![sompa](https://i0.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2023/09/sompa.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
স্টেশনমাস্টারের কলম
...তাঁদের সেই প্রশ্রয়ে বলীয়ান হয়েই, আমরা আরও একবার আমাদের চিরাচরিত প্রথার বাইরে যেতে মনস্থ করেছি। সম্পাদকীয়তে আমরা সচরাচর আলোচ্য বিষয়ের অভিমুখ সম্পর্কে কিছু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করে থাকি। কিন্তু এ-সংখ্যায় কেবলমাত্র শিরোনামে ছাড়া বিষয়ের কোনও উল্লেখ আমরা না-রাখার সিদ্ধান্ত করেছি। এ সিদ্ধান্তের পেছনে কোনও নাটকীয়তা নেই। বস্তুত অনুবাদের এত বিচিত্র ও বহুমুখী বিষয়সম্পাতে এই সংখ্যাটি সেজে উঠতে পেরেছে যে, একটি নাতিদীর্ঘ সম্পাদকীয় রচনায় তার পুরোটা আঁটানো মুশকিল হত। বিষয়ভাবনার ক্ষেত্রে একটিই কেবল সূত্র উল্লেখ করার— যা লেখক-নির্বাচনের সময় থেকেই আমাদের অন্যতম সিদ্ধান্ত ছিল— এ-সংখ্যায় লিখবেন কেবল তাঁরাই, যাঁরা নিজেরা হাতেকলমে অনুবাদকর্মের সঙ্গে যুক্ত।...
বছরখানেকেরও বেশি আগে চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের সম্পাদকমণ্ডলীর কোনও একটি বৈঠকে বিষয়নির্বাচন নিয়ে আলোচনায় প্রস্তাব উঠেছিল অনুবাদ-সাহিত্য নিয়ে একটি সংখ্যা প্রকাশের। ভাবা গিয়েছিল, সে হবে এমন একটি সংখ্যা, যেখানে অনুবাদের বিভিন্ন দিক, নানান সমস্যা ও সঙ্কটগুলিকে যেমন চিনতে চেষ্টা করা হবে, তেমনই থাকবে অনুবাদের নানা স্বল্পালোচিত সম্ভাবনার দিকগুলির ওপরে আলো ফেলার প্রয়াস। নানা কারণে বিষয়টি তখন কার্যকর করা যায়নি, কিন্তু তা বলে মাথা থেকে একেবারে বেরিয়েও যায়নি সে ভাবনা। ইতোমধ্যে পত্রিকায় অনুবাদ নিয়ে পৃথক বিভাগ চালু করা গিয়েছে, সেখানে প্রায় নিয়মিত নানা ভাষার সাহিত্যের— মূলত কবিতারই— অনুবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। আমাদের পক্ষে সে ছিল দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো— অনুবাদ-সাহিত্যকে তার প্রাপ্য গুরুত্বের নিরিখে পুরোপুরি না-হলেও অন্তত খানিকটা জায়গা দেওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু, দুধের স্বাদ ঘোলে পুরোপুরি কখনওই মেটে না— যিনি খাচ্ছেন এবং যিনি পরিবেশন করছেন— উভয়েই ফাঁকিটা, মুখে জানান না-দিলেও, বিলক্ষণ টের পান।
নানা প্রসঙ্গে, আরও অনেক এ-যাবৎ-সামলে-উঠতে-না-পারা বিষয়ের প্রসঙ্গে প্রস্তাবিত অনুবাদ সংখ্যাটির প্রসঙ্গও উঠত প্রায়ই, এবং খানিক আলোচনার পর একটি সম্মিলিত দীর্ঘশ্বাস ও পরে-নিশ্চয়-কখনও-হবে সূচক স্তোকবাক্যে নিজেদের অপারগতাকে নিজেদের চোখেই আড়াল করার চেষ্টা চলত।
