Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মইনামতীর মন

প্রকৃতি নাজির-এর গল্প 'মইনামতীর মন' | ভাষান্তর: বাসুদেব দাস

প্রকৃতি নাজির

 

মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদবাসুদেব দাস

ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতকোত্তর প্রকৃতি নাজির অসমিয়া ছোটগল্পের ক্ষেত্রে একটি পরিচিত নাম। ১৯৭৩ সালে যোরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। পেশায় শিক্ষয়িত্রী। তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্প সঙ্কলন ‘প্রাণতরঙ্গ’ ২০২১ সালে প্রকাশিত হয়। সঙ্কলনটি পাঠক ও সমালোচকের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়েছে। অসমের প্রথম সারির পত্রপত্রিকায় নিয়মিত গল্প লিখে থাকেন প্রকৃতি।

মইনা দোকানটি খোলার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহক কয়েকজন কাছে চলে এল। সে আগেরদিনেই রাতের বেলা ঝেড়েপুঁছে রাখা দোকানঘরটিতে জল ছিটিয়ে ধূপ জ্বালানোর সময় গ্রাহক কয়েকজন দোকানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল। আসলে ওরা এমনিতেই দাঁড়ায়নি। মইনার শোলমাছের মতো মোটাসোটা পিছল শরীরটা, তাঁর সিঁদুরে পুঠির মতো চকচকে গাল দুটির মায়া ওদের মুগ্ধ করে রেখেছিল। জিনিস আর কী কিনবে ওরা! প্রত্যেকেই কাছাকাছি অফিসকাছারিতে চতুর্থ শ্রেণির চাকরি করা মানুষ। দুটো রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রিও আছে। কাজে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মইনার দোকানে একটা পান খায়, একটা সিগারেট টানে। কিছুটা দূরেই একই ধরনের দোকান খোলা থাকলেও ওরা মইনার দোকান খোলার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। মইনা বুঝতে পারে। কেউ পাঁচ টাকার পান খেতে গিয়ে দশ টাকার নোটে এগিয়ে দেয়। বাকি টাকাটা মইনা ফিরিয়ে দেয় না। কেউ চায় না।

কিছুদিন আগে পর্যন্ত দোকানটির অবস্থা ভালই ছিল। বন্ধন প্রতিষ্ঠান থেকে ধার নেওয়া দশ হাজার টাকায় খোলা দোকানটা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সারা মাস ঘর চালানোর পরেও মইনার হাতে বেশ ভালো টাকাপয়সাই থেকে যেত। সেই টাকা দিয়ে মইনা স্কুলের উঁচু ক্লাসে পড়া ছেলেকে টিউশনে দিয়েছিল। নিজের জন্য লক্ষ্মীমপুরের ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টকটকে লাল একজোড়া কাপড় নিয়েছিল। সেই কাপড় পরে কপালে জোড়া সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে বেরোনো মইনাকে একবার না দেখে কেউ থাকতে পারত না। মদনও তাকে দেখে চোখ ফেরাতে পারেনি। মোহিনীবাণে বিদ্ধ মানুষের মতো সে চোখের পলক না ফেলে তার দিকে স্থির  দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। স্বামীর সঙ্গে মদের ঘাঁটিতে পরিচিত হয়ে বাড়িতে আসাযাওয়া করতে শুরু করা মদন ছিল আর্মির জোয়ান। উঁচু লম্বা মানুষটার কোমল চাহনি, মধুর মতো মিষ্টি কথাবার্তায় মইনা গলে গিয়েছিল। মানুষটার কাছে কিছুক্ষণ বসলে তার সমস্ত শরীর শান্ত হয়ে যেত। শ্রাবণ মাসের কাঠফাটা রোদে চাষবাস করে এসে উঠোনের কোণে হরতুকিগাছের ছায়ায় বসে লেবুর জল খেতে যেমন লাগে, ঠিক সেরকম মনে হত। পুরুষের মধ্যেও এত কোমলতা, স্নেহের আকুলতা থাকে! মইনা অবাক হয়েছিল। পুরুষের সঙ্গে প্রথম সম্পর্কে আসা দিনগুলির কথা মনে পড়লে তার শরীরটা ছটফট করে। খরায় বাঙি ফেটে যাওয়ার মতো মাঠে দুপুরের রোদ গায়ে নিয়ে বসে থাকার মতো মনে হয়।

