Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

স্বপ্নলোক

মিথিলেশ ভট্টাচার্য

 

একসময়ে পরিচিতি ছিল শান্ত সুবোধ নিস্তরঙ্গ শান্তির দ্বীপ-উপত্যকা বলে। সে-সব কবেকার কথা ঘুচে গেছে কবে। এখন বড্ড উথালপাথাল। মানসিক-আর্থিক-সামাজিক-রাজনৈতিক। তবু মন পড়ে রয়— কেঁদে কেঁদে ফেরে— উড়ে বেড়ায় কোনও সোনালি ডানা চিলের মতো ভিজে মেঘের দুপুরে বা জবুথবু শীতরাতে বড়বক্র নদীপারে। অইখানে যে নীলাঞ্জনের স্বপ্নলোক!

মায়ানগরী বা জাদুনগরী যে-নামেই ডাকা হোক না কেন গোলাপ গোলাপই এমন প্রত্যয়ে মুম্বাইকে যারা প্রতিনিয়ত তাদের উপার্জন ও বিলাসবহুল জীবনের লক্ষ্যস্থল করেছে নীলাঞ্জন তাদের দলে পড়ে না, সে দলছুট, বদলির চাকরিতে এসে কী জানি কেমন করে বাঁধা পড়ে গেছে অনিচ্ছাকৃত। স্বদেশ-স্মৃতিতাড়িত সে কেবলই বন্ধনমুক্তি চায়। তাই তো তার মন পড়ে রয় রুগ্ন শালিকের মতো দুর্বল ও ভারি অক্ষম ওই শান্তির দ্বীপ ভূখণ্ডে।

এখন সে গ্রীষ্মের প্রলম্বিত বিকেলে বসে আছে ভিনদেশি সম্ভ্রান্ত এক পুরনো পরিচয়ের মুখোমুখি। ডক্টর মহেন্দ্র এন সাংভি। ও অশেষ কৌতূহলে জানতে চায় নীলাঞ্জনের দেশ-কাল-সমাজের কথা। ওর গৌরবর্ণ চেহারায় চকচকে কয়েনের মতো ঝিকমিক করে অজানাকে জানার সুতীব্র বাসনা। ও যে শুধু রোগ-আরোগ্যকারী চিকিৎসক না, ও মারাঠি ভাষার এক সুদক্ষ কথাকারও।

কিছু বলার আগে নিজেকে সঙ্গোপনে তৈরি করে নেওয়ার ক্ষণিক অবকাশে নীলাঞ্জন ভাবে তার তো শান্তির দ্বীপের ভূগোল বা ইতিহাস কিছুই জানা নেই, নিতান্তই অজ্ঞ, কীভাবে কোথা থেকে পাঠদান শুরু করবে সে!

একেবারে গোড়া থেকেই শুরু করে নীলাঞ্জন, স্বরবর্ণের পাঠ দিচ্ছে এমন কোনও অবোধ জিজ্ঞাসুকে।

—তুমি আসামের নাম শুনেছ নিশ্চয়?
—শুনব না কেন, আসাম-গুয়াহাটি-কাজিরাঙ্গা…

কী চটপট জবাব ডক্টর সাংভির। চোখেমুখে সবজান্তা ভাবের দ্যুতি।

—আমার যেখানে বাড়ি সেখানকার নাম শোনোনি নিশ্চয়ই।
—কী নাম বলো তো?
—শান্তির দ্বীপ। রিমোটেস্ট কর্নার অফ আসাম।

মায়ানগরীর মহানাগরিক সাংভি বিহ্বল দৃষ্টিতে নীলাঞ্জনের মুখের দিকে তাকায়। মুহূর্তে সবজান্তা ভাবের বিভোরতা কাটে। এক জটিল ধাঁধার আবর্তে পড়ে হাবুডুবু খেতে থাকে ডক্টর মহেন্দ্র এন সাংভি।

