তৃষ্ণা বসাক
জয়া মিত্র একবার বলেছিলেন যে একজন অনুবাদকের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল— তাকে নমনীয় এবং শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আর এসবই একজন নারীকে অনুবাদের উপযোগী করে তোলে। কারণ অনুবাদের সারমর্ম হল একটি নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া, যা নারীরা সারাজীবন করে চলেছে
Translation is a mental activity in which a meaning of given linguistic discourse is rendered from one language to another.
মিথিলায় জন্মেছিলেন ভামতী, বিখ্যাত পণ্ডিত বাচস্পতি মিশ্রের স্ত্রী, যাঁকে বাচস্পতি পুথি লিখতে গিয়ে কোনওদিন খেয়ালই করেননি। সেই ভামতী শঙ্করাচার্যের ভাষ্যকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন এবং তাঁর এই অসাধারণ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ পুথির একটি অংশকে ভামতী টিকা হিসাবে নামকরণ করা হয়। আজকের সময়ে জন্মালে ভামতীকে তো অনুবাদকই বলা হত।
সাম্প্রতিককালে মৈথিলি থেকে বাংলায় অনুবাদকদের কথা বলতে গেলে, দুজন মহিলার নামই খুঁজে পাওয়া যাবে, প্রয়াত গৌরী সেন এবং এই লেখক। অন্যান্য ভারতীয় ভাষায়ও অনেক দক্ষ নারী অনুবাদক রয়েছেন। যেমন সরোজিনী কামতানুরকর, নীতা সেন সমর্থ, বন্দনা আলাসে হাজরা, মধুছন্দা মিত্র ঘোষ (মারাঠি), নিলিনা আব্রাহাম, মলিনা রায়, দেবীরানী ঘোষ (মলয়ালম), পুষ্পা মিশ্র, কণিকা বসু, ঈশানী হাজরা, অমিয়া রায় (কন্নড়), সুখলতা রাও, মৈত্রী শুক্লা, রত্না সাহা, মঞ্জুশ্রী রায়, মঞ্জুলা চক্রবর্তী, ভারতী নন্দী (ওড়িয়া), সন্ধ্যা চৌধুরী, রমা ভার্মা, সুস্মিতা দত্ত, মায়া গুপ্ত, লিপিকা সাহা, অর্পিতা পোদ্দার, শম্পা রায় (হিন্দি), মৌসুমি বসু, পম্পা পাল (ভারতীয় ইংরেজি), অমিতা চক্রবর্তী, সুকুমারী ভট্টাচার্য, গৌরী চট্টোপাধ্যায়, ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায় (সংস্কৃত), শ্যামলী দেবী, রঞ্জিতা সরকার, পূর্বা দাস (মণিপুরি), সুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় (তেলুগু), বীণা মিশ্র, নন্দিতা ভট্টাচার্য (অসমিয়া), জয়া মিত্র (রাজস্থানি ও পাঞ্জাবি), মিতা দাস (হিন্দি, রাজস্থানি) অরুণা মুখোপাধ্যায়, সঞ্চারী সেন (উর্দু), সেবন্তী ঘোষ (নেপালি), বিতস্তা ঘোষাল প্রমুখ।
এই নারী অনুবাদকদের সম্পর্কে একটি মজার তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁদের বেশিরভাগই ভিন্ন ভাষায় কথা বলা পরিবারে বিয়ে করার পর অনুবাদক হয়ে উঠেছেন। পরিস্থিতি তাঁদের একটি ভিন্ন ভাষা শিখতে বাধ্য করে এবং যা ফলত ভারতীয় অনুবাদক্ষেত্রের উপকারই করেছে। বাংলা থেকে ইংরেজিতে, আমাদের কাছে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের মতো কিংবদন্তি অনুবাদক আছেন যিনি মহাশ্বেতা দেবীর অনুবাদ করেছেন। এটা অনেকেই বলেন যে নারী অনুবাদক নারী লেখকের জন্যে ভাল, তাঁরা পুরুষ লেখকের চেয়ে মূলের প্রতি আরও সুবিচার করতে পারেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় লিপিকা সাহার হিন্দি অনুবাদে বাণী বসুর ‘মৈত্রেয় জাতক’, ভারতী নন্দীর অনুবাদে ‘ইন্দিরা দাশের ওড়িয়া গল্প’, বীণাপাণি মোহান্তির ‘চিত্রিত অন্ধকার’, বিতস্তা ঘোষালের অনুবাদে কমলা দাসের ‘মাই স্টোরি’ কিংবা নন্দিতা ভট্টাচার্যের অনুবাদে অসমিয়া উপন্যাস রূপলেখা দেবীর ‘অন্যত্র বিড়লা দেবী’, প্রার্থনা বড়ুয়ার ‘জটাধারী’-র নাম করা যেতে পারে।
বিখ্যাত লেখক এবং অনুবাদক জয়া মিত্র একবার বলেছিলেন যে একজন অনুবাদকের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল— তাকে নমনীয় এবং শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আর এসবই একজন নারীকে অনুবাদের উপযোগী করে তোলে। কারণ অনুবাদের সারমর্ম হল একটি নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া, যা নারীরা সারাজীবন করে চলেছে।
সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে মূলের ভাবটাকে ধরা। বলছেন পুরস্কারপ্রাপ্ত অনুবাদক রঞ্জিতা বিশ্বাস। তিনি করেছেন অসমিয়া লেখিকা অরূপা পতঙ্গিয়া কলিতার গল্প সঙ্কলন অনুবাদ— দ্য লোনলিনেস অফ হীরা বড়ুয়া।
অনুবাদকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন, এই প্রশ্নের উত্তরে রঞ্জিতা বলেন— অনুবাদ একটা সৃজনশীল প্রক্রিয়া, যেখানে অনুবাদক, লেখক কী বলতে চেয়েছেন আর অন্য ভাষায় এটা কত ভালভাবে বোঝানো যায়— এ দুয়ের মধ্যে ব্যালান্স করেন। সব অনুবাদক পাঠকের কাছে এমনভাবে পৌঁছতে চান যাতে খুব বেশি চেষ্টা না করেই পাঠক মূলের সঙ্গে রিলেট করতে পারেন।
অনুবাদের ইতিহাস বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন মধ্যযুগ থেকে একদম সাম্প্রতিককাল অব্দি সাহিত্যের অনুবাদ বিদ্যাচর্চাকে প্রভাবিত করেছে, আঞ্চলিক ভাষার অগ্রগতি ঘটিয়েছে, এইসব ভাষা ঘিরে গড়ে উঠেছে জাতীয় পরিচয়। ভারতেও অনুবাদ আঞ্চলিক ভাষার উন্নতি এবং সাহিত্যের গরিমা ধরে রাখতে সাহায্য করেছে। একটা নতুন বিদ্যাচর্চার শাখা, ট্রান্সলেশন স্টাডিজ গড়ে উঠেছে বিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে। এই ট্রান্সলেশন স্টাডিজ নামটা দিয়েছিলেন কবি ও অনুবাদক জেমস এস হোমস। ভারতে এই সৃজনশীল শাখা বিশেষ উৎসাহ পেল যখন সাহিত্য একাডেমি পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি ‘ভাষা’ সাহিত্য অনুবাদের মাধ্যমে পাঠকের কাছে তুলে দেওয়ার প্রকল্প হাতে নিল। এখন তো বিশিষ্ট কিছু প্রকাশন সচেতনভাবেই আঞ্চলিক ভাষার সাহিত্য অনুবাদের মাধ্যমে বৃহত্তর পাঠকের কাছে তুলে আনছেন। যে কারণে অনুবাদকরা এখন অনেক বেশি দৃশ্যমান হচ্ছেন এবং তাঁদের নাম প্রচ্ছদে আসছে। এখন তো অনুবাদের জন্যে আলাদা পুরস্কারও আছে। এই সবই অনুবাদের পক্ষে ভাল।
২০১৭-তে রঞ্জিতা অরূপা পতঙ্গিয়ার ‘রিটন ইন টিয়ার্স’ গ্রন্থের জন্যে সাহিত্য একাডেমি অনুবাদ পুরস্কার পান। তাঁর সাম্প্রতিক ‘দা লোনলিনেস অফ হীরা বড়ুয়া’-ও অরূপার লেখা গল্পের সঙ্কলন। কেন বারবার অরূপার কাছে ফিরে আসেন রঞ্জিতা?