মোটে চৌদ্দ বছরের ছিল সে। আগের দিন রাতে গ্রামের নামঘরে ভাওনা দেখে সন্ধেবেলা ঘুমে তার দুচোখ জড়িয়ে আসছিল। ঘরে ছিল আগের দিন ভাওনা দেখতে আসা অতিথি। তার মাসির দেওর। সন্ধের পরে বাবা দোকানে বেরিয়ে গিয়েছিল। মা কাছেই একটি ঘরে বসে তামোল পানের আস্বাদ নিচ্ছিল। ভাতের হাঁড়ি বসানোর আগে একবার পাড়া বেরিয়ে আসা তার বহুদিনের অভ্যাস। বিছানায় পড়া মাত্র কখন যে দু চোখে ঘুম জড়িয়ে এসেছিল, মইনা বুঝতেই পারল না। সে যখন জেগে উঠল, তার বিছানার চারপাশে ভিড় করেছিল আশেপাশের প্রতিবেশীরা। চমকে উঠে বসে সে দেখছিল, তর্জনগর্জন করতে থাকা মানুষগুলির মধ্যে মাথা নিচু করে বসেছিল তাদের অতিথি। বিশৃঙ্খলভাবে চিৎকার করে মা তাকে চুলে ধরে ঝাঁকুনি দিল। কালসন্ধ্যায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মইনা জানতে পারল না কখন অতিথিকাকা এসে তার বিছানায় উঠল, কীভাবে তার হাত তার জামার ভেতরে ঢুকল। সে গভীর ঘুমে আর অতিথি তাঁর আসুরিক তৃপ্তি নিবৃত্তির চেষ্টা করতেই পুরো ঘটনাটা স্বচক্ষে দেখতে পেল প্রতিবেশী জালতীপিসি। দেখেই পিসি চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করল এবং সমগ্র গ্রামের মানুষ এসে মইনাদের বাড়িতে সমবেত হল। ঘুমের ঘোর কাটার অনেকক্ষণ পরেও মইনা কিছুই বুঝতে পারছিল না। আগের দিন রাতে ভাওনা দেখে ঘুমের ক্ষতিপূরণ করতে গিয়ে সন্ধেবেলা শুয়ে পড়ার দোষে সে কীভাবে ‘মা-বাবার মাথা খেল’, ‘রক্ত খেল’ তা সে বুঝতে পারল না।

গ্রামের মানুষ এটাই সিদ্ধান্ত করল যে বদনামী মেয়েটিকে অতিথি মানুষটার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। চৌদ্দ বছরের মইনার কচি শসার মতো শরীরটাতে তার অজান্তে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকার কৃতিত্বে দেড় কুড়ি পাঁচ বছরের গজেন তার বর হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করল। কেবল এক সপ্তাহের আয়োজন। শাখা-সিঁদুর, পাটের কাপড় পরিয়ে মাসি এসে দেওরের কনে সাজিয়ে মইনাকে নিয়ে গেল। শৈশব থেকে আসা-যাওয়া করা মাসির বাড়িটা মইনার কেমন যেন অপরিচিত বলে মনে হল। আগে মায়ের সঙ্গে আসার সময় আদরযত্ন করা মাসির কর্তৃত্বসুলভ গম্ভীর কথাবার্তায় তার ভয় ভয় করতে লাগল। সবচেয়ে বেশি ভয় হল যখন রাতের বেলা একটা ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে গজেন দরজা বন্ধ করে দিল। মাথা থেকে পা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া একটা আতঙ্কে থর থর করে কাঁপলেও সে বুঝতে পেরেছিল যে তার চিৎকার করা ঠিক হবে না। মানুষটার শরীরে যেন অপদেবতা ভর করেছিল। আগে একবার ঘুমের মধ্যে তার কাপড়ের নিচে চুপি চুপি হাত ঢুকিয়ে দেওয়া মানুষটা এখন সমস্ত শরীর দিয়ে তার শরীরটা লেহন করতে লাগল। মাঠ থেকে চেপায় (মাছ ধরার সরঞ্জাম) ধরে আনা সাদা পুঁটিমাছগুলির মতো মইনার শরীরে আঘাত লাগল, তার মধ্যে যেন নুন ছিটিয়ে দেওয়া হল এবং সর্বশেষে উত্তপ্ত তেলে পড়ে সে ছটফট করতে লাগল। কিন্তু তাকে বাঁচানোর জন্য গ্রামের মানুষ তো দূরের কথা, একই বাড়িতে শুয়ে থাকা মাসিও বেরিয়ে এল না। সকালে মাসির ডাকে তার ওঠার বা চলাফেরার শক্তি ছিল না। মানুষটা তখন বিছানার একপাশে শুয়ে নাক ডাকছিল। তার উলঙ্গ শরীরটার দিকে এক মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে মাসির মুখ হা হয়ে গেল।