দেশ-বাড়ি-ভিটেমাটি-কাল-মানুষজন-সমাজ ওসব কথা বলতে গিয়ে অবাধ্য মন লহমায় উড়ে যায় গতকাল দুপুরবেলাতে। অতুলদের সান্তাক্রুজের বহুতল আবাসনের ড্রইং কাম ডাইনিং রুমে টেবিলের ওপর সযত্নে গুছিয়ে রাখা ক-খানা বইয়ের মধ্যে শারদীয় দেশ ১৪১৮ দেখে মুহূর্তে চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল নীলাঞ্জনের শরীর-মন। এই ঘোর বই-বিমুখতার দুর্দিনেও সে ভীষণ ভীষণ বইমুখো। লহমায় হাতে তুলে নিয়েছিল শারদীয়া দেশ। নতুন বইয়ের ঘ্রাণে ভরে উঠেছিল তার মন। সূচিপত্রে নত বড় বড় সব নাম আর কিছু নামের প্রতি তার দীর্ঘলালিত দুর্বলতা। এর মধ্যে একটি নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। কবিতা-গল্প-উপন্যাস বা যা কিছু রচনা এই নামে অলঙ্কৃত হয়ে কাগজে বেরোয়, নীলাঞ্জনের প্রথম পক্ষপাত পায় তা-ই।

বইয়ের ১৯৮ পৃষ্ঠা খুলে নীলাঞ্জন চোখ রেখেছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা ‘পাখির চোখে দেখা ৮’-এ। এবং মুহূর্তে মগ্ন হয়ে গেছিল কবিতাপাঠে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার সে এক ক্ষুধার্ত পাঠক।

কবিতার ১৭ নম্বর স্তবকে নীলাঞ্জন থমকে পড়েছিল, আর এগোতে পারেনি। “আমার বাবা মৃত্যুর আগে বলেছিলেন,/ আমি বাড়ি যাচ্ছি।”

বাড়ি— বাড়ি— বাড়ি… বাকি জীবন তো নীলাঞ্জনের বৃদ্ধ বাবাও এই একই আর্ত হাহাকার ধ্বনিতে চারপাশকে আলোড়িত করতে করতে একদিন চোখ বুজেছিলেন। কবিতার শরীরে চোখ রেখে নীলাঞ্জন স্তব্ধ হয়ে বসেছিল। এক বিশাল দুঃখময় স্মৃতির অতলে যেন তলিয়ে গেছিল সে। কত কত পেঁচা-কাঁদা নিশুতি রাতে ফেলে আসা বসতভিটের স্বপ্ন দেখে আর্তনাদ করে জেগে উঠতেন বাবা বিছানার অন্ধকার মশারির ভিতরে।

কয়েকটা স্তবক পেরিয়ে আবার ২০ নম্বর স্তবকে, “এই দেশ-বিভাগ, বাংলা-বিভাগ এখনও/ শেল হয়ে বিঁধে আছে আমার বুকে/ এটা ইতিহাস মেনে নেওয়াও তো উচিত/ কিন্তু যখনই ভাবি, রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে/ কী করতেন/ বাংলার নীল যাঁর প্রাণ, তিনি কি আর একদিনও/ বাঁচতেন/ মাঝে মাঝে এইসব ইতিহাসের মুখে/ জুতো মারতে ইচ্ছে হয় না?”…

আপনি ভুলে গেলেন কবি, বাংলার সীমানা থেকে ১৮৭৪ সালে যেদিন প্রথম নিষ্ঠুরভাবে কেটে বাদ দেওয়া হয়েছিল বাংলারই শরীর তারপর রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়ার কথা? বৃদ্ধ বয়সেও এই বিচ্ছেদবেদনায় যারপরনাই কাতর ছিলেন তিনি। আজীবন এই বেদনা তাঁকে বিদ্ধ করেছে। ১৯৩৫ সালে সেই দীর্ঘস্থায়ী বেদনা প্রকাশ পেল অসম্ভব আবেগপূর্ণ কবিতার ভাষায়। “মমতাবিহীন কালস্রোতে/ বাংলার রাষ্ট্রসীমা হোতে/ নির্বাসিতা তুমি/ সুন্দরী শ্রীভূমি”…

কই, এসব কথা তো আপনার রচনায় কোথাও স্থান পেল না। আসলে কী জানেন, আপনারা আমাদের বাংলার মানুষ বলে ভাবেন না। বাংলা ভাষার জন্যে রবীন্দ্র-শতবর্ষে বুকের রক্ত ঝরিয়ে আমরা সৃষ্টি করেছিলাম অমর ১৯শে মে, দিনটি আপনাদের কাছে তেমন স্বীকৃতি পেল না, এটা বাঙালিমাত্রেরই দুর্ভাগ্য।

কবিতার এক-একটা স্তবক তোলপাড় তুলছিল নীলাঞ্জনের মনে। অতুলদের বাড়ি ছেড়ে পথে নেমেছিল সে। বেশ খানিকটা হেঁটে বাসস্টপ। মাথায় কড়া রোদের তাপ নিয়ে ভিড় ফুটপাথে গা বাঁচিয়ে হাঁটছিল সে। হঠাৎ করে সামনে তাকিয়ে চমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।

জামরুল। জামরুল!

সবিস্ময়ে মনের ভেতরে ডুকরে উঠেছিল নীলাঞ্জন। এটা যে এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য— ঘটনা। মায়ানগরীর ফুটপাথে ডাঁই করে রাখা বাংলার ফল। দুপুরের প্রচণ্ড রোদ মাথায় করে একজন বৃদ্ধ লোক মলিন টুকরো কাপড় পেতে তাতে জামরুলে পসরা সাজিয়েছে। ঈষৎ সবুজাভ সাদা রঙের ছোট ছোট ফল। রসে টইটম্বুর, স্বাদ ও গন্ধ চমৎকার। ছেলেবেলায় সে কত খেয়েছে এই ফল।

চলে যাব শুকনো পাতা ছাওয়া ঘাসে— জামরুল হিজলের বনে… চেয়ে দেখি কিশোরী করেছে মাথা নিচু— এসেছে সে দুপুরের অবসরে জামরুল লিচু আহরণে… রূপসী বাংলার কবি মুহূর্তে স্মৃতি তোলপাড় করেন নীলাঞ্জনের। সে নিজেও তো কতবার ওই কিশোরীর মতো জামরুল লিচু আম জাম কুড়োতে গিয়েছে গাছতলায় দুপুরের রোদে—!

একসময় দেশভাগের দুরন্ত অভিশাপ মাথায় বয়ে নীলাঞ্জনের বাবা-মা-আত্মীয়-ভাইবোন সব পাড়ি জমিয়েছিল এ-দেশের মাটিতে। ক্যাম্পের ঠাসবুনোন ভিড়, রিলিফ অফিসের দরজায় নিত্যরোজ হানা, এতসব সয়ে হাড়ভাঙা খাটনি খেটে চোখের জল ঘাম ও রক্ত ঝরিয়ে সামান্য গেরস্থালির আয়োজন করতে সমর্থ হয়েছিলেন বাবা। এক টুকরো জমিতে করোগেটেড টিনের দোচালা মাথা গোজার ঠাঁই তৈরি হয়েছিল। ওসব দিনানুদিনের সংগ্রাম-কথা তো আজ ইতিহাস। ওই অতি সামান্য আশ্রয়ের এক-আধটু ফাঁকা জমিতে মা-বাবা দুজন মিলে পুঁতে দিয়েছিলেন কত কত ফুল-ফলের গাছ। এবং এভাবেই ক্রমে তৈরি হয়েছিল তাদের ওপারে ফেলে আসা স্বপ্নলোকের বিকল্প।

আজ এতদিন পরও মনে মনে নীলাঞ্জন সন্ধান করে ফেরে মায়ের মরচে-ধরা টিনের ঢাউস তোরঙ্গটি। ওটি যে কোথায় কার কাছে রয়েছে। অনেককেই জিজ্ঞাসা করেছে একদিন যারা তাদের পাশে ভিড় করেছিল। কেউই সঠিক কিছু বলতে পারে না। কত কত বার যে ওটির স্থান বদল হয়েছে। ক্যাম্প থেকে এসপি রোডে মামার বাড়ি— বিলপাড়ে গণেশকাকাদের বাড়ি, তারপর হাসপাতাল রোডের ভাড়াবাড়ি, তারপর— তারপর তো তাদের নিজের বাড়ির খাটের তলায় রাখা ছিল। একে একে সকলে যখন মাথা গোজার ঠাঁই ছেড়ে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়েছিল— বোনেদের বিয়ে-থা হয়ে গেছিল— বাড়িটা পড়েছিল একেবারে একলা ভাড়াটেদের হাতে, তখন কেউ নিয়ে যায়নি তো? ওই তোরঙ্গের ডালার ভিতর দিকে বেশ বড় বড় দুটি খোপের শরীরে ছেনির আঘাতচিহ্নগুলো এখনও চোখের সামনে ফিনকি দিয়ে ওঠে নীলাঞ্জনের। কুলাউড়া জংশনে সরকারি জল্লাদেরা ওটা খুলেছিল সোনাদানার সন্ধান করতে। ছেনির আঘাতে তোরঙ্গের খোপ দুটিকে জর্জরিত করে দিয়েছিল সেদিন। ওটার ভিতরে মার অনেক টুকিটাকি জিনিসের সঙ্গে সযত্নে ভাঁজ করা ছিল একখানি নকশি কাঁথা। তার জন্মের বছর মা পরম যত্নে তৈরি করেছিলেন ওই কাঁথা। যা গায়ে চাপিয়ে মায়ের উষ্ণ বুকের তলায় নীলাঞ্জন ঘুমিয়েছে কত কত দিন। তোরঙ্গটি খুঁজে পেলে ওই কাঁথাখানায় হাত বুলিয়ে সে অনুভব করতে পারত তার স্নেহময়ী মায়ের বিরল স্পর্শ!

এই সমস্ত তীব্র দুঃখানুভূতির ছোট-বড় অভিজ্ঞতার কথা শুনতে শুনতে সাংভির মনে হয় শান্তি দ্বীপে স্বপ্নলোকের মতো বসতভিটে গড়ে তোলার রণরক্ত সত্যকাহিনি যেন অবাস্তব এক কল্প-কথা! কথাকার সে জানে মানুষের ভিতরকার অপরিমেয় দুর্জয় প্রাণশক্তির কথা— যা রূপ পায় বুঝি শান্তি দ্বীপের পরতে পরতে। রূপকাররা সব ছিন্নমূল বাস্তুহারা সর্বহারার দল— এই ঐতিহাসিক সত্যের সামনে পড়ে ডক্টর সাংভি কেমন বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে থাকে।

—জানি, জানি— তবে এতসব জানতাম না— দেশভাগের কথা তো গোটা দেশের মানুষই জানে— যাকে বলে দ্য হিমালয়ান ব্লান্ডার— কিন্তু তার পরের জীবনযুদ্ধ— প্রতিটি ফ্যামিলির সদস্যের সংগ্রাম এত বিস্তারিতভাবে কখনওই জানতে পারতাম না মিস্টার নীলাঞ্জন।

দুপাশে ঈষৎ টেকো মাথাটা নাড়তে নাড়তে ডক্টর সাংভি বিড়বিড় করে বলতে থাকে অনেকটা স্বগতকথনের ভঙ্গিতে।

এখনও মাঝে মাঝে নীলাঞ্জন মিনতি-ভরা কণ্ঠে স্ত্রী জবার কাছে প্রস্তাব করে, চলো যাই।

—কোথায় যাব? বিস্ময়ভরা সুরে জবা শুধোয়।
—আমাদের স্বপ্নলোকে। ওখানে গিয়ে জীবনের বাকি কটা দিন কাটিয়ে দিই…।
—উরেব্বাস বলছ কী তুমি! পাগল হয়ে গেছ নাকি!
—কেন, পাগল হব কেন? চমকের সঙ্গে প্রশ্ন করে নীলাঞ্জন।
—এই স্বর্গলোক ছেড়ে তুমি ওখানে গিয়ে থাকতে চাও, বলিহারি তোমার!
—চাই-ই তো। ওটা যে আমার— আমাদের স্বপ্নলোক।
—ওই প্যাচপ্যাচে গরম ঘাম বৃষ্টি বন্যা কাদা কারেন্টহীন আকালের দেশে তুমি যেতে চাও! পথঘাট কিসসু নেই, ঢুকলে বেরোনো যায় না আর ওখানে গিয়ে ঢোকাও তো কী সাংঘাতিক ব্যাপার!
—আমার কিন্তু খুব ইচ্ছে করে ওখানে গিয়ে থাকি।
—কী সুবিধাটা আছে ওখানে, বলো? আছে লোকাল ট্রেন, মনোরেল, সিটিবাস? আছে হাতের কাছে মল-বিগবাজার? তোমার ওই স্বপ্নলোকে তো একটা বাথরুম পর্যন্ত নেই, কুয়োতলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চান সারতে হয়!
—তুমি যদি আমার মনের সুখের কথাটা বুঝতে জবা!
—বুঝে কাজ নেই আমার। ওসব বস্তাপচা সেন্টিমেন্ট বাদ দাও তো। দেশই নেই, আবার দেশের আদলে বাড়ি—
—হুম, বাড়িটা…। ওই স্বপ্নলোক যে আমার বুকের ভিতরে বাসা বেঁধে আছে গো। ডুকরে উঠেছিল নীলাঞ্জন।
—দ্যাখো, অত ইমোশন ভাল না। যারা তোমার মতো অবুঝ ইমোশনাল তারা খুব কষ্ট পায়!
—আমিও কষ্ট পাচ্ছি যে!
—পাচ্ছ, মিছিমিছি পাচ্ছ। ওখানে ভোটার লিস্টেও আমাদের নাম নেই। কেটে বাদ দিয়েছে। সে খেয়াল আছে তোমার?
—তাতে কী হয়েছে?
—ওখানে গেলে আমাদের সবাইকে যদি বাংলাদেশি বলে…
—বলুক। বাংলার মানুষ হওয়া তো গর্বের কথা।
—ওই গর্বের কথা তোমার ওখানকার কেউ বুঝবে না। আমাদের বিদেশি বলে বাংলাদেশ পাঠিয়ে দেবে, তখন?
—কী যা-তা বলছ, ওসব অসম্ভব কথা কে বলেছে তোমাকে শুনি?
—কেন শোনোনি, সেদিন আমার জ্যাঠতুতো ভাই সৌভিক এসে কত দুঃখ করে গেল। ওখানে কত কত প্রকৃত ভারতীয়কে হ্যারাস করছে। ডি-ভোটার বানিয়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে ভরে তারপর রাতের অন্ধকারে বর্ডারে নিয়ে গিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে…
—ওসব আমাদের সঙ্গে করবে কেন? আমরা হচ্ছি এদেশের প্রথম শ্রেণির নাগরিক।
—ওসব কে বুঝবে বলো! তার চেয়ে এক কাজ করো…
—কী কাজ?
—বাড়িটা চেনাশোনা কোনও প্রোমোটারকে দিয়ে দাও।
—ও কী করবে?
—কী করবে আবার? বাড়িটা ভেঙে চারতলা ফাউন্ডেশন দিয়ে সুন্দর ডিজাইনের ফ্ল্যাটবাড়ি বানাবে। চারটে ফ্ল্যাট আমাদের দেবে, বাকিগুলো বিক্রি করবে। তিনটে ফ্ল্যাটে আমরা ভাড়াটে বসাব, একটা নিজেদের জন্য রেখে দেব। মাঝে মাঝে দু-চার দিন গিয়ে থাকতে পারব।

অবাক বিস্ময়ে নীলাঞ্জন তাকায় স্ত্রী জবার মুখের দিকে। এসব কী কথা বলছে ও? স্বপ্নলোককে ভেঙে গুঁড়িয়ে নতুন প্রজন্মের চাহিদার আদলে তৈরি হবে খোপ খোপ মানুষ-পাখির বাসা! ওসব খোপে মানুষ-পাখি বাস করে মাঝেমধ্যে এক-আধটা ডিম পাড়বে কখনও? ওই ডিম ফুটে যখন বাচ্চা বেরোবে সে কি তার মতো সেন্টিমেন্টাল, ইমোশনাল থাকবে— থাকবে তার কিছু অতীত জানার কৌতূহল— থাকবে পূর্বপুরুষের রক্ত জল করা জীবন সংগ্রাম ইতিহাস জানার কোনও বাসনা?

ছেলে সবুজ ইংরেজি-মারাঠি-হিন্দি এসব ভাষায় তুখোড় হলেও নিজের মুখের ভাষার বর্ণবোধেই আটকে গিয়ে সহজে ও-পথ মাড়াতে চাইত না। নীলাঞ্জন ছেলের পিছনে পড়ে বহুদিনের চেষ্টায় সবুজের মনে মাতৃভাষা শেখার আগ্রহ তৈরি করেছিল। ছেলেকে বুঝিয়েছিল সে, শিশুবেলা যেমন মায়ের বুকের দুধ খেয়ে শিশু বেড়ে উঠে ক্রমে বড় হয়, ঠিক তেমনি নিজের ভাষা না জানলে কেউ বড় হতে পারে না, বেড়ে উঠতে পারে না। সেই ছোটবেলা থেকেই ছেলে সবুজকে পাঠ দিয়েছিল বাংলার নবজাগরণের করুণাসাগর বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমচন্দ্র-শরৎচন্দ্র-মাইকেল মধুসূদন-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ-রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ আরও কত দিকপালের আশ্চর্য সব কাহিনিকথা— আর তারপর শুনিয়েছিল অসীম বেদনাময় দেশভাগের কথা— বাস্তুহীন হওয়ার কথা— সর্বহারা হওয়ার কথা— অসহনীয় লাঞ্ছনা আর জীবনযন্ত্রণার কথা— আর তাদের সকলের বুকের পাঁজর দিয়ে গড়া স্বপ্নলোকের কথা…!

আর কথা বাড়ায় না নীলাঞ্জন। বৃথা বাক্যব্যয় করে লাভ কী। তীব্র অভিমানে মনে মনে স্থির করে ছেলে-বউকে মায়ানগরীর মায়াজালে আচ্ছন্ন রেখে সে একাই যাবে তার স্বপ্নলোক দর্শনে।

ডক্টর সাংভির সঙ্গে কথা বলতে বলতে নীলাঞ্জন কখন যে বেরিয়ে পড়ে স্বপ্নলোকের পথে— মানস ভ্রমণে— সে নিজেও ঠিক বুঝতে পারে না। এমন বিজন এক পথ সে— সাদা পথ— সোঁদা পথ— বাঁশের ঘোমটা মুখে বিধবার ছাদে চলে গেছে…

আবছা অন্ধকারে নীলাঞ্জন দাঁড়ায় এসে বাঁশের জীর্ণ আগলের সামনে— বাড়িখানা— মাথা গোঁজার ঠাঁইখানা বড্ড নিঝুম— কেউ কোথাও নেই— এক গভীর রাতে বাবা স্বপ্ন দেখে আর্তনাদ করে উঠেছিলেন— যেন অবিকল সেই রাত এসে হাজির আজ সন্ধ্যায় স্বপ্নলোকের চারপাশে— বাড়িতে। একা একা বাবা ফিরে গেছিলেন দেশের বাড়িতে— দাঁড়িয়েছিলেন তারই মতো ফালি বাঁশের জীর্ণ বেড়ার আড়ালে একদলা বিরাট অন্ধকার গায়ে মেখে— মাথার ওপর কেঁপেছিল প্রাচীন আমলকিগাছ— শিশিরের শব্দের মতন আমলকি ফল ঝরছিল একটা দুটো করে নিচের মুথাঘাসের জঙ্গলে— চারধার নিঝুম শব্দহীন— সেদিন সবাইকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে নাম ধরে ডাকছিলেন বাবা— মনোরমা, ও-মনোরমা— নীলু, ও-নীলু— বসন্ত, ও-বসন্ত— পাখি, ও-পাখি— কেউ সাড়া দেয়নি— কেউ ছিল না কোথাও! আজ ভূতগ্রস্ত নীলাঞ্জনের চারপাশেও কেউ নেই— কিছু নেই— নেই মায়ানগরীর অহোরাত্র যান্ত্রিক নিষ্পেষণ, নেই আরব সাগরের উত্তাল ঢেউ ভাঙার শব্দ, নেই উথালপাথাল নোনা বাতাস— নেই ডক্টর সাংভিও— নীলাঞ্জন এই নিঃসাড় পটভূমিতে একা বিচ্ছিন্ন বিবশ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।


*গল্পটি লেখকের অনুমতিক্রমে তাঁর বই ‘দেশভাগের গল্প’ থেকে নেওয়া হয়েছে