মোদি-শাহের সাত বছরের রাজ: নির্বাধ লুঠতরাজ

সৌমিত্র ঘোষ

 



রাজনৈতিক কর্মী, পরিবেশকর্মী, গবেষক

 

 

 

 

আধিপত্য, হানাদারি ও প্রতিরোধ

এনডিএ ওরফে বিজেপি ওরফে সঙ্ঘ আসলে মোদি-শাহ সরকার সদ্য সাত বছর পেরোল। তার কাজের (বিশেষত না-কাজের) ফিরিস্তি কোভিডকালে দিশি-বিদিশি মিডিয়ায় অহরহ বেরুচ্ছে, গোদি মিডিয়ার পক্ষেও এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এই লেখাটায় সেকারণে সংখ্যাতত্ত্ব বা ইতিমধ্যেই খবর হয়ে যাওয়া বয়ানের মধ্যে বড় একটা ঢুকব না। চালু খবর, জানা ঘটনার পিছনের বিবিধ ক্ষমতাসম্পর্ক, তার বিচিত্র বিন্যাসের রাজনীতির সবটা জানাবোঝার আয়ত্তে থাকে না, সেদিকে নজর দেওয়াটা বোধহয় বেশি দরকার।

সমস্যাটা হল, আমাদের সমাজজীবনের এমন ক্ষেত্র নেই, যেখানে মোদি-শাহ সরকার মারফত রাষ্ট্ৰ ও বড় একচেটিয়া পুঁজির স্যাঙাতি যুগলবন্দির করাল ছায়াপাত ঘটেনি। রাষ্ট্ৰপুঁজির বিরামহীন যুগল হানাদারিতে মোদি-শাহ সময়ের গোদা-রাজনীতি অর্থাৎ রিয়ালপলিটিকের শরীর-আত্মা নির্মিত, যেদিকে তাকানো যায় স্থূল পুরুষ পেশিবহুলতা, নিঃসংশয় আধিপত্য। অবশ্য, তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, মিডিয়াদুনিয়ার চমৎকারে যেমন ঠেকছে, তেমন আসলে নয়, আধিপত্যের আপাত নিরেট প্রাচীরেও সরুমোটা ফাঁকফোকর আছে। বাংলার নির্বাচনে হার বা কোভিডকালে ল্যাজেগোবরে হওয়াটা বড় মিডিয়াঘটনা, সেসব বলছি না। প্রান্তিক দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের জীবন যেখানে যেখানে বিপর্যস্ত হচ্ছে, প্রতিরোধও গড়ে উঠছে। সেই প্রতিরোধ ভাঙার মরিয়া চেষ্টাও চলছে আবার। শ্রেষ্ঠ ফ্যাসিপন্থী কায়দায়, মোদি-শাহ সরকার গত সাত বছর ধরে এমন একটা অবস্থা তৈরি করতে চাইছে, যাতে হামলা-হানাদারির তরঙ্গের পর তরঙ্গের ধাক্কায় প্রতিরোধ ও বিরুদ্ধতার ডাঙা ক্ষয়ে, ভেঙে, অবলুপ্ত হয়ে যায়। ভারতবর্ষের বিপুলসংখ্যক প্রকৃতিনির্ভর মানুষ, বিশেষত আদিবাসী-অরণ্যবাসীদের ধরে, এই লেখাটায় আমরা সেই হামলা-হানাদারির চরিত্র বুঝবার চেষ্টা করব।

মোদি-শাহ জমানার তীব্র রাষ্ট্রপুঁজি হামলার পুঞ্জীভূত অভিজ্ঞতা টাটকা ও চলমান, ফলে মনে হতেই পারে এখন যা ঘটছে যা এই জমানারই বিশেষ, আগে বা অন্যত্র এমন ঘটেনি। ভাবনাটা ঠিক হবে না। এদেশে এখন যা ঘটছে, তার সমান্তরাল ঘটনা বহু ভিনদেশে সহজলভ্য তো বটেই, দেশেও যে এজাতীয় অত্যাচার-আক্রমণ আগে নামেনি, এমন তো নয়। কোনও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক ঘটনা বা ঘটনাস্রোত ঝুপ করে আবির্ভূত হয় না, ইতিহাস-ভূগোলে তার শিকড়বাকড় ঝুরি জটাজাল ছড়ানো থাকে। পরিপ্রেক্ষিত বা কনটেক্সট ব্যাপারটা আমাদের বোঝাজানার ক্ষেত্রে সেকারণে এত গুরুত্বপূর্ণ।

