Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

১৭তম কলকাতা প্রাইড ওয়াক: যৌন এবং লৈঙ্গিক অধিকারের আন্দোলনের নিরিখে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে?

পাঞ্চালী কর

 



নাট্য ও রাজনৈতিক কর্মী

 

 

 

 

কোভিড এবং লকডাউনজনিত খরা কাটিয়ে এ বছর মানুষ দৈনন্দিন জীবনে ফেরা শুরু করেছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে। স্কুল-কলেজে শারীরিক উপস্থিতি, চলচ্চিত্র উৎসব, মেলা, মিটিং-মিছিল, সবই ল্যাপটপ আর স্মার্টফোনের গণ্ডি পেরিয়ে ফিরছে পরিচিত ছন্দে, আঁকছে নান্দনিক ছবি। এরই সঙ্গে ২০২২-এর প্রায় শেষ লগ্নে অনুষ্ঠিত হল কলকাতা ১৭তম রেইনবো প্রাইড ওয়াক। প্রান্তিক যৌনতা এবং লৈঙ্গিক পরিচয়ের মানুষেরা রামধনু রঙে রাঙিয়ে তুললেন রাজপথ।

লকডাউনের কড়াকড়ি বন্ধ হওয়ার পর LGBTQIA+ কম্যুনিটির বহু মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল এই বছরের প্রাইড ওয়াকের জন্য। কলকাতা প্রাইড এশিয়ার প্রাচীনতম প্রাইড ওয়াকের ঐতিহ্য বহন করে। ১৯৯৯ সালে প্রথম কলকাতা প্রাইড উদযাপন হয়, যার নাম ছিল ফ্রেন্ডশিপ ওয়াক, এবং যার মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রান্তিক যৌন এবং লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষের এজেন্সি প্রতিষ্ঠা এবং এইডস সচেতনতা বাড়ানো। দুই দশকের বেশি সময় জুড়ে কলকাতা প্রাইডে যোগ হয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক প্রেক্ষাপট। কলকাতার প্রাইড বরাবরই বহুত্ববাদের নিদর্শন রেখেছে; সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ নিয়ে বরাবরই সরব থেকেছে। বিভিন্ন সময়ে কলকাতা প্রাইড থেকে উঠে এসেছে রোটি-কাপড়া-মকানের দাবি, রাষ্ট্রীয় শোষণের বিরোধিতা, যৌনকর্মীদের প্রতি সলিডারিটির আহ্বান, এনআরসি-সিএএ বিরোধী স্লোগান, জয় ভীম ধ্বনি। প্রাইডে পরিচালনা এবং অংশগ্রহণ করেন, এমন অনেক মানুষের হয়তো প্রাইডে বহুত্ববাদের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, কিন্তু কলকাতা প্রাইড এবং তার পরিচালক কমিটি কখনওই প্রাইডকে শুধুমাত্র সেলিব্রেশনের একটি অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বেঁধে দেয়নি।

এই বছর প্রাইড ওয়াকের আগে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে LGBTQIA+ কম্যুনিটির মানুষ তাঁদের স্বাধিকার উদযাপন করেন। এর মধ্যে ডায়লগস চলচ্চিত্র উৎসব, ক্যুর্নিভাল (ক্যুয়র কার্নিভাল), স্পোর্টস ইভেন্ট, এবং ক্যুয়র মানুষের বাবা-মায়েদের নিয়ে পেরেন্টস মিট উল্লেখযোগ্য। ২০২২-এর প্রাইড ওয়াক এক বর্ণময় চলমান কার্নিভাল যা শুরু হয় পার্ক সার্কাসে, লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের সামনে থেকে, শেষ হয় পার্ক স্ট্রিটে। LGBTQIA+ কম্যুনিটির মানুষ এবং কম্যুনিটির আ্যলাই-রা আর একবার শহরের রাস্তা দখল করলেন, মুখরিত করলেন নাচে, গানে, স্লোগানে, আজাদির আহ্বানে।

