Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

চিত্ত যেথা ভয়শূন্য…

প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

 

“বর্ন ফ্রি”।

ছোটবেলায় বাবা-মা এই বিখ্যাত সিনেমাটি দেখিয়েছিলেন।

রোমাঞ্চিত, আপ্লুত হয়েছিলাম আফ্রিকার সেই উদ্দাম, স্বাধীন বন্যজীবন দেখে। তারও অনেক পরে জয় এডামসনের এই বিখ্যাত বইটি পড়ার সুযোগ হয়। কিন্তু স্মৃতিতে গেঁথে বসেছিল ভার্জিনিয়া ম্যাকেনা, বিল ট্রাভর্সের অভিনয়। আর সেই উন্মুক্ত অভয়ারণ্য। যেখানে পরাধীনতা বলে কিছু নেই।

তারও অনেক পরে ইউরোপে গিয়ে এই পরিচিত শব্দটিকে নতুন করে খুঁজে পাই।

ক্যাপিটালিস্টরা কিছুটা বিদ্রূপ করেই সাংবাদিকদের ‘বর্ন ফ্রি’ বলে ডাকতেন। সাধারণ মানুষও তাই। কারণ, তাদের বাধা দেয়ার কেউ নেই। নেই প্রশ্ন করার বা কর্মকাণ্ড নিয়ে তর্জনী তোলা। মনে মনে বেশ একটা ‘ফিল গুড ফ্যাক্টর’ কাজ করলেও পরবর্তীকালে দেখেছি, ওই সম্বোধনটি প্রহসন মাত্র।

অন্তত ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি তথাকথিত উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের দেশীয় সাংবাদিকতার বাজারে। সেখানে সাংবাদিকদের ‘বর্ন ফ্রি’ বলে ডাকা অপার্থিব গালিগালাজ মাত্র। কারণ, স্বাধীনতার আগে তো বটেই, স্বাধীনতার সত্তর বছর পেরিয়েও গোটা দেশের প্রকৃত স্বাধীনতা নিয়ে যেখানে প্রশ্ন ওঠে, সেখানে সাংবাদিকদের স্বাধীনতা ও তাতে লাগাম কসার মুহুর্মুহু প্রচেষ্টা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠবে না — সেটাই অপ্রত্যাশিত।

ভাবছেন, এত গৌরচন্দ্রিকার কারণ কী? তা হলে খুলেই বলি…

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় তথ্যসম্প্রচারমন্ত্রী স্মৃতি জুবিন ইরানী ‘ফেক নিউজে’র তত্ত্বকে শিখণ্ডীর মতো সামনে দাঁড় করিয়ে পিছন থেকে পরাধীনতার বিষাক্ত শরনিক্ষেপ করেছেন আপামর সাংবাদিককুলের বিরুদ্ধে। আধা বাঙালি, আধা পাঞ্জাবী পরিবারে জন্ম নেওয়া স্মৃতির ‘মাল্টি-ডিমেনশনাল প্রোফাইল’ কিন্তু বিতর্কের আঁতুরঘর। এর আগেও একাধিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন তিনি। কখনও নিজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষাগত যোগ্যতাকে ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে টেনে নিয়ে গেছেন, কখনও দিল্লীর জেএনইউ’কে ‘সন্ত্রাসবাদের সংঘ’, মহিষাসুর-দুর্গাকে নিয়ে নানান অলৌকিক গালগপ্প বা লোকসভায় হার্ভার্ডিয়ান ইতিহাসবিদ সুগত বসুকে “চুপ করে বসুন, ইতিহাসের তো কিছুই জানেন না” বলে বিতর্কের সুনামি তুলেছেন। তাঁর গগনচুম্বী আস্ফালনে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী স্বয়ং। হাতছাড়া হয়েছিল মানবসম্পদ উন্নয়নের মতো হাইপ্রোফাইল মন্ত্রক। নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন টেক্সটাইলের মতো কম গ্ল্যামারওয়ালা স্থানে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আবার তাঁর পুনরাবির্ভাব। প্রধানমন্ত্রীর কাছের লোক বলে চিড়ে ভিজেছিল। বস্ত্রমন্ত্রকের পাশাপাশি তথ্যসম্প্রচার মন্ত্রকের দায়িত্ব তাই কম কৃতিত্বের নয়। ফিরে এসেই স্মৃতি আবার সেই বিতর্কেই পা দিলেন। রাতারাতি জারি হল সার্কুলার। ভুয়ো নিউজ করলেই বাতিল হবে সরকারি স্বীকৃতি। ইরানির দপ্তর বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলেছিল ‘ভুয়ো’ খবরের জন্য দোষী সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যমকে গ্রেফতার পর্যন্ত করা যেতে পারে।