নিওলিবরল পরিপ্রেক্ষিত, নিওফ্যাসিপন্থা

নিওলিব বা নিওলিবরল পরিপ্রেক্ষিত থেকে হালের অবস্থার উদ্ভব, পুষ্টি। পুঁজিতন্ত্রের নানান রকমফের আছে ধরে নিয়ে, আজকের সময়েরটিকে বলা হয় নিওলিব। ব্যবস্থাটি ভারতবর্ষে আদৌ হালের আমদানি নয়, মোদি-শাহের পেটেন্ট নেওয়াও নয়। আশির দশক ও বিশেষত নব্বইয়ের দশকের শেষ দিক থেকে, ‘মুক্ত’ বা ‘বাজার’ অর্থনীতির নামে বিশ্বব্যাঙ্ক এবং আইএমএফ যথা আন্তর্জাতিক অর্থসংস্থাদের প্রত্যক্ষ পরামর্শমাফিক, নির্দেশানুযায়ী বড় করপোরেশনগুলোর কাছে দিশি অর্থনীতি হাট করে খুলে দেওয়ার পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় প্রক্রিয়া শুরু হয়। জনকল্যাণে রাষ্ট্রের ভূমিকা কমবে, উৎপাদনের মূল ক্ষেত্রগুলোয় রাষ্ট্রের ভূমিকা ক্রমে শূন্য করে আনার উদ্দেশ্যে চালু আইনকানুন নির্মমভাবে বদলানো হবে। সবচাইতে বড় বদল ঘটবে ব্যক্তি/কোম্পানি-মালিকানাধীন ব্যবসাপাতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে। অর্থাৎ, কীভাবে পুঁজিমালিকেরা ব্যবসা করবেন সে বিষয়ে রাষ্ট্ৰ হয় কিছু বলবে না, নচেৎ কম বলবে, না হলে যা বলবে সর্বদাই পুঁজিমালিকের পক্ষে। রাষ্ট্ৰনীতি ও আইন আধড়মুড়ো বদলের এই পদ্ধতির নাম দেওয়া হল স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট, কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস।

কাজটা শুরু হয়েছিল আশির দশকের গোড়ায়, ভারত যখন আইএমএফ থেকে বিপুল পরিমাণ কর্জ নিচ্ছে। কর্জের যেসব চুক্তি ছিল, তা সেসময়কার রাষ্ট্ৰনীতিকে স্পষ্টতই আরও শ্রমিকবিরোধী ও পুঁজিপন্থী হয়ে উঠতে বাধ্য করে। এতদসত্ত্বেও, নিওলিব বলতে এখন যে বল্গাবিহীন নাফাধান্দার হুড়দৌড়ের কথা মনে আসে, ভারতের অর্থনীতির অবস্থাটা রাতারাতি ওই জায়গায় পৌঁছোয়নি, রাষ্ট্রের লাগাম ক্রমশ আলগা হতে হতে গেছে। এই শ্লথতার নানাবিধ কারণ ছিল। সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর বড় অংশের লাগাতার বিরোধিতা, মাঝখানের একটা বড় সময় ধরে দেশে মিলিজুলি কোয়ালিশান সরকার থাকা, দেশে বিদেশে তথাকথিত ‘খোলা’ অর্থনীতির বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সামাজিক আন্দোলনের চাপ, এবং সর্বোপরি, ২০০৮-এর মহামন্দার অভিঘাত।

অবস্থা খুব যে বদলেছে, তা নয়। তা সত্ত্বেও, ভারতবর্ষে গত সাত বছর ধরে (বিশেষ গত দু বছরে) সরকারি নীতি-আইন ইত্যাদি যেভাবে বদলানো হচ্ছে, বোঝা যায়, রাষ্ট্ৰ কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসের বকেয়া কাজটা যত দ্রুত সম্ভব সেরে ফেলতে চায়। যেহেতু মসনদসই মোদি-শাহ সরকার চরিত্রে ফ্যাসিপন্থী, ইউনিয়নের বাধা বা সামাজিক আন্দোলনের চাপ ইত্যাদি তার কাছে বিশেষ গ্রাহ্য নয় (সামনে ভোট থাকলে অন্য কথা), উল্টোদিকে, পছন্দের পুঁজিমালিকের স্যাঙাতগিরির প্রয়োজনে সে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যাপারটাই পুরো ভুলে যেতে পারে।

নিওলিবরল পুঁজির সঙ্গে ফ্যাসিপন্থী চরিত্রের রাষ্ট্রের মণিকাঞ্চনযোগ ঘটলে, জন বেলামি ফস্টারের সাম্প্রতিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী, নিওফ্যাসিপন্থা জন্মায়। নিওফ্যাসিপন্থায়, মানুষের জীবনজীবিকা, যাবতীয় গণতান্ত্রিক অধিকার ও মূল্যবোধের ওপর নির্বিচার, নির্মম আক্রমণ চলতেই থাকে। বিষয়টা মোটেই কাকতালীয় নয়। কোভিড লকডাউনের মধ্যে নতুন শ্রম কোড ও কৃষি আইন সহ একাধিক নতুন আইন পাশ করানো, গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের সংস্থাগুলোকে বেসরকারিকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া, এর সবটাই আধুনিক পুঁজিবাদের, অর্থাৎ নিওফ্যাসিপন্থী আধিপত্য বিস্তারের অংশ। পুঁজির বিস্তার ও পুঁজিবৃদ্ধির উপযুক্ত পরিস্থিতি তৈরির জন্য, ফ্যাসিপন্থী রাষ্ট্ৰ ও বড় করপোরেশনগুলো ঐতিহাসিক ফ্যাসিপন্থার সময়েও একসঙ্গে কাজ করেছে, এখনও করছে।

