ব্রেশট ও হাবিব: বাংলা থিয়েটারের এখন-তখন

চন্দন সেন

 


ব্রেশট ও হাবিব তনভীরকে নিয়ে কথা বলতে গেলে সংঘাতের প্রেক্ষিতেই আমাদের আলোচনাকে রাখতে হবে। কারণ আমি যতটা না রাস্তায় দাঁড়িয়ে মিছিল করে রাজনীতি করি, তার চেয়ে অনেক বেশি, বা তার বদলে আমি মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমার রাজনীতিটা করি। নাটকের লোকেরা সবাই তাই করেন। আর, নাটককে মনোগ্রাহী হতে হবে, সাধারণ মানুষের আবেগের সঙ্গে নাটককে কোথাও একটা মিলতে হবে। সাধারণ মানুষকে জুড়তে না পারলে ব্রেশট-হাবিব আর গ্রুপ থিয়েটার করে কোনও লাভ নেই

 

এই ২০২৩ সালটা বাংলা নাটকের কাছে নানান কারণে গুরুত্বপূর্ণ। তার মধ্যে মাত্র দুটো কারণ হল, এই বছরে বিশ্বের অন্যতম নাট্যগুরু বের্টোল্ট ব্রেশট পড়লেন ১২৫-এ, আর আমাদের দেশের, একেবারে নিজের ঘরের মানুষ হাবিব তনভির সবে পূর্ণ করলেন তাঁর জন্মশতবর্ষ।

প্রথমে একটা কথা পরিষ্কার করে নেওয়া দরকার। কথাটা হল, এই যে আমরা এক নিঃশ্বাসে ব্রেশট ও হাবিবের কথা বলছি, এই কাজটা কি উচিত হচ্ছে?

একটা দিক থেকে কাজটা ঠিকই হচ্ছে। কারণ এঁরা দুজনেই খুব সচেতন ও সক্রিয়ভাবে নিজেদের থিয়েটারে রাজনৈতিক বক্তব্য ও অবস্থান প্রতিষ্ঠা করতেন। ব্রেশট মঞ্চে প্রতিটি নাটকের জন্য তার উপযুক্ত আঙ্গিক বেছে নিতেন, তেমনি হাবিব তনভির আজীবন কাজ করে গেছেন আদিবাসী এবং গ্রাম্য মানুষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, তিনি তাঁর মাধ্যম হিসেবে ফোককেই বেছে নিয়েছেন। ফোক বা লোকশিল্পের মাধ্যমে আরও বেশি সংখ্যক সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছনো তাঁর লক্ষ্য ছিল। মূল কথাটা হল— যে দর্শক বা সামাজিক স্তরের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা অভিনয় করছি, আমরা সেই সামাজিক স্তরের শ্রেণিচেতনা বা শ্রেণিসংঘর্ষ বাড়ানোর চেষ্টায় কোনও সাহায্য করছি কি করছি না। সেটা কোনও প্রেমের নাটকও হতে পারে, রূপকথাকে আশ্রয় করে তৈরি কোনও নাটক হতে পারে, যা ইচ্ছে হতে পারে। কনটেন্ট যাই হোক না কেন, ফর্ম ও কনটেন্ট-এর সঠিক মিশ্রণটাই বড় কথা। এই কথাটাই, অর্থাৎ ফর্ম ও কনটেন্ট-এর যথাযথ মিশ্রণ ঘটিয়ে শ্রেণিচেতনা তৈরিতে সাহায্য করে, শ্রেণিসংঘর্ষে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে থিয়েটার করতে চাওয়া বা করে যাওয়া— সমাজমনস্ক, সমাজমুখী ও সমাজসচেতন থিয়েটারের কাছে এটাই এখন কাম্য। আর ব্রেশট ও হাবিব, তাঁদের নিজেদের মতো করে এই কাজটাই বারংবার ঘটিয়ে দেখিয়েছেন। এই বিশ্বব্যাপী হিংস্রতার ঋতুতে তাই আমরা তাঁদের দুজনকে একই উদ্দেশ্যে স্মরণ করে মহাভারতকে এমন কিছু অশুদ্ধ করছি না।

এই গৌরচন্দ্রিকার পর গোড়ার কথা একটু বলে নিতে চাই। এই দুজন মহান নাট্যব্যক্তিত্বের কাজে-কথায় কীভাবে প্রভাবিত হলাম, আর কোন মন নিয়েই বা এতদিন ধরে বাংলা রঙ্গমঞ্চে পরীক্ষা দিয়ে আসছি সেটাই একটু ব্যখ্যা করে বলা। সে-ক্ষেত্রে গোড়ার কথা একটু না বললেই নয়।

খুব ছোটবেলা থেকেই আমার বাবা-মা আমাকে প্রথমে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, একটু বড় হওয়ার পর অর্থাৎ কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় রাহুল সাংকৃত্যায়ন— এগুলো ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এছাড়া বিদ্যাসাগর রামমোহনকে নিয়ে চর্চা তো ছিলই। আর যেহেতু আমি রামকৃষ্ণ মিশনে পড়াশুনো করে বড় হয়েছি, পাঠতালিকায় স্বামী বিবেকানন্দও ছিলেন। তাঁর আধ্যাত্মিক দিকগুলোর চেয়েও তাঁর বৈপ্লবিক দিকগুলোর সঙ্গে বেশি পরিচিত হতে শুরু করি। আর যেহেতু আমার বড় হয়ে ওঠা নকশাল আমল ও ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে, এই পুরো সময় জুড়েই আমাদের মধ্যে একটা মনন তৈরি হচ্ছিল, যা তখন পুরোটা না বুঝতে পারলেও পরবর্তী সময়ে বুঝেছি। অবশ্য কখনওই আমাকে কোনও বই পড়তেই বাধা দেওয়া হত না, তা সে ভূতের বই হোক আর যাই হোক। তবে ক্লাসিক যে আগে পড়ে শেষ করতে হবে এটা বাবা ক্লাস টেন থেকেই বলতেন। তারপর রামায়ণ পড়ার সময়েও বাবা বলতেন, “ওই যে তোর রামানুজমকাকু, চিনিস তো, ওঁরা কিন্তু রাক্ষস, তোর কি রামানুজমকাকুকে দেখে রাক্ষস বলে মনে হয়? তেমনি, অজিত সিং জেঠুকে দেখেছিস, ওঁরা কিন্তু আর্য, কারণ ওঁদের পূর্বপুরুষ ইরান থেকে পঞ্জাবে এসেছে।” এরপর যখন মহাভারত পড়ি, আমাকে বলা হল, “এই যে চারপাশে দেখছিস জমিদখলের জন্য লড়াই হচ্ছে, মহাভারতেও তাই। পাণ্ডবদের জমিজায়গা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, তা ফিরে পাওয়ার জন্যেই মহাভারতের লড়াই, এখনও চারপাশে সেই নিজের জমি ফিরে পাওয়ার জন্যই লড়াই চলছে।” একইসঙ্গে আমি সুকুমার রায় পড়ছি, আবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পও পড়ছি। এগুলো তাড়াতাড়ি পড়ে শেষ করে ফেলার একটা তাগাদা বাড়ির বড়দের কাছ থেকে সবসময়েই ছিল। সবমিলিয়ে এইসব পাঠ ও পরিবেশ আমার মানস তৈরি করেছিল। পরবর্তীকালে এর সঙ্গে মূল মার্ক্সিস্ট লেখাপত্র এসে যুক্ত হয়েছে, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় ও রাহুল সাংকৃত্যায়ন, আগেই বলেছি, যার ভিতটা তৈরি করে দিয়েছিলেন, ফলে আমার জানাবোঝাটা আরও সহজ হচ্ছিল।

১৯৬৭-তে আমার বাবা ছিল আবদুল্লা রসুল সাহেবের সিএ, ৬৯-এ জ্যোতি বসুর পিএ। মা গণনাট্য সঙ্ঘের সেন্ট্রাল স্কোয়াডের প্রধান গায়িকা এবং অভিনেত্রী। ফলে আমি মূলত ‘হারানের নাতজামাই’, ‘রাহুমুক্ত’, ‘লং মার্চ’ এগুলোর মধ্যে দিয়েই বেড়ে উঠেছি। অবশেষে আমার যখন ক্লাস টুয়েলভ, বাবা আমাকে উৎপল দত্তের ‘স্তানিস্লাভ্‌স্কি থেকে ব্রেশট’ এবং ‘চায়ের ধোঁয়া’ এই দুটো বই, তখন চটি বই হিসেবে পাওয়া যেত, কিনে দেন। পাশাপাশি, আমাকে কিনে দেন শম্ভু মিত্রের ‘কাকে বলে নাট্যকলা’। বাবা আমাকে সবসময় বলতেন, যেকোনও কিছুর দুটো দিকই পড়বে, জানবে। সবদিক না জেনে কোনও সিদ্ধান্ত নেবে না।

‘নাটক করা’ বলতে যা বোঝায়, আমার ক্ষেত্রে তার সূত্রপাত শিশুকালেই হয়েছিল। তবে আমি সচেতন সিদ্ধান্ত নিয়ে নাটক করতে শুরু করি ১৯৭৯ সালে। বিসর্জন নাটকের নির্দেশনা দিয়ে শুরু। তবে, এ-ক্ষেত্রে সময়ের দাবিতেই সম্ভবত, আদর্শের মনোলিথিক পূজার বদলে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে তার থেকে বিচ্যুতিই আমাদের অনেককে ভাবিয়ে তুলেছিল। লক্ষ করলে দেখা যাবে, অদ্ভুতভাবে আশি থেকে পঁচাশি সাল পর্যন্ত কলকাতার প্রায় পাঁচটি দল সার্ত্রের ‘দ্য ডার্টি হ্যান্ডস’ অভিনয় করছে। এটা গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে সেইসময় প্রথম বামফ্রন্টের শাসনকালে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির— আমি জেনেশুনেই শব্দগুলি উচ্চারণ করছি— কাছে বামফ্রন্টের মধ্যেকার বিচ্যুতি তুলে ধরার একটা চেষ্টা শুরু হয়। আমরাও সার্ত্রের নাটকের মাধ্যমে সে চেষ্টা করেছি। এরপরে আমাদের আরেকটা নাটকে, শঙ্করবাবুর লেখা নাটক ‘দরদী’, তাতেও Inner party struggle-এর বিষয়টা উঠে আসে। গল্পটা ছিল এরকম, শাসক দলের একজন এমএলএ উন্নয়নের নাম করে এলাকার বিভিন্ন পুকুর ভরাট করছে, জমিজায়গা অধিকার করে নিচ্ছে। তার অধীনে এলাকার ছেলেপুলেরা আশ্রয় পাচ্ছে ও সেই নেতার হয়ে নানা অনৈতিক কাজকর্ম করছে। এলাকায় বাড়ি তৈরির জন্য বালি সিমেন্ট নিতে হলে এদের কাছ থেকেই নিতে হবে, ফলে এলাকার ছেলেদের কাজকর্ম হবে, আয় হবে। অর্থাৎ সেই নেতাটি যা গড়ে তুলেছিল তা হল বর্তমান সিন্ডিকেট ব্যবস্থার একটি প্রাথমিক রূপ। আমি শুরুটা একটুখানি বদলে দিয়েছিলাম। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর শুরুতে ইউরোপ যেমন কমিউনিজমের ভূত দেখে, আমাদের এই এমএলএ-ও তেমনি নিজের প্রাক্তন নেতার ভূত দেখে। প্রথম সিনটা শুরু হচ্ছে এইভাবে। নেতার ভূত এমএলএ-কে বলছে— “এসব কী করতাছস? তরে কি ইয়ার লেইগ্যাই পার্টিতে আনসিলাম আমি?” সেই মুহূর্তে একটা তর্কাতর্কির সৃষ্টি হয়। সেখানে একটা প্রসঙ্গ আসে, যা ছিল বামফ্রন্টের তৎকালীন বক্তব্য, যে এই বর্তমান ব্যবস্থায় তো বিপ্লব হবে না, যেটা হতে পারে তা হল মানুষকে খানিকটা সুযোগসুবিধে দেওয়া, রিলিফ দেওয়া। ফলে সেই এমএলএ বলছেন, আমি তো ভুল কিছু করছি না, পার্টি লাইনই ফলো করে চলেছি। যাই হোক, ‘দরদী’ নাটকে আমরা সেই সময় পার্টির অন্তর্দলীয় সংঘাতটা তুলে আনার একটা চেষ্টা করেছিলাম। বিভিন্ন আইডিয়ার সংঘাতের মধ্য থেকে একটা সর্বজনকল্যাণকারী একটা আইডিয়াকে বের করে আনার চেষ্টা, এই শিক্ষাটা হয়তো ব্রেশটই আমাদের দিয়েছিলেন।

 

আমি যেহেতু শহরে থিয়েটার করি, আমার মূল আঙ্গিক পাবলিক থিয়েটার, কিন্তু বিগত তিন-চার বছর ধরে আমরা স্পেস-ওরিয়েন্টেড থিয়েটারও করছি। ফলে এখন যখন আমরা কোনও নতুন নাটক নিয়ে ভাবি, আমরা তার স্পেস-ওরিয়েন্টেশন এবং ফোর্থ ওয়াল কনভেনশন— এই দুটো দিক নিয়েই ভাবি। নাট্য আননে আমরা সেভাবেই ভাবি এবং সেভাবে নাটক করেও দেখেছি। ‘যুগনায়ক’ বলে বিবেকানন্দের ওপর আমরা যে নাটকটা করেছিলাম, সেটা যেমন প্রসেনিয়ামে করেছি, ঠিক তেমনি যখন কোভিডের প্রবল দাপট চলছে, তখন আমরা নাটকটিকে সম্পূর্ণ ওপেন স্পেসে অভিনয় করি। ‘আমি ও আমরা’ ওপেন স্পেসেই অভিনীত হত। ‘পোড়ামাংসের গন্ধ’ আমরা স্ট্রিট থিয়েটার হিসেবে অভিনয় করতাম৷

আমি পাবলিক থিয়েটার বা পেশাদারি রঙ্গমঞ্চে প্রবলভাবে বিশ্বাস করি। দুঃখের বিষয়, সেটা এখন আর নেই।  আমাদের সংস্কৃতি থেকে একেবারেই লুপ্ত হয়ে গেছে। পেশাদার রঙ্গমঞ্চের জন্য যেটা প্রথমে চাই ও যার বড় অভাব, তা হল একজন প্রযোজক। সেই প্রযোজক নেই। এখন থিয়েটার বলতে শুধুমাত্র অ্যাকাডেমি, রবীন্দ্র সদন, মধুসূদন মঞ্চ ইত্যাদি জায়গায় গ্রুপ থিয়েটারের অভিনয়। অথচ গ্রুপ থিয়েটার একটা প্রতিস্পর্ধার ফসল। পেশাদারি রঙ্গমঞ্চের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সে শাসকশ্রেণির চোখে চোখ রেখে সমাজের ন্যায়-অন্যায়গুলো নিয়ে কথা বলবে, মানুষের পাওয়া, না-পাওয়া, প্রেম, বিচ্ছেদ, যন্ত্রণা এইগুলো নিয়ে কথা বলবে। এ-কথা ঠিকই, যে এই অবস্থান থেকে সামগ্রিকভাবে আমাদের গ্রুপ থিয়েটার কখনও সরে আসেনি। আর ঠিক সেই কারণেই ব্রেশট আমাদের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য।

