Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

গুজরাত গণহত্যার বিচার হয়নি: রজনীশ রাই-এর কথা

প্রদীপ দত্ত

 


২০০৫ সালের ২৬ নভেম্বর আমেদাবাদের শহরতলিতে সোহরাবুদ্দিন শেখের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে তিন আইপিএস অফিসার গুজরাতের ডিজি বানজারা, আরকে পান্ডিয়ান এবং রাজস্থানের দীনেশ এমএন-কে গ্রেফতার করার পরই রজনীশ রাই সংবাদমাধ্যমের নজরে আসেন। এর পরই বিজেপি সরকারের সঙ্গে রজনীশের সরাসরি সংঘর্ষ শুরু হয়। ধৃত পুলিশ অফিসাররা সবাই ছিলেন অমিত শাহের ঘনিষ্ঠ। তাঁরা সোহরাবুদ্দিন হত্যা ছাড়াও তুলসিরাম প্রজাপতির জাল এনকাউন্টারে জড়িত ছিলেন

 

পূর্ব-প্রসঙ্গ: কুলদীপ শর্মার কথা

দাঙ্গার কিছুকাল পর পুলিশ গুজরাতে বেশ কয়েকটি এনকাউন্টার বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। পরে কয়েকজন অন্যান্যদের সঙ্গে কয়েকজন আইপিএসকেও গ্রেফতার করা হয়। সাধারণ ধারণা হল, তদন্তকারীরা কঠোরভাবে পুলিশের ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যান না। তাই ওই সিনিয়র আইপিএস অফিসারদের গ্রেফতারের ঘটনা ব্যাতিক্রমী। ধৃতদের মধ্যে আরকে পান্ডিয়ান ছিলেন রজনীশ রাইয়ের ব্যাচমেট এবং ভাল বন্ধু। তাঁরা একে অন্যের বাড়িতে গিয়ে সময় কাটাতেন। তদন্ত করতে গিয়ে রজনীশ বুঝলেন পুলিশি হেফাজতে খুনে পান্ডিয়ানও জড়িত, এই অপরাধের মাফ হয় না, তাই তাকেও গ্রেফতার করেছিলেন।

২০০৫ সালের ২৬ নভেম্বর আমেদাবাদের শহরতলিতে সোহরাবুদ্দিন শেখের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে তিন আইপিএস অফিসার গুজরাতের ডিজি বানজারা, আরকে পান্ডিয়ান এবং রাজস্থানের দীনেশ এমএন-কে গ্রেফতার করার পরই রজনীশ রাই সংবাদমাধ্যমের নজরে আসেন। বানজারা তার আগের পাঁচ বছরে অন্তত ১০ জন তথাকথিত সন্ত্রাসবাদী ও সমাজবিরোধীকে জাল এনকাউন্টার করে হত্যা করেছিলেন। ওদিকে নিহত হওয়ার আগে তুলসিরাম প্রজাপতি রজনীশের কাছে তাকে সাজানো এনকাউন্টারে হত্যা করা হতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল।

ওই পুলিশ অফিসারদের গ্রেফতার করার পর বিজেপি সরকারের সঙ্গে রজনীশের সরাসরি সংঘর্ষ শুরু হয়। ধৃত পুলিশ অফিসাররা সবাই ছিলেন অমিত শাহের ঘনিষ্ঠ। তাঁরা সোহরাবুদ্দিন হত্যা ছাড়াও তুলসিরাম প্রজাপতির জাল এনকাউন্টারে জড়িত ছিলেন। সবকটি ক্ষেত্রেই হতদের সন্ত্রাসবাদী বলে প্রচার করা হয়েছিল। তাই সন্ত্রাসবাদ মুছে যাচ্ছে বলে গুজরাতের মানুষের কাছে বিজেপির ইমেজ বড় হয়েছিল। ওই আইপিএস অফিসারদের গ্রেফতারের আগে রজনীশ গুজরাতের উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের অনুমতি নেননি। সরকার ওই মামলা পুলিশ অফিসার গীতা জোহরির হাতে তুলে দেয়।

