Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

শিকার

শিকার | দেবার্ঘ্য গোস্বামী

দেবার্ঘ্য গোস্বামী

 

থকথকা তুলার মতন চেটকান নরম থেকে ছটাক দূরে নাক ঘুরঘুরিয়ে ধুকপুকানি খুঁজে চলছে মাস খানেকের টলমল বিলাই। কখন পরম নিকট নরম থাবায় নাক ডুবাতে গিয়ে অপরিচিত খর খর নখে ফাল খায় নাক— কখন মা ঠাকুমার সব হুটাপুটির নির্যাসে তিড়িং লাফিয়ে জুলজুল অপেক্ষা করে প্রতিলাফের— কখন দুই ক্যানাইনের আলগা চাপে মাটিতে ছেতরে থাকা লেজের ভিতর খুনসুটি খোঁজে। নিজের মাস খানেকের বাচ্চার মরিয়া কৌতূহলের কেন্দ্রে বিমুখ জিরান খাচ্ছে এক পশম মৃত্যু। সেই কেন্দ্রটিকে উত্তরপশ্চিমে রেখে গামারিগাছের পাশ দিয়ে রান্নাঘরের জানলা পর্যন্ত বাগান জুড়ে আগাছার ভিতর আবছা পালানোর দাগ।

সেই দাগ ধরে ধরে এগিয়ে জানলার কাছে গলার ভিতর উঁচু হয়ে ওঠানামা করছে, বহুকাল আড়চোখে রয়ে যাওয়া এক হাড়হিম আশঙ্কা।

রাগ হতে দুঃখ হয়।

দুঃখ পেতে ভয়।

রান্নাঘরের পিছনের বাগানে এক গা রক্তমাখা মিনির শরীরের চার পাকে উশখুশাচ্ছে ওর এক মাসের বাচ্চা। আর রান্নাঘরের ভিতর উলটানো সসপ্যান থেকে আসা ঘন শুকান সাদা, মুখ থুবড়ে আছে মেঝেতে। তার থেকে ছুটকে আসা এক দুইটা সোঁতা, হাঁটু লেছড়ে কোনওক্রমে দরজা পেয়েছে। বার হয়ে যাওয়ার সেই দাগ জুড়ে ভনভনাচ্ছে মাছি। ছোট্ট চার থাবার এলোপাথাড়ি পালানোর ছাপ মেঝে, টেবিল, জানলার চৌকাঠ হয়ে লাফিয়ে গেছে বাগানে, আগাছায়।

এক উন্মুখ লোভী চুমুকের ছড়িয়ে যাওয়া এঁটো আর উদাসীন মরে থাকা গুটান নরমের মাঝে, জানলার ঠিক পাশটায় দাঁড়িয়ে নাকে এক টকটক গন্ধ আসে সুনীতির। ঠান্ডা লাগে। নিজের গা জুড়ে আগাছার আঁচড় টের পাওয়া যায়। এক ঝাঁপ পালানোর জন্য কোঁত দেয় পেট। পালাতে হবে। পালা… পেট মুচড়ে আসা টক আঠায় কষ কষ ভিমরি খায় জিভ। একটু জল পাইলে হত। রান্নাঘরের টেবিলের উপর কাত হয়ে আছে প্লাস্টিকের জগ। দুধ খায়ে পালানোর সময় নিশ্চয়ই এতে ধাক্কা লাগে মিনির। ফিল্টার করে কুড়ি মিনিট ফোটানোর পর জগে ভরতে হয় জল। বছর খানেক হল কাকুর পেটের খুব সমস্যা। রাতবিরাতে কাপড়েচোপড়ে হয়ে যায়। ঘুম ভাঙাতে চায় না বলে চুপচাপ বাথরুমে যাইতে গিয়ে সারা ঘর ল্যাটাপ্যাটা করে দেয়। ঘুম ভাঙলে আগে নিজের কাপড়ে লাগা গু ধুয়ে তারপর সারা বাড়ি ধুতে হয়। ফোটানো জলটা পইড়ে গেল লোকটা কী খাবে……

শকুন্তলাকাকিমা মরার তিন মাসের ভিতরেই প্রথম হাত মারে কাকু। রান্নাঘরে কী একটা ওঠানো না নামানোর নাম করে, তিন চার সেকেন্ড হাত বুকে ঠেকায়ে খুব ব্যস্তমতন ঘর থেকে বার হয়ে যায়। ফতনা দেখে সুনীতি। একলা শাঁসালো বুড়ার আলুর দোষ থাকলে তারা খুব লক্ষ্মীমন্ত হয়। খুব আঠা। ঝাঁঝ কম। বয়সকালেই এদের বাচ্চাকাচ্চা হয় নাই, যন্ত্রের ঝক্কি আর খুব কী হবে! ডোবা ফতনার অনেক নিচে থাকে লোহা গেলা হা মুখ। তার হাউস জমা মাংসের সাইজ সবসময় উপর থেকে থা পাওয়া যায় না।