হাবিবের প্রসঙ্গে বলি, ফোক থিয়েটার নিয়ে আমরা কাজ করিনি তা নয়, তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে তা খুব একটা ফলপ্রসূ বলে মনে হয়নি। কারণ অ্যাকাডেমির মঞ্চে দাঁড়িয়ে ফোক থিয়েটার করার আমার কাছে তেমন কোনও গুরুত্ব আছে বলে আমরা মনে করিনি। সেটা আমি বাঁকুড়ায় গিয়ে করতে পারি, অথবা নকশালবাড়িতে গিয়ে করতে পারি। কিন্তু কলকাতার শহুরে দর্শকের কাছে এই থিয়েটার করার অর্থ তাদের কিছু আমোদ জোগানোর থেকে বেশি বলে আমার মনে হয়নি।

 

আমাদের সাম্প্রতিক যে প্রযোজনা হতে চলেছে, ‘আমাদের গপ্পো’, সেটা ব্রেশটের ‘ফিয়ার অ্যান্ড মিজারি অফ দ্য থার্ড রাইখ’ ওপর ভিত্তি করে তৈরি। এই নাটকটা আমরা করছি ব্রেশটের ১২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষেই। তবে শুধু প্রথম সিনটাই আমরা ব্রেশট থেকে নিয়েছি, বাকিটা উনি যেরকমভাবে বিভিন্ন ঘটনার কোলাজ করে প্রকৃত রাজনৈতিক অবস্থাটা কী সেটা দেখিয়েছেন, আমরাও ঠিক সেইভাবেই নাটকটা করতে চলেছি।

এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, আমরা ব্রেশটের মূল নাটকের প্রথম অংশটুকু রাখলাম, বাকিটা মূল নাটকের আঙ্গিকের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেও নিজেদের মতো করে বিন্যস্ত করে নিলাম, এই পরিবর্তনটার প্রয়োজন হল কেন? আমরা যেটা দেখতে পেলাম, ব্রেশটের নাটকের পরবর্তী দৃশ্যগুলো খুব বেশি করে জার্মানির প্রেক্ষাপটে খাটে। ব্রেশটের অন্যান্য নাটক যেমন খুবই আন্তর্জাতিক, কিন্তু বিশেষ করে এই নাটকটির প্রেক্ষিত প্রবলভাবে জার্মানি-কেন্দ্রিক, যা নির্দিষ্টভাবে ১৯৩৯ ও তার পরের কয়েক বছরের জার্মানি। কিন্তু বর্তমান ভারতবর্ষের যে সাঙ্ঘাতিক একটা অবস্থা সেটা প্রকাশ করার জন্য এই নাটকটাই উপযুক্ত মনে হয়েছে। আমরা মূল নাটকের প্রেক্ষিত বদল করেছি, কিন্তু নাটকের অনুসরণে কোলাজের আঙ্গিকটা ব্যবহার করেছি। নাটকটা শুরু হচ্ছে এইভাবে, যে একটা ক্লাসে অধ্যাপক পড়াচ্ছেন। তিনি ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের দশটা পয়েন্টের কথা বলছেন যা দিয়ে তারা ফ্যাসিবাদকে চিনে নিতে পারবে।