রজনীশের অভিযোগ ছিল, মন্ত্রী এবং তাঁর অনুগামী পুলিশ অফিসাররা সোহরাবুদ্দিন জাল এনকাউন্টারের অপরাধ ঢাকতে সবরকম চেষ্টাই করেছে। তুলসিরাম প্রজাপতি হত্যাও মন্ত্রী-পুলিশ চক্রান্তের অঙ্গ, কারণ সেই ছিল সোহরাবুদ্দিন ও তার স্ত্রী কৌসরবাই অপহরণের প্রত্যক্ষদর্শী।

 

পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪

 

২০১৪ সালে কেন্দ্রে বিজেপি সরকার আসার পর থেকে অবস্থা বদলায়। একে একে সব পুলিশ অফিসারই জেল থেকে মুক্তি পান, চাকরিতে ফিরে আসেন এবং পদোন্নতি হয়। ওদিকে যাদের নির্ভীক তদন্তে মন্ত্রী-সহ অনেক পুলিশ অফিসার জেলে যান তাঁরা ক্রমাগত হয়রানির শিকার হন।

রজনীশের স্ত্রী গুজরাতের আইএএস অফিসার হলেও ২০০৭ সাল থেকে কখনও তাদের এক জায়গায় পোস্টিং হয়নি। রজনীশকে শিলঙেও পাঠানো হয়েছে। যা বলে ঠিক মনে করেছেন তা করতে গিয়ে ব্যক্তিগত এবং পেশাগত মাসুল দিয়েও তিনি কিন্তু দুঃখিত নন। রজনীশ হর্ষ মন্দরকে বলেছেন, বিচারবহির্ভূত হত্যার তদন্ত করার পর এই কথা ভেবে তাঁর তৃপ্তি হয় যে ২০০২ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত গুজরাতে যে এনকাউন্টার হত্যা আকছার ঘটত এবং বলা হত জঙ্গিরা মুখ্যমন্ত্রীকে হত্যা করতে চেয়েছিল, তা একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। পুলিশি হেফাজতে মৃত্যুর জন্য অফিসারদের কোনও শাস্তি হয় না— দীর্ঘদিনের এই প্রথা যদি না তাঁরা ভাঙতেন তাহলে আজও এনকাউন্টার চলত। কিন্তু তা বন্ধ হয়েছে, এটাই তাদের তৃপ্তি। এ কথা ভেবেই হয়রানির শিকার হওয়া এবং ক্যারিয়ারে পিছিয়ে যাওয়া নিয়ে আক্ষেপ নেই।

২০১৫ সালের এপ্রিলে তাঁকে সিআরপিএফ-এ পাঠানো হয়। তিনি ঝাড়খণ্ডের জাদুগোড়ার ইউরেনিয়াম কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার (ইউসিআইএল) চিফ ভিজিলেন্স অফিসার হয়ে এলেন। সোহরাবুদ্দিন হত্যার জন্য গ্রেফতারির ফলেই এই শাস্তিমূলক পোস্টিং। রজনীশ সেখানে ইউরেনিয়াম খননের সরকারি কাজের ঠিকা নিয়ে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির খোঁজ পান। আর্থিক মূল্যে যা ছিল প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। ইউরেনিয়াম আকর খননের জন্য যে ঠিকাদাররা কম বাজেটের টেন্ডার জমা দিতেন, তাদের নিযুক্ত না করে বেশি বাজেটের টেন্ডার জমা দেওয়া ঠিকাদারদের কাজ দেওয়া হত। দুর্নীতি বন্ধ করতে তাঁকে উৎসাহ না দিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক বিনা অনুমতিতে সেই কাজে এগোনোর জন্য অসদাচরণের অভিযোগ এনে রজনীশকে চার্জশিট দেয়। পরে অবশ্য সেন্ট্রাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটেটিভ ট্রাইবুনাল বা ক্যাট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সেই তদন্ত স্থগিত করে দেয়।

