাঁথব কেনে…

কয়েক পা এগোতেই ইমন দেখতে পেল একদল ছেলে লম্বা লম্বা আঁকশি নিয়ে চলেছে পলাশের জঙ্গলে। ভোরের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা পলাশের কোমল শরীরে লোহার আঁকশির তীক্ষ্ণ খোঁচা লাগতেই মায়ের হাত ছেড়ে ছুট্টে পালিয়ে যাওয়া শিশুর মতো ঝরে পড়ছে একটা করে ফুল। মায়ের সঙ্গে হচ্ছে তার অকালবিচ্ছেদ। অসহায় ছিন্নপতন। বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে যাওয়া ফুলগুলো যেন আর্তনাদ করে— আমাকে তোমরা বাঁচতে দিলে না। ঝরে পড়া ফুল খুব যত্ন করে ঝুড়িতে তুলছে ছেলের দল। একটাও যেন না ছেঁড়ে। ছেঁড়া ফুলের মালা বাবুরা কিনবে না যে। একবার গলায় ঝুলিয়ে, মাথায় লাগিয়ে, বাজুবন্দ করে ছবি তুলবে দিদিমণিরা। সে ছবি ছড়িয়ে দেবে সারা দুনিয়ায় যেখানে যত পরিচিত মানুষ আছে সকলের মধ্যে। তারপরই দলামচলা করে সেসব ফেলে দিয়ে যাবে রাস্তার মাঝখানে। তাদের চেপ্টে দিয়ে চলে যাবে পলাশ দেখতে আসা আর একজনের গাড়ির চাকা। অকালে শেষ হয়ে যাওয়া ছোট্ট ফুলটা তখনও ক্ষীণ স্বরে বলতে থাকবে— তোমরা আমায় বাঁচতে দিলে না।

এই ছেলের দল ঝুড়ি ভর্তি করে ফুল এনে জড়ো করে বাড়ির উঠোনে ছায়ায় রাখা খাটিয়ার উপর। খাটিয়ার চারদিকে ছুঁচ সুতো নিয়ে বসে আছে কোয়েল মুর্মু, চুমকি হেমব্রম, পায়েল মাল-দের মতো ছোট ছোট মেয়েরা। এরা মালা গেঁথে, গ্রামের চারদিকের রিসর্টগুলিতে বিক্রি করবে, তারপর বাড়ি ফিরে, স্নান করে দুটি গরম ভাত খেয়ে ইস্কুলে যাবে। একদল মেয়ে রিসর্টে যাবে, প্রত্যেকে বেড়াতে আসা কোনও দিদিমণির কাছে আর্জি জানাবে— আমার থেকে একটা মালা নাও না!

ইমনের মনে পড়ে যায় ফুলমণি মারান্ডির কথা। অন্ধকার থাকতে জঙ্গল থেকে শুকনো শালপাতা কুড়িয়ে আনত ফুলমণির দল। লাটসাহেব ভাইরা তখন ঘুমের দুনিয়ায়। শালের কাঠি আর শুকনো পাতা দিয়ে থালা বাটি বানাত ফুলমণির মায়ের মতো আরও অনেক মা। লাটসাহেব ভাইরা সাইকেলে করে সেসব বেচতে যেত শহরে। সমস্ত উপার্জনের উপর ছিল শুধু তার অধিকার। ‘বেটাছানা’ বলে কথা। যা হোক এখন সমস্ত উপার্জন ‘বেটাছানা আর বিটিছানা ভাগ কইরে ল্যায় বটে।’ এই পরিবর্তনই বা কম কী!