বিষয়টি সামলে উঠতে না-পারার কারণ ছিল একাধিক। তার মধ্যে প্রধান কারণটি ছিল— যে লেখাগুলি চাই, তার অধিকাংশই সময়ে সংগ্রহ করে উঠতে না-পারা। বেশ কয়েকজন লেখক তাঁদের অপরিসীম ব্যস্ততার মধ্যেও সময় করে আমাদের লেখা পাঠিয়েছিলেন, আবার বেশ কয়েকটি লেখা যেগুলি আমরা চাইছিলাম— এবং যেগুলিকে ছাড়া সংখ্যাটি অসমাপ্ত রয়ে যাবে বলে ক্রমাগত প্রকাশের তারিখ পিছিয়ে দিতে থাকছিলাম— কিছুতেই এসে উঠছিল না। সবকটি-লেখা-হাতে-এলে-তবেই-সংখ্যা-হবে-নচেৎ-নয় গোছের ধনুকভাঙা পণ যে বস্তুত শেষ ঢেউটি চলে গেলে তবেই সমুদ্রস্নানের পরিকল্পনার সামিল— তা অবাণিজ্যিক বাংলা ওয়েবপত্রিকা বিষয়ে ন্যূনতম ওয়াকিবহাল পাঠকমাত্রই বুঝবেন। এদিকে যাঁরা লেখা দিয়ে বসে আছেন তাঁদেরও কেউ কেউ তাগাদা দিচ্ছেন, কেউ বা ঠারেঠোরে লেখাটি তুলে নেওয়ার প্রস্তাবও দিতে শুরু করেছেন। এমনিতেই বাপু তোমরা লেখকদের পারিশ্রমিক দিতে পারো না, তার ওপর লেখা নিয়ে ফেলে রেখেছ… এ কেমন অভদ্রতা?
অভদ্রতা বস্তুতই, কেননা এরকম ক্ষেত্রে নিজেদের অপারগতার জন্য ক্ষমা চেয়ে লেখা ফিরিয়ে দেওয়াই দস্তুর, কিংবা অন্তত বিলম্বের কারণ জানিয়ে কবে প্রকাশিত হবে তার সম্ভাব্য তারিখ অন্তত জানিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমরা দুটোর কোনওটাই করছিলাম না। করছিলাম না, কারণ আমরা সত্যিই ডেট জানতাম না। আমরা অপরিসীম ভাগ্যবান, লেখকদের মধ্যে একজনও শেষাবধি লেখা ফেরত নেননি, উলটে আমাদের বিলম্বে প্রশ্রয় দিয়ে গিয়েছেন। শেষ অবধি যে অনুবাদ-সংখ্যাটি প্রকাশিত হতে পারছে, তার একমাত্র কারণ এই যে, আমাদের দীর্ঘসূত্রিতা তাঁদের সম্মিলিত শুভেচ্ছা ও সহমর্মিতার জোরের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছে। ফলে, যা দেরি তার সব দায় আমাদের; আর সংখ্যাটি প্রকাশের যাবতীয় কৃতিত্ব তাঁদের।
তাঁদের সেই প্রশ্রয়ে বলীয়ান হয়েই, আমরা আরও একবার আমাদের চিরাচরিত প্রথার বাইরে যেতে মনস্থ করেছি। সম্পাদকীয়তে আমরা সচরাচর আলোচ্য বিষয়ের অভিমুখ সম্পর্কে কিছু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করে থাকি। কিন্তু এ-সংখ্যায় কেবলমাত্র শিরোনামে ছাড়া বিষয়ের কোনও উল্লেখ আমরা না-রাখার সিদ্ধান্ত করেছি। এ সিদ্ধান্তের পেছনে কোনও নাটকীয়তা নেই। বস্তুত অনুবাদের এত বিচিত্র ও বহুমুখী বিষয়সম্পাতে এই সংখ্যাটি সেজে উঠতে পেরেছে যে, একটি নাতিদীর্ঘ সম্পাদকীয় রচনায় তার পুরোটা আঁটানো মুশকিল হত। বিষয়ভাবনার ক্ষেত্রে একটিই কেবল সূত্র উল্লেখ করার— যা লেখক-নির্বাচনের সময় থেকেই আমাদের অন্যতম