Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কেন ডারউইন চাই?

অশোক মুখোপাধ্যায়

 


বিবর্তনবাদী চেতনা এমনভাবে আমাদের সমগ্র জ্ঞানজগতে অনুপ্রবেশ করেছে যে আমরা যে-কোনও বিষয়ে একটু গুরুগম্ভীর কিছু আলোচনা করতে গেলে প্রায় আনমনেই ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের প্রসঙ্গ টেনে আনি। সে মানুষের কথাই হোক, তার অসুখবিসুখের কথাই হোক, পরিবেশ বা আর্থসামাজিক সমস্যার কথাই হোক। ভূ-উষ্ণায়ণ সম্পর্কে বলতে গেলেও যেমন আমরা সেই শিল্পবিপ্লবের কাহিনি থেকে শুরু করতে চাই, লগ্নি পুঁজির বিশ্বায়ন নিয়ে কথা বলতে উঠেও তিন-চার দশক পেছন থেকে বিশ্ব-অর্থনীতির কথাচালাচালি করতে থাকি। আমাদের তখন খেয়াল থাকে না যে আমরা এতে সেই ডারউইনের চিন্তাধারার গতিপথটাই জীববিজ্ঞানের বাইরের পরিসরেও অনুসরণ করছি

 

পূর্ব-প্রসঙ্গ: বিবর্তনের চার স্তম্ভ

আমরা চার্লস ডারউইন নিয়ে এত কথা বলছি কেন? বিবর্তনের বৈজ্ঞানিক ধারণা নিয়ে কেন এত মাথা ঘামাচ্ছি? স্কুলের দশম শ্রেণিতে ছাত্রদের ডারউইন-তত্ত্ব না পড়ালে বা তারা এটা না শিখলে এমন কী মহাভারত বা ইলিয়াদ অশুদ্ধ হয়ে যাবে যে আমরা প্রায় গেল গেল রব তুলছি? বিজ্ঞানপন্থীদের ডারউইনের প্রতি কি একটু বিশেষ দুর্বলতা বা পক্ষপাতিত্বের ভাব এতে প্রকাশ পাচ্ছে না? ভারতে এবং বাংলাদেশে এই সব প্রশ্নও উঠছে। অবশ্যই ওঠার কথা। আমাদেরও এই জাতীয় প্রশ্নের মোকাবিলা করা দরকার। যথাযথ যুক্তি-তথ্য সহ।

আসুন, সেই চেষ্টা করা যাক।

প্রথমেই যেটা বলা এবং বোঝা দরকার তা হল, সিলেবাস বা কারিকুলাম বলতে আমরা বাংলায় যখন পাঠ্যক্রম বা শিক্ষাক্রম বলি তার মানে কী? ক্রম কেন? কীসের ক্রম?

হ্যাঁ, যা শেখার তাকে ধাপে ধাপে নিম্নতর স্তর থেকে উচ্চতর স্তরে গিয়ে পর্যায়ক্রমিকভাবে জানতে হয় বলেই এর নাম শিক্ষাক্রম। তার মানে নির্দিষ্ট বয়সে ছাত্রদের কিছু জিনিস শেখাতে হয়, যাতে পরবর্তীকালে তারা আরও জটিল জিনিস বুঝতে পারে। নবম-দশম শ্রেণিতে নিশ্চয়ই বিবর্তন তত্ত্বের সব কিছু শেখানো হবে না বা যাবে না। কিন্তু কিছু মৌলিক বা বুনিয়াদি জিনিস তো শেখাতেই হবে।

শেখানো যায়ও।

বিশিষ্ট জিনতত্ত্ববিদ থিওদসিয়াস দবঝ্যান্সকি তাঁর একটি প্রবন্ধে দাবি করেছিলেন, “Nothing makes sense in biology except in the light of evolution— sub specie evolutionis.”[1] মানে হল, জীববিজ্ঞানে আপনি যাই পড়তে যান, বিবর্তনের আলোকে না পড়লে তার কিছুই বুঝতে পারবেন না। কথাটা কিছুকালের মধ্যেই ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সারা বিশ্বের জীববিজ্ঞানের ছাত্রদের কাছে এটা প্রায় বেদবাক্যের মর্যাদা লাভ করেছে।

কেন, একটা অত্যন্ত সহজ উদাহরণ দিয়ে বলি।

ধরুন, দশম শ্রেণির একজন ছাত্রকে আপনি ব্যাঙের জীবনচক্র পড়াচ্ছেন। ব্যাং একটি উভচর প্রাণী। উভচর মানে কিন্তু এরকম নয় যে সে জলেও থাকে, স্থলেও থাকে। যেটা আসে উপর উপর সাধারণ লোকপ্রিয় ধারণা থেকে। উভচর মানে হল, প্রাণীটির জন্ম হয় এবং কিছু দূর পর্যন্ত বড় হওয়ার সময়টা সে থাকে জলে; তার পর এক সময় সে ডাঙায় উঠে আসে। সম্ভাবনা থাকে যে ছাত্রটি প্রশ্ন করবে, ওদের এরকম জীবনচক্র কেন? শুধু জলেই কেন থেকে গেল না, কিংবা, ওদের মা-ব্যাঙেরা স্থলেই কেন ডিম পাড়ে না? আর যদি সে প্রশ্নটা নাও করে, ভাল করে বিষয়টা বোঝাতে হলে আপনাকেই এই প্রশ্নের দিকে তাকে ঠেলে নিয়ে যেতে হবে।

আর যেই না এই প্রশ্নের উত্থাপন হবে— সে যেই করুক— সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে বিবর্তনের প্রশ্নে ঢুকতে হবে, পৃথিবীর ভূত্বকেরও এক সময় স্থলভাগ বলে কিছু ছিল না, পুরোটাই জলে ঢাকা ছিল, তারপর একসময় স্থলভাগের উৎপত্তি হয়; আর সেই ঘটনাক্রমেই জলচর থেকে স্থলচর আসার এক মধ্যবর্তী পর্যায়ে উভচর প্রাণীর উদ্ভবের কথা বলতে হবে; এর মধ্য দিয়ে বিবর্তনের গোড়ায় সমস্ত প্রাণীই কেন জলচর ছিল তা ব্যাখ্যা করতে হবে। All this will make sense only in the light of evolutionary theory of Darwin! উদ্ভিদ ও প্রাণীর সমস্ত প্রশ্নের ক্ষেত্রেই এই ব্যাপারটা লক্ষ করা যায়।

কিংবা, মনে করুন, একজন শিক্ষক জীবনবিজ্ঞানের ক্লাসে উদ্ভিদের পরাগসংযোগ পড়াচ্ছেন, কীভাবে কিছু কিছু পতঙ্গ ফুলের মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে এক জায়গার পুংকেশর থেকে পরাগরেণু পায়ে মাখামাখি করে যেই অন্য ফুলের উপর বসে, কিছু না কিছু রেণু গর্ভকেশরে লেগে যায়। এমন সময় একজন ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার, একটা পোস্নো করব?

—হ্যাঁ, কর, বল কী বলবি।
—আচ্ছা স্যর, সব গাছেরই কি ফুল আছে? যে-কোনও গাছেই কি পতঙ্গরা বসে?

এবার কিন্তু সেই শিক্ষককে বিষয়টা ঠিকঠাক বোঝাতে হলে আবারও বিবর্তনের ঘটনায় ঢুকতেই হবে। উদ্ভিদের অপুষ্পক-সপুষ্পক ভাগাভাগি বোঝাতে হবে। এককালে যে পৃথিবীতে শুধু অপুষ্পকরাই ছিল, সপুষ্পক উদ্ভিদের উদ্ভব যে অনেক পরে এই সেদিন হয়েছে, এরকম অনেক কথা বলতে হবে। অন্যদিকে প্রায় সমকালেই যে পতঙ্গকুলেরও ধাপে ধাপে উদ্ভব ঘটেছে, সেই তথ্যও জানাতে হবে। বুঝতেই পারছেন, এর মানেও আবার সেই দবঝ্যান্সকির মন্তব্যে ফিরে যাওয়া।