–ইস ইস! হে ভগবান। কাঁচা খাওয়া। যা মা স্নান করে নিয়ে শরীরে একটু সরষের তেল মেখে নে। একটু আরাম পাবি।

পরের দিন বিকেলে মইনা মাসির ঘরের মধ্যেই ঢুকে থাকল। রাতে মানুষটা কয়েকবার ডাকল। একবার হাতে ধরে টানাটানিও করল। মইনা  বেরিয়ে এল না। সম্পূর্ণ সাতটি রাত মইনা মাসির বিছানায় ঘুমোল। আটদিনের দিন রাতের বেলা আকণ্ঠ মদ গিলে এসে মানুষটা অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করতে লাগল— ওকে কে বিয়ে করে এনেছে! আমি না আমার দাদা! ও দাদার ঘরে কেন?

মাসি মইনাকে বোঝাল— তুই তার বিয়ে করা স্ত্রী। তোকে বিছানায় চাইলে তোকে যেতেই হবে। তুই এখন যা।

তারপর থেকে প্রতি রাতে মইনা উত্তপ্ত তেলে পড়ে ছটফটায়। সারা রাত মানুষটা তেলে পুড়ে মুচমুচে হওয়া সরপুঠি পরম তৃপ্তিতে জিভ দিয়ে টকাশ টকাশ শব্দ করে খায়। দিনের পরে বছর গড়িয়ে গেল। মানুষটার হুতাশ কমল না। দিনের পর দিন এখানে সেখানে বসে কাটিয়ে দেয়। দাদার রোজগার করে আনা টাকা দিয়ে মইনা ভাত রেঁধে খাওয়ায় এবং গভীর রাত পর্যন্ত সতেজ সরপুঠির স্বাদের নেশায় উন্মত্ত হয়ে থাকে। মইনার বাচ্চা পেটে আসার পরও সে রাতের নেশা ছাড়ার নাম নেয় না। মাসি বলল— পেটের বাচ্চাটাকে বাঁচাতে হলে মায়ের কাছে গিয়ে থাক। এই অনাচারী নির্লজ্জের সঙ্গে থাকলে তুইও মরবি, তোর পেটের বাচ্চাটাও মরবে!

পরের দিনেই মায়ের কাছে চলে যাওয়া মইনা বাচ্চা ছয় মাসের না হওয়া পর্যন্ত সেখানেই রইল।

কোনও কাজ না করে সংসার বৃদ্ধি করা গজেনের ওপরে দাদা বৌদি তিতিবিরক্ত হয়েছিল। অবশেষে একদিন তার পরিবারকে আলাদা খেতে আদেশ করা হল। মইনাকে মাসি বলল— তুই কাজ করা মেয়ে। যেভাবেই হোক সংসারটা চালাবি। বিপদে-আপদে আমি দেখব।

কুড়ি বছর বয়স না হতেই মইনা ভাসুরের হাল বাওয়া নিজের জমিতে ধানের চারা লাগানোর পরে অন্যের জমিতেও কাজ করে। ঘরের নুনভাতের খরচটা বেরিয়ে আসে। মাঝেমধ্যে মাসি কিছু টাকা দেয়। কুড়িতে পা দিয়ে তার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মুক্ত হয়েছিল। বাড়তে বাড়তে সে গজেনের চেয়ে বেশি উচ্চতা লাভ করল। রোদের মধ্যে জমিতে কাজ করে ফিরে আসার সময় তার চালতার বাকলের মতো গাল দুটি সিঁদূরে আমের মতো লাল হয়ে পড়ে। কোমল কলাগাছের চারার মতো কাফ মাসলের কাদা পেছনের খালটিতে ধোয়ার সময়ও গজেন তাকে পেছন থেকে বিরক্ত করার সুযোগটুকু ছাড়ে না। আজকাল সে গজেনকে তিরস্কার করতে ভয় পায় না।

দিনে দুই-তিনবার বিছানায় টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় তো পুরুষ হয়ে ওঠো। বউয়ের রোজগারে খেতে লজ্জা লাগে না!