সিদ্ধান্ত ছিল— এ-সংখ্যায় লিখবেন কেবল তাঁরাই, যাঁরা নিজেরা হাতেকলমে অনুবাদকর্মের সঙ্গে যুক্ত। তাঁদের মধ্যে অনুবাদতাত্ত্বিকরা থাকবেন না, থাকবেন মূলত তাঁরা, যাঁরা অনুবাদের সমস্যা ও অনুবাদকের সঙ্কটগুলিকে নিজেদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার নিরিখে জেনেছেন, বুঝেছেন, এবং সেগুলিকে নিজেদের মতো করে অতিক্রম করার চেষ্টায় ব্যাপৃত আছেন। সেদিক থেকে দেখতে গেলে— আমরা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি— এই নিবন্ধগুলির কোনওটিই সত্যের প্রস্তরখোদিত রূপ নয়— বরং অনুবাদশিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের অভিজ্ঞতাসঞ্জাত ‘ওয়ার্কিং ড্রাফট’। হ্যাঁ, আমরা আমাদের লেখকসূচি এবং বিষয়সম্ভারকে একটি সম্মিলিত ঐকতান হিসেবে দেখতে চাইছি যা প্রাণবান ও ক্রমজায়মান— যা এখনও রচিত হয়ে উঠছে এবং যার চূড়ান্ত অবয়বটি এখনও অধরাই।
নবীন ও প্রবীণ অনুবাদকর্মীদের এক আশ্চর্য সম্মেলন আমাদের এই সংখ্যাটিতে— লিখেছেন দত্তাত্রেয় দত্ত, অভিজিৎ মুখার্জি, জি এইচ হাবীব, অরুণাভ সিনহা, তৃষ্ণা বসাক, শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভদীপ বড়ুয়া, পার্থপ্রতিম মণ্ডল, জয়া চৌধুরী, নবনীতা সেনগুপ্ত এবং মুম রহমান। তাঁদের সকলকে ও প্রত্যেককে আমাদের আভূমিনত কৃতজ্ঞতা। পৃথক উল্লেখের দাবি রাখে অধুনা প্রাগ-নিবাসী কবি নিরুপম চক্রবর্তীর নেওয়া ফিনল্যান্ডের কবি হান্নেলে পোহ্ইয়ানমিসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার। সে-দেশের এসপো শহরে বসে গত দু-দশকেরও বেশি সময় ধরে হান্নেলে নিরবচ্ছিন্নভাবে রবীন্দ্রনাথের কবিতা অনুবাদ ও বই আকারে প্রকাশ করে চলেছেন ফিনিশ ভাষায়। তাঁর এই নিবিষ্ট রবীন্দ্রচর্চা বিষয়ে আমরা এখনও অনবগতই থাকতাম, যদি নিরুপম চক্রবর্তী তাঁর অনুবাদকর্মের সঙ্গে অত্যন্ত যত্নে আমাদের পরিচয় ঘটিয়ে না-দিতেন। ধন্যবাদ প্রাপ্য সমসময়ের অন্যতম সাহিত্যিক ও অনুবাদক তৃষ্ণা বসাকেরও, যিনি নিজদায়িত্বে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখা আমাদের জন্য সংগ্রহ করে দিয়েছেন। সঙ্গে রয়েছে মলয়ালি ভাষার লেখক এস হরিশ-এর উপন্যাস মিশা-র অনুবাদের প্রথম পর্ব, যা ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য। উপন্যাসটি এই সংখ্যা থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে। রইল শীর্ষা ও শত্তীশ্বরনের করা তামিল কবি সুকীর্তরানির কবিতার অনুবাদ, মূল তামিল থেকে করা। সোহেল ইসলাম অনুবাদ করেছেন প্যালেস্তিনীয় কবি মোসাব আবু তোহা-র কবিতা; মহাশ্বেতা