Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

জঙ্গলের অধিকার রক্ষার জন্য আন্দোলনে নামছেন আদিবাসী জনগণ

উন্মেষ মিত্র

 


গত ২৭ মার্চ লোকসভায় বিল হিসাবে উত্থাপিত হল Forest Conservation (Amendment), 2023। উদেশ্য খুব সাধারণ, গ্রামসভার অনুমোদন না নিয়েই বনের জমি সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার বন্দোবস্ত। খুবই সুকৌশলে রচনা করা হয়েছে কর্পোরেটবান্ধব আইনের খসড়া

 

 

রাজস্থানের ভরতপুর জেলায় অবস্থিত বাঁশি পাহাড়পুর অঞ্চল। ভারতবর্ষের বন আইন অনুসারে এখানে বিগত ২৬ বছর ধরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল খনিজ উত্তোলন সংক্রান্ত সকল কাজ। এখানেই সরকারি অনুমতি নিয়ে শুরু হয়েছে গোলাপি বেলেপাথর উত্তোলনের কাজ। বন আইনকে বুড়ো আঙুল দেখাতে জরুরি বৈঠকে বসেছিলেন  রাজস্থান ওয়াইল্ডলাইফ বোর্ড, নেতৃত্বে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তারপর বৈঠক শেষে ঘোষণা করা হয়েছিল, “বাঁশি-পাহাড়পুর এলাকার ৩টি বনখণ্ড ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, সেই ক্ষতি আর মেরামতযোগ্য নয় বলেই সেখানে খনিজ উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া হল।” তারপর সেই ‘সামান্য’ বনভূমি বদলে ৫.৫৬ বর্গ কিলোমিটার বনভূমির চরিত্র বদল করে গোলাপি বেলেপাথর উত্তোলনের অনুমতিও এসে গেল। কিন্তু এত গোলাপি বেলেপাথর লাগবে কোন কাজে? অনেকদিন পর সংবাদে প্রকাশ হল আসল সত্যি। অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরি হবে এই পাথর দিয়ে। তাই চোখের নিমেষে রুমাল থেকে বেড়ালের মতো বনভূমি হয়ে গেল খনি।

 

দুই.

আমাদের কি সত্যিই পরিবেশ নিয়ে কথা বলার অধিকার আছে? কি বাঁচিয়ে রেখেছি আমরা পরিবেশের? জঙ্গল সাফ করে সাধের শহর বসিয়েছি। সহাবস্থানের নীতি থেকে সরে গিয়ে হত্যা করেছি বন্যপ্রাণীদের। চাহিদার বেশি সম্পদের ওপর ভাগ বসিয়েছি, ছড়িয়ে নষ্ট করেছি, তারপর একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মনে পড়েছে, আরে সব কিছুই তো সাবাড় করে দিয়েছি আমরা! এবার যা কিছু অবশিষ্ট আছে সেটুকু বাঁচানোর গুরুদায়িত্ব আমাদেরই, কারণ আমরা সভ্য, শিক্ষিত, ইংরেজি-জানা প্রাণী। প্রথমেই আমাদের নজর গিয়ে পড়ল জংলি আদিবাসীদের ওপর। ওরা এখনও শিকার করে নাকি! কী অসভ্য! কী অসভ্য! সব ঘৃণ্য অপরাধী। এরা হল গিয়ে ক্রিমিনাল ট্রাইবস। যখন ইচ্ছে হবে এদের তুলে নিয়ে গিয়ে জেলের ভাত খাওয়ানোর বন্দোবস্ত করা হল। জঙ্গলে কাঠ কুড়োলে জেল, মাছ মারলে জেল, মধুর চাক কাটলে জেল। দেশে তখন বিদেশি শাসন। তারপর দেশ স্বাধীন হল। আমরা গিয়ে বসলাম দেশের আইনসভাতে। ততদিনে আমাদের বিবেকের ডাক বলেছে যে এই আদিবাসীদের সঙ্গে অন্যায় হয়েছে। এরা এখন দেশের নাগরিক, তাই আর যাই হোক এদের ক্রিমিনাল ট্রাইব বলা মোটেই ঠিক না। ১৮৭১ সালের ভুল আমরা শুধরেছি ১৯৪৯ সালের আগস্ট মাসে।