অরূপার গল্প তিনি প্রথম পড়েন আশির দশকে অসমিয়া পত্রপত্রিকায়। পড়েই তাঁর মনে হয় এই সময়ের অসমিয়া সাহিত্যের অন্যতম শক্তিশালী কণ্ঠস্বর অরূপা। একটি সাম্প্রতিক ইন্টারভিউতে অরূপা বলেছেন টেলিগ্রাফ ১৯৯৭-তে ‘গ্রান্ডমাজ ফেয়ারি টেল’ বলে যে গল্পটি রঞ্জিতা অনুবাদ করেছিলেন, সেটি তাঁর প্রথম ইংরেজি অনুবাদ। এর পরে তিনি অনুবাদ করেন উপন্যাস অয়নান্ত, যা ডন নামে জুবান থেকে বেরোয় ২০০৪ সালে। এটা পরে হিন্দিতেও অনুবাদ হয়। কলিতার লেখায় আছে শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। তাঁর প্রধান চরিত্রেরা বেশিরভাগই নারী, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে সেই মেয়েদের অবস্থান, তাদের যন্ত্রণা, তাদের অন্তর্জগতের তোলপাড়ের কথা দরদ দিয়ে বলেন। একই সঙ্গে এই নারীরা সাহসী চরিত্র আর নিজেদের শক্তি দিয়ে সবরকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। একজন সাংবাদিক হিসেবে রঞ্জিতা দীর্ঘদিন মেয়েদের ওপর কাজ করেছেন এবং জেন্ডার ইস্যু নিয়ে লিখে চলেছেন আর সেইকারণেই অরূপার লেখা তাঁকে খুব আকর্ষণ করে। আর একটা কারণ হল যেভাবে অরূপা অসমের গাছপালা আর পশুপাখির রূপকের মধ্যে দিয়ে অনুভূতির সূক্ষ্ম দিক তুলে ধরেন। এর ফলে পাঠক তাঁর গল্পে উপন্যাসে মাটির গন্ধ পান।
‘অয়নান্ত’ উপন্যাস অনুবাদের সময় রঞ্জিতা কলকাতায়। সেসময় অরূপা ভুটানের এক প্রত্যন্ত পাহাড়ি জায়গায় অধ্যাপনা করেন, ফোনের লাইন পাওয়া যায় না, মোবাইল তো নেইই। সেইসময় রঞ্জিতা কিছুদিন অরূপার বাড়ি গিয়ে ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করেন লেখকের সান্নিধ্যে থেকে তাঁর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার সুযোগ পেলে মূল লেখার অনেক বেশি গভীরে যাওয়া সম্ভব, তাতে অনুবাদের সুবিধে হয়। কারণ অনুবাদক সমালোচক নয়, তাকে লেখকের আঙ্গিক এবং শব্দভাণ্ডার— এই দুই সম্পর্কেই শ্রদ্ধাবান হতে হয়।
জয়া মিত্র বলেছিলেন একজন অনুবাদকের সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে নম্রতা আর শ্রদ্ধাশীলতা। আর তাইই কি অনুবাদক হিসেবে মেয়েদের একটা বেশি সুবিধে কাজ করে? হয়তো তাই। হয়তো নয়। তবে এটা ঠিক এখন অনেক মেয়েই অনুবাদে নিরলস কাজ করে চলেছেন। তাঁদের কথা মনে রেখেই আগস্ট মাসকে ‘ওম্যান ইন ট্রান্সলেশন’ ঘোষণা করা হয়েছে। এটা একটা বড় জয় নিঃসন্দেহে।
লেখাটির মধ্যে লেখিকার আত্মবিলোপ প্রশংসা দাবি করে । “একজন অনুবাদকের সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে নম্রতা আর শ্রদ্ধাশীলতা।” এঁর রচনায় নিরর্থক তাত্ত্বিক কচকচির ভারিক্কিপনা নেই; ইনি জানেন, লেখকের পাণ্ডিত্যে পাঠকের কোন উৎসাহ নেই– যেটুকু জানার কথা, সেটুকু সে সহজ ভাষাতেই শুনতে চায় । হয়তো আরও একটু আনুপুঙ্খিক আলোচনা– উদাহরণ সহযোগে– থাকলে আমাদের কাছে সামগ্রিক চিত্রটা আরেকটু বর্ণাঢ্য হতো । তবে ‘কাজের কথা’-র মতো ‘কাজের লেখা’-ও সংক্ষিপ্ত ভাষণ দাবি করে । Brevity is the soul of wit!’