লুঠপন্থা ও মোদি-শাহ শাসিত রাষ্ট্ৰ

নিওলিবরল পুঁজিতন্ত্রের যে আগ্রাসী, আপাত-অপ্রতিরোধ্য প্রকাশ সচরাচর আমরা দেখে অভ্যস্ত, তার নির্যাস আহরণ বা এক্সট্রাকশান, সাদা বাংলায় লুঠ। কথা উঠতে পারে, এ আর নতুন কী, পুঁজিমালিকের দল চিরকালই লুঠ করে থাকে, লুঠ না থাকলে পুঁজিপন্থাও থাকে না। ঠিক, কিন্তু সাম্রাজ্যবিস্তার ও উপনিবেশ তৈরির ঐতিহাসিক পর্বে পুঁজি ঠিক যে কায়দায় যেভাবে বেড়েছে, পরের দিকে সে অবস্থাটা বদলায়। পুঁজির সঙ্গে রাষ্ট্রের সমীকরণ একবগগা একরৈখিক থাকে না, অবস্থার চাপে রাষ্ট্রের চরিত্রের নানা ফেরবদল ঘটে। বিশেষত, লুঠপন্থী পুঁজিপন্থী রাষ্ট্রের ঔপনিবেশিক চেহারার থেকে উপনিবেশ-উত্তর রাষ্ট্ৰব্যবস্থার চরিত্রগত ফারাক ঘটেছিল। যে সব রাষ্ট্ৰ উপনিবেশবিরোধী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে, তাদের বহু সামাজিক দায়িত্ব বহন করতেও হয়। সামাজিক দায়িত্ব পালন করার যে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি, তার পক্ষে নির্লজ্জভাবে লুঠপন্থী হওয়া সম্ভব নয়, বরং বহু ক্ষেত্রে তাকে অন্তত কাগজেকলমে হলেও পুঁজিমালিক বিরোধী অবস্থান নিতে হয়েছে। ফলে, যে উৎপাদন ব্যবস্থার মাধ্যমে পুঁজিবৃদ্ধি হয়, তার মধ্যেও রাষ্ট্ৰকে ঢুকতে হয়েছে বারবার, ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করতে হয়েছে। নিওলিব রাষ্ট্ৰ কদাচ এমত করবে না। আবার, রাষ্ট্ৰ সরেও যাবে না। রাষ্ট্ৰ থাকবে, অথচ সে ফিরে যাবে পুরনো ঔপনিবেশিক লুঠপন্থায়, পুঁজিমালিক করপোরেশনগুলোকে সাহায্য করবে যাতে লুঠপ্রক্রিয়া নির্বাধ ও নিরঙ্কুশ হতে পারে। এই লুঠ শাসন ও দখল করবে প্রকৃতি, প্রকৃতিনির্ভর সমস্ত উৎপাদনব্যবস্থা, সেই উৎপাদনব্যবস্থার অংশ সমস্ত মানুষী ও না-মানুষী প্রক্রিয়া। জমি জল লুঠ হবে, জঙ্গল ধ্বংস বা দখল, এমনকি দখল হবে জলবায়ু। লুঠ, লুঠ এবং আরও লুঠের এই ব্যবস্থার নাম আহরণমুখী পুঁজিতন্ত্র, এক্সট্রাকটিভ ক্যাপিটালিজম, সংক্ষেপে এক্সট্রাকটিভিজম বা আহরণপন্থা। অর্থাৎ লুঠপন্থা।

মোদি-শাহ-শাসিত ভারতবর্ষে অচিরে লুঠপন্থার পরাকাষ্ঠা দেখা যাবে, ভাবা যেতে পারে। লুঠনিয়ন্ত্রক যে রাষ্ট্রনীতি, আইন এবং আদেশনির্দেশ দেশে ছিল, সেগুলোকে একে একে ছক কষে আস্তাকুঁড়ে পাঠানো হচ্ছে। ফলে, লুঠ এবং লুঠেরাদের বাড়বাড়ন্ত, প্রান্তিক দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের সর্বনাশ।

উপনিবেশের কাল ও জমিদখল

জমির কথা ধরা যাক। ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের হিসাব ছিল, যে জমিতে কারও লিখিতপড়িত অধিকার নেই, তাতে একচ্ছত্র রাষ্ট্রাধিকার, এমিনেন্ট ডমেইন। অধিকার থাকলেও বা কী, রাষ্ট্রের প্রয়োজনের, দাবির সাপেক্ষে সে অধিকার ‘বিরুদ্ধ’ বা অ্যাডভার্স, রাষ্ট্ৰ তা অগ্রাহ্য করতে, প্রয়োজনে দখল বা অ্যাকুয়ার করতেও পারে। সেইমতো, রাষ্ট্রের তরফে জমিদখলকে আইনত বৈধ করে তুলবার জন্য ব্রিটিশ ভারতে একাধিক নতুন আইন তৈরি হয়। তন্মধ্যে অন্যতম, ১৮৯৪-এর কুখ্যাত ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন অ্যাক্ট বা ভূমি অধিগ্রহণ আইন। তার আগেও রাষ্ট্ৰ জমিদখল করেছে। ১৮৬৫-তে প্রথম ভারতীয় বননীতি তৈরি হয়, ১৮৭৮-এ পূর্ণাঙ্গ ভারতীয় বন আইন। তারও আগে, কোম্পানিশাসনের পুরো সময়টাতে, জমি নিয়ে যাচ্ছেতাই চলেছে, নামমাত্র খাজনায় সায়েব ও দিশি জমিদারকূল জমি পেয়েছেন, উর্বরা চাষজমি বা বনভূমিকে খাজনাশূন্য করতে চেয়ে পোড়ো বলে দেখানো হয়েছে। প্রাক-ব্রিটিশ ভারতে বহুস্তরীয় জটিল ভূমিব্যবস্থা ছিল, মুঘলেরা জমি মেপে খাজনা নিত বটে, কিন্তু জমি কে কোথায় কীভাবে ব্যবহার করবে, সে বিষয়ে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ছিল নামমাত্র। সমতল জমিতে চাষিরা স্থায়ীচাষ করতেন, বনভূমিতে আদিবাসীরা জুম চাষ। তারপরেও অনেক বন, অনেক মাঠ পড়ে থাকত, মানুষ ইচ্ছেমতো ডেরা বদলাতেন, চাষজমি বা বনও। যাঁরা বড় নদী উপত্যকার বা উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দা, তাঁরা মাছ ধরতেন। পশুপালকেরা ব্যবহার করতেন ফাঁকা, অব্যবহৃত জমি, পালিত পশুরা চরত। কেউ জমিতে শুধু ঘর বেঁধে থাকতেন, চাষ বা পশুপালন ভিন্ন অন্য কাজ করতেন। এই সব ভূমিব্যবহারের খানিক খানিক লেখাপড়া করেই রাজস্বীকৃত ছিল, ভূমিদানের বিষয়টি ভারতেতিহাসের প্রত্যেক পর্বে উপস্থিত ছিল।

ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতের সমস্ত জমি মেপে ফেলার বিপুল কর্মযজ্ঞ চালানোর জন্য কোম্পানির আমিন ও সার্ভেয়রের দল যখন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে, অনেকাংশেই পুরনো দলিল-দস্তাবেজের উপর তাদের নির্ভর করতে হয়। জমি, জল, জঙ্গল, যা-ই মাপা হোক, মালিকানা এবং অধিকার ঠিক হত হয় পুরনো দস্তাবেজ দিয়ে নয় নিতান্তই সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকর্তার ইচ্ছামতো। প্রায় সব ‘মাপা’ ও সমীক্ষাগ্রস্ত জমিতেই মালিক ও নির্দিষ্ট ব্যবহারকারী থাকত। বাংলা প্রেসিডেন্সি এলাকা, যেখানে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালিয়ে প্রায় সব জমি জমিদারদের হাতে তুলে দেওয়া হয়, সেখানেও ২ নং খতিয়ান বলে একটা ব্যবস্থা থাকত। সেখানে কোন রায়তের কী ধরনের স্বত্ত্ব এবং অধিকার, বিস্তারিত লেখা থাকত। বনের অধিকার, পশুচারণের অধিকার, মাছধরার বা অন্য কোনও কাজের, যথা রেশম কিংবা লাক্ষা চাষ, ইত্যাদির বয়ানের জন্য ২ নং খতিয়ানের প্রয়োজন হত। ভারতের যে যে অঞ্চলে সরকার নিজে প্রজা বসাত বা রায়তওয়ারি ব্যবস্থা ছিল, সে সব জায়গায় চাষ ও বাস্তুজমি বাদ দিয়ে বাকি ফাঁকা অব্যবহৃত জমি (তার ভিতর কমদামি গাছের বনও) হয় সর্বসাধারণের বা কমন্স, নচেৎ অন্য বিশেষ কাজে ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত, যথা পশুচারণ। এই জমিগুলোর সাধারণ পংক্তিনাম ছিল ‘নিস্তার’।

নিস্তার হোক, আর দু নং খতিয়ান হোক, রাষ্ট্রের কাছে প্রয়োজনীয় জমিতে রাশিরাশি ‘বিরুদ্ধ অধিকার’ বা অ্যাডভার্স রাইটস নিয়ে ব্রিটিশ শাসনকর্তারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। চাষ ও বাস্তুজমি নিয়েও সমস্যা। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি এলাকায় ১৮৮৮ সালে যে বেঙ্গল টেনান্সি অ্যাক্ট চালু হয়, তাতে পরিষ্কার বলা ছিল, জমিতে দশ-বারো বছর বসে আছেন এমন কোনও দখলদার বা ব্যবহারকারীকে উচ্ছেদ করা যাবে না, কাগজ থাক না থাক। উনিশ শতকের শেষ দিকে এবং বিশ শতকের প্রথম অংশে জমি বা বন নেওয়ার জন্য ঔপনিবেশিক রাষ্ট্ৰ যে সব নতুন আইন চালু করল, তাতে বিরুদ্ধ অধিকার নির্মূলকরণের নির্দিষ্ট ও নিশ্চিত নিদান ছিল।

উত্তর-উপনিবেশ, না উপনিবেশ চলিতেছে?

উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতেও, “স্বাধীন ও সার্বভৌম” রাষ্ট্ৰ উপনিবেশের আইনকানুনের যথেচ্ছ প্রয়োগ করেছে। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে শিল্পস্থাপন, নগরায়ণ, বড় বড় তাপবিদ্যুৎ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি, বিশাল নতুন সেনাছাউনি পত্তন, রাস্তা তৈরি ও রেললাইন বসানো, ইত্যাদি প্রভৃতি উন্নয়নকাজে চাষজমি, বাস্তুজমি, বন ও পশুচারণ এলাকা নির্বিচারে দখল করা হয়েছে, ফলে সেই সব ভূমিভাগের উপর জীবনজীবিকার কারণে ও সাংস্কৃতিক বিবিধ প্রয়োজনে নির্ভরশীল জনসমুদায় ক্রমাগত উচ্ছেদ হয়েছেন। উপনিবেশের কাল শেষ হয়েও হয়নি, বরং বহুক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় দখলের শারীরিক সীমা বেড়েছে। ভারতবর্ষের বর্তমান রাজনৈতিক সীমার সাপেক্ষে, ব্রিটিশরা মধ্য ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে ‘এক্সক্লুডেড টেরিটরি’ বলে ছেড়ে রেখেছিল। প্রধানত আদিবাসী-অধ্যুষিত সেই সব এলাকায় ব্রিটিশ ভারতের আইনকানুন চলত না, যেমন চলত না দেশীয় রাজ্যগুলোতেও। স্বাধীন দেশের নতুন রাষ্ট্ৰ কিছুই ছেড়ে রাখল না। উল্টে রাষ্ট্রীয় দখলদারির সবচেয়ে বড় শিকার হলেন আদিবাসীরা, এক জীবনে একবার নয়, দুবার তিনবার উচ্ছেদ হয়েছেন এরকম অগুনতি পরিবারের সন্ধান এখনও খুঁজলে পাওয়া যাবে।

প্রতিরোধ ও বি-উপনিবেশিকরণ

উচ্ছেদ ও বনধ্বংসের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের দীর্ঘদিনের লড়াই, পরের দিকে পরিবেশ রক্ষার জন্য দমদার সামাজিক আন্দোলন, এসবের ফলস্বরূপ রাষ্ট্রের আচরণে কিছু আপাত পরিবর্তন আসে। একদলীয় শাসনের জায়গায় বহুদলীয় কোয়ালিশান শাসন চালু হচ্ছিল ক্রমশ, ফলে রাষ্ট্রের সঙ্গে আন্দোলনের দরকষাকষির সুযোগ বাড়ছিল, কোথাও রাষ্ট্রকে মানুষের কথা শুনতে বাধ্য করা যাচ্ছিল খানিকটা। দক্ষিণ-মধ্য-পশ্চিম ভারতের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোকে দেশের সংবিধানের পঞ্চম তফসিলের মধ্যে এনে বিশেষ নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল, উত্তর-পূর্বের বিভিন্ন এলাকায় স্বশাসনের পরিসর তৈরি করার জন্য ছিল ষষ্ঠ তফসিল। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে বিভিন্ন আদিবাসী আন্দোলন ও পরিবেশরক্ষার সংগ্রামের যৌথ মঞ্চ ভারত জন আন্দোলনের উদ্যোগে আদিবাসী স্বশাসনের দাবিতে নতুন লড়াই শুরু হয়। ফলস্বরূপ, পঞ্চম তফসিলভুক্ত এলাকায় পঞ্চায়েতিরাজ চালু করার লক্ষ্যে নতুন এক আইনের জন্ম হয়, সংক্ষেপে যাকে ‘পেসা’ বলা হয়। ১৯৯৬-তে পেসা আইন সংসদে পাস হয়, কিন্তু আইনের নিয়ম(রুলস) তৈরির দায়িত্ব রাজ্যের উপর ছাড়া ছিল বলে সে আইন রূপায়িত হয় না। দশ বছর পর, অরণ্যের অধিকারের দাবিতে ভারতের প্রায় সর্বত্র আদিবাসী-বনবাসী মানুষের যে আন্দোলন গড়ে ওঠে, তার ধাক্কায় ঐতিহাসিক বন অধিকার আইন পাস হয় ২০০৬-এর ডিসেম্বরে। সে বছরেই সংশোধিত হয় বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন। ২০১৩-য় আসে নতুন জমি আইন, যার মাধ্যমে ১৮৯৪-র ঔপনিবেশিক জমি অধিগ্ৰহণ আইনের কার্যত পরিসমাপ্তি ঘটে।

পেসা, বন অধিকার আইন এবং নতুন জমি আইন। সংবিধানের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তফসিল মারফত সংরক্ষিত অধিকার। নতুন আইনগুচ্ছ ও সাংবিধানিক সুরক্ষার মাধ্যমে রাষ্ট্রের কেন্দ্রীভূত ও মাথাভারী ধাঁচটাকে আংশিকভাবে বদলানোর চেষ্টা করা হল। এক অর্থে বলা যেতে পারে, বি-উপনিবেশিকরণ বা ডিকলোনাইজেশান।

কী ছিল? নতুন আইন আসার পরেও কী চলছে আসলে? ঔপনিবেশিক নিয়ম অনুযায়ী, রাষ্ট্ৰ ইচ্ছামতো জমি নেবে, সে জমিতে এমন সব কাজ হবে, যাতে পরিবেশধ্বংস ঘটে, বাস্তু ও জীবিকা থেকে উচ্ছেদ হন হাজার লক্ষ কোটি মানুষ। জমি বলতে বনভূমি, চাষজমি, চারণক্ষেত্র, নদীসমুদ্র বা এমন এলাকা, যা সরকারি হিসেবে অব্যবহার্য, পোড়ো, ওয়েস্ট ল্যান্ড। সবসময় যে পরিবেশ প্রত্যক্ষভাবে ধ্বংস হবে, তা নাও হতে পারে। পরিবেশ বাঁচানো ও বন বাঁচানোর প্রয়োজনেও রাষ্ট্রীয় দখলদারি চলতে পারে। ঔপনিবেশিক ভারতীয় বন আইন ১৮৭৮/১৯২৭ ও পরবর্তীতে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন মারফতও লক্ষ লক্ষ আদিবাসীকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, এখনও হচ্ছে।