প্রাইড ওয়াক প্রান্তিক যৌনতা এবং লৈঙ্গিক পরিচয় বহন করা মানুষের অনেকাংশের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্ল্যাটফর্ম কারণ সামাজিক, পারিবারিক, কর্মস্থলজনিত চাপের কারণে বহু মানুষ নিজের সত্তা মেলে ধরার সেফ স্পেস বা নিরাপদ পরিসর খুঁজে পান না। আইপিসি ৩৭৭ ধারার অন্তর্ভুক্ত সমকামকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিতকরণ বন্ধ হয় ২০১৯ সালে, কিন্তু আইনি পরিবর্তন এলেও আসল সামাজিক স্বীকৃতি আসে শ্লথ গতিতে, এবং তা অনেক ক্ষেত্রেই নির্ভর করে মানুষের জনতত্ত্বগত বা ডেমোগ্রাফিক অবস্থানের ওপর। অনেকে মনে করেন শহরাঞ্চলে ক্যুয়র কম্যুনিটির মানুষের প্রতি সংবেদনশীলতা বেশি, গ্রামাঞ্চলের তুলনায়। তথ্যগতভাবে এই ভাবনা হয়তো পুরোপুরি ভুল নয়, কিন্তু আমরা, তৃণমূল স্তরের সঙ্গে কাজ করা মানুষেরা জানি যে সংখ্যাতত্ত্বের ঊর্ধ্বে গিয়ে প্রায় প্রতিদিনই শহরাঞ্চল থেকেই খবর আসছে যে সমকামী মানুষ, রূপান্তরকামী মানুষ, এফেমিনেট বা “মেয়েলি” পুরুষ, আ্যন্ড্রোগাইনাস বা পুরুষালি নারী, নন-বাইনারি মানুষ প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের হিংসা এবং বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এই হিংসা কখনও পরিবারের তরফে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, কখনও বা রাস্তায় টোন টিটকারি, কখনও কর্মস্থলে বা পাড়ায় অন্যান্য সদস্য ও প্রান্তিক যৌনতার মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করার চেষ্টা।

যদি যেই তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই আছি, তাহলে তিন দশকের আন্দোলন এবং ৩৭৭ ধারা নস্যাৎ করে যে জিতে যাওয়া, তার থেকে কী পেলাম? পেলাম অনেক কিছু। নিজের ব্যক্তিসত্তার অভিব্যক্তির উপর থেকে “অপরাধী” তকমা মুছল, মানুষের সম্মতির সঙ্গে নিজের বিছানায় কী করবে তার ওপর থেকে রাষ্ট্রের নজরদারি মুছল, চার্চ-কেন্দ্রিক ভিক্টোরিয়ান মূল্যবোধভিত্তিক একটি আইন যার উৎপত্তি ব্রিটিশ আমলে তার হাত থেকে নিষ্কৃতি মিলল, পার্কে রাস্তায় দুজন সমলিঙ্গের মানুষকে এক সঙ্গে হাত ধরে চলাচল করতে দেখে “টাকা না দিলে ৩৭৭ লাগিয়ে ঢুকিয়ে দেব” বলা পুলিশি জুলুম থেকে মুক্তি মিলল। অথচ সমকামী হওয়া বা হাত ধরে হাঁটা কখনওই ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী অপরাধ ছিল না, অপরাধ ছিল “সমকামী যৌনাচার”, অর্থাৎ পায়ু এবং অন্যান্য যৌনাচার যা প্রজননশীল যৌনাচারের পরিপন্থী হিসেবে সনাক্ত করত চার্চ। ৩৭৭ ধারার থেকে নিষ্কৃতি যৌন এবং লৈঙ্গিক অধিকারের আন্দোলনে একটি অন্যতম মাইলফলক অবশ্যই, কিন্তু আইনি পথ চলা এখনও অনেক, অনেক বাকি। আইন সংশোধনের মাধম্যে সমকামিতা স্বীকৃতি পেলেও বিয়ের অধিকার, সন্তান দত্তক নেওয়ার অধিকার, ক্যুয়র পার্টনারের উত্তরাধিকারের অধিকার সহ একাধিক লড়াই জারি রয়েছে। প্রসঙ্গত বিয়ের অধিকার কতটা প্রগতিশীল সেই প্রশ্ন কেউ কেউ তুলে থাকেন, কিন্তু যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই অধিকার যথেচ্ছ উদযাপন এবং নর্মালাইজ করে চলেছে যুগ যুগ ধরে, সেখানে একটি সংখ্যালঘু কম্যুনিটির মানুষের সামনে আইনিভাবে বিয়ে করার নূন্যতম চয়েসটুকু থাকবে না কেন, সেটাই বড় প্রশ্ন।