এখনকার যে ছেলেমেয়েরা নাটক করতে আসছে ব্রেশট বা তনভিরের আদর্শ নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা আছে বলে আমার মনে হয় না। তাদের আমি দোষ দিই না। বর্তমান রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে যে রাজনৈতিক আদর্শের জায়গাটা মাত্র পনেরো শতাংশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, বাকিটুকু পুরোটাই স্রেফ রাজনৈতিক কৌশল। এই নষ্ট পরিবেশে আমাদের ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে উঠছে। পাশাপাশি, এই মুহূর্তে সারা বিশ্ব জুড়ে দক্ষিণপন্থার যে বাড়বাড়ন্ত ও তার প্রতি ঝোঁক, তা অবশ্যই তাদের জীবনকে প্রভাবিত করছে। এখন যারা কুড়ি-পঁচিশ বা বড়জোর চল্লিশ বছর বয়সের ছেলেমেয়ে তারা বামফ্রন্টের শেষ জমানা দেখে এসেছে এবং বিগত এগারো-বারো বছর ধরে নতুন জমানাও দেখতে পাচ্ছে যেখানে সর্বব্যাপী চুরি এবং চুরি সত্ত্বেও প্রচারের ঢক্কানিনাদে কান পাতা দায়।

তবে এটা আশার কথা যে বিগত চার-পাঁচ বছর ধরেই আমি লক্ষ করছি যে যুব এবং ছাত্রদের মধ্যে একটা অংশকে কিছুটা হলেও নড়েচড়ে বসতে দেখছি। বিশেষত, কোভিড-এর সময় এরা খুব সক্রিয়ভাবে মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবেলায়, যখন ক্ষমতার সুবাতাস বইছে না, তখনও তারা নির্ভয়ে পথে নেমেছে। এটা অবশ্যই একটা আশাপ্রদ ঘটনা। ফলে শ্রেণিসংগ্রাম যে দরকার, তা শুধুমাত্র ক্ষমতার দিকে তাকিয়ে নেওয়া কোনও পদক্ষেপ বা রাজনৈতিক কৌশলমাত্র নয়, শ্রেণিগত ভিত্তিটা তৈরি করে ফেলতেই হবে, নতুন প্রজন্মের একাংশ এটা খুব ভালভাবে বুঝতে পারছে। দ্বিতীয়ত, সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশে যে চূড়ান্ত প্রযুক্তিগত পরিবর্তন হয়েছে, তার সুযোগ নিচ্ছে আরএসএস। ঐতিহাসিক কারণেই বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই আসছে যাদের কোনও ধরনের কোনও জ্ঞানগম্যি নেই, বা থাকলেও তা ফেসবুক বা হোয়াটস্যাপের নানা গ্রুপের মধ্যে আটকে আছে। এতদসত্ত্বেও আমাদের একটা দায়িত্ব থেকে যায়, যে আমরা কী নাটক করছি, কেন করছি তা নিয়ে আলোচনা করার, তা নিয়ে তর্কাতর্কি করার। কারণ আমাদের দলে আরএসএস যেমন আছে, কনভার্টেড তৃণমূলও আছে, পিওর তৃণমূল আছে, পিওর কংগ্রেস আছে এবং লুকোনো কিছু সিপিআইএমও আছে। আমরা দলে প্রবলভাবে রাজনৈতিক তর্কাতর্কি করি, শুধু তাই নয় রাজনীতি থেকে শুরু করে যৌনাচার নিয়ে আলোচনা, সমস্ত কিছু নিয়ে খোলাখুলি কথাবার্তা বলার পরিবেশ আমরা তৈরি করতে চেয়েছি। কারণ খেলাধুলো থেকে শুরু করে নাচ-গান, সমাজ, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান— সবকিছুই আমাদের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলে। যেমন সৌভাগ্যবশত, আমাদের দলে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে আছে যারা এআই সিমুলেশন নিয়ে কাজ করে, তাঁরা আমাদের বোঝায় যে এআই কী করতে পারে, কী করতে পারে না, এআই কার দখলে থাকলে কী হতে পারে। কারণ আজকের সময়ে নতুন প্রযুক্তি কার হাতে রয়েছে তার ওপরেই পৃথিবীর মানুষের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। সবসময়েই এই ব্যাপারটা ছিল ও এখনও আছে। ফলে সামগ্রিকভাবে যান্ত্রিক বস্তুবাদের দিকে না গিয়ে মূল ভাবনা ও আলোচনার দিকে বিষয়গুলিকে টেনে আনার একটা চেষ্টা আমাদের সবসময়েই থাকে। সাধারণভাবে ভারতবর্ষ থেকে যেটা উধাও হয়ে যাচ্ছে তা হল ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার বা পরিসর। সেটা আমরা আমাদের দলের মধ্যে রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু যেহেতু তাদের ব্যক্তিগত জীবনে বেশিরভাগেরই এসবের কোনও প্র‍্যাকটিস নেই, তাই একটা খটাখটি লেগেই থাকে।