একদিন মাসি বলল— কত আর ধারদেনা করে চলবি। বাড়ির সামনে একটা দোকান দে। আমিও কিছু টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করব।

মইনা বন্ধন ব্যাঙ্ক থেকে ধার নেওয়া দশ হাজার টাকার সঙ্গে মাসির পাঁচ হাজার টাকা যোগ করে দোকানটা আরম্ভ করল। প্রথমে পান-সুপারি-গুটখা নিয়ে আরম্ভ করা দোকানটায় ধীরে ধীরে তেল, নুন, ডাল, আলুও রাখা হল। কাপাসের চাদর, গামছা রাখা হল। আসলে আশেপাশের পুরুষ মানুষরা মইনার দোকানে এসে খুশি হত। সারা সন্ধেবেলাটা যুবক থেকে আধবয়সি গ্রাহক মইনার দোকানে ভিড় করত। মইনা হাইস্কুলে পড়া ছেলেটিকে টিউশনির জন্য পাঠাল। ছেলেকে নিয়ে একটি স্বপ্নের জাল বুনতে লাগল। এখন সেই জালে পুঁটি-খলসেও নেই। কিন্তু সে জানে একদিন তাতে রুই-বোয়াল ধরা পড়বে।

মইনার কাপড়চোপড় গয়না আদিতে বড় শখ। খরার সময় সে গ্রামে আসা মনিহারি মালের ব্যাপারীর কাছ থেকে সস্তায় ঝলমলে অলঙ্কার কিনে হাত-গলা সাজাত। আশীর্বাদে পাওয়া মাসির কানের দুল ছাড়া তার আর সোনার কোনও অলঙ্কার ছিল না। বন্ধনের ধার শোধ করার পরে সে দুগাছি সোনার চুড়ি বানাল। শহরের বাঙালি একজন সোনারুর গড়ে দেওয়া দুইজোড়া চুড়ি পরে সে তার সঙ্গে মিলিয়ে হাতে বোনা একজোড়া কাপড় পরল। অনেক সময় নিজেকে তাকিয়ে দেখল সে। খোঁপা খুলে গিয়ে লম্বা চুল কোমর পর্যন্ত নেমে এসেছিল। তার সমগ্র দেহে আছড়ে পড়া ফাগুনের রং মনের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল। সেদিনই বিকেলে স্বামীর সঙ্গে মদন প্রথমবারের জন্য তার বাড়িতে এসেছিল।

বাড়িতে নতুন আসা বিদ্যুতের আলোতে মইনাকে দেখে মদন চোখ সরিয়ে আনতে পারছিল না।

মইনাও তাকিয়েছিল। সমবয়সী একটা শক্তসমর্থ যুবককে এই প্রথম সে এত কাছ থেকে দেখতে পেল। তার তুলনায় গজেনকে একজন বুড়োমানুষ বলে মনে হচ্ছিল। বেশি করে মদ খাওয়ার ফলে গজেনকে চল্লিশেই ষাট বছরের মতো দেখায়। মদনের মতো এক যুবকের মদখাওয়ার সঙ্গী সে কীভাবে হতে পারল ভেবে মইনা অবাক হয়েছিল। সেদিন পুরো বিকেলটা মদন সেখানে বসে রইল। যাওয়ার সময় সে সোজাসুজি মইনার চোখের দিকে তাকাল— আমি আবার আসব। কখনও অনুভব না করা একটা শিরশিরে উত্তেজনা মইনার মাথা থেকে পা পর্যন্ত বয়ে গেল।

দুদিন পরে মদন আবার এল। এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই আসতে লাগল। মইনা বিকেলের দিকে দোকান বন্ধ করে তার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। এরপরে সে মদের ভাঁটিটা পেছনের ঘরটাতে নিয়ে এল। মইনা ভাততরকারি রেঁধে ছেলেকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। স্বামী এবং মদনও খায়। বিনা পয়সার মদ পেয়ে গজেন বেহুঁশ না হওয়া পর্যন্ত খেয়ে যায়। গজেন বেহুঁশ হয়ে পড়ার পরে মদন মইনাকে কাছে টেনে নেয়। মইনা বাইরে-ভেতরে কেঁপে ওঠে। পুরুষের স্পর্শ এত কোমল! তার ঠোঁটে, গলায়, বুকে এত মিষ্টি উষ্ণ নিশ্বাসের স্পর্শ! মইনার মনে নেশা ধরে যায়। মধ্যরাতে মদন উঠে যাওয়ার পরেও তার শরীরে মদনের শরীরের গন্ধ ছড়িয়ে থাকে।