নতুন আইনগুলোয় প্রথমবারের মতো জমির উপর স্থানীয় জনসমষ্টির যৌথ অধিকার স্বীকৃত হল। পেসা ও বন অধিকার আইন একসঙ্গে জুড়লে, শুধু পঞ্চম তফসিলভুক্ত এলাকা নয়, দেশের কোনও বনেই তৃণমূল স্তরের গ্রামসভার (গ্রামের প্রাপ্তবয়স্ক অধিবাসীদের জমায়েত) বিনানুমতিতে বনভূমিতে এমন কাজ করা যাবে না, যাতে বন নষ্ট হয়, মানুষ উচ্ছেদ হন বা তাঁদের অধিকার খর্ব হয়। বন বাঁচানো ও পরিবেশ রক্ষার আপাত প্রয়োজনেও অধিকার খর্ব করা বা উচ্ছেদ চলবে না, যতক্ষণ অবধি মানুষ গ্রামসভা ডেকে সম্মতি না দিচ্ছেন। ১৩-র জমি আইন অনুযায়ী, যে কোনও জমি রাষ্ট্ৰ তখনই অধিগ্রহণ করতে পারবে, যখন স্থানীয় গ্রামসভার অন্তত ৮০ ভাগ মানুষ সম্মতি দিচ্ছেন, এছাড়া ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের বিশদ পরিকল্পনাও অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরুর আগেই জানানো হচ্ছে, লোকে মেনে নিচ্ছেন।

আশির দশকে বন ও পরিবেশ রক্ষায় আরও দুটি আইন হয়। প্রথমটা বন সংরক্ষণ আইন, যাতে বলা আছে বনভূমিতে এমন কিছু করা যাবে না যা বনসংক্রান্ত (গাছ লাগানো ইত্যাদি) নয়। দ্বিতীয়টা পরিবেশ সুরক্ষা আইন, যাতে বলা ছিল, পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন কিছু করা যাবে না। অর্থাৎ, যাঁরা বাণিজ্যিক বা অন্য কারণে কোনও প্রকল্প করতে চাইছেন, তাঁদের কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কাছ থেকে বিশদ অনুমতি নিতে হবে, তাঁর আগে পরিবেশ অভিঘাত সমীক্ষা বা ইয়াইএ করাতে হবে। পেসা, বন অধিকার আইন এবং নতুন জমি অধিকার আইনের সঙ্গে এগুলোর মূল পার্থক্য, নতুন আইনগুলোয় ক্ষমতা চলে আসছে প্রান্তিক প্রকৃতিনির্ভর মানুষদের কাছে। আগের আইন দুটোয় যা হবে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায়, মানুষ নিয়ন্ত্রক ভূমিকায় নেই।

লুঠের রাষ্ট্ৰ-অরাষ্ট্র

লেখাটা গুটিয়ে আনা দরকার। তার আগে গোটা দুই-তিন কথা। এক, সাধারণ (ভারতীয় বামপন্থীদের বড় অংশেরও) ধারণা অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে লোকের জমিজায়গা ভিটেমাটি চাঁটি করলে তা ন্যায়সম্মত। রাষ্ট্ৰ জমি নিয়ে টাটা আম্বানি আদি পুঁজিমালিকদের দিলে তা অন্যায় হতেও পারে, তবে সবসময় নয়। যার জমি, তার কাছ থেকে জবরদস্তি নেওয়া যায় কিনা সে প্রশ্নের উত্তর নেই। দুই, লুঠপন্থার কথা যদি বলি, তা ঔপনিবেশিক সময় থেকে চলছে। রাষ্ট্ৰ জমি নিয়ে প্রকল্প করলে তা লুঠ নয়, এটি খোয়াব মাত্র। বর্তমান লেখকের রাষ্ট্রীয় কোম্পানিসমূহ ও তন্নিযুক্ত ঠিকাদার কোম্পানির সঙ্গে নিরন্তর ধস্তাধস্তির অভিজ্ঞতা আছে, জমিজঙ্গল নেওয়ার বা উচ্ছেদ করার ক্ষেত্রে ব্যক্তি-পুঁজিমালিক ও রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রণাধীন কোম্পানির আচরণে প্রায়শই পার্থক্য থাকে না। তিন, নতুন আইনগুলো তৈরি হয়েছে লুঠপন্থার বিরুদ্ধে মানুষের লাগাতার আন্দোলনের চাপে, রাষ্ট্ৰ খুশি হয়ে নিজেকে ডিকলোনাইজ করছিল, আদৌ এমন নয়।