আচার্য অনুবাদ করেছেন স্পেনীয় কবি লিওন ফেলিপে-র কবিতা। গল্প বিভাগেও আমরা রেখেছি তিনটি অনূদিত গল্প। লায়লী দাসের মূল ওড়িয়া থেকে অনুবাদে বিভূতি পট্টনায়কের গল্প; বাসুদেব দাসের মূল অসমিয়া থেকে অনুবাদের মনোজ কুমার গোস্বামীর গল্প; এবং সৈকত ভট্টাচার্যের অনুবাদে ইরানি গল্পকার সামাদ বেহরাঙ্গির গল্প। এছাড়াও তৃষ্ণা বসাক অনুবাদ করেছেন মলায়ালি গল্পকার পি কে পারাক্কাদাভুর কয়েকটি অণুগল্প— সেগুলিও রইল আমাদের এই সংখ্যার অণুগল্পের কামরায়। সর্বশেষ যে বিষয়টি উল্লেখ করার, আজ থেকে ৬৬ বছর আগে ‘কবিতা’ পত্রিকায় (পঞ্চদশ বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যা, আষাঢ় ১৩৫৭) প্রকাশিত বুদ্ধদেব বসুর একটি অত্যন্ত মূল্যবান রচনা ‘ইংরেজিতে রবীন্দ্রনাথ’ আমরা পুনঃপ্রকাশ করতে পেরেছি, যা নিঃসন্দেহে এ সংখ্যার উজ্জ্বলতম উদ্ধার।
এ ছাড়া গল্প, কবিতা, ধারাবাহিক রচনা, বিশেষ নিবন্ধসহ আমাদের অন্যান্য বিভাগগুলি যথাযথ প্রকাশিত হল। আশা করব, আপনারা লেখাগুলি যত্নসহকারে পড়বেন ও বরাবরের মতো আপনাদের মূল্যবান মতামত জানিয়ে আমাদের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেবেন।
সংখ্যাটি প্রকাশে বিলম্বের জন্য আরও একবার সনির্বন্ধ ক্ষমাপ্রার্থনাসহ ইতি।
সম্পাদকমণ্ডলীর তরফে,
অভীক ভট্টাচার্য
নমস্কার।
আমি শংকর চ্যাটার্জি। পুরুলিয়ায় থাকি। আমি অনুবাদ করতে ভালোবাসি। কিছু কিছু করেওছি। তবে বিক্ষিপ্ত ভাবে। যখন যেমন ইচ্ছে হয়েছে। এই যেমন মপাঁসা-র নেকলেস গল্পটি এই মুহূর্তেই হাতের কাছে আছে। ইংরাজি থেকে বাংলায়। বা যেমন জয় গোস্বামীর মালতীবালা কবিতাটি, বাংলা থেকে ইংরাজিতে। এখানে কি পাঠাতে পারি? কিভাবে পাঠাতে হয় জানতে চাই।
ধন্যবাদ জানাই।
সম্পাদক, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম
সমীপেষু
আপনি অনুবাদ-সংখ্যা পড়ে মতামত জানাতে বলেছিলেন বলে সসম্ভ্রমে নিবেদন করছি যে যেহেতু আমি নিজে ঐ সংখ্যায় অনুবাদ সম্বন্ধে কিছু লিখেছি, অতএব অন্যান্য লেখকদের সম্বন্ধে সানুপুঙ্খ সমালোচনা লেখা আমার পক্ষে অসমীচীন হবে । কিছু সাধারণ লক্ষণের কথা বরং বলতে পারি, যা অপরের চিন্তার খোরাক জোগালে কৃতার্থ হব । স্থানাভাবে মতামত পর্যায়ক্রমে পাঠাচ্ছি ।
