যোধপুরের ‘পাগল সাব’— ইতিহাস ও জল সংরক্ষণের লেগ্যাসি

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

যোধপুর। তিনশো বছরেরও বেশি পুরনো রাজস্থানি রাজপুত স্থাপত্য-শহর। ইন্দো-ইসলামিক আর্কিটেকচার। ঝরোখা, ছত্রী, বাওয়ারি, ঝালারা। এই বাওয়ারি বা স্টেপওয়াল নিয়েই এক গল্প। বলা ভালো সিঁড়ি দিয়ে দিয়ে জলাধার তৈরির এই সুবিখ্যাত স্থাপত্য কৌশল ভারতবর্ষের প্রাচীনতম বৃষ্টির জল সংরক্ষণের দৃষ্টান্ত। এবং তার সঙ্গে স্থাপত্যশিল্প ও সৌন্দর্যের মিশেল। যা টেনে আনে পর্যটকদেরও। উত্তর ভারতের এই সিগনেচার বাওয়ারি বা স্টেপওয়াল পরবর্তীকালে যত্নের ওভাবে ক্ষয়ে যেতে বসেছে। শহরে নদী থেকে জল আনা ইন্দিরা গান্ধি ক্যানেল এই বাওয়ারির জলের উপর মানুষের এককালীন নির্ভরতা প্রায় ইতিহাসে পরিণত করে দিয়েছে। ব্যবহারবিহীন এইসব জলে দুর্গন্ধের পাশপাশি প্রচুর মাছ অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে। এবং তার সঙ্গে নান্দনিকতাও এসে ঠেকছে তলানিতে। ক্ষতি করছে পর্যটনশিল্পেরই। এমন খুব পরিচিত এক গল্পে অন্য মুখ। এক ক্ষয়িষ্ণুতার গল্পে এক একটা ভালো খবর। দেশের গণ্ডির বাইরে অন্য এক মুখ। সাহেবি মুখ। স্থানীয়দের ‘পাগল সাব’।

আয়ারল্যান্ড থেকে এদেশে আসা ক্যারন রনস্লির কথা বলছিলাম। স্থাপত্য নিয়ে ভালোবেসে গবেষণা করা ক্যারনের এই ভালবাসা মূলত এসেছিল ভারতে চিফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করা তাঁর পিতামহের কাছ থেকে। স্থাপত্যের এই অনবদ্য নমুনাগুলি কিভাবে পাবলিক ল্যাট্রিনে পরিণত হতে পারে তা এদেশের লেগ্যাসিতে খুব সাধারণ হলেও ক্যারনের চোখে অবিশ্বাস্য লেগেছিল। এবং অবিশ্বাস থেকেই জন্ম নিয়েছিল এক অন্য গল্পের।

প্রথমদিকে ক্যারন সরকারি সাহায্য চাইলেন। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে একধরনের হাত পাতলেন। তারা ফিরিয়ে দিল। সরকার ফিরিয়ে দিল। ক্যারন বাধ্য হয়ে একাই ব্রত নিলেন। সামান্য হাতেগোনা কিছু স্থানীয় মানুষ এবং মেহরানগড় মিউজিয়াম ট্রাস্ট— সহায়তা বলতে এইটুকুই। বাকিটা দিনরাত ক্যারনের পরিশ্রম। নিজে সাঁতার কেটে নোংরা পরিষ্কার করা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে এবং সর্বোপরি নাক সিঁটকানো কফি-টেবিল এলিট ইতিহাসপ্রেমী ভারতবাসীকে একধরনের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ক্যারন নিজেই জঞ্জাল সাফাইয়ে নামলেন। স্থানীয়রা দেখল সাদা চামড়ার এক মানুষ কেল্লার বাওয়ারির জলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর কুড়িয়ে নিচ্ছেন দলা দলা নোংরা। কখনও সিঁড়ি বরাবর জমতে থাকা ধুলোতে নিজেই ঝাড়ু বোলাচ্ছেন। জল ঘেঁষা সিঁড়ির দেওয়ালের শ্যাওলা তুলে দিচ্ছেন নখ দিয়ে ঘষে ঘষে। এভাবেই দশ দশটা স্টেপওয়াল। কী সেগুলি? রাম বাওয়ারি, ক্রিয়া ঝালারা, গোবিন্দ বাওয়ারি, চাঁদপোল বাওয়ারি, মহামন্দির বাওয়ারি, মহিলা বাঘ ঝালারা, তাপি বাওয়ারি, গুলাব সাগর লেক ইত্যাদি।