একদিন মদনের কথামতো মইনা দুপুরবেলা শহরে গিয়ে পৌঁছাল। সে তাকে একটা রঙিন শাড়ি কিনে দিল। তারপরে একটা সঙ্কীর্ণ গলি দিয়ে একটা ঘরে নিয়ে গেল। সেটা নাকি তার বন্ধুর ঘর। ঘরটিতে তখন কেউ ছিল না। মদন এবং তার নিঃশ্বাসের উত্তাপে ভরে পড়া অন্য কারও জন্য জায়গা ছিল না। সন্ধের পরে বাড়ি ফিরে মইনার দোকান খুলতে, ভাত রাঁধতে  ইচ্ছা করছিল না। তারপরে বেশ কয়েকদিন শহরের মধ্যে সেই সঙ্কীর্ণ ঘরটিতে মদনের সঙ্গে গিয়েছিল। একদিন মদন বলল— আমি তোকে এখান থেকে নিয়ে যাব। অনেক দূরের একটা শহরে আমার বদলি হবে। তুইও আমার সঙ্গে যাবি।

–আমি চলে গেলে বাপু কার সঙ্গে থাকবে? মইনা তার ছেলেকে বাপু বলে ডাকে। মদন এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। তারপরে বলে— ওকেও নিয়ে যাবি। ওকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করে দেব।

এক নতুন স্বপ্নে মইনার মুখ আলোকিত হয়ে পড়ে। সে বাপুকে জড়িয়ে ধরে। তুই শহরের বড় স্কুলে পড়বি। বাপু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। রাতে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তাকে বিছানায় টেনে নিয়ে যাওয়া গজেনের ওপরে সে রাগ করে না।

আমি চলে গেলে মাসি ওকে ভাত দেবে। না খেয়ে মরবে না।

মদন তাকে একটা ছোট মোবাইল ফোন কিনে দিল।‌ সেটা কীভাবে ব্যবহার করতে হয় শিখিয়ে দিল। মইনা আনন্দিত হল। এখন সে সুযোগ বুঝে মদনকে ডেকে আনতে পারবে। সে-ও মইনা বাড়িতে একা আছে কিনা জেনে চলে আসতে পারবে।

একদিন পুরো বিকেলটা মদন চুপ করে বসে ছিল। মইনা বারবার তার কী হয়েছে জিজ্ঞেস করল। মদন মাকড়সার জালে ঘিরে ধরা সিলিংটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল তার টাকাপয়সার টানাটানি চলছে। বোনের বিয়েতে তার সমস্ত সঞ্চিত টাকাপয়সা খরচ হয়ে গেছে। এখন তার টাকার খুব দরকার। মইনা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ধীরকণ্ঠে বলল— আমার হাতে কিছু টাকা আছে। এখন আমার টাকার দরকার নেই। এক মাসের জন্য দোকানের জিনিস কিনে রাখা আছে। তুমি একমাস পরে ফিরিয়ে দিলেই হবে।