বিজেপি-র ক্যাডাররা জানতে চাইতে পারে, এরও কি কোনও বিকল্প নেই? বাংলাদেশের হেফাজতি মৌলবাদীরাও তার খোঁজ চাইতে পারে।

তাদের উদ্দেশে জানিয়ে দিই, আছে। খুব সহজ এবং ভাল বিকল্পই বিদ্যমান।

ডারউইনের বিবর্তনবাদ যদি একান্তই পড়াতে না চান, সেরকম হলে স্কুলছাত্রদের জীবনবিজ্ঞান পড়ানোই বন্ধ করে দিন না! কে বলতে পারে, বিজেপি-র সুচারু পরিচালনায় এনসিইআরটি হয়ত এই সম্ভাবনাও মাথায় রেখেছে। সিলেবাসের বোঝা কমানোর নামেই যখন ডারউইন বাদ পড়েছে, সেই একই অজুহস্তে জীবনবিজ্ঞান নামক পুরো বিষয়টাও বাদ দিয়ে ফেললেই হয়। তাতে সিলেবাস আরও অনেক হালকা হয়ে যাবে। তখন আর দবঝ্যান্সকিরা কে কী বললেন, তা নিয়েও মাথা ঘামাতে হবে না।

তাছাড়া, যত দূর জানা আছে, গণেশের ধড়ে হাতির মুন্ডু স্থাপন কিংবা কর্ণর জন্মকাহিনি বর্ণনায় আপনার জীববিজ্ঞান বা বিজ্ঞান কিছুই পড়তে লাগবে না। শুধু পিএম-এর মতো এবং তাঁর মতে বিশ্বাসটা থাকলেই হবে। ফলে তার জন্যও আর ডারউইনকে লাগছে না। এনসিইআরটি-র দিগ্‌গজ পণ্ডিতরা নিশ্চয়ই এরকম আগুপিছু না ভেবে কাজটা করেননি। ওসব ক্ষেত্রে বিজ্ঞান জানলে এবং মানলেই বরং বিস্তর অসুবিধা।

কী অসুবিধা জানতে চান? প্রথম সমস্যা হবে গণেশের ধড়ে হস্তীমুণ্ডস্থাপনের নাম প্লাস্টিক সার্জারি কী করে হল। দ্বিতীয় সমস্যা হবে, এর সংস্কৃত নাম কী ছিল জানতে চাইলে। এখন পর্যন্ত কেউ সেটা বলতে পারেনি বা খুঁজে পায়নি। আজকাল আবার একদল বলছেন, আরে বাবা, রাইনোপ্লাস্টি বলে একটা জিনিস সেকালে সত্যিই ছিল। আবারও সেই সমস্যা। যদি ছিলই, তার নামও গ্রিক বা রোমান লব্জে কেন হবে? সংস্কৃত শব্দে তা প্রকাশ করা হয়নি? বিজ্ঞানপাঠে এবং উপলব্ধিতে আপনার তখন সন্দেহ জাগতেই পারে, অত প্রাচীনকালের এক-একটি ঘটনার শিরোনাম অশাস্ত্রীয় ম্লেচ্ছ ভাষায় কে রেখেছিল। সেই সন্দেহ আরও গভীরে এগোলে আপনার মধ্যে আরও প্রশ্ন জাগবে, আচ্ছা, বিজ্ঞানের এত বড় একটা কাজ বিজ্ঞানের কোনও পাঠে না থেকে সাহিত্যের পুঁথিতে কেন লেখা হল? সুশ্রুত ছিলেন খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের একজন প্রসিদ্ধ শল্য চিকিৎসক। তিনি একটি বিশাল গ্রন্থও লিখে রেখে গেছেন। তাঁর রচিত সেই পুঁথিতে এটা নেই কেন?

তারপর হয়ত আপনি ভাবতে শুরু করবেন, আচ্ছা, গণেশের ধড়ে যখন হাতির মাথা লাগানো হল, পরস্পরের পেশিগুলো স্নায়ুগুলো শিরা ও ধমনীগুলো আকারে প্রকারে মিলল কী করে? গণেশঠাকুরের হৃৎপিণ্ড মস্তক অভিমুখে যে রক্ত পাঠাল, হাতির মাথা তাকে চিনতে পারল কেমন করে? [ছবি] মানুষের রক্তই যেখানে গ্রুপ না মিলিয়ে একে অপরকে দেওয়া যায় না, এবং দিলে প্রাণসংশয় হয়, সেখানে এটা কি সম্ভব? মহাভারত-আমলে এসব না হয় জানা ছিল না, ফলে ব্যাসদেবের লিখতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু এখনকার দিনে এরকম কথা শিক্ষিত বিজ্ঞান জানা লোকেরা বলে কী করে?