এ-সংখ্যাটির গুরুত্ব সম্বন্ধে কারোর মনে কোনো সংশয় থাকতে পারে না, কাজেই সে-বাবদ প্রাপ্য প্রশংসার বহর আর বাড়াচ্ছি না । বারোজন অনুবাদকর্মীর কাছ থেকে অনুবাদ-সংক্রান্ত প্রবন্ধ সংগ্রহ করা (“আদায় করা” বলাই বোধহয় ভালো) কতটা দীর্ঘায়িত উদ্যমের কাজ, তা অমন কাজ যাঁরা কখনও হাতে নিয়েছেন, মাত্র তাঁরাই বুঝবেন । আমি অল্পবয়সে পত্রিকা প্রকাশ করেছি, এবং অকারণেই নামী-অনামী লেখকদের প্রীতি ও স্নেহভাজন হয়ে পড়ার ফলে লেখা-সংগ্রহে বিশেষ বেগ পাইনি । কিন্তু আপনাদের এই বিশাল উদ্যোগ বরাবর আমার ক্ষমতার বাইরে ছিল বলে এর মূল্য তথা সমস্যা আমি কিছু কম অনুভব করছি না । সাধারণভাবে, আপনাদের পত্রিকার আলোচ্য বিষয়ব্যাপ্তি ও আলোচনার গভীরতা এমনিতেই পাঠকের সমীহ উদ্রেক করে । তার ওপরে অনুবাদসাহিত্যের ওপর এমন একটি ‘রিজার্ভড বগি’ যোগ করে একধরনের অসাধ্যসাধন করেছেন বললে খুব একটা অত্যুক্তি হয় না । প্রকাশিত একাধিক রচনা পড়া নানা কারণে প্রয়োজন ঞ্ছিল ।
এ-সংখ্যায় সবচাইতে সুপাঠ্য লেখাটি নিশ্চয় বুদ্ধদেব বসুর । তাঁর তুলনায় আমার নিতান্ত দীন অবস্থান থেকে যদি কোনো মন্তব্য করতেই হয় তো বলব যে কিছু বাস্তবিক— যাকে বলে concrete— উদাহরণ তিনি দিয়ে রাখলে আমাদের সামনে একটা আদর্শ খাড়া করতে পারতেন । অন্তত, তুলনামূলক কিছু আলোচনা অবশ্যই আমাদের শিক্ষিত করত । ধরে নিচ্ছি যে শুধুমাত্র পরিসরের অভাবেই তিনি মূল লেখাটি যথাসাধ্য সংক্ষিপ্ত রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন ।
এ-মন্তব্য অবশ্য নিরুপম চক্রবর্তীর লেখাটির সম্বন্ধে প্রযোজ্য নয়; কারণ হান্নেলে যে-সব অনুবাদ থেকে ফিন্নিশ অনুবাদগুলি করেছেন, সেগুলি যদি বা আমরা বুঝতে পারি (ইংরিজির ক্ষেত্রে), সেখান থেকে কেমন ফিন্নিশ অনুবাদ কীভাবে হয়েছে, তুলনার মাধ্যমে তা বোঝবার কোনো উপায় আমার মতো ফিন্নিশ না-জানা পাঠকের ছিল না । ফলে বাংলার কবি ও কবিতার প্রতি হান্নেলের সুতীব্র আবেগের পরিচয় পেয়ে বাংলার গৌরববৃদ্ধি নিয়েই খুশি হয়েছি । মোটের ওপর নিরুপম যেমন সুচিন্তিত মুন্সিয়ানায় সাক্ষাৎকারটি পরিচালনা করেছেন, তা আমার প্রশংসনীয় লেগেছে । কিন্তু ঐ একই সমস্যা— বস্তুগত উদাহরণ না-পেলে, অর্থাৎ শিক্ষণীয় উদাহরণ না-পেলে, মন কেবলই খুঁত কাটে ।
এই সূত্রে একটা কথা মনে পড়ল । দীর্ঘকাল অ্যারিস্টটলের পোয়েটিক্স বইটার যে-পুঁথিটা লভ্য ছিল, সেটা গ্রীক পুঁথি নয়, গ্রীক থেকে সিরিয়াক ভাষায় অনূদিত (এবং বিলুপ্ত) কোনো পুঁথির একটি আরবি অনুবাদ (আবু বশিরের করা)। সেই আরবি অনুবাদটির ল্যাটিন অনুবাদই ‘পোয়েটিক্স’ হিসেবে ইয়োরোপে চলিত ছিল । কিন্তু পঞ্চদশ শতকের শেষে যখন একটি গ্রীক পুঁথি পাওয়া গেল, তখন বোঝা গেল, ল্যাটিন পুঁথিটা যে অমন অর্থহীন, তার কারণ সিরিয়া ও আরবের লোকেরা জানতই না যে নাট্য/নাটক বস্তুটা কী ।
আমার লেখাটি সম্বন্ধে মন্তব্য করা অর্থহীন; কারণ ওতে যা-যা ত্রুটি আছে, সেগুলো আমার অবধানের বাইরে আছে বলেই ওখানে রয়েছে । কাজেই আমার পক্ষে সে-সব জানাই অসম্ভব ।