এছাড়াও রয়েছে কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, এবং সার্বিক মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে সাম্যের লড়াই। এখনও পর্যন্ত এই লড়াইয়ের অভিমুখ এনজিও এবং অন্যান্য সংস্থা-নির্ভর। বিভিন্ন সংস্থা দিনরাত পরিশ্রম করে, নেটওয়ার্কিং করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে, বিভিন্ন ক্যাম্প করে ট্রিটমেন্ট, টিকাকরণের দায়িত্ব নিচ্ছে, বড়সড় চিকিৎসা বা এসআরএসের ক্ষেত্রে ক্রাউডফান্ডিংয়ে সাহায্য করছে, লকডাউনে রেশনের ব্যবস্থা করছে। নিঃসন্দেহে এতে বহু ক্যুয়র মানুষ উপকৃত হচ্ছেন, কিন্তু এই কাজের মডেল দীর্ঘস্থায়ী বা সাস্টেনেবল নয়। যৌন এবং লৈঙ্গিক সংখ্যালঘু মানুষের অধিকারের ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী বদল আনতে গেলে তা হতে হবে সমাজতন্ত্রগত বা সিস্টেমিক। সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক অন্তর্ভুক্তিকরণ অত্যন্ত জরুরি।

এর সঙ্গেই থেকে যায় সামাজিক মর্যাদা, স্বীকৃতির লড়াই। এই লড়াই মানুষের মননের সঙ্গে, যাপনের সঙ্গে। এই লড়াই আরও লেয়ার্ড, আরও কঠিন— কারণ আইন, কানুন, রীতিনীতি এক ঝটকায় খাতায়কলমে বদলে ফেলা যায় বটে, কিন্তু তা দিয়ে সংবেদনশীলতা গড়ে ওঠে না। এই লড়াই সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি, এতে চড়াই-উৎরাই সবচেয়ে বেশি। এই লড়াই যতটা ব্যক্তিগত, ততটাই সামাজিক, ততটাই প্রাতিষ্ঠানিক। সেন্সিটাইজেশন প্রসেস সহজতর করে তোলার কাজটা আমাদের যাপনের একটা অংশ, তা চলতে থাকে অবিরত, বিভিন্ন স্তরে। এই কাজ কখনও প্রেরণাদায়ক তো কখনও বেদনাদায়ক। এই সমস্তটা নিয়ে এগিয়ে যাওয়াই একটা বহতা পরিবর্তনের রাস্তা দেখাতে পারে।

প্রাইডের মূল মিছিল থেকে বেরিয়ে পাশ দিয়ে হাঁটছি, বাইক থামিয়ে দুই ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন কীসের মিছিল? বললাম: প্রান্তিক যৌনতা এবং লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষের অধিকারের দাবি নিয়ে মিছিল? তাঁদের পাল্টা প্রশ্ন: আজাদি আজাদি বলছে, রেইনবো থেকে আজাদি চায়? প্রশ্নের ইন্টেন্ট বা অভিপ্রায় বোঝা গেল স্পষ্টভাবে। মনে মনে বললাম “আপনাদের থেকে আজাদি চায়”, কথোপকথনে ইতি টানার জন্য মুখে বললাম একটু এগিয়ে দেখুন লিফলেট পেতে পারেন। সবিস্তারে লেখা থাকবে তাতে।

আমার এক পরিচিতা কলকাতার নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সিনিয়র সেকশনের ইংরেজি শিক্ষিকা। প্রাইডে যাব শুনে বললেন “সেটা কী?” জেন্ডার এবং সেক্সুয়াল মাইনরিটির মানুষের ফেস্টিভ্যাল শুনে আর কিছু জানতে চাইলেন না, কথা ঘোরালেন। আনকমফোর্টেবল টপিক বলে কথা! এঁরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এটা যদি বুঝতে না পারি, যদি আমাদের পরিচিত পরিসর দিয়ে দুনিয়াটার বিচার করি, তাহলে আমরা নিজেরাও কমফোর্ট জোনের মধ্যেই আবদ্ধ থেকে রঙিন চশমা চোখে এঁটে দুনিয়াটা দেখছি।

ক্যুয়র কথাটার আভিধানিক অর্থ “উৎকট”, এই শব্দটি প্রান্তিক যৌনতা এবং লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষকে কটাক্ষ করার জন্য ব্যবহৃত হত। এই শব্দকেই আমরা রিক্লেইম করেছি আমাদের পরিচয় হিসেবে। আমরা উৎকট, আমরা আলাদা, এবং তৎসত্ত্বেও আমাদের মানবাধিকার, সামাজিক, আইনি অধিকার সমস্ত কিছু অক্ষুণ্ণ থাকে। এই ভিন্নতার মধ্যে একত্ববোধই প্লুরালিজমের উৎস, সংবেদনশীল রাজনীতির উৎস। মানুষের যৌনতা এবং লৈঙ্গিক অধিকারের লড়াই আদ্যোপান্ত রাজনৈতিক।