Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মানসিক অসুস্থতা: এক নীরব অতিমারি — ষষ্ঠ বর্ষ, দ্বিতীয় যাত্রা

স্টেশনমাস্টারের কলম

 

করোনা-অতিমারি মোটের ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণেই হয়তো, বা হয়তো নয়— অন্তত আপাতত একটা স্বস্তিকালই কাটাচ্ছি আমরা বলা যায়। সেই অবসরে আজ অন্য এক অতিমারির কথা হোক। এ এমন এক অতিমারি, যা শুধু আজ নয়, যুগ-যুগ ধরে ঘাপটি মেরে রয়েছে আমাদের মধ্যে, প্রজন্মের পর প্রজন্মে অতিবাহিত হচ্ছে নীরব ঘাতকের মতো, অথচ যা নিয়ে সবিস্তার আলোচনাও করি না আমরা! আলোচনা করি না, তার কারণ— হয়তো বা আমাদের সঙ্কোচবোধ, হয়তো বা তাকে সম্যক বুঝতেও আমাদের অনীহা কাজ করে— গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা করাতেও, অতএব।

হ্যাঁ, আমরা মানসিক অসুস্থতার কথা বলছি। কিন্তু, সে আলোচনায় ঢোকার আগে, প্রথমেই কতগুলি কথা স্পষ্ট করে দেওয়া যাক।

মানসিক অসুস্থতা কোনও অজুহাত নয়। মানসিক অসুস্থতা ভয়ঙ্কর। এ যদি স্রেফ কোনও তুচ্ছ অজুহাত হত, বা আমাদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির কোনও সহজ হাতিয়ার, তবে, আর যা-ই হোক, একে সাইলেন্ট প্যানডেমিক আখ্যা দেওয়া হত না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) আশঙ্কা, এই বছরের শেষে প্রায় ২০ শতাংশ ভারতীয় মানসিক অসুস্থতায় ভুগবেন। হু বলছে, ৫.৬ কোটি ভারতবাসী মানসিক অবসাদ বা ডিপ্রেশনে ভুগছেন এবং ৩.৮ কোটি ভারতবাসী ভুগছেন উদ্বেগজনিত সমস্যা বা অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডারে। শুধু এ-ই নয়, হু একটা অর্থনৈতিক হিসেবও কষেছে, যে হিসেব অনুযায়ী ২০১২ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে মানসিক অসুস্থতার কারণে ভারতের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ১.০৩ ট্রিলিয়ন ডলার (২০১০ সালের ডলারের বিনিময়মূল্য অনুযায়ী)। সামান্য এই কয়েকটি পরিসংখ্যানই সমস্যাটির ব্যাপকতা বুঝতে পারার পক্ষে যথেষ্ট, অথচ আশ্চর্য, আমরা এখনও এক স্বর্গীয় স্বস্তিবোধের মধ্যে রয়েছি। এ যে কেবলই অজ্ঞতাপ্রসূত তা নয়, জেনেও না-জানার ভান করা বা বাস্তবকে অস্বীকার করার (‘ডিনায়াল’) এ এক বিচিত্র প্রয়াসও বটে।

মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যার চিকিৎসার জন্য প্রথম প্রয়োজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টদের— কেউ এই ধরনের সমস্যায় সহায়তা চাইলে এঁদের সঙ্গেই প্রথম যোগাযোগ করা বাঞ্ছনীয়। তারপরে আসবেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা সাইকিয়াট্রিস্ট, সাইকিয়াট্রিক সোশ্যাল ওয়ার্কার এবং সাইকিয়াট্রিক নার্সরা। অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ওআরএফ)-এর ২০২১-এর একটি সমীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে এই ধরনের প্রশিক্ষিত পেশাদারদের সংখ্যা প্রয়োজনের ধারেকাছেও নেই।

ইন্ডিয়ান সাইকিয়াট্রিক সোসাইটির হিসেব অনুযায়ী, সারাদেশে এই মুহূর্তে সাইকিয়াট্রিস্টের সংখ্যা ৯০০০, এবং তার সঙ্গে মোটের ওপর ৭০০-র কাছাকাছি মনোবিজ্ঞানের ছাত্র প্রতি বছর স্নাতক হয়ে বেরোচ্ছেন। সবমিলিয়ে হিসেবটা দাঁড়ায়, আমাদের দেশে প্রতি ১ লক্ষ মানুষ-পিছু মনোবিদের সংখ্যা ০.৭৫ জন। যেটা কিনা প্রতি ১ লক্ষ মানুষ-পিছু নিদেনপক্ষে ৩ জন হওয়া উচিত বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

ভাবুন তো, শরীরের কোনও যন্ত্রণায় চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন, কিন্তু কোনও ডাক্তার নেই যে আপনি কোনও চিকিৎসা পাবেন! বা তীব্র জ্বরে বেহুঁশ হয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু ওষুধটুকু পাওয়ারও কোনও ব্যবস্থা নেই! এই নারকীয় হতাশা মানসিক রোগগ্রস্ত মানুষদের নিত্যসঙ্গী। চিকিৎসার সুযোগ পাওয়া তো ছেড়ে দিন, তাঁরা লোকলজ্জার ভয়ে তাঁদের সমস্যার কথা কাউকে খোলাখুলি বলতে পর্যন্ত পারেন না।