এত সব প্রশ্নের ধাক্কা খেতে খেতে আর সামলাতে সামলাতে তখন আপনি হয়তো বুঝে ফেলবেন, আপনাকে এই ব্যাপারে একটা আস্ত মিথ্যে জিনিস বলা হয়েছে। এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং সেই মিথ্যার একজন অন্যতম ফেরিওয়ালা। আপনার দুদিকের বিশ্বাস তৎক্ষণাৎ সম্পূর্ণ টলে যাবে।

আর এই বিশ্বাস না থাকলে আপনি বুঝবেন, জীববিদ্যা পড়াতে হলে এবং বুঝতে হলে বিবর্তনবাদ পড়ানোটা জরুরি, বাধ্যতামূলক। তবে এই বাস্তব উপযোগিতার দাবি ছাড়াও আরও কয়েকটি কারণ আছে যার জন্য আমরা বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদীরা স্কুলে ডারউইনের জীবন ও তত্ত্ব পড়ানোর কথা বলি।

বিশ্বের বড় মাপের বিজ্ঞানীদের মধ্যে ডারউইনই সম্ভবত একমাত্র যিনি পেশাগতভাবে বিজ্ঞানী ছিলেন না; শুধু তাই নয়, তাঁর এমনকি বিজ্ঞানের কলেজীয় কোনও ডিগ্রিও ছিল না। বাল্যকাল থেকে নিবিড় চিত্তে হাতেকলমে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ, নানারকম কীটপতঙ্গ নিয়ে নাড়াচাড়া এবং সেইসব বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করতে করতেই তিনি প্রথমে একজন সাধারণ বিজ্ঞানকর্মী ও পরে পুরোদস্তুর বিজ্ঞানী হয়ে ওঠেন। তাঁর এই বিজ্ঞানপ্রাণতা এতটাই গভীর ও সদর্থক ছিল যে খুব তাড়াতাড়িই তিনি সেইকালের ইংল্যান্ডের বেশ কয়েকজন পেশাদার বিজ্ঞানীর খুব কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন। কয়েকজন ভূতত্ত্ববিদ তাঁদের ক্ষেত্রবীক্ষণে যাওয়ার সময় চার্লসকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ এবং সে সম্পর্কে খুঁটিনাটি বিবরণ লিখে রাখার ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত যত্নশীল ও মনোযোগী থাকতেন। সেইসব বিষয়ে যা কিছু জানা যাচ্ছে তাকে ধরে রাখার ব্যাপারে নিজেকে দায়বদ্ধ বোধ করতেন, যা সচরাচর এমনকি বিজ্ঞানের সমস্ত ছাত্রদের মধ্যেও অনেক সময় দেখা যায় না। যাঁরা আজকের দিনেও হাতেকলমে বিজ্ঞানশিক্ষা নিতে এবং দিতে চান, তাঁদের কাছে চার্লস ডারউইনের জীবন একটা জীবন্ত পুস্তকের মতো।

তৃতীয়ত, এক জায়গায় তিনি এক অনন্যসাধারণ নৈতিক নৈর্ব্যক্তিক ও বৈজ্ঞানিক মানসের পরিচয় রেখে গেছেন। নতুন কোনও তথ্য পেলে— যা তাঁর সিদ্ধান্তের সঙ্গে মিলে যায়, তার তুলনায় সেইসব তথ্য— যা তাঁর বক্তব্যের বিরোধী বা ভিন্ন, তিনি তাকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। আত্মজীবনীতে লিখেছেন:

