Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

শতাব্দী দাশের লেখা

শতাব্দী দাশ 

 

আজ ‘বিলকিস বানো কেস’-এর রায় বেরিয়েছে মুম্বাই উচ্চ আদালতে। বিলকিস, যিনি ছিলেন ২০০২ সালে গুজরাটে গণধর্ষিতা। গোধরা-পরবর্তী দাঙ্গাবিধ্বস্ত গ্রাম ছেড়ে, ট্রাকে চেপে পালাচ্ছিলেন ওঁরা। বিলকিসের সঙ্গে ছিল তাঁর প্রথম সন্তান– দুই/তিন বছরের বাচ্চা মেয়েটি। বাড়ির অন্যরাও ছিলেন।

তারপর গেরুয়া ঝান্ডাওয়ালাদের হামলা। দুই বা তিন বছরের শিশুকন্যাটিকে বিলকিসের চোখের সামনে মেরেছিল ওরা। মেরেছিল মোট আটজন সদস্যকে, বিলকিসের পরিবারের। বিলকিসের মায়ের সামনে বিলকিসকে, আর বিলকিসের সামনে তাঁর মাকে ধর্ষণ করেছিল। ২০০২ সালে বিলকিস ছিলেন ঊনিশ বছর। বিলকিস ছিলেন দৃশ্যতই গর্ভবতী।

বিলকিস বানো প্রেসবিবৃতিতে জানিয়েছেন, তিনি খুশি। ১১ জন অভিযুক্তর যাবজ্জীবন হয়েছে। তিনজনের ফাঁসির আবেদন নাকচ হয়েছে। আমরাও খুশি। কারণ ব্যক্তিকে ফাঁসি দিয়ে ধর্মের ও পিতৃতন্ত্রের সেই চোখ বদলাবে না, যে চোখ দিয়ে তারা নারীকে ভোগ্য ভাবে, বিধর্মী নারীকে ‘নষ্ট’ করে বিধর্মকে ‘বেইজ্জত’ করা যায়, ভাবে।

বরং অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ডাক্তার ও পুলিশ দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। যে পুলিশ অভিযোগ নিতে চায়নি, যে ডাক্তার ধর্ষিতার সঠিক শারীরিক পরীক্ষা করেনি। আমরা জানি, তারা ‘বোড়ে’ মাত্র। ‘রাজা’ তো ২০১৩ সালেই প্রমাণের অভাবে নির্দোষ। ২০০২ সালের দাঙ্গায় তো বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কোনও ভূমিকাই ছিল না, তাই না? ২০০২ সালের দাঙ্গাটা হয়েছিল তো আদৌ?

নানা স্তরে ‘অ্যাবিউস’ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ‘গ্যাসলাইটিং’ কথাটা খুব ব্যবহার করি আমরা। আপনার মাথায় ফোলা মতো কেন? কেউ ঠুকে দিয়েছে? ওমা, না তো! মাথা ঘুরে নিজেই তো নিজের মাথা ঠুকে ফেলেছিলেন দেওয়ালে। মনে নেই? এই মিথ্যে জোর দিয়ে দশবার বললে আপনি, যিনি স্বয়ং ভিক্টিম, তিনিও বিশ্বাস করতে শুরু করবেন। নিজের বোধ, বুদ্ধি, অনুভূতি, অভিজ্ঞতা সবই ধোঁয়াটে হয়ে যাবে।

বৃহত্তর ক্ষেত্রে, আদালতের শুনানিরও আছে এক নিজস্ব, স্বীকৃত গ্যাসলাইটিং প্রক্রিয়া। বিলকিসের ক্ষেত্রে, প্রতিটি নির্যাতিত মেয়ের ক্ষেত্রে সেই প্রক্রিয়া চলে, ‘আইনি যুদ্ধ’-এর নামে। এক্ষেত্রে চলেছিল পনের বছর। পনের বছর ধরে ধর্ষিতা মেয়েটি শুনলেন তিনি ধর্ষিতাই নন। তাঁর মৃত পুচকে মেয়েটাও ওখানে ছিল না। ছিলেন না আত্মীয়রাও, যাঁদের চোখের সামনে এফোঁড়-ওফোঁড় হতে দেখেছেন। এই আইনানুগ গ্যাসলাইটিং-এর সামনে অটল থাকতে পারেন আমাদের বিলকিসরা। কুর্ণিশ।

আর আমরা এত সহজে হাল ছেড়ে দিই কোন অধিকারে? নিজের উপর, অন্যের উপর ঘটে যাওয়া যে কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার না হওয়া মানে বিলকিসদের অপমান করা।

আবারও একবার বলি।

১) ২০১৩-তে নরেন্দ্র মোদী গুজরাট দাঙ্গার দায় এড়াতে পেরেছেন আইনি ফাঁকফোকর দিয়ে।

২) ২০০২ থেকেই পুলিশ বিলকিসদের দূর দূর করে খেদিয়েছে।

৩) ডাক্তার প্রমাণ তছরুপ করেছে।

৪) বিলকিস, তার আইনজীবীরা নিরন্তর নানা হুমকি পেয়েছেন।

৫) এতৎসত্ত্বেও বিলকিস লড়েছেন। শুধু ধর্ষক না, পুলিশ ও জড়িত ডাক্তারকেও শাস্তি দিতে পেরেছেন। একটা ঘুণধরা বিচারব্যবস্থার বুকের উপর বসে ন্যায়বিচার উপড়ে এনেছেন তিনি।

তার মানে পারা যায়। চূড়ান্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও পারা যায়। বিলকিস প্রমাণ করেছেন, হাল ছেড়ে দেওয়াটা একটা বিলাসিতা, যা সবার সাজে না।

শুধু বিলকিস বানোর মতো দৃঢ় ও সাহসী হতে পারলেই একটা জীবন সার্থকভাবে কেটে যাবে। অন্তত তার কাছাকাছি কিছু পারলেও। আর না পারলে সব শিক্ষা ও তত্ত্বকে বৃথা বলে জানব।