প্রশ্ন উঠেছে, ক্যাপিটালিজমের এই সর্বগ্রাসী বাড়বাড়ন্তের যুগে বাজারের কথা না ভেবে কেবলমাত্র আদর্শকে ভিত্তি করে নাটক করা আদৌ সম্ভব কিনা। এর উত্তর নির্ভর করছে আমি বা আপনি আসলে কী চাইছি নাটকের থেকে। সঞ্জয় গাঙ্গুলিরা যখন ফোরাম থিয়েটার বা লেজিসলেটিভ থিয়েটার করে বেড়ান গ্রামে গ্রামে, তখন ওঁরা যেভাবে কাজটা করেন, আমরা নিরানব্বই শতাংশ মানুষই তা করি না। জনম বা জননাট্যমঞ্চ যে কাজটা করে দিল্লি থেকে শুরু করে উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন চত্বর জুড়ে, যেভাবে একটা বিরাট রিস্ক নিয়ে নাটক করে, আমরা সে কাজটাও করি না। আমরা অনেক বেশি সুখী, অনেক বেশি নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমরা থিয়েটার করি। একটু টোকা মারলেই আমাদের ডিমের খোলস ভেঙে যাবে। অতএব কে থিয়েটার থেকে কী পেতে চাইছেন, তার ওপর নির্ভর করছে কে কীভাবে তার থিয়েটারটা করছে। হ্যাঁ, আমি যদি পাবলিক থিয়েটার করি, তাহলে আমার খরচা চালাবার জন্য একটা অর্থ চাই। সেটা যদি আমারই ট্যাক্সের টাকা থেকে কেন্দ্র সরকারের হাত ঘুরে আমি পেতে পারি, তাহলে খুব ভাল। কারণ ওই টাকাটা তো আমারই, আমিই ট্যাক্স দিয়েছি। সুতরাং রাজ্য সরকার হোক বা কেন্দ্র সরকার,  টাকাটা পাওয়ার অধিকার আমার আছে। দেশের সরকারের কাছ থেকে টাকা নেওয়া মানে আমি কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে টাকাটা নিচ্ছি না। বলে রাখি, এই ন্যায্য অধিকারের টাকাটি আমরা আর পাই না। গত বছর থেকে আমরা তালিকা থেকে বাদ হয়ে গেছি। আমার শোনা কথা, দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের কোনও নেতার অঙ্গুলিহেলনে এসব হয়েছে। কিন্তু আমার তা মনে হয় না। সরকার এমন কাঁচা কাজ করবেন বলে আমার মনে হয় না।