অনেক বছর ধরে আমি একটা পরম নীতি অনুসরণ করে এসেছি; তা হল, যখনই আমার সাধারণ সিদ্ধান্তের বিরোধী কোনও প্রকাশিত তথ্য, কোনও নতুন পর্যবেক্ষণ বা চিন্তা আমার নজরে পড়েছে, আমি তৎক্ষণাৎ অবহেলা না করে তাকে সযত্নে টুকে রেখেছি। কেননা, আমি অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, আমাদের নিজস্ব মতে মেলা জিনিসগুলির তুলনায় এরকম তথ্য এবং চিন্তা স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এই অভ্যাসের ফলে আমার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যে সমস্ত আপত্তি উঠেছে তাকে নজর করিনি বা উত্তর দিইনি, এরকম ঘটনা খুবই কম।[2]

তথ্য ও যুক্তির প্রতি এরকম নিষ্ঠা পেশাদার বিজ্ঞানীদের মধ্যেও খুব একটা সুলভ নয়, আর আমাদের মতো সাদামাটা গড়পরতা বিজ্ঞান অনুরাগীদের মধ্যে তো বাস্তবে দেখাই যায় না। স্বাভাবিক প্রবণতা হিসাবে যেটা দেখা যায়, আমাদের নিজস্ব মতের সপক্ষে বললে আমরা যতটা খুশি হই এবং মনোযোগ দিই, তর্কবিতর্কের সময় কাজে লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, বিরুদ্ধে বললে তার এক আনিও আগ্রহ দেখাই না। অথচ, আমরা সকলেই মেনে থাকি যে বিজ্ঞানের নিরন্তর অগ্রগতি সম্ভবই নয় বিভিন্ন চিন্তা এবং যুক্তির মধ্যে সংঘর্ষ না হলে। কেননা, মুখে বললেও আমরা সহজে ভাবতে পারি না বা ভাবতে চাইও না যে আমার ধারণাটা ভুলও হতে পারে। একমাত্র এইভাবে ভাবতে পারলেই তবে অপরের ভিন্নমত শোনার এবং তা থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে নিজের মতের ভুল ত্রুটি সীমাবদ্ধতা সংশোধন করা সম্ভব হতে পারে। সত্যের প্রতি, সত্য জানার প্রতি প্রগাঢ় আস্থা না থাকলে এই মনোভঙ্গি আয়ত্ত করা যায় না। ডারউইনিয়ানা চর্চার এটাও একটা বড় কারণ।

চতুর্থত, বিজ্ঞানের ইতিহাসের পাঠকরা নিশ্চয়ই জানেন, ডারউইনের বিবর্তনবাদ ঊনবিংশ শতাব্দের সবচাইতে সফল একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, যা অনেকরকম পরীক্ষা নিরীক্ষা পর্যবেক্ষণ ও যাচাইয়ের মধ্য দিয়ে এবং বেশ কিছু সংশোধন ও সংযোজনের পরেও দেড় শতাধিক বছর ধরে অত্যন্ত শক্তিশালী একটা দিকনির্দেশ হিসাবে কাজ করে চলেছে। বিজ্ঞানের জগতে এরকম সফল তত্ত্ব খুব বেশি নেই। এই কারণেই আধুনিক সভ্য দুনিয়ায় অন্তত স্কুলস্তরের ছাত্রদেরকে মানবজাতির এই মূল্যবান অর্জনের সঙ্গে একটা ন্যূনতম পরিচিতি ঘটানো বুনিয়াদি শিক্ষার একটা মুখ্য অঙ্গ বলেই গণ্য করা হয়।