এই মহিলা বাঘ ঝালারা দিয়েই ক্যারনের স্বপ্ন-প্রচেষ্টার শুরু। বর্তমানে খেতারাম নামের এক স্থানীয় মানুষের সাহায্যে এই ঝালারা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে। তবে মাঝেমধ্যেই প্লাস্টিক ফেলে চলে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ। দূর থেকে সাময়িকভাবে হতাশ অথচ আরও দৃঢ়কণ্ঠী ক্যারনকে দেখে জোর পাচ্ছেন খেতারাম। তীব্র রোদের পশ্চিম ভারতের এক শহরে প্লাস্টিক, জঞ্জাল তুলে ঘরে ফিরছে এক ভারতীয়, এক আইরিশ।

এর কাছাকাছি গুলাব সাগর লেক। সেখানে অন্যতম এক স্বেচ্ছাসেবী যুবক প্রত্যুষ যোশী অবশ্য খেতারামের মতো শুধু কাজ ভালোবেসে আসেননি। এসেছেন পড়াশোনা করে। জেনেছেন কীভাবে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতায় ভূগর্ভস্থ জল সংরক্ষণের এক অতুলনীয় ঐতিহাসিক নমুনা হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রত্যুষ সেই ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছেন যেখানে তার যোধপুর জলের অভাবে ধুঁকছে। প্রত্যুষ সেই দিন চান না। আর তাই স্যার ক্যারনের হাত ধরে তাঁকে ফ্রেন্ড ফিলজফার গাইড করেই জল সংরক্ষণের কাজে হাত মিলিয়েছেন যুবক। বলছেন, পুরনো যোধপুরকে ফিরিয়ে আনতেই হবে। পাশে এসে দাঁড়ানো আরেক সহযোদ্ধা মেহরানগড় মিউজিয়াম ট্রাস্টের অধিকর্তা কর্নি সিং জসলের কথায় ধরা পড়ে সমস্যার অন্য দিক। বাওয়ারিগুলির জলের গভীরতা এবং স্থাপত্যের গঠন এমনই যে যন্ত্রের সাহায্যে নোংরা পরিষ্কার প্রায় অসম্ভব। ম্যানুয়াল প্রচেষ্টাই কষ্টকর হলেও একমাত্র উপায়। ক্যারনও সেইসব ভেবেই এই কাজে হাত দিয়েছেন।

‘পাগল সাব’ মাঝেমধ্যেই ইউরোপে তাঁর দুই ছেলেমেয়ের কথা মনে করেন। পঁচাত্তর পেরোনো বৃদ্ধের সেই সন্ততিরা আজ স্বাবলম্বী, নিজের পৃথিবীতে তাঁরা সফল। কখনও সেই পৃথিবীতে গেলেও আবার বাওরিদের ডাকে চলে আসেন ভারতে। এদেশ তাঁকে টানে। কাওয়ালি, ওস্তাদ ফতেহ আলি খান, গরম দুপুরে ক্যারনের ফেভারিট ড্রিঙ্ক ফেরিওলার আখের রস— তাঁকে টানে। বয়সের ভারে কষ্ট হলেও ক্যারন তুলে নেন ময়লা, ঘষে সাফ করেন শ্যাওলার পর শ্যাওলা। কাচের মতো জলে মাছেদের গায়ে হাত বোলান। কখনও জল মাথায় নেন। নিজের মুখ দেখেন। শান্তি পান।

এভাবেই ২০১৪ সালের শেষের দিকে যোধপুরে আসা পাগল সাবের গল্পটা তৈরি হয়। ফ্রান্সে জন্মানো আইরিশ এই মানুষটি বহু দেশ ঘুরে এলেও এখন তাঁর মনে প্রাণে শুধুই ভারতবর্ষ। শুধুই আখের রস খেয়ে একটা সস্তার টুপি মাথায় দিয়ে ভূগর্ভস্থ জল বাঁচিয়ে চলা। শুধুই ইতিহাস ধরে রেখে এগিয়ে চলা। মুষ্টিমেয় কিছু স্বপ্নকণ্ঠীদের তুলে আনা। কারণ বয়স পঁচাত্তর পেরোচ্ছে। কাজটাকে তো ধরে রাখতে হবে। এগোতে হবে।

আরও অনেকদিন থাকুক ‘পাগল সাব’। ভালো থাকুন ক্যারন রনস্লি।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...