আগেই বলেছি, আন্দোলনের চাপে মোশা সরকার আইন বদলাবে, এটা ধরে নেওয়াটা ঠিক হবে না। বরং যে যে আইন গণ্ডগোলের, যেখানে গ্রামসভা জাতীয় গোলমেলে অনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওপর জমি পাওয়া না পাওয়া নির্ভর করছে, সেগুলোকে রদ করা বা বদলানো বেশি দরকার। নিওলিবরল সময়ের লুঠপন্থায় এজাতীয় খিঁচ থাকা ঠিক নয়। পুঁজি ও প্রকৃতি (যার ভিতরে জমি ও শ্রম দুইই আছে), এ দুয়ের মধ্যে রাষ্ট্ৰ ব্যাগড়াদার রূপে খাড়া থাকবে না, সুতরাং বনপরিবেশ রক্ষা আইনে যা-ই বলা থাক, তৎকাল ছাড়পত্র দিয়ে দিতে হবে। ইয়াইএ যথা যে যে হুজ্জতিতে পুঁজিমালিকের খরচা হয়, সেগুলো ছেঁটে দিতে হবে। অর্থাৎ, লুঠ চালানোর আদর্শ পরিস্থিতি, যাকে কনডিউসিভ এনভায়রনমেন্ট বলে, তৈরি করতে হবে। এসব করতে গিয়ে যদি কিছু আদিবাসী উচ্ছেদ হয়, হোক গে।

মোশা জমানায় আদিবাসীজীবন

মোদি-শাহ জমানায় উচ্ছেদসন্ত্রাস তাড়া করছে ভারতবর্ষের তামাম বনবাসী-আদিবাসীদের। বন্যপ্রাণীপ্রেমী এনজিওকুল আর প্রাক্তন ফরেস্টসাহেবের দল বন অধিকার আইনের বিরুদ্ধে দেশের সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছেন, বক্তব্য বনের মানুষ বেশিটাই অবৈধ দখলকারি, সুতরাং উচ্ছেদযোগ্য। একতরফা শুনানিতে ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারিতে জনৈক বিজেপি-ঘনিষ্ঠ বিচারপতি (হালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রধান) নির্দেশ দিলেন, অবৈধ দখলদার খুঁজে বার করুক সরকার, উচ্ছেদ শুরু হোক। বিপন্ন হয়ে পড়লেন প্রায় কুড়ি লক্ষ আদিবাসী। সরকারি আইনের বিরুদ্ধে মামলা চলছে ২০০৮ থেকে, ২০১৬ থেকে কেন্দ্র আদালতে আইনজীবী পাঠানো বন্ধ করে দিল। সেই মামলা এখনো চলছে, সরকার নিয়মিত আইনজীবী পাঠাচ্ছে না।

দেশের কোথাও বন অধিকার আইন এখনও ঠিকমত চালুই হয়নি। তার আগেই কেন্দ্রের তরফে এই আইন বাতিল করে বন আর বনের জমি বড় কোম্পানিদের হাতে তুলে দেওয়ার ছক তৈরি হচ্ছে। ২০১৮-য় নতুন রাষ্ট্রীয় বননীতি তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেভাবে বড় কোম্পানিদের ডাকা হচ্ছে, নতুন বননীতিতে সে নিদান বনেও। বন অধিকার আইন অনুযায়ী গ্রামসভার আওতায় থাকা বন ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানিদের ইজারা দেওয়া হবে। বড় কাগজকল, জঙ্গলজাত জিনিস যাদের উৎপাদনের জন্য দরকার, দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানাচ্ছিল, অবক্ষয়িত, নষ্ট হয়ে যাওয়া বন, তাদের দেওয়া হোক। কোম্পানিগুলো বলছে দেশে মোটামুটি ২৮০ লক্ষ হেক্টর এরকম ‘নষ্ট’ জঙ্গল রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রক থেকে সব রাজ্যের বন দপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জমি খুঁজতে। ২০১৫তে প্রথম সরকারি নির্দেশিকা বার হয়। করোনা লকডাউনের মধ্যে আবার নির্দেশিকা জারি হয়। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোয়, যথা মধ্যপ্রদেশে, জমি খোঁজা চলছে। বন অধিকার আইন কার্যত বাতিল করার উদ্দেশ্যে, পুরনো ঔপনিবেশিক বন আইনকে হিংস্রতর ও আরও শাস্তিমূলক করে তুলে নতুন খসড়া বন আইন তৈরি হয় ২০১৮-য়। দেশ জুড়ে আদিবাসী আন্দোলনের ফলে, বিশেষত ঝাড়খণ্ড এলাকার পাত্থলগড়ি গণ-বিদ্রোহ পরবর্তী সময়ে, খসড়াটি আপাতত ধামাচাপা।

২০১৫ থেকে ২০২০-র মধ্যে প্রায় ৫৫০০০ হেক্টেয়ার বনভূমি নষ্ট করার সরকারি ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। কত আদিবাসী উচ্ছেদ হয়েছেন, কত জীবিকা নষ্ট হয়েছে হিসাব নেই। প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে এক গুজরাটেই সর্দার প্যাটেলের মূর্তি বসানোর জন্য উচ্ছেদ হয়েছেন ৩০০০-এর বেশি আদিবাসী।