পড়াশোনা আমার অল্প বলেই নিজের বৈদগ্ধ্যে বিমুগ্ধ হবার অবকাশ আমি কখনো পাই নি । তাই নিজেকে শিক্ষিত করার উদ্দেশ্যে আমি খুঁজি এমন আলোচনা, যা প্রয়োগের মাধ্যমে আমাকে তত্ত্ব বুঝিয়ে দেবে । এখানে কেউ কেউ গহন সব বিদেশী তত্ত্বের কথা বলেছেন; কেউ বা প্রকাশনা-জগতের বা অর্থনীতির নানা সমস্যার কথা বলেছেন । কিন্তু সেগুলি তাঁদের নিজেদের অনুবাদকর্মকে ঠিক কী ভাবে প্রভাবিত করেছে, তার কোনো উদাহরণসহ বিশ্লেষণ না-থাকায় আলোচনাগুলি আমায় আলোকিত করেনি ।
বস্তুত, বস্তুগত উদাহরণই, আমার ধারণায়, অপরাপর অনুবাদককে অনুবাদকর্মে কিঞ্চিৎ সাহায্য করতে পারে । একাধিক লেখক/লেখিকা অবশ্য উদাহরণ সহযোগেই আলোচনা করেছেন । অনেকে আবার অনুবাদ-জগৎ ও তার বিভিন্ন দিকের সমস্যা তুলে ধরেছেন । এছাড়া আছে পূর্বোক্ত অনুবাদ-তত্ত্বও । সেগুলি অবশ্যই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার; তবে এককালে আমি এইসব Translation Theories নিতান্ত অল্প যেটুকু নেড়ে দেখতে পেরেছিলুম, তাতেই আমার অনুবাদকর্ম বন্ধ হয়ে গেছিল । তাছাড়া অনুবাদতত্ত্ব জেনে অনুবাদকালে কার্যত কোনো সুবিধে পেয়েছেন, এমন কোনো অনুবাদকও আমি আমার অত্যন্ত সীমিত অভিজ্ঞতার মধ্যে দেখিনি । মানি, অনুবাদকর্মকে সিরিয়াসলি নেওয়াটা আমাদের মতো শখের কলমচির পক্ষে খুবই দরকার; যার জন্য হয়ত তত্ত্বজ্ঞান আবশ্যিক । কিন্তু সে-কাজে আমাদের প্রণোদিত করার জন্য দরকার এমন বাস্তব উদাহরণ, যা স্পষ্ট বুঝিয়ে দেবে যে তত্ত্বজ্ঞানের ‘আগে এবং পরে’-র মধ্যে অনুবাদে কী উন্নতি ঘটছে । বাইরের বইয়ের জগতে তো নয়ই, এমনকি পত্রিকার এই সংখ্যাতেও তেমন কোনো বিশ্লেষণ না-পেয়ে একটু মনমরা লাগছে ।
তত্ত্ব নিয়ে বেশি মাথা ঘামালে কারো কারো গদ্য রচনারীতি স্বচ্ছ ও প্রসন্ন হওয়ার বদলে জট পাকিয়ে যায় । সে-ত্রুটি যে প্রকাশিত রচনাগুলির কোনোটিতেই নেই, সে-কথা বলতে পারছি না । অতিদীর্ঘ বাক্যবন্ধে অন্বয়ের খেই হারিয়ে ফেলার দরুন অর্থ স্পষ্ট হচ্ছে না— অর্থাৎ প্রসাদগুণের নিতান্ত অভাব ঘটছে— এমন নমুনা একেবারে বিরল নয় । বিবিধ ভাবনাঋদ্ধ একটি চিন্তার জট ছাড়িয়ে তাকে সুবোধ্য রূপে পরিবেষণ করাটা যে গদ্যলেখকের অন্যতম দায়িত্ব, এ-কথাতে বোধহয় কেউই আপত্তি করবেন না । তাছাড়া অত্যন্ত দরকারি একটা কথা— যা অনেকেই বলেছেন— যে, অনুবাদ করতে গেলে বিশেষত মাতৃভাষায় সবিশেষ অধিকার প্রয়োজন— সে-কথাটা এক-আধজন প্রবন্ধকার আরেকটু বেশি খেয়াল রাখলে প্রবন্ধপাঠে সুখ বাড়ত । (এরপর দ্বিতীয়াংশ দেখুন)
দত্তাত্রেয় দত্ত ।