যেহেতু আমাদের কথা হচ্ছে ব্রেশট ও হাবিব তনভীরকে নিয়ে, সেহেতু সংঘাতের প্রেক্ষিতেই আমাদের আলোচনাকে রাখতে হবে। কারণ আমি যতটা না রাস্তায় দাঁড়িয়ে মিছিল করে রাজনীতি করি, তার চেয়ে অনেক বেশি বা তার বদলে আমি মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমার রাজনীতিটা করি। নাটকের লোকেরা সবাই তাই করেন। যিনি রামকৃষ্ণদেবের জীবন নিয়ে নাটক করছেন, তিনিও একটা রাজনীতি করছেন। আমরা যে রাজনীতিটা থিয়েটারের মাধ্যমে করি, সেটা সংঘর্ষের রাজনীতি৷ ফলে বিষয়বস্তু থেকে আঙ্গিক, তার যতরকম বিনির্মাণ সম্ভব সব করেও আমাদের আসল উদ্দেশ্য কিন্তু শ্রেণিচেতনা ও শ্রেণিসংঘর্ষকে প্রতিষ্ঠা করা। আমি ছদ্ম-প্রবন্ধে বিশ্বাস করি না। আমি একটা নাটকীয় ঘটনায় বিশ্বাস করি। আমি সেই নাটকীয় ঘটনায় আবেগের সৃষ্টি হওয়াতে বিশ্বাস করি। যারা দর্শকাসনে বসে আছেন, তারা দেখতে দেখতে ভাববেন— এ তো আমার কথাই বলছে, এই বোধে বিশ্বাস করি। আবার পাশাপাশি, তর্ক বাঁধছে, এরকমটা হয় না, ওরকমটা হয়— ইত্যাদিতে বিশ্বাস করি। সুতরাং আমার একটা গল্প চাই, সে আমি যতরকম বিনির্মাণই ঘটাই না কেন গল্পের মধ্যে দিয়ে, সেই গল্প যেন দর্শকের মনে শ্রেণিচেতনার বিকাশের উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত না হয়৷ যেমন আমি অ্যাকাডেমিতে যখন শো করি, শো-এর পর আমার সারথিকে জিজ্ঞেস করি, কেমন লাগল। আসারকে জিজ্ঞাসা করি। অ্যাকাডেমিতে একজন দর্শক আছেন, তাঁর নাম কালিয়া, তিনি শম্ভু মিত্রের সময় থেকে নিয়মিত নাটক দেখছেন। এখনও প্রতিটি দলের নতুন নাটকের শো তিনি অন্তত বিরতি অবধি তিনি দেখেন, যদি নাটকটিকে তিনি সহ্য করতে পারেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করি। তাঁদের যদি ভাল না লাগে, আমি বুঝতে পারি, নাটকটা হয়নি। কারণ আমি জানি, চুল-দাড়ি চুলকে যাঁরা মতামত দেবেন, তাঁরা সত্যি কথাটা কখনওই বলবেন না। অর্থাৎ এক্ষেত্রে আমি আমাদের কথা বলছি। আমরা এতটাই নোংরা যে সত্যি কথাটা তো আমরা কখনওই বলি না। আমাদের নানা অঙ্ক আছে। আমরা সেই অঙ্ক অনুযায়ী কথা বলি। কিন্তু এঁদের কোনও অঙ্ক নেই। এঁরা কোনও অঙ্কের ধারও ধারেন না। আমার সারথিকে জিজ্ঞেস করলে বলে দেন, ধুর, ভাল লাগল না। আসার যিনি আছেন, তিনি বলেন এ হবে না, ছেড়ে দাও। কোরো না। কালিয়া তো সোজাসুজিই বলে দেয়, বন্ধ করে দিন, বন্ধ করে দিন। এ নাটক করবেন না। কালিয়াকে কনফ্রন্ট করা যায় না। ওঁকে মোকাবিলা করতে গেলে সেই ষাটের দশকের নাটক থেকে আমাদের শুরু করতে হবে, আচার্য শম্ভু মিত্রের সময় থেকে, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাটক, অশোক মুখোপাধ্যায়, অরুণ মুখোপাধ্যায় থেকে আমাদের কনফ্রন্ট করতে হবে। কারণ ও উদাহরণ দেবে ওইসব নাটক থেকে৷ মূলত আমার যেটা বলার তা হল, নাটককে মনোগ্রাহী হতে হবে, সাধারণ মানুষের আবেগের সঙ্গে নাটককে কোথাও একটা মিলতে হবে, এটা আমি মনে করি। সাধারণ মানুষকে জুড়তে না পারলে ব্রেশট-হাবিব আর গ্রুপ থিয়েটার করে কোনও লাভ নেই।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...