–কত টাকা? মদনের কণ্ঠস্বরে ঔৎসুক্য।
–দশ হাজারের মতো আছে।
–সেটা দিয়ে হবে না। আমার বেশি টাকার প্রয়োজন। মদন উঠে গিয়ে জানালাটা খুলে দিল। কিছুক্ষণ বাইরের দিকে তাকিয়ে আবার বন্ধ করে দিল। এক ঝাঁক অন্ধকার ঘরের ভেতরে চলে এল।
–ত্রিশ হাজার টাকা ডাকঘরে আছে— মইনা বলল। সেই টাকাটা সে বাড়িটা ভালো করে সাজিয়ে নেবে বলে রেখেছিল। কিন্তু বাপুকে নিয়ে সে যদি মদনের সঙ্গে চলে যায় বাড়ি কার জন্য সাজাবে। গজেনের বাড়ির প্রয়োজন নেই। সে মাসির এখানে এক কোণে পড়ে থাকবে। কাল ডাকঘরে গিয়ে টাকাটা তুলে এনে সে মদনকে দিয়ে দেবে। কিন্তু মদনের প্রয়োজন এর চেয়েও বেশি টাকার। মই্না কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল। অবশেষে সে সঞ্চিত করে রাখা বাক্সটা খুলে কাপড়ের মধ্যে সযত্নে রাখা কাচের সুন্দর ডিবেটা বের করে এনে মদনকে দিল। ডিবেটার মুখ খুলে মদন থমকে গেল। সে মই্নাকে ধমক দিয়ে উঠল— তোর সোনার কানফুলি, চুড়ি কয়টা আমি নেব বলে কীভাবে ভাবলি? যা গুছিয়ে রাখ এসব।
–এখন পয়সার দরকার হয়েছে। তুমি এইগুলি নিয়ে যাও। পরে আমাকে এর চেয়ে সুন্দর অলঙ্কার গড়িয়ে দিও। মইনা তার চোখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল। মদন তার হাতটা ধরে কাছে টেনে আনল। পুনরায় সেই পরিচিত পরিক্রমা, উষ্ণতা, আবেষ্টন, আলোড়ন, পিষ্টন, যন্ত্রণা, পরিতৃপ্তি, ক্লান্তি।

সময় গড়িয়ে চলল। মইনা কয়েকবার মদনের সঙ্গে শহরে গেল, মদনও তার কাছে আসতে থাকল। শুধুমাত্র সে ধারে দেওয়া টাকাগুলি মই্নার কাছে ফিরে এল না। দোকানের জিনিস কমতে কমতে নাই হয়ে গেল। চুরুট, তামাক, পান, তামোলের বিক্রিটাই কেবল চলতে লাগল। মইনা চিন্তিত হল না। নতুন পরিকল্পনা তার মাথায় ভিড় করে আসছিল। সে যখন মদনের সঙ্গে চলেই যাবে দোকান বাড়িয়ে কী করবে। দরকার নেই, দোকানের জন্য সে আর কোনও জিনিস আনে না। সে প্রতিদিনই মদনকে জিজ্ঞেস করতে থাকে— আমাকে কবে নিয়ে যাবে?

মদন হাসতে হাসতে বলে— খুব শীঘ্রই।

বাড়িতে যাচ্ছি বলে বেরিয়ে যাওয়া মদন ফিরে এসেছে কিনা জানার জন্য মইনা উৎসুক হয়ে ছিল। দশদিন ধরে সে তার কাছে আসছে না। সে ঘরে থাকা অবস্থায় ফোন না করার জন্য মদন বারবার নিষেধ করেছে যদিও, তবু অবশেষে সে আর ধৈ্র্য ধরতে পারল না। কিন্তু বারবার চেষ্টা করা সত্ত্বেও নাম্বারটা লাগল না। এবার ময়না চিন্তিত হল। তার কোনও বিপদ হয়নি তো! অসুখ-বিসুখ, দুর্ঘটনা! কয়েকদিন সে ছটফট করে কাটাল। তারপর একদিন সে তার ব্যারাকে গিয়ে উপস্থিত হল।

একটা লম্বা মানুষ এগিয়ে এসে তার সঙ্গে নানা কথা বলল। মদন বদলি হয়ে গেছে। মানুষটা দূরের কোনও রাজ্যের একটি শহরের নাম করল। সেই সব নাম মইনা আগে শোনেনি। তার মনে থাকল না।

সেদিন বাড়ি ফিরে মইনা অনেকক্ষণ অন্ধকারে বসে রইল। বাড়িতে কিছু চাল ছাড়া আর কিছুই ছিল না। বাপুকে শুধুমাত্র নুন দিয়ে ভাত বেড়ে দিতে গিয়ে তার বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল।

বাপুর টিউশনে যাওয়া বন্ধ হল। পান-সুপারি, চুরুট বিক্রির পয়সায় দুবেলা ভাত জোটানো মইনার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ল। গজেন আজকাল সকাল থেকে রাত দুপুর পর্যন্ত এক মাইল  দূরের শ্মশানটিতে একজন বুড়ো চণ্ডালের সঙ্গে বসে গাঁজার ছিলিম  টানে। কখনও কখনও রাতেও সেখানেই থাকে। একদিন একজন পরিচিত মানুষ তাকে অন্য একজন চণ্ডালের সঙ্গে চিতার মৃতদেহ খোঁচাতে দেখে মইনার কাছে এসে দুঃখ করছিল। কথাটা শুনে মইনা স্তব্ধ হয়ে রইল। যাই হোক, এত বছর নিষ্কর্মা হয়ে থাকার পরে কিছু একটা কাজ করছে। নিজের উপার্জনে এক মুঠো খাচ্ছে।