আর শেষ কথা, স্মরণ করা দরকার, ডারউইনের তত্ত্ব বিশ্বকে জ্ঞানের বৃহত্তর ক্যানভাসে কী দিয়েছে। একটা চিত্তাকর্ষক জিনিস সন্ধান নিলে জানতে পারব, ডারউইনের দুটো প্রধান গ্রন্থ— প্রজাতির উদ্ভব এবং মানুষের উদ্গমন (Descent of Man)— বেরোনোর পর মানুষের জ্ঞানজগতের প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে এই বিবর্তনবাদী দৃক্‌পাতের একটা স্থায়ী ছাপ পড়ে গিয়েছিল। সাহিত্য সংস্কৃতি ধর্ম দর্শন সঙ্গীত স্থাপত্য ভাস্কর্য চিত্রশিল্প মূর্তিবিদ্যা (iconography) আইন সমাজতত্ত্ব বিবাহ পরিবার রাষ্ট্র ইত্যাদি মানব সংস্কৃতির সমস্ত আনাচেকানাচেই ক্রমবিবর্তনের, ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের একটা খোঁজ শুরু হল। ফরাসি নৃতত্ত্ববিদ মরিশ ব্লশ ১৯৮৩ সালে প্রথম এই দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।[3] আমিও একসময় ডারউইনের “প্রজাতির উদ্ভব” গ্রন্থ প্রকাশের পরবর্তী (১৮৬০-১৯১০) পঞ্চাশ বছর সময়কালে প্রকাশিত একটা নির্বাচিত অসম্পূর্ণ গ্রন্থতালিকা তৈরি করেছিলাম, যার মধ্যে ডারউইন-প্রভাবের শিলমোহর অস্বীকার করা যায় না।[4] পরিশিষ্টে সেই তালিকাটি সকলের পাঠের জন্য তোলা রইল।

এ সম্পর্কে বহু বিশিষ্ট বিজ্ঞানীই নানা সময়ে খুব সুন্দরভাবে কিছু কিছু সুনির্দিষ্ট বক্তব্য রেখে গেছেন। বোঝা যায়, তাঁরা সকলেই এই বিষয়টি নিয়ে ভেবেছেন। তাঁদের মধ্য থেকে স্বল্প কয়েকজনের কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, আমি আমার সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বইতে সঙ্কলিত দুটি পুরনো প্রবন্ধে এই বিষয়গুলি নিয়ে অনেক দিন আগে খানিকটা আলোচনা করেছিলাম।[5]

ঊনবিংশ শতকের এক মহান পদার্থবিজ্ঞানী, ল্যুড্‌হ্বিগ বোলৎস্‌মান, ১৮৮৬ সালে তাঁর এক লোকপ্রিয় ভাষণে ঘোষণা করেছিলেন,

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আগামী প্রজন্ম আমাদের এই [ঊনবিংশ] শতাব্দকে ডারউইন শতাব্দ বলেই চিহ্নিত করবে।

আর পরের শতকে জীববিজ্ঞানী জুলিয়ান হাক্সলি লেখেন,

ডারউইন জীবজগতের জন্য যে জানালা খুলে দিয়েছিলেন, তা অন্য বিষয়গুলোকেও এক নতুন বিবর্তনবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখবার সুযোগ করে দিয়েছে।

কীভাবে?

মানুষ নীহারিকা থেকে তারার বিবর্তন, ভাষা এবং যন্ত্রের ক্রমবিকাশ, রাসায়নিক মৌলসমূহ এবং সামাজিক সংগঠনের বিবর্তন অধ্যয়ন করছে। এইভাবে তারা সমগ্র বিশ্বজগৎকেই এক বিবর্তমান সত্তারূপে দেখছে এবং সামগ্রিক বিবর্তনের এক সামান্যীকৃত ধারণাকে তুলে ধরেছে। ডারউইনের মূল তত্ত্ব— প্রাকৃতিক উপায়ে বিবর্তন— এর এই বর্ধিত প্রয়োগ বিশ্বজগৎ এবং মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এক নতুন দৃষ্টি মেলে দিয়েছে।[6]

প্রায় পঞ্চাশ বছর বাদে একেবারে হুবহু এই কথাগুলোরই যেন পুনরুচ্চারণ করে অতি সাম্প্রতিক কালের দুই লেখক দেখিয়েছেন যে “মহাবিশ্বতত্ত্ব থেকে শুরু করে জীববিজ্ঞান, এমনকি সমাজ বিজ্ঞানের কিছু কিছু অংশও এখন বিবর্তনবাদী চিন্তাধারার উপর নির্ভর করছে” এবং “বিবর্তন তত্ত্ব বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অগ্রগতির ক্ষেত্রে একটা বেশ সমৃদ্ধিশালী নির্দেশতন্ত্র হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে।”[7] অর্থাৎ, প্রথম প্রকাশের একশো বছর বাদেও যেমন ডারউইনের চিন্তাধারা জীবন্ত ছিল, দেড়শো বছর পরেও তাই।