ফুলমণির মায়ের সঙ্গে আরও অনেক মা সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের মতো স্বামীর গালিগালাজ, মারধোরকেও দিনের একটা কাজ বলেই ধরে নিয়েছিল। তাই বিনা প্রতিবাদে আর পাঁচটা কাজের মতো এই কাজ করে চলাই নিয়তির বিধান বলে মেনে নিয়েছিল তারা। আজ চম্পা হেমব্রমের মায়ের মতো আরও অনেক মা কাজ জুটিয়েছেন উপার্জনের খোঁজে। স্বামীর প্রভুত্বের উপর ভরসা না রেখে কেউ রান্নার কাজ নিয়েছে রিসর্টে, কেউ বা ঘরদোর পরিষ্কার বা অন্যান্য কাজ। তা সে হোক না সারাদিনের পরে ঘর প্রতি তিরিশ টাকা, তবু তো স্বামীর বিনি পয়সার প্রভুত্বের থেকে কাজের! মেয়েগুলো মালা বেচে যে বিশ পঞ্চাশ টাকা রোজগার করে তা গুছিয়ে রাখলে মন্দ কিছু হয় না। পলাশ শেষ হয়ে গেলে শালপাতা, মহুলের ফুল এটা ওটা করে সারাবছর কিছু না কিছু কুড়োতে কুড়োতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে যায় নুনে আর পান্তাভাতে। ‘কাজ লাই কাজ লাই’ করে ঘ্যানঘ্যান করে এরা কাটিয়েছে দিনের পর দিন। কাজের বদলে শুধু একটাই কথা শুনেছে— ‘হবেক বটে, উমুক রাজা হলেই হবেক বটে।’ চম্পার মায়েরা ঘরেবাইরে আজ আর রাজার আশায় থাকে না। এ তো শুধু পরিবর্তন নয় এ তো ভোল পালটানো। বইতে পড়া, ভয়ে কুঁকড়ে থাকা, রক্ষণশীল সেই ‘আদিবাসী’ বিটিছানাদের এই ভোলবদল দেখে খুব আনন্দ পায় ইমন।

আনন্দ পেলেও ইমনের মনে একটু সংশয় জাগে। ভোল বদলানোর চোটে খড়কুটোর মত ওদের পরম্পরাটাও ভেসে গেল না তো! আজ থেকে বহু বছর আগে যে সব পরম্পরা ইমনকে ভাবতে শিখিয়েছিল ‘আদিবাসী’ মানে একদল পিছিয়ে পড়া মানুষ নয়। বরং অনেক আধুনিক, সংবেদনশীল, আত্মগরিমায় মুগ্ধ একদল মানুষ যারা এদেশের সনাতন পরম্পরা বহন করে আসছে আদিম কাল থেকে। আদিকালের বাসিন্দা বলে তারা ‘আদিবাসী’ বটে কিন্তু পরিবেশ সচেতন, আধুনিক সংস্কৃতির সুঠাম বুনিয়াদের উপর দাঁড়িয়ে থাকা তাদের অস্তিত্বের আসল পরিচয় তারা ‘জনজাতি’।

এসব তত্ত্বকথা সে সময় তাদের জানা ছিল না। চারিদিকের এত উন্নয়ন, পরিবর্তন এসব দেখে আশায় বুক বাঁধে ইমন। আজ বোধহয় ওরা বুঝতে শিখেছে ওদের আসল পরিচয়। ছিনিয়ে নিতে শিখেছে তাদের অধিকার। বেশ কয়েকটা ঘরের ঢোকার রাস্তাটা ইতিমধ্যে নিকিয়ে পরিষ্কার করা হয়ে গিয়েছে। কয়েকটা ঘরে শুধু গোবরজল দেওয়াটা বাকি। সমস্ত গ্রামটা জুড়ে কেমন একটা গোবর গোবর গন্ধ যা শহুরে মানুষের অপছন্দের হলেও ওদের কাছে শুচিশুভ্র এক সামাজিক রীতি। যাক দিন শুরুর এই রীতিটা অন্তত বদলায়নি। গ্রামটার চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে ইমন বুঝতে পারল একটুআধটু বদলালেও আসলে বেশিরভাগটাই বদলায়নি। ছবি তুলতে চাইলে গোবর নিকোতে থাকা পার্বতী হেমব্রম আজও লজ্জায় ঘোমটা টানে। জঙ্গলের কাঠের বোঝা মাথায় নিয়ে ছোট্ট ছেলেটার হাত ধরে হেঁটে আসা সরস্বতী বাস্কে, আজও ঘরে ঢুকে ডেকে তোলে হাঁড়িয়া খেয়ে বেলা অবধি ঘুমিয়ে থাকা ‘বেটার বাপটোকে’। ‘তোমরা কোন জনজাতির মানুষ গো?’ এই প্রশ্নের উত্তরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাওয়া লক্ষী মুর্মু আজও চাপা গলায় বলে— ‘আমরা আদিবাসী বটে।’