শহরের একপ্রান্তে নদীর তীরে একটি রিসর্ট খুলেছে। বাপু স্কুল থেকে ফিরে আসার সময় নির্মাণকার্য চলতে থাকা রিসর্টের ভেতরে প্রবেশ করে। বিকেলে সে মায়ের কাছে জায়গাটার বর্ণনা দেয়— গাছ, ফুল, সুন্দর ঘর, প্রকাণ্ড সুইমিং পুল। একদিন সে স্কুল থেকে ফিরে আসতে বিকেল হয়ে গেল। মইনা বারবার জিজ্ঞেস করা সত্ত্বেও ভাল করে বলল না এতক্ষণ কী করছিল। তারপরের দিনও যখন সে বিকেলবেলা দেরি করে বাড়িতে প্রবেশ করল, মইনা তাকে হাতে ধরে বসিয়ে জেরা আরম্ভ করল। বাপু রিসর্টের কাজে ঢুকেছে; গ্রাহকের অর্ডার নিয়ে খাবার জোগান দেওয়া টেবিলবয়। মইনা গায়ের জোরে তাকে একটা চড় কষিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করল। তারপরে অনেকক্ষণ সে চুপ করে বসে রইল। বাপুকে নিয়ে তার স্বপ্নের জালটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তার মধ্যে রুই-বোয়াল দূরের কথা, পুঁটি-খলসেও উঠল না।

একদিন বাপু ঘরে একজন মানুষ নিয়ে এল। সে কাজ করে রিসর্টের সিকিউরিটি গার্ড। বাপু সিরাজুলদা বলে ডাকা মানুষটা উঁচু লম্বা, স্বাস্থ্যবান যুবক। দাড়ি ভর্তি মুখমণ্ডলের মানুষটার চোখ দুটি বড় শান্ত। মানুষটার আনা পুঁটলিটা থেকে একটা মিষ্টি খেয়ে মইনা ভাবল— এখন সে কেবল নেবে, কাউকে কিছু দেবে না। তার সঞ্চিত টাকায় কেনা সোনার অলঙ্কারগুলির কথা মনে পড়ল। এক মুহূর্তের জন্য তার চোখ দুটি দপ করে জ্বলে উঠল।

তারপরে আরও কিছুদিন সিরাজুল এল। প্রতিবারই বাপুর সঙ্গে আসে। আসার সময় প্রতিদিনই কিছু না কিছু নিয়ে আসে। মিষ্টি, ফলমূল। তাকে বসিয়ে বাপু কোথাও চলে গেলেও সে মইনার সঙ্গে বসে থাকে। তার দোকানটির খবর নেয়। ক্বচিৎ কখনও ঘরে আসা গজেনের কথা জিজ্ঞেস করে। বাপুকে একটা  অবৈতনিক স্কুলে ভর্তি করে দেওয়ার কথা বলে। বাপুর বুদ্ধি ভালো। সে ম্যাট্রিক পাশ করতে পারবে। সিরাজুল নিশ্চয় হিসেব-নিকেশ করছে: বসে থাকা চেয়ারটা থেকে পাশের ঘরের মইনার বিছানা পর্যন্ত দূরত্বের হিসেব। মইনাও এখন হিসেবি। ধার করার তার দোকান একটা আছেই। আর দরকার নেই।

কখনও কখনও মইনার রাতগুলি বড় দীর্ঘ মনে হয়। ভাবতে না চাইলেও পুরনো রাতগুলি তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে। কোথা থেকে যে এত গরম আসে। মাঘ মাসের শীতের রাতেও তার শরীর ঘামে ভিজে যায়। সেই সময়ে সে সিরাজুলের কথা ভাবে। তার হিসাব কি মিলছে না! বেশি হিসেবি তো তার হওয়া উচিত ছিল। দেড় কুড়ি দুই বছরের আঁটো-সাঁটো শরীরটা থাকতেও সে হিসেবি হতে পারেনি। সিরাজুলের কী আর এমন আছে! সে তার মুখটা মনে করল। গালের হনু দুটো উঁচু, শক্তিশালী। চুলগুলি শক্ত। বাহু দুটি তার কাজের উপযুক্ত। দেখলেই বন্দুক ধরা হাত বলে মনে হয়। বন্দুক ধরা হাত! সে ওপরের ঠোঁটটা দিয়ে নিচেরটাকে চেপে ধরে। মুখটা কঠিন হয়ে পড়ে।