১৯৬০-এর দশকে ফ্রান্সের আর একজন বড় মাপের পদার্থবিজ্ঞানী, লুই দ্য ব্রয়ের যোগ্য কৃতী ছাত্র, মার্ক্সবাদের চিন্তায় আলোকিত, জাঁ পল ভিজিয়, লক্ষ করেছিলেন যে,

জীববিজ্ঞান ও মানববিদ্যা থেকে শুরু করে বিবর্তনের ধারণা ধাপে ধাপে বিজ্ঞানজগতের প্রায় সমস্তটাই দখল করে নিয়েছে; জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে শুরু করে এখন সে রসায়নশাস্ত্র ও পদার্থবিজ্ঞানের রাজ্যেও ঢুকে পড়েছে।

তাঁর মতে:

ইতিহাস, বিবর্তন বা ক্রমবিকাশের মাধ্যমে বিশ্লেষণের এই ধারণা প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা বোঝার ক্ষেত্রে আমাদের গভীরতর যুক্তিশাস্ত্র। এরকমও বলতে পারি, বিভিন্ন পরিঘটনার অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যগুলিকে স্থির-চিত্র বিবরণ বাতিল করে গতিময় বিশ্লেষণ করার দ্বারাই এক অর্থে বিজ্ঞানের যাবতীয় অগ্রগতি ঘটে চলেছে। আমরা বুঝি, বিজ্ঞান এগিয়ে চলেছে ক্যুভিয় থেকে ডারউইনের দিকে, নিথর চিত্র থেকে চলিষ্ণুতার দিকে, নৈয়ামিক ন্যায়শাস্ত্র থেকে দ্বন্দ্বতত্ত্বের দিকে।[8]

এই বিবর্তনবাদী চেতনা এমনভাবে আমাদের সমগ্র জ্ঞানজগতে অনুপ্রবেশ করেছে যে আমরা যে-কোনও বিষয়ে একটু গুরুগম্ভীর কিছু আলোচনা করতে গেলে প্রায় আনমনেই ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের প্রসঙ্গ টেনে আনি। সে মানুষের কথাই হোক, তার অসুখবিসুখের কথাই হোক, পরিবেশ বা আর্থসামাজিক সমস্যার কথাই হোক। ভূ-উষ্ণায়ণ সম্পর্কে বলতে গেলেও যেমন আমরা সেই শিল্পবিপ্লবের কাহিনি থেকে শুরু করতে চাই, লগ্নি পুঁজির বিশ্বায়ন নিয়ে কথা বলতে উঠেও তিন-চার দশক পেছন থেকে বিশ্ব-অর্থনীতির কথাচালাচালি করতে থাকি। আমাদের অধিকাংশেরই তখন খেয়াল থাকে না যে আমরা এতে সেই ডারউইনের চিন্তাধারার গতিপথটাই জীববিজ্ঞানের বাইরের পরিসরেও অনুসরণ করছি।

এর বিপরীতক্রমে, আজ থেকে যদি দেশের ছাত্রছাত্রীরা ডারউইনকে বুঝতে না শেখে, তারা এই দৃষ্টিভঙ্গি হারিয়ে ফেলবে, বা, বলা ভাল, জীবনে খুঁজেই পাবে না। তখন তাদের জীবনের সামনে নানা সমস্যাকে তারা ঠিকমতো ধরতেও পারবে না, সমাধানের পথে এগোতেও পারবে না।

এই কটা কথা আজ বিশেষ করে সবাইকে বুঝতে এবং বোঝাতে হবে।

 

[আবার আগামী সংখ্যায়]


[1] Dobzhansky 1964, 449; italics in the original.
[2] Barlow (ed. 1993), op. cit.; p. 123.
[3] Bloch 2004, 5.
[4] Mukhopadhyay 2012, 102-03.
[5] মুখোপাধ্যায় ২০২৩।
[6] Huxley 1960, 18.
[7] Lurquin and Stone 2007, preface.
[8] Cited by Novack 1964.