রান্নাঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে শোওয়ার ঘরের আলোর ফালি দেখা যায়। আধভেজানো দরজায় চোখ আটকালে কান ছড়াতে চায় সুনীতি। টের পাওয়া লাগে। নিজের বুকের ধড়পড়ানি, নিশ্বাসের সাথে কাঁপে দুই কান জুড়ে। কিচ্ছু শোনা যায় না। শোনা খুব দরকার। বিপদ কতটা গড়াইল! আর কতটুকু সময় পাওয়া যাবে! আট বছরের বাচ্চা ঠাকুর! ওইটুকু বাচ্চাটার কী ক্ষতি করতে পারবেন! আপনারে দাদু বলে! ভিতরে কি ফোনে কথা বলার আওয়াজ? ক্লাব কি জানে? পুলিশ? এমএলএ? তালে কি এতক্ষণ কেউ আসে না? সামনের গেটের দিকে তড়াক পারে আড়াল চোখ। কেউ নাই। গেট বন্ধ। লাইটও বন্ধ। লাইট জ্বালানোর কাজটা সুনীতির। সন্ধ্যায় আসার পরে গেটের লাইট ঘরের লাইট জ্বালায় বিকালের ওষুধ সর্তায় আধ করে হাতে ধরায় দেওয়া। হাত যা কাঁপে নিজে তো ওষুধ আধা করতে পারবে না…

সন্ধ্যার আবছায় আলো না জ্বলা ঘরের ভিতরটা এখন রাতের তিস্তার মতন ছমছমা কাঁদাল লাগে। আলো জ্বললেই চার কাঠা জমি হিসাবের খাতার মতন পরিষ্কার— ছাদপিটানো ঘর মরদের ছাতির মতন পোক্ত। তা বলে অত বড় সাধ ছিল বলা যায় না। সাধের একটা লজ্জাশরম থাকে। লোভের ভয়। ভাগ্যের সে সব বাছবিচার নাই। বছর দুই আগে ঠোঁটে ভেসলিন লাগায়ে দিতে দিতে যখন নদীর চড়ে ওঠানো ঝোপড়ার ফাটা ত্রিপল–বৃষ্টি ভাসা খাটিয়া আর মেয়ের জ্বরের গল্প দিচ্ছিল সুনীতি, তখন হাজার দুই তিনের বেশি ধান্দা ছিল না তার। খানিক চুপ থেকে, টুক করে কাকিমার ছবির দিকে তাকায়, ঠোঁটে হাত ঘষে, একখান ঢোক আদ্ধেক গিলে ভাসা ভাসা গলায় কাকু যখন প্রায় ফিসফিস করল, একটা দিন সময় দে। পরশু দুপুরে ভাইকে নিয়ে আসিস, তখনও সে ভাবছিল হয়ত টিনের ঘর উঠবে এবার। চার কাঠা জমির উপর ছাদপিটানো বাড়ি, এককথায় নমিনি করে দেবে, এতটা ধান্দা তার চরুয়া কলিজায় আঁটা সম্ভব ছিল না। খুব কাঁইক্যাচাল হয়। পাশের বাড়ির মাস্টার, উল্টাদিকের কেরানি, তার পাশের হোমিওপ্যাথি ডাক্তার আর চার-পাঁচ খোঁচর বিশাল তম্বি দেয়: ভদ্র পাড়াকে মাগীপাড়া করতে দিব না… দুই মাসের ভিতর মাগী বিষ খাওয়ায় মারবে… কুকুরেও মুখে আগুন দিবে না। রা না কাটা কাকুকে দেখে সুনীতির কথি মার্কা এমন ব্যাটাছেলের মুখে পেচ্ছাপ করতে ইচ্ছা করে। দুইদিন পরে কোন এক অফিসে মাস্টারের নামে টিউশনির কমপ্লেন জমা পরে। উল্টাদিকের কেরানির পিছনের জমিতে পাড়ার ক্লাবের সাইনবোর্ড লাগে “জাগরী সংঘের শ্যামা পুজার জন্য সংরক্ষিত স্থান (১৩৯২)”, হোমিওপ্যাথির বাড়ির প্রায় সেটল হয়ে যাওয়া ৪৯৮এ নিয়ে আবার নাড়াচাড়া শুরু হয়। কাকু এক সময়ের কাউন্সিলার, লোকাল কমিটির মেম্বার, এমএলএর সঙ্গে কেমন একটা… গলার তলায় একটা টক টক বুদবুদ ফাটে।

পালাতে হবে। আর সময় নষ্ট করা যায় না। ভাগ্যিস আজ মেয়ে জংলুর কাছে। এমন সময় না হলে এখানেই থাকে। জংলুকে ফোন করা লাগত। চার্জ নাই। প্ল্যান করা লাগে। শিলিগুড়িতে মাসির বাড়ি আছে কাকু জানে। কাটিহারে জংলুর ঘর চিনবে না নিশ্চয়ই। কিন্তু জংলুর পুলিশের খাতায় নাম আছে। গুষ্টির হিসাব তোলা। এনজেপি থেকে কোনও একটা ট্রেনে উঠে গেলে হয়। মনে মনে দৌড় লাগায় সুনীতি। সাঁই সাঁই রাস্তা বনবাদার বাস গাড়ি কাটতে কাটতে পিছনে চলে যায়। পায়ের পাতার তলায় ফোস্কার মতন টলটলা জ্বালা গুটি পাকায়। হু হু হাওয়ার ঝাপটে লাল চোখ বন্ধ হয়ে আসে। দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে বেদম হাঁফে গলা বন্ধ হয়। মনে মনে হঠাৎই খাওয়া হোঁচটে পড়তে পড়তে জানলার শিক ধরে নেয় সুনীতি। তারপর চলবে কী কইরে? বাচ্চাটার স্কুল। টিউশনেও দেওয়া হইচে। চরুয়া পরতে চামড়া ঢাকা পড়ার আগেই দালান ফুটানির অভ্যাসে মেয়ে আর চরে হাগতে পারে না। প্যান লাগে। দাদুর বাড়ি ছাইড়ে জংলুর বাসায় সে থাকতেও চায় না। এই বাড়িতে যখন ঢোকে তখন মেয়ের বয়স চার কি পাঁচ। কাকুও ওকে নিয়ে কোনওদিন ঝামেলা করে নাই। শুধু রাতে শোওয়ার সময় সঙ্গে নেওয়া যাবে না। সে নেওয়া মুশকিলেরও। প্রথম প্রথম রাতে হুটাপুটি করার হাউস ছিল। বছর খানেক হল আর সেটুকুও করতে পারে না। খুব বেশি হলে হাত মারে। কয়েক মিনিট। তারপর বেহুঁশ ঘুমায়। ঘুমের ভিতরও দুই হাতে এমন জাপট যে পাশ ফেরা যায় না। রাতে ঘুমের ভিতর হাত পা নাড়ে। বিড়বিড়ায়। হঠাৎ হঠাৎ তাতে কাকিমার নাম শোনা যায়। আরও অনেকক্ষণ ধরে খুব মন দিয়ে সেই জড়ানো আওয়াজের গিঁট খোলার চেষ্টা করলে কোনও কোনও দিন শেষ রাতের দিকে তার নিজের নামের মতনও বোধহয় কিছু একটা শুনচে সুনীতি। তার এমনটাই মনে হয়। ঘুম হয় না ঠিকমতন। এমন ছেঁড়া ছেঁড়া রাতের মধ্যে বাচ্চাকে না শোয়ানোই ভাল।

যেদিন সম্পত্তি লিখে দিল, তার দিন দুই পরে কাকুর খাসি খায়ে বমি হল। পেট ছাড়ল। এক দুই দিন সুনীতির ঘরে ঢোকা বন্ধ হল। রক্ত পায়খানা পরীক্ষার রিপোর্ট আসা টাসার পরে তিনদিনের মাথায় আবার ফোন করে ডাকল। তখন তার সঙ্গেই মিনি এল বাড়িতে। নিজে খাওয়ার আধ ঘণ্টা আগে নিজে হাতে এক এক করে সব পদ মিনিকে খাওয়ানো শুরু করে কাকু। বাথরুমে গেলে ব্যাগ হাতায় দেখা শুরু হল। ওষুধ চোখের সামনে প্যাকেট থেকে না খুলে দিলে খায় না। ওর সমস্ত কাগজপত্র কাকুর আলমারিতে রাখা হল।

স্ট্রিট লাইট জ্বলে ওঠার সময় হয়ে গেসে। পালাতে হবে। এখনই পালাতে হবে। জংলুর পাটা হবে ব্যবস্থা করার? ভেরুয়া শালা। কোনও ধক নাই। রাতজাগার বিরক্তি কিংবা খিস্তি খাওয়ার রাগ নিয়ে কাকুর নামে দু চার কথা পাড়লেই ফাটা ক্যাসেট— তোক ভালবাসে। কাজের লোক কে লিখা দেয় সম্পত্তি।

বাল বাসে শালা।

দুই বছরে মানুষ কী করে ভুলে যায় কিভাবে ঘরে বসে শুধু ফোনে ফোনে থুথু চাটাইতে পারে এই মানুষটা। খবর পাওয়ারই ছিল। হাটুয়া ফিসফিস কারও একার হয় না। সব আড়াল এখানে সবার ঠোঁটে ভনভনায়। না জানতে দেওয়ার সব কসরতের পরেও যে জানতে পারল, তাতে চমকানোর কিছু ছিল না। কিন্তু হাভাইত্তা কাংলাদেরও যে কী ভীষণ দেউলিয়া হওয়ার ভয় দেখানো যায়, তা টের পাওয়ার বিষম থেকে এতদিনেও বের হতে পারল্ না সুনীতি। সকালে জানল জংলু শুধু তার পিস্তাত ভাইই না। জংলুর চোলাইয়ের ঠেক বিকালে ভাঙল মহিলা সমিতি। বাঁ হাতের কনুই ভাঙল। হাজতে গেল।

জংলুকে ছাড়ানো প্রয়োজন। ক্ষয়ক্ষতির জল মাপা প্রয়োজন। ক্ষতি এড়ানোর সবচেয়ে ভাল উপায় বশ মানা। বেশিরভাগ সময়েই কাজে আসে। পরদিন সকালেই কাকুর পায়ে আছাড়িবিছাড়ি খায় সুনীতি।

–মা বাঁচা সময় থেকে জবরদস্তি করত আমাকে… এই দেখেন বুকে মারের দাগ… ওকে শহর থেকে ভাগায় দেন। ওর মুখ আমি দেখব না। কিন্তু মায়ের পেটের না হলেও আমি ত ছোটবেলা থেকে ভাই ভাইবেই আসচি। যতই খারাপ হোক হাজতে দেখতে পারব না কাকু…
–কী মুশকিল, আমার তো কোনও ব্যাপার নাই এখানে। পুলিশ টুলিশ একবার ঢুকে গেলে আর কিছু করার থাকে না। ছেলেটা তো ভাল না।
–আপনি চাইলে…
–মেয়েটা কি ওর?
–অ্যাঁ? না। পায়ের বুড়া আঙুল দিয়ে মেঝে ঘষে সুনীতি।
–ওর তো বিহারে বউবাচ্চা আছে বলে, পুলিশ খোঁজ নিয়ে বলল?
–ছিল। মরে গেসে।
–অ। তাই ছুঁক ছুঁক করে জবরদস্তি করে বেড়াবে! এর আর কোথায় কটা বাচ্চা আছে কে জানে? আমাদের দেশের পপুলেশন জানিস? মানুষ করার ক্ষমতা নাই এ দিকে পিল পিল করে… আচ্ছা শোন, ওর বিয়ের কাগজপত্র আছে তো? বউবাচ্চার প্রমাণ তো আছে নাকি? সরকারি হাসপাতালে নসবন্দি মাস সেলিব্রেশন হচ্ছে এবার শুনলাম। হাজার দুই টাকাও দেয়-টেয়। অসুবিধা হলে চিকিৎসার টাকাপয়সাও দেয়। করায় নিক। পুলিশ আর ঘাঁটাবে না। শহর ছাড়তে হবে না। তোর উপর আর জবরদস্তির সাহস পাবে না। ভয় নাই।

‘ভালবাসার’ জোর এমনই থাকলে এবার কেউই প্রাণে বাঁচবে না।

বডিও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাচ্চা জংলু সবাইকে নিয়ে যাইতে হবে। বগড়িবাড়িতে মামাবাড়ির কথা এরা জানবে না। পৌঁছাইতে তাও ঘণ্টা ছয়েকের বেশি লাগবে। কিংবা পানিট্যাঙ্কি হয়ে যদি নেপালে ঢোকার ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু কাগজ ছাড়া খরচ প্রচুর পড়বে। ব্যাঙ্কের টাকা তোলার সময় নাই। জংলুর ঠেকে কিছু পয়সা তোলা থাকেই। নিজের হাতে শ পাঁচেক হবে। প্রথম কাজ গেট দিয়ে বার হওয়া। ঢোকার সময় দেখে নাই। অন্ধকার থাকতে থাকতে… প্লিং প্লিং করে তড়পায় গেটের সামনের টিউব লাইট… এক হাত লম্বা আগাছার আকড় পায়ের চালে ছিঁড়ে যেতে বড় সরসর করে ওঠে বাগান। চুপ চাপ অন্ধকারের ভিতর এক ঢিল ন্যাংটা শব্দে মুখ লুকানোর জায়গা খোঁজে কান। ভেপসে ফুলে ওঠা নিঝুম বুদবুদ, খুব দমকা ফেটে ওঠে বিড়াল গোঙানির চমকে। এক থাবা দুই থাবা খারিজ জমে জমে অভিমানে চুর একটুকুন বেঁচে থাকা ততক্ষণে সরে এসচে মৃত্যুর আঠা থেকে। এখন ঘরের খুব কাছে মিনির বাচ্চা। ক্যান ক্যান করে দরজার গোড়ায়। যে বিরক্তিতে লাথি মারে মানুষ, তেমন ভীষণ ঝোঁকে কোলে তুলে নিতে দরজা খুলে নিচু হন আশিস রায়। দুই পা জোড়া পালানি আর ঘেমো চুলের হাজার ফলায় ঝুলে থাকা লক্ষ্য আতঙ্ক-মতলব নিয়ে উলঝুল এক মানুষ গেটের কাছে দৌড়চাপা জমাট গায়ে দাঁড়িয়ে পরে।

–সুনীতি?
……
–সুনীতি কি?
……
–মিনিটা মরে গেল।
………
–ঘরে আয়! আসবি না?
……
–আমার জন্মদিন আজকে জানিস! ৮২ হল।
………
–আমি শরীরে টের পাই সুনীতি আর বেশিদিন নাই আমি! খুব বেশি হলে বছর কয়েক। সেই কয়েক দিন আমাকে সাথে থাকতে দিবি? সারা দিন দেখতে না পাইলে খুব দুশ্চিন্তা হয়! তুই জংলু আর মেয়েকে নিয়েই থাক না এই বাড়িতে। আমি লিখে দিব তোকেই। কোনও অসুবিধা করব না! থাকা খাওয়া সব আমার দায়িত্ব। আমাকে একটা ঘরে থাকতে দে শুধু যতদিন আছি! দিবি?

বাল বাসে।

বা আ আ আ আ আ আ ল বাসে।

পালানোর গা থেকে লুকাছাপার চটলা গলে মাটিতে মিশে গেলে খুব একটা উদম ঠ্যাটা চলে যাওয়া চপ্পলের ফিতার মুঠায় বুক চিতায় দাঁড়ায় পরে। চরুয়া বুকে উঠে আসা চোঁয়াঢেকুরের তোরে দালানঘর, শানের মেঝে, ভদ্র পাড়া আধহজম দানার মতন জিভের উপর কিচ কিচ করে।

বুকের উপরে খুব অভিমান জমে।

গলা বেয়ে উঠতে উঠতে কান্না পায়।

শেষে জিভের লালায় ভিজে ভীষণ রাগে কান ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে।

–নসবন্দি করাইলেও সব করা যায় জানেন তো?

প্লিং প্লিঙ্গানো টিউবলাইট স্পষ্ট হয়ে থিতু হয়ে গেছে। গেট থেকে একফালি সাদা লাইট আঁচড়ের মতন পৌঁছে গেছে ঘরদোরের আলাজিহ্বা অব্দি। এক টুকরা পশম-আঠালো বাঁচা সেই আঁচড় ধরে ঢুকে যায় ঘরের অন্ত্রে। দক্ষিণপশ্চিমের গামারিগাছের তলায় পড়ে থাকা দাঁত নখ করে ভীষণ মাটি তপস্যা। আর আলগা হয়ে আসা পালক পশম আসমানি মেজাজে বেশ ভাসে এক দুই।

এক কোমর গভীর ঘুম ঘুম গলা থেকে খুব জড়ানো গিঁটমারা আবছা আওয়াজ রাস্তা পর্যন্ত ভেসে আসে। রাস্তায় কল থেকে জল নিতে আসা শ্যামলী রায় সেই গিঁট খোলার চেষ্টা করলে, খোনা গলার একটানা বিড়বিড়ানি শোনে— ভালবাসি। খুব ভালবাসি। বাড়িতে গিয়ে তার হোমিওপ্যাথি ডাক্তার বরকে বললে, সে বলে কী শুনতে কী শুনচ!