কল কল করে একটা নদী বয়ে চলেছে। জলগুলি এত নীল। ঝিরঝির করে বাতাস বইছে। নদীর জল ছুঁই ছুঁই অবস্থায় কদমগাছে বসে কে বাজাচ্ছে মোহন বাঁশি! একবার কাছ থেকে দেখতে ইচ্ছা করছে। নদীর জলে একবার ডুব দিতে ইচ্ছা করছে। আঃ গলাটা শুকিয়ে গেছে। জল জল… মইনা জেগে উঠল। তার সমস্ত শরীর, বিছানা ঘামে ভেজা। এত পিপাসা পেয়েছে! সে কষ্ট করে উঠে বসল। দরজায় কেউ ধাক্কা দিচ্ছে। বাপু! পাশের ঘরে বাপু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মইনা দরজা খুলল। সিরাজুল! তার হিসেব মিলেছে তাহলে। এখন রাত কত হল। চারপাশ নিস্তব্ধ। সিরাজুল ভেতরে এল। সব সময়ের মতো তার হাতে একটা পুঁটলি। মইনা স্পষ্টভাবে দেখল প্লাস্টিকের পুঁটলিটার ভেতরে লম্বা বোতল। সে দৌড়ে গিয়ে সিরাজুলের হাত থেকে পুঁটলিটা কেড়ে নিল।

–সব চলবে। কিন্তু এখানে বসে মদ খাওয়া চলবে না! আমার স্বামী শ্মশানে থাকে। আমার স্বামী চণ্ডাল। মদ খেতে হলে শ্মশানে যাবি। আমার ছেলের সঙ্গে মদের কারবার চালাবি না।

ঝনঝন করে ছড়িয়ে পড়া কাচের টুকরোগুলির মধ্যে থেকে লাল জলীয় পদার্থ বেরিয়ে এল। গন্ধটা মইনার পরিচিত নয়। সে সিরাজুলের দিকে এগিয়ে গেল। খসিয়ে ফেলল বুকের কাপাসের চাদর। সিরাজুল যেন চমকে উঠল— ইয়া আল্লাহ!

সে বসে বসে ছড়িয়ে পড়া কাচের টুকরোগুলি কুড়োতে লাগল।

–দিনের বেলা বাপুর কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম। দশটার সময় আমার ছুটি হল। আশেপাশের ফার্মেসিগুলি বন্ধ হয়ে গেছে। দূরে একটি খোলা পেয়ে ওষুধ কিনে আনতে দেরি হয়ে গেল। ফার্মাসির ছেলেটি এক বোতল টনিক দিয়ে পাঠাল। বলেই সে পকেট থেকে একটা  রুমাল বের করে জলীয় পদার্থগুলি মুছতে লাগল। মইনা ঘরের এখানে সেখানে ছিটকে পড়া ওষুধের ফাইলগুলি দেখতে পেল।

মইনা সশব্দে ফুঁপিয়ে উঠল। সিরাজুল কাছে চলে এল। তার কপালে হাত রাখল— ইস জ্বর দেখছি খুব বেশি। মইনার চোখে প্লাবন নামল‌। চৌদ্দ বছর বয়সে এই বাড়িতে আসার পর কত যন্ত্রণার ক্ষণ পার হয়ে গেছে, কিন্তু সে কোনওদিন কাঁদেনি। মাসিক রক্তের স্রোত বয়ে থাকা তার শরীরটাকে যখন গজেন বিছানায় ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে নিয়ে যাচ্ছিল তখনও তার চোখ শুকনো ছিল। অনেক কষ্টে গড়া, অনেক শখের সোনার অলঙ্কারগুলি থেকেও আপন তার মনটা ভেঙেচুরে যখন মদন চলে গিয়েছিল, তখনও ময়না কাঁদেনি।

–অসুখ ভাল হয়ে যাবে, চিন্তা কোরো না। আমি আছি তো।

ভাঙা কাচের টুকরোগুলি দুহাতে কুড়িয়ে নেওয়া সিরাজুল হোসেনের দিকে তাকিয়ে মইনা জোরে জোরে কাঁদতে লাগল।