কিন্তু জঙ্গলের অধিকার? সে অধিকার আদায় করতে স্বাধীন দেশেও শুরু হয়েছে লড়াই। জান কবুল লড়াই। একদিকে বড় বড় ব্যবসায়ীরা, একদিকে পুলিশ-প্রশাসন, সুদখোর, আর আরেকদিকে মুষ্টিবদ্ধ অদম্য হাতের সারি। অবশেষে সেই দিন, ১৮ ডিসেম্বর, ২০০৬, আমাদের হাত থেকে জঙ্গল উদ্ধার করার দিন। জঙ্গলের ভূমিপুত্রদের অধিকার আদায়ের দিন। আইনসভায় পাশ হয়েছিল The Scheduled Tribes and Other Traditional Forest Dwellers (Recognition of Forest Rights) Act. আদিবাসীরা পেয়েছিলেন তাঁদের ন্যায্য অধিকার। সিঁদুরে মেঘ দেখেছিল বড় ব্যবসায়ী আর তাদের মণিকাঞ্চনে লালিত রাজনৈতিক গোষ্ঠী। “লাঙল যার, জমি তার”-এর মত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, বনভূমির ওপর আদিবাসীদের অধিকার। বহু বছরের উন্নাসিকতার ভুলগুলিকে একটু একটু করে ঠিক করার পথে এগিয়ে ছিলাম আমরা। দিল্লি নয়, বনের অধিকারের ফেরত গিয়েছিল গ্রামসভার হাতে। যে মানুষগুলি কয়েক শতাব্দী ধরে রক্ষা করে চলেছিলেন দেশের সবুজ সম্পদ, জীবন-জীবিকার প্রশ্নে যাঁরা একসময়ে ব্রিটিশ এবং পরবর্তীকালে স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের আইনি ঢাল হিসাবে পাশে দাঁড়িয়েছিল বন অধিকার আইন। সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফসিলের উদ্দেশ্য খানিকটা হলেও সফলতা পেয়েছিল। কিন্তু, চুপ করে বসে ছিল না জঙ্গলের মাফিয়ারা। জারি ছিল তাঁদের সমস্ত ফন্দিফিকির। পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল বিশ্বগুরুর সরকার। আধ শতক ট্রিলিয়ন ডলার ইকোনমির স্বপ্নে মশগুল দেশের সম্পদ লুঠ করার জন্য তাদের সামনে প্রধান অন্তরায় এই আইনের বেড়াজাল। তাই এই বছর ২৭ মার্চ লোকসভায় বিল হিসাবে উত্থাপিত হল Forest Conservation (Amendment), 2023। উদেশ্য খুব সাধারণ, গ্রামসভার অনুমোদন না নিয়েই বনের জমি সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার বন্দোবস্ত। সুকৌশলে রচনা করা হয়েছে Panchayat (Extension to Scheduled Areas) Act (PESA) 1996, National Forest Policy 1988 এবং Forest Right Act, 2006-এর মাধ্যমে গ্রামসভার অনুমোদনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কর্পোরেটবান্ধব আইনের খসড়া। প্রতিবাদে পথে নেমেছে ভূমি অধিকার আন্দোলনের যৌথ সংগঠন ‘ভূমি অধিকার আন্দোলন’। তাঁদের স্পষ্ট কথা, এই বিল ফিরিয়ে নিতে হবে অথবা আদিবাসীস্বার্থ-বিরোধী বিলের অংশগুলির পরিবর্তন করতে হবে। এই দাবি নিয়েই আগামী ৩০ জুন সারা দেশে এই সংগঠন ‘কালা দিবস’ পালন করার ডাক দিয়েছে।

 

তিন.

সরকার আসে সরকার যায়। কিন্তু, বজায় থাকে রাস্তার লড়াই। অফিসার-নবাব-রাজা-আমির-ওমরাহদের বিলাসবহুল শিকারযাত্রা কিংবা ‘পরিবেশবান্ধব শিল্পপতি’ তকমাধারীদের সবুজ ধ্বংসের বুলডোজারের সামনে দাঁড়িয়ে ভারতের বনভূমিকে রক্ষা করেছেন সিধু-কানু-বিরসার উত্তরসূরিরা। ‘দিকু’রা এসেছে নতুন নতুন নাম নিয়ে। প্রতিশ্রুতির ভরা ডালির নিচে ধারালো করাত নিয়ে তারা এসেছে দেশের সম্পদকে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তির হাতে তুলে দিতে। ঠান্ডা ঘরের পরিবেশবিজ্ঞানীরা রাশিবিজ্ঞানের জটিল অঙ্ক কষে জঙ্গলের অধিকার কেন আদিবাসীদের হাতে থাকা উচিত নয় সে বিষয়ে গভীর জ্ঞানবহ ভাষণ দিতে সদা তৎপর। কখনও চাপা সরকারি হুঁশিয়ারি, কখনও বা মিষ্টভাষণ। জাত-উপজাত, গোষ্ঠীর সুড়সুড়ি দিয়ে আদিবাসীদের ঐক্য ভাঙার নিরন্তর চেষ্টা। তাও এখনও অবদমিত কিছু মুষ্টিবদ্ধ হাত। সামনে জোর লড়াই। গ্রামসভার অধিকার রক্ষার লড়াই, বসতভূমি রক্ষার লড়াই, বিশুদ্ধ পানীয় জলের লড়াই, বিশুদ্ধ শ্বাসবায়ুর জন্য লড়াই। দ্রিমি দ্রিমি মাদলের শব্দ জানান দিচ্ছে, সামনে উলগুলান।


*মতামত ব্যক্তিগত