বিষাদ ও জ্বলন্ত গুলমোহর: রোশেল পোটকার ও তার হাইকু

প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত

 

কবিতা মাত্রই অনুবাদ-সাধ্য নয়। সে কবিতা যদি ‘হাইকু’ হয়, তবে তা নিঃসন্দেহে দুর্গম, দুরূহ এবং কুয়াশাচ্ছন্ন। প্রশ্ন ওঠে, হাইকু তবে কি শুধুমাত্রই তিন লাইনের জাপানি কাব্যশৈলী নয়, বরং তার চাইতেও অনেক বেশি কিছু? সেই বিষয়ে সন্দেহ নেই যে তিন লাইনের আড়ালে এক অনন্যসাধারণ পৃথিবীর কথা বলে গেছেন বৌদ্ধ জেন সন্ন্যাসীরা যার পরতে পরতে দার্শনিক উদ্ভাস। রবি ঠাকুরের কথায় “এ পদ্য ছবি দেখার, গান গাইবার জন্য নয়।” তাই হাইকু লেখা সহজসাধ্য নয়। ‘বিন্দুতে সিন্ধুদর্শন’— মনোযোগ আকর্ষণকারী, কিন্তু গভীর অর্থবহও। হাইকুর স্রষ্টা মাৎসুও বাশো (১৬৪৪-১৬৯৪) নিজেই বলে গেছেন, প্রকৃত হাইকু লেখা অত্যন্ত কঠিন। একজন প্রকৃত কবি সারাজীবনে একটি কি দুটি হাইকু লিখে যেতে পারেন। তাতে চিত্রকল্প সৃষ্টির পাশাপাশি ঋতু বা প্রকৃতি নির্ভর নান্দনিক তত্ত্বের সঙ্গে ঠাঁই পায় গভীর দর্শনবোধ ও মননশীলতার ছোঁয়া। ৫-৭-৫ মাত্রা বা ধ্বনিতে নