Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

‘বিশ্বগুরু’র মেয়াদ ফুরোল?— আন্তর্জাতিক মহলে একাধিক প্রশ্নের মুখে ভারত

অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 


গণতন্ত্র, মুক্তচিন্তার পরিসর, সাংবাদিক নিরাপত্তা, সমাজে সংখ্যালঘুদের অবস্থান— ইত্যাদি অনেক বিষয়েই বিগত বেশ কিছু বছর ধরে আমাদের দেশ ক্রমান্বয়ে পিছনের সারিতে গিয়ে বসেছে। একাধিক সুপরিচিত আন্তর্জাতিক সংগঠনের বিবিধ সমীক্ষা-রিপোর্টের ভিত্তিতে, গণতন্ত্রের বিভিন্ন মাপকাঠিতে ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’র শোচনীয় ফলাফল পরিলক্ষিত হয়েছে। কাজেই সরাসরি গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি সরকারগুলির তরফে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আসাটা একেবারেই অকল্পনীয় ছিল না। সিএএ কার্যকর করা এবং অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেফতারি সেই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে

 

উত্তর দিনাজপুর জেলার হেমতাবাদে নির্বাচনী জনসভায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছেন, “নরেন্দ্র মোদির সরকার যদি জিতবার বিষয়ে এতখানিই আত্মবিশ্বাসী হয়ে থাকে, তাহলে তারা অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও হেমন্ত সোরেনকে জেল থেকে মুক্তি দিক, সেই অবস্থায় নির্বাচনে লড়ুক।” খোলাখুলি এই আহ্বান গ্রহণের সাহস নরেন্দ্রভাইয়ের আছে বলে মনে হয় না। বিপরীতে, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, হেমন্ত সোরেনকে গ্রেফতারের পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক মহলে কার্যত তিনি আরও বেশি করেই চাপের মুখে পড়েছেন। তবে কি সত্যি করেই ‘বিশ্বগুরু’র, ‘বিশ্বগুরু’ত্বের মেয়াদ ফুরোল? কতগুলি বিষয় লক্ষ করা যাক।

গণতন্ত্র, মুক্তচিন্তার পরিসর, সাংবাদিক নিরাপত্তা, সমাজে সংখ্যালঘুদের অবস্থান— ইত্যাদি অনেক বিষয়েই বিগত বেশ কিছু বছর ধরে আমাদের দেশ ক্রমান্বয়ে পিছনের সারিতে গিয়ে বসেছে। একাধিক সুপরিচিত আন্তর্জাতিক সংগঠনের বিবিধ সমীক্ষা-রিপোর্টের ভিত্তিতে, গণতন্ত্রের বিভিন্ন প্রয়োজনীয় বিষয় বা ব্যবহারিক সেই সমস্ত মাপকাঠির নিরিখে ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’র শোচনীয় ফলাফল পরিলক্ষিত হয়েছে। কাজেই সরাসরি গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি সরকারগুলির তরফে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আসাটা একেবারেই অকল্পনীয় ছিল না। যদিও, ওয়াকিবহাল মানুষেরা জানেন এ-ধরনের প্রতিক্রিয়া সকল সময়েই কার্যকারণ সম্পর্ক বিচার করে (পড়ুন, সামগ্রিক ভূ-রাজনৈতিক অবস্থাকে বিবেচনা করে) দেওয়া হয়ে থাকে। তবুও, সমকালীন ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে কূটনৈতিক পরিসরে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে এতখানি কড়া পদক্ষেপ (তা মূলত প্রকাশ্য বিবৃতির ধরনে হলেও) গ্রহণ করতে দেখা গিয়েছে বলে মনে পড়ছে না।

সাধারণ নির্বাচনের ঠিক মুখেমুখেই দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে গ্রেফতারের পরবর্তীতে প্রথম দেশ হিসেবে জার্মানি এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া জানায়। এরপর রাষ্ট্রপুঞ্জ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফেও মোদি সরকারের এই ‘অগণতান্ত্রিক’ মনোভাবের সমালোচনা করা হয়। মার্কিনি স্বরাষ্ট্রদফতরের তরফে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, কেজরিওয়ালের গ্রেফতারির পরবর্তীতে সেই ঘটনার দিকে বাইডেন প্রশাসনের তরফে ‘কড়া নজর’ রাখা হচ্ছে এবং “স্বরাষ্ট্রদফতর আশা করছে অরবিন্দ কেজরিওয়াল স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও সময়-নির্ধারিত বিচারপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবেন।” এই বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় বিদেশমন্ত্রক দিল্লিতে নিযুক্ত মার্কিন দূতাবাসের উপ-রাষ্ট্রদূত গ্লোরিয়া বারবেনাকে সরকারিভাবে ডেকে পাঠিয়ে এই বিষয়ে তাদের আপত্তির কথা জানায়। মার্কিন প্রশাসন এই তলবের পরিপ্রেক্ষিতে নিজেদের অবস্থান থেকে একচুলও না সরে, বরং আরও একধাপ এগিয়ে, ঠিক নির্বাচন শুরুর সময়েই প্রধান বিরোধী দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়টিকে নিয়ে পালটা সমালোচনার সুর চড়ায়। ভারতীয় বিদেশমন্ত্রকের অস্বস্তি এই ঘটনার ফলে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর নিজেই ঘটনার মোকাবিলা করতে ময়দানে নামেন।

জয়শঙ্কর তাঁর বক্তব্যে জানান, “অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়ে অন্য কোনও দেশের তরফে অযাচিত মন্তব্যের ঘটনা পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে অমর্যাদাকর।” জয়শঙ্কর বোধকরি বিস্মৃত হয়েছেন, ২০২০ সালের মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়, তার আগে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হাউস্টনে ‘হাউডি মোদি’ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রভাই ‘অব কি বার ট্রাম্প সরকার’-এর জিগির তুলেছিলেন। সেই বক্তব্যও কি তাহলে ‘পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে অমর্যাদাকর’ ছিল না?

এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকা ও কানাডার তরফে সে-দেশে বসবাসকারী দুই কানাডীয় ও মার্কিন নাগরিক, যথাক্রমে হরদীপ সিং নিজ্জর ও গুরপতওয়ান্ত সিং পন্নুকে হত্যা ও হত্যার চেষ্টার ঘটনায় ভারত সরকারের গুপ্তচর সংস্থাগুলির দিকেই সরাসরি অভিযোগের আঙুল তোলা হয়েছে। এই ঘটনাও পাশ্চাত্যের এই দুই প্রধান শক্তির সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্ক তিক্ত করে তুলেছে। পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে নিজ্জরের হত্যা ও পন্নুকে হত্যার চেষ্টার বিষয়ে ভারত সরকারের অবস্থান বেশ কিছুটা নড়বড়ে জায়গায় রয়েছে। এছাড়াও গার্ডিয়ান সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুসারে প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানেও ভারত সরকারের গুপ্তচর সংস্থাগুলির তরফে এমন একাধিক গুপ্তহত্যার ঘটনা কৌশলে ঘটানো হয়েছে বলে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে।[1] সব মিলিয়ে বৈদেশিক সম্পর্করক্ষার ক্ষেত্রে ভারতের বেশ কিছু আচরণ কূটনৈতিক মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে।

নির্বাচনের ঠিক আগেই বিতর্কিত আইন সিএএ কার্যকর করা নিয়েও আন্তর্জাতিক মহলে ভারত সমালোচনার মুখে পড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, রাষ্ট্রপুঞ্জ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার-বিষয়ক সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তরফেও এই সিএএ আইনকে ‘বৈষম্যমূলক’ বলে সমালোচনা করা হয়েছে।[2] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে স্বরাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র জানিয়েছেন, “ভারতে কীভাবে এই সিএএ আইনকে কার্যকর করা হয়, সেই প্রক্রিয়ার দিকেও আমাদের সরকার কড়া নজর রাখবে।” এই প্রসঙ্গে র‍য়টার্সকে দেওয়া আরেকটি সাক্ষাৎকারে সেই মুখপাত্র জানান, “ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা, ও আইনের চোখে সকল সম্প্রদায়ের সমানাধিকার গণতন্ত্রের মৌলিক ধারণা।” সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে আয়োজিত ইন্ডিয়া টুডে কনক্লেভের এক অনুষ্ঠানে ভারতে নিযুক্ত মার্কিনি রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেত্তির গলাতেও একই সুর প্রতিধ্বনিত হয়। গণতান্ত্রিক পরিসরে ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি তাঁর বক্তব্যে জানান, “আদর্শের প্রশ্নে কোনও আপস চলে না। যত কাছের বন্ধু অথবা যত দূরের শত্রুর কাছ থেকেই সেই প্রস্তাব আসুক না কেন, মৌলিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে কোনও আপস অসম্ভব।”[3]

নিঃসন্দেহে একথা বলা উচিত, স্যামচাচার দেশ আজ হঠাৎই গণতন্ত্র-দরদি হয়ে উঠে ভারতকে ‘সমানাধিকার’ শেখানোর তাগিদে উঠে-পড়ে লেগেছে, তা মোটেই নয়। বরং দীর্ঘদিন ধরেই রাশিয়া-ইউক্রেনের সংঘাতের ক্ষেত্রে ভারতের নিরপেক্ষ ও বেশ কিছু ক্ষেত্রে রাশিয়া-পন্থী অবস্থান নিয়ে চলা, এমনকি প্রায় সমস্ত দেশের তরফেই আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থাকলেও রুশ খনিজ তেল সস্তায় আমদানি করে স্বদেশে জ্বালানির দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার ‘চেষ্টা’, ইত্যাদি নানান বিষয়ে ভারতের কার্যকলাপ নীতিগতভাবে বাইডেন-প্রশাসনের বিপক্ষে গিয়েছে। সর্বোপরি, ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সংঘাতের বিষয়ে একদিকে ভারতের দোদুল্যমান মনোভাব, অন্যদিকে মুসলিম দুনিয়ার কাছে আমেরিকার অবস্থানও প্রত্যাখ্যাত হওয়ায়, ভারতে সংখ্যালঘু অত্যাচারের বিপক্ষে মুখ খোলা ছাড়া বাইডেন-সরকারের আর কোনও রাস্তা খোলা ছিল না। মুসলিম-দুনিয়ার কাছে আমেরিকার বর্তমান অবস্থান এক এমনই সঙ্কটপূর্ণ জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে, হোয়াইট হাউজে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয়ে আসা ইফতার উদযাপনকে অবধি বাইডেন প্রশাসন এ-বছরের জন্য বাতিল ঘোষণা করেছে। সংশয় ছিল মার্কিন মুসলিম প্রতিনিধিদের অনেকেই নাকি সেই ইফতারে যোগদান করবেন না। এমতাবস্থায় সেই ক্ষোভের যন্ত্রণায় সান্ত্বনার প্রলেপ দিতে গিয়ে নরেন্দ্রের নেতৃত্বাধীন ‘গণতান্ত্রিক’ ভারতে সংখ্যালঘুদের অবস্থার বিষয়ে সরব হওয়া ভিন্ন বাইডেনের কাছে আর কোনও বিকল্প ছিল না।

এর পাশাপাশি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আবারও ট্রাম্প-বনাম-বাইডেনেরই লড়াইয়ের সম্ভাবনা এখন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বিশ্বজুড়ে খুল্লমখুল্লা দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থানের বিষয়ে দেখলে সব সময়েই বাইডেনের বিপরীতে ট্রাম্প, মাঁকর-র বিপরীতে লো পঁ অথবা লুল্যা-র বিপরীতে বলসেনারোর মতো রাষ্ট্রপ্রধানেরাই মোদি-শাহের স্বাভাবিক মিত্ররূপে উঠে আসেন। সে-ক্ষেত্রেও, রাজনৈতিক প্রভাবের দিক থেকে দেখলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘বিশ্বগুরু’র আসন টলে যাওয়া বর্তমানে কোনও অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। কিন্তু মূল বক্তব্য হল, গণতন্ত্র-হত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার, সংবিধানের অসম্মান, সংবাদমাধ্যমের উপর হামলা— মোদি-শাহের সরকারের বিরুদ্ধে তোলা এমন প্রতিটি অভিযোগ, নির্ভেজাল রকমে সত্যি। সে-কথা মোদি-শাহের তরফেও অজানা নয়। তদুপরি, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও এদেশের ভবিষ্যৎ এক গাঢ়তর অন্ধকারের সুমুখে দাঁড়িয়ে। এমতাবস্থায় পাশ্চাত্যের দেশগুলির তরফে ‘বিশ্বগুরু’র এই সমালোচনা, তাঁর ও তাঁর দলের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ক্ষেত্রেও যথার্থই এক আশঙ্কার কারণ।


[1] Ellis-Petersen, Hannah. et al. Indian government ordered killings in Pakistan, intelligence officials claim. The Guardian. Apr 4, 2024.
[2] ‘Discriminatory in nature’: UN, US, Amnesty International slam CAA rules. The Wire. Mar 14, 2024.
[3] ‘Religious freedom a cornerstone of democracy. The US can’t give up on that principle’: Eric Garcetti. The Wire. Mar 16, 2024.


*মতামত ব্যক্তিগত