২০২০ সালের কোভিড লকডাউনের মধ্যে, মানুষ জঙ্গল নষ্ট করে দিচ্ছেন এই অজুহাতে একটার পর একটা বন থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হয়েছে: অসমের কাজিরাঙা ও অন্যান্য বন, মহারাষ্ট্রের বিদর্ভের তারোবা ও মেলঘাট, মধ্যপ্রদেশের সাতপুরা, উত্তরপ্রদেশের শোনভদ্র ও দুধোয়া, বিহারের কাইমুর, তেলেঙ্গানা, ওডিশার বহু জায়গায়। হাজার হাজার মানুষের ঘর জ্বালিয়ে, ভেঙে, কোথাও গুলি চালিয়ে লোক মেরে উচ্ছেদযজ্ঞ চলেছে। খালি করা জমিতে প্রকৃতি পর্যটন হবে বা লাভজনক গাছের বাগিচাবন বানানো হবে।

পরিবেশ রক্ষার পুরনো আইন বাতিল করার আগের ধাপে পরিবেশ অভিঘাত সমীক্ষা বা ইআইএ-র নিয়মে বদল আনার চেষ্টা হচ্ছে।

লড়াই চলছে

বনের বাইরে যে সর্বসাধারণের জমি বা কমন ল্যান্ড থাকে, যেখানে ভূমিহীন মানুষ ঘর বাঁধেন, পশুচারণ করেন বা চাষবাসও হয়, সেসব জমিতে হাত পড়ছে। ঝাড়খণ্ড ও উড়িষ্যা ও ছত্তিশগড় যথা লাগোয়া রাজ্যের কমন ল্যান্ড, পেসা ও বন অধিকার আইন মোতাবেক যার পুরোটাই গ্রামসভার সম্পত্তি, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার একসঙ্গে সে সব জমি কোম্পানিদের হাতে তুলে দেবার চেষ্টা করছে বহুদিন ধরে। আদিবাসীদের প্ৰতিরোধের কারণে সর্বত্র জমি নেওয়া সম্ভব হয়নি বটে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় হিংসার ঘটনা পুনরাবৃত্ত হয়েছে: ওডিশার কাশীপুর, কলিঙ্গনগর, নিয়মগিরি, পারাদ্বীপ, ঝাড়খণ্ডের কোয়েলকারো, দুমকা, নেতারহাট, ছত্তিশগড়ের বাইলাডিলা। ২০১৬ নাগাদ ঝাড়খণ্ডের রঘুবর সিং সরকার যখন মুন্ডারি জনগোষ্ঠীর সাধারণ জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করল, আদিবাসীরা আন্দোলনে নামলেন আবার। পেসা ও বন অধিকার আইন অনুযায়ী তাঁদের গ্রাম ও গ্রাম-সন্নিহিত বনএলাকার ওপর পূর্ণ স্বশাসন ঘোষণা করে ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীরা যে পাথ্বলগড়ি বিদ্রোহ শুরু করেন, তা ছত্তিশগড় ও উড়িষ্যায় ছড়িয়ে পড়ে। ঝাড়খন্ডের বিজেপি সরকার বিদ্রোহ দমনে তীব্র নিপীড়ন চালায়। এর পরেও আন্দোলন চলতে থাকে। আন্দোলনের অভিঘাত এত তীব্র ছিল, ২০২০-র বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি হেরে যায়।

বন ও গ্রামের সাধারণ ভূমি বাদ দিলে বাঁচে কৃষিজমি। সেখানেও ২০১৩-র জমি আইনের খিঁচ, গ্রামসভা এবং ৮০ শতাংশ জমিদাতার সম্মতি ইত্যাদির কথা। ২০১৪-য় ক্ষমতায় আসার পরপরই তুরন্ত আইন সংশোধন করে অর্ডিন্যান্স আনা হয়। সংশোধিত আইনে গ্রামসভার ভূমিকা ছাঁটা হয়, ৮০ শতাংশের সম্মতির বিষয়টাও বাদ দেওয়া হয়। ২০১৫-য় লোকসভায় বিল আকারে সংশোধিত আইন পেশ করা হয়। রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না বলে, এবং দেশজুড়ে তুমুল আন্দোলনের ফলে বিলটি অবশেষে তুলে নেওয়া হয়।

গত কয়েক বছর ধরে দেশের তামাম ভূমি-সংঘর্ষ বিষয়ে তথ্যসংগ্রহ ও দস্তাবেজিকরণের কাজ করছেন কিছু সংস্থা ও ব্যক্তি। ল্যান্ডকনফ্লিক্টওয়াচ নামে তাঁরা একটি ওয়েবসাইট চালান, সেখানে বিভিন্ন ও বিচিত্র জমি লড়াইয়ের কথা বলা আছে। আপাতত মোট ৭৯১টা লড়াই যোগাড় করা হয়েছে, ওঁদের হিসেবমতো সেগুলোয় জড়িয়ে পড়েছেন, আক্রান্ত হয়েছেন ৭২ লক্ষেরও বেশি মানুষ। প্রায় ২৯ লক্ষ হেক্টর এলাকা জুড়ে সংঘর্ষ চলছে। লুঠপন্থীরা লুঠের প্রয়োজনে আইনকানুন সংবিধানের য়্যায়সি কি ত্যায়সি করতে পারেন, ওসব তাঁদের জিম্মায়। কিন্তু শুধু আদিবাসী কেন, একতরফা জুলুমবাজি কেউই মুখ বুঁজে দীর্ঘকাল সহ্য করেন না। আগেও করেননি, এখনও নয়।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...