Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

জাতীয়তাবাদ-বিরোধী বিশ্ববাসী ভারতীয়ের মরমী গল্পের নাম — দ্য আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান

দ্য আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান

সুমিত দাস

 

সময়টা অনেক রকম। দিনদিন জনসংখ্যা বাড়ছে, চাকরি কমছে। দারিদ্র বাড়ছে, আর্থিক নিরাপত্তা কমছে। বড়লোকের টাকা বাড়ছে, না খেতে পেয়ে মরার সংখ্যা বাড়ছে। মনে মনে দাঙ্গার রং বাড়ছে, একান্তি কমছে। তথ্যের ভিড়ে ক্রমেই বাড়ছে তথ্যের বুদবুদ, বাড়ছে মানে বিস্ফোরণ হচ্ছে। কিন্তু এতসব ঘটছে কোথায়? কলকাতায়-গুজরাটে নাকি সোমালিয়ায়?

২০০৮-এর শীত, সেবার নন্দীগ্রামের অশান্তি তুঙ্গে। পৌষমেলায় ঢুকে এক চক্কর দিয়ে প্রবীণ অর্থনীতিবিদ সবে দাঁড়িয়েছেন। উত্তাল রাজ্যরাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন করতেই বলেছিলেন — ‘ভয় চেনো? আশ্রমের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে বোমারু বিমান, ভয়ে শান্তিনিকেতন ছাড়ছে পড়ুয়ারা। নন্দীগ্রাম কি তেমন নাকি?’ সে বয়সে বুঝিনি, প্রশ্নটাই ভুল ছিল। তথ্য যা নলেজ নিধন করে, নলেজ যা প্রজ্ঞা দূরে সরায়, তেমন মুখশ্রুত বাইট থেকে ব্রেকিং নিউজ পর্যন্ত যা যা দেখা যায়, তাতে শান্তিনিকেতন, প্রেসিডেন্সি কলেজ, কেম্ব্রিজ বা নোবেল প্রাইজ দেখা যায়। যা দেখা যায় না, তা হল অর্থনীতির হৃদয়।

অর্থনীতির কঠিন পথে হাসতে মানা? ভাবগম্ভীর সে পথে সংখ্যা আর তত্ত্বের অচেনা সখ্যতা? নির্জন সে পথে সাধারণের হাঁটা মানা? এর উত্তর এক কথায় ধরা পড়ল সুমন ঘোষের তথ্যচিত্র দ্য আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান-এ। ১৯৭২-এ অর্থনীতিতে নোবেল জয়ী কেনেথ জে অ্যারো এই ছবিতে বললেন — অমর্ত্য সেনের অর্থনীতিতে ‘হৃদয়’ আছে।

কী আশ্চর্য! সময়ের গায়ে বড্ড বেশি বিদ্বেষ। ঘৃণার সে পথে চিন্তাহীন, প্রশ্নহীন হৃদয়সর্বস্বতা! আর তাদের পরিচিত আগ্রাসনে ছ’টি শব্দ আটকে জুলাই মাসে ছাড়পত্র দেয়নি সেন্সর বোর্ড। কাউ (গরু), হিন্দু, ইন ইন্ডিয়া, গুজরাট, দিজ ডেইজ ও হিন্দুত্ব। দাবী ছিল — এই শব্দগুলি দেশের ভাবমূর্তি নাকি নষ্ট করবে! এরপর পরিচালকের আবেদন পৌঁছায় রিভাইসিং কমিটিতে। না, ডিলিট বা মিউট ছাড়াই মুক্তি পেল তথ্যচিত্র।

রিল টাইম আর রিয়েল টাইমে ‘দ্য আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান’-এর জার্নিতে ধরা আছে আটটি দশক। ঢাকার সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে শান্তিনিকেতন হয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজের দিনগুলিতে অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর প্রশ্নে আড্ডাবাজ প্রবীণ সাবলীল ডুব দিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, বদলাতে থাকা বিশ্বসমাজ আর অর্থনীতির অলিগলি টপকাতে টপকাতে শান্তিনিকেতনের প্রতীচীতে ঢুকে পড়ে সুমন ঘোষের ক্যামেরা।

রিয়েল টাইমে পনেরো বছরের এদিক ওদিক। ক্ষিতিমোহন সেনের কন্যা অমর্ত্য সেনের মা, অমিতা সেনের তথ্যচিত্রে উপস্থিতি জানান দেয়, সুমন ঘোষের গভীর অন্বেষণ। সাদামাটা অমিতা সেনের কথায় আছে — ক্যান্সারজয়ী ছেলের গল্প। রসিক অমর্ত্য সেন স্মৃতির সেসব অলিগলি পার করতে করতে ৬৬ থেকে পৌঁছে যান ৮৪ বছর বয়সে। ছাত্র, শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ মানুষটি আসলে সাবলীল পারিবারিকও, সুমনের ক্যামেরা আর কৌশিক বসুর প্রশ্ন — তা খুঁজে নেয় শেষমেষ।

ঢাকার দিনগুলি, মহাত্মা গান্ধীর প্রতি আকর্ষণ জানিয়ে, এই সময়ের বলিষ্ঠ মন্তব্যটি জোর গলায় বললেন মরমী অর্থনীতিবিদ। “আমি জাতীয়তাবাদী নই, কিন্তু আমি দেশের জন্য গর্বিত।” সহজ এই উচ্চারণই বুঝিয়ে দেয়, কেন হিন্দুত্ব বা গুজরাটের মতো শব্দগুলিতে ভয় পায় অতি জাতীয়তাবাদীরা!

“আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান” বড় যত্নে বানানো তথ্যচিত্র। এই বহুরকম ও জটিল সময়ে দীর্ঘকাল ধরে প্রশ্ন ও কৌতূহল নিয়ে চারপাশ দেখা, অঞ্চল-পথঘাটে চোখ ফেলে সমস্যা খুঁজে সমাধান করতে চাওয়া এক বিশ্বনাগরিকের গল্প। সন্ধ্যার শো’য়ে কলকাতা পারল কি — দর্শক হতে? বড্ড প্রশ্নহীন রাগী সময়ে — স্বস্তিতে বাঁচার স্পর্ধা ধার নিতে? পেরেছে খানিক। আর সেক্ষেত্রে ক্রেডিট গোজ টু সুমন ঘোষ। নিজের সৃষ্টির প্রতি সহজ-সরল দায় থেকে টানটান এক সপ্তাহ কলকাতার কয়েকটি মাল্টিপ্লেক্সে কাটিয়ে গেল “দ্য আর্গুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান”। কেনেথ জে অ্যারোর কথায় “মরমী অর্থনীতিবিদ”।