আসলে সবাই জানত, ভুয়ো খবরটা আদতে ‘ভুয়ো’ অজুহাত।

নেপথ্যে রয়েছে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের কদর্য বাসনা।

সংসদীয় গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে পরিচিত সংবাদমাধ্যম। গণতন্ত্রের চোখ-কান ও জিহ্বা রূপে সত্যদ্রষ্টার কাজ করে থাকাই সংবাদমাধ্যমের উদ্দেশ্য। কিন্তু বিশ্বব্যাপী দুর্নীতি ও বিশ্বায়নের জমানায় সেই সংবাদমাধ্যমই যে কালিমালিপ্ত হবে না এমনটা জোর দিয়ে বলা শক্ত। তবু দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, আজও সিংহভাগ সাংবাদিকই পেইড বা ফেক নিউজকে চরম লজ্জাকর ও অসম্মানজনক বস্তু রূপেই দেখে। তা ইরানি যতই বিতর্কিত সার্কুলার জারি করে নিজেকে তথাকথিত ন্যায় ও সততার প্রতিমূর্তিরূপে প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টা করুন না কেন! যা সত্য, তা সত্যই।

কিন্তু এটাও সত্যি যে স্বাধীনতার পর থেকে একাধিকবার সংবাদমাধ্যমকে পোষ্য করে রাখার ষড়যন্ত্র চলেছে। তা ইন্দিরা জমানায় আনা এমার্জেন্সি, রাজীব জমানার প্রেস বিল বা মোদী জমানায় আনা এই নোটিশ — ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে’। আসলে সংবাদমাধ্যমকে দাসানুদাস করে রাখাটাই রেওয়াজ হয়ে গেছে শাসকদলের কাছে। তা সেটা রাজ্যস্তরেই হোক, বা কেন্দ্রে। কিন্তু তাঁরা ভুলে যান, সংবাদমাধ্যম চিরকালই শাসনের ঊর্ধ্বে। হয়তো পরিস্থিতি নিরিখে আপোষ করতে পারে, কিন্তু ‘পদলেহনে’ রাজি হয়নি কখনও। শিরদাঁড়া ঝুকিয়ে ফেলা তাঁদের স্বভাববিরুদ্ধ। তাই ‘প্রতিবাদ হবে, রক্তপলাশে রক্তজবায়’।

স্মৃতি ইরানির ফরমানকে কেন্দ্র করে যখন সাংবাদিকরা দিল্লীর রাস্তায় আগুন জ্বেলেছেন, তখন অন্যত্র প্রমাদ গুনছেন কেউ। সে কেউ আবার কোনও ফেকলু কেউ নন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কারণ, স্মৃতিকে সামনে রেখে যিনি তীরটি ছুঁড়েছিলেন তিনি স্বয়ং মোদীই। মন্ত্রকের কোনও নির্দেশিকা, বিবৃতি প্রধানমন্ত্রী দপ্তরের সবুজ সংকেত না পেলে প্রকাশ্যে আসতে পারে না। এটাই রেওয়াজ। অথচ সাংবাদিকদের মুখে কুলুপ আঁটার এত বড় সিদ্ধান্ত ও তা নিয়ে নির্দেশিকা মোদীর দপ্তরে আমোদিত হয়ে যায়নি, এমনটি অতি বড় মূর্খেও বিশ্বাস করবে না। ঘরে-বাইরে প্রবল চাপের মুখে যখন নির্দেশিকা প্রত্যাহার করছেন মোদী, যখন বলতে চাইছেন “তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন না” — ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে বড়। ধীরগতিতে তিনিও ঢুকে পড়েছেন ইন্দিরা-রাজীব-জগন্নাথ মিশ্র বা বসুন্ধরা রাজের দলে। সংবাদ ও সংবাদমাধ্যমকে প্রভাবিত করার চেষ্টা এর আগেও করেছে সরকার। কিন্তু এভাবে সরাসরি চাবুক চালানো এই প্রথম। তবে শেষমেশ ইরানির বলিষ্ঠ কাঁধে বন্দুক রেখেই ‘ফেক নিউজ’ বিতর্কের বৈতরণী পার হতে চেয়েছেন মোদী। শান্তভাবে জানিয়েছেন, তিনি ‘কিছুই জানতেন না’। কিন্তু ভবী আর কবেই বা ভুলল এসব কথায়!