এরপর সেই বছরই তাঁকে গুজরাত সিআইডি (ক্রাইম) বিভাগে নিয়ে আসা হয়। সেখান থেকে তাঁকে পাঠানো হয় অসমে। অসমের ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট অফ বড়োল্যান্ডের দুই সদস্যকে ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ জাল এনকাউন্টারে মেরে ফেলা হয়েছিল। রজনীশ ওই বিচারবহির্ভূত হত্যার তদন্ত করে ১৭ এপ্রিল রিপোর্ট জমা দেন। রিপোর্টে তিনি জানান, ওই হত্যাকাণ্ডে কয়েকটি সরকারি নিরাপত্তা সংস্থা যৌথভাবে কাজ করেছে। রিপোর্ট অনুযায়ী কোনও পদক্ষেপ না নিয়ে সরকার ২০১৭ সালের জুন মাসে ফের তাঁকে স্থানান্তর করে। ওই স্থানান্তর এতই জরুরি ছিল যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের নির্দেশে বলা হয় তাঁর জায়গায় যিনি আসবেন তাঁকে তাঁর কাজ বোঝানোর দরকার নেই! এই ঘটনা নিয়ে তিনি যখন রাঁচিতে সিবিআইয়ের অফিসে রিপোর্ট করলেন মন্ত্রক তাঁকে চার্জশিট দেয়, যার মূল বক্তব্য তাঁর তদন্ত অনুপযুক্ত ও বেঠিক। ওই চার্জশিটের জন্য তাঁর পদোন্নতিও আটকে যায়।

ওদিকে ২০১৮ সালে মুম্বাইয়ের সিবিআই আদালতে সোহরাবুদ্দিন, কৌসরবাই ও তুলসিরাম প্রজাপতি হত্যার রায় ঘোষণা করার আগের দিন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক রজনীশকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে। তিনি ছিলেন ওই হত্যা মামলার প্রধান তদন্তকারী। পরে ওই বছরই আগস্ট মাসে তাঁকে শিলঙে স্থানান্তর করা হলে তিনি পুলিশের চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার জন্য আবেদন করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করে।

চাকরির নিয়ম অনুযায়ী তিন মাস আগেই রজনীশ চাকরি ছাড়ার নোটিস দিয়েছিলেন। তাই তিন মাস পেরোলে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। অফিসে যাওয়া বন্ধ করলে ফের তাঁকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্ত থাকাকালীন মন্ত্রক নির্দেশ দেয় তিনি যেন অন্ধ্রপ্রদেশের চিত্তুরে চলে যান। তাঁর আইনজীবী অবসৃত আইপিএস রাহুল শর্মা বলেন, তিন মাসের নোটিস দিয়ে কোনও কর্মীর অবসর নেওয়া বৈধ। তিন মাস পেরিয়ে গেলে ধরতে হবে তিনি অবসর নিয়েছেন। এই অবস্থায় সরকার তাঁকে বরখাস্ত করতে পারে না।

২০১৮ সালে অবসর না নিলে তাঁর চাকরি ছিল ২০২৫ সাল পর্যন্ত। চাকরি ছেড়ে রজনীশ আমেদাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টে (আইআইএমএ) অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসাবে যোগ দেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ইনস্টিটিউটকে অনুরোধ করে, চাকরিতে বরখাস্ত করা অবস্থায় যেন তাঁকে নতুন চাকরিতে না নেওয়া হয়, কেন্দ্র তাঁর প্রতি এতটাই প্রতিশোধপ্রবণ। অথচ আইআইএমএ-কে সে-কথা বলার মানে ছিল না, কারণ ওই ইনস্টিটিউট স্বশাসিত।

দ্য স্টেটসম্যান রজনীশের প্রশংসা করে বলে এই সিনিয়র আইপিএস অফিসার ২০০২ সাল থেকে তাঁর সাংবিধানিক অধিকার এবং দেশের আইন রক্ষার জন্য লড়ছেন। হিন্দুস্তান টাইমস হুইসলব্লোয়ার হিসাবে রজনীশের সাহসের প্রশংসা করে। ২০২৩ সালে আইআইএমএ রজনীশকে দেয় বিশিষ্ট পুরস্কার ‘মাতৃ মান্নারিয়া গুরুনাথ আউটস্ট্যান্ডিং টিচার অ্যাওয়ার্ড’। ছাত্রছাত্রীদের ভোটের মাধ্যমে শিক্ষকদের মধ্যে থেকে এই পুরস্কারপ্রাপককে বেছে নেওয়া হয়। প্রমাণিত হয় ঢেকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভাঙে।

 

Reference:

 

 

[পরের পর্ব – সতীশচন্দ্র ভার্মার কথা]