আপনি যদি সহৃদয়তার সঙ্গে তাঁদের সঙ্গে না-মেশেন, তাঁদের অকল্পনীয় হতাশা সম্বন্ধে আপনি ধারণাই করতে পারবেন না। প্রতিটা কাজ আপনি করে যাচ্ছেন, আর আশ্চর্য হচ্ছেন এই ভেবে যে, এটা কেন করলাম! প্রতি মুহূর্তে এই অনুভূতি, এই উপলব্ধি আপনার হচ্ছে যে, আপনি কোনও কাজেরই নন। নিজের চিন্তাভাবনা, কথাবার্তা, কাজকর্ম, কোনও কিছুর ওপরেই নিয়ন্ত্রণ না-থাকা যে কী ভয়ঙ্কর অনুভূতি শুধু কল্পনা করুন। এই জগতে আরও অনেক বড় সমস্যা আছে, অনেক গহীন সঙ্কট রয়েছে, আরও অনেকানেক খারাপ জিনিস ঘটে চলেছে অহরহ— এসব অনুধাবন করাও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। তুলনা বস্তুটা মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত মানুষদের কাছে সবচাইতে দুর্বোধ্য।

আমি কোনও অদ্ভুত আচরণ করে ফেলছি কি না ভেবে ভেবে জীবন কাটানোটা, বিশ্বাস করুন, সহজ নয়। আরও বিশেষ করে যখন আপনি জানেন যে, গোটা দুনিয়া ক্রমাগত আপনাকে আতসকাচের তলায় ফেলে বিচার করে চলেছে— বিচার করছে আপনাকে, বিচার করছে আপনার প্রতিটি নিভৃত অশ্রুপাতকে, বিচার করছে আপনার প্রতিটি সতর্ক পদক্ষেপকে, বিচার করছে আপনার প্রতিটি কার্যকলাপকে। যখন কোনও মানসিক সমস্যা আপনার ভেতরে বাসা বেঁধেছে, আপনি কিন্তু জানতেও পারছেন না কোনও কিছুতে আপনি অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ফেলছেন, নাকি উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছেন, নাকি অতিরিক্ত স্পর্শকাতর হয়ে পড়ছেন।

পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো মানুষকে উন্মত্ত করে দেয়। নিজের ওপরেই নিজের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই, শুধু তা-ই নয়, এই অসহায়তা, এই যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে অবিরত। নিজের ছায়াই নিজেকে ধাওয়া করে বেড়াচ্ছে। নিজের খোলসটুকু, যা কিনা প্রতিটি মানুষের সবচাইতে কমফোর্ট জোন, সেটাই পরিণত হয়ে যাচ্ছে একটি রীতিমতো ওয়ার জোন-এ।

নিজের মাথার মধ্যে, নিজের বিরুদ্ধে নিজের এ এক অন্তহীন লড়াই। বিশ্বাস করুন, এইরকম একটা পরিস্থিতিতে আপনি এক মুহূর্তের জন্যেও থাকতে চাইবেন না।

এর মধ্যেই অসংখ্য মানুষ ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি, পার্সোনালিটি ডিজর্ডার, সাইকোটিক ডিজর্ডার, ইটিং ডিজর্ডার, ইমপালস কন্ট্রোল অ্যান্ড অ্যাডিকশন ডিজর্ডার, অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজর্ডার, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজর্ডার আদি নানাবিধ মানসিক সমস্যার সঙ্গে নিয়ত যুঝে চলেছেন। আমাদের জুন মাসের মেল ট্রেনের রিজার্ভড বগিটি নিবেদিত হল সেই সব মানুষদেরই উদ্দেশে। থাকল এই নীরব অতিমারি সম্পর্কে কিছু মূল্যবান আলোচনা। আলোচনা করলেন সীমন্তিনী ঘোষ, অনন্যা রায়আত্রেয়ী কর। সঙ্গে থাকল কোভিড ১৯ অতিমারি যে মানসিক অসুস্থতার ক্ষেত্রেও কি ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে সে সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি সংবাদ প্রতিবেদনের তর্জমা। আমাদের উদ্দেশ্য, যাতে আমার-আপনার মতো সাধারণ মানুষ এই ভয়ঙ্কর সমস্যাটা আর একটু ভালো করে অনুধাবন করতে পারি। শারীরিক ব্যাধির চিকিৎসা আমাদের কাছে যেমন একটি সহজ সাধারণ জিনিস, মানসিক ব্যাধির ক্ষেত্রেও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি যেন অনুরূপ হয়, সেটাই প্রত্যাশা রইল।

অন্যান্য বিভাগের কথায় আমরা এ-মাসে স্মরণ করলাম বাংলাদেশের সদ্যোপ্রয়াত সাংবাদিক-প্রাবন্ধিক আব্দুল গাফফার চৌধুরীকে। এছাড়া কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, বিশেষ নিবন্ধ, অণুগল্প, অন্যগদ্য, অনুবাদ সাহিত্য, ফটোফিচার, ধারাবাহিক উপন্যাস এবং রচনা-র মতো নিয়মিত বিভাগগুলি। এবং স্টিম ইঞ্জিন, সবুজ স্লিপার, হুইলার্স স্টল এবং ভালো খবর-এর মতো বিশেষ বিভাগগুলিও।

ভালো থাকবেন। নমস্কার…

 

সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষে,
আত্রেয়ী কর