প্রশ্ন ওঠে, সংবাদমধ্যমকে কুক্ষিগত করার যে অপচেষ্টা তাতে সংবাদমাধ্যমই বা কতটা দায়ী? কতটা স্বচ্ছ আমরা নিজেরাও? কতটা বিবেকের কাছে থাকতে পেরেছি পরিষ্কার? কোনও সৎ সাংবাদিক পেইড বা ফেক নিউজের তত্ত্ব মেনে নেবেন না। কিন্ত তাঁরাই যদি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হন, সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবেই। সবাই তো আর পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা নন। অবশ্য এই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাইতেও বড় রকমের সংক্রমণে পরিণত হয়েছে রাজনৈতিকমহলের সাথে ঘনিষ্ঠতা। এধরনের বহু তথ্য সেখান থেকেও যে চালান হয় তার নিদর্শনও রয়েছে ভুরিভুরি। এই অনাবশ্যক নিজেকে বিকিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বড় মারাত্মক। একপ্রকার ব্যাধি বললেও অত্যুক্তি হবে না। উদাহরণস্বরূপ, হোম মিনিস্ট্রি কভার করতে গিয়ে নিজে দেখেছি কীভাবে সবার সামনে একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক এক প্রথমসারির রাজনৈতিক দলের নেতার পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিচ্ছেন যার নামে রয়েছে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেওয়ার একাধিক অভিযোগ।

ব্যাক্তিগত সুসম্পর্ক থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু অন ডিউটি কারও পায়ে দণ্ডবৎ হওয়া মানে গোটা সংবাদজগতকে সেখানে শুইয়ে দেওয়া। পরবর্তীকালে, এখান থেকেই উঠে আসে এ জাতীয় সরকারি তুঘলকি ফর্মানের আশঙ্কা। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে যেখানে রয়ে যায় আমাদেরই মদত। তাই সংবাদমাধ্যমকেও সতর্ক হতে হবে। হতে হবে একরোখা, আপোষহীন। নয়তো শুধু এধরনের অগণতান্ত্রিক নির্দেশিকা নয়, নগ্ন করে মারধর করার ঘটনা আবারও ঘটবে অদূর ভবিষ্যতে।

এক্ষেত্রে দুটি ঘটনার কথা বলে এই অতিকথন শেষ করব। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সাথে সফরসঙ্গী হয়ে নেপালে গেছি। কাঠমান্ডুর ‘ইন্ডিয়া হাউসে’ হচ্ছে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান শেষে স্থানীয় সাংবাদিকমহলের একাংশের সাথে দেখা করেন রাষ্ট্রপতি। তাঁর মধ্যেই একজন ভারতীয় ‘বিদেশী প্রতিনিধি’ রাষ্ট্রপতিকে প্রণাম করতে যান। প্রোটোকল অনুযায়ী যা একেবারেই সম্ভব নয়। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি তাকে বাধা দিয়ে বলেন, শ্রদ্ধা ভক্তি নিজের জায়গায়। কিন্তু ‘লাইন অফ ডিউটি’তে কখনও কারও সামনে নতজানু হবে না। সাংবাদিকটি তা মানে। আর আমাদের জন্যও একটা বড় শিক্ষার পাঠ পড়িয়ে দেন ভারতের এই বাঙালি রাষ্ট্রনায়কটি। হয়তো এরই ফলস্বরূপ, বিজেপির ‘লৌহপুরুষ’ লালকৃষ্ণ আদবানির সাথে সাক্ষাৎ করার সময়, তার অনুগতবৃন্দের তরফে বারবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার চাপা শাসানি উড়ে আসলেও আদবানির সামনেই এই প্রতিবেদক বলতে পেরেছিলেন –শ্রদ্ধাটা ভিতর থেকে আসাই ভালো। তার জন্য পা ছোঁয়ার দরকার আছে কি? মনে আছে, তিনি খুশিই হয়েছিলেন।

তাই, ‘ফিজিসিয়ান, হিল দাইসেল্ফ’। আগের নিজের রোগটা সারানো দরকার। বাকিটা আপনা-আপনিই সেরে যাবে। শিরদাঁড়া ও মস্তিষ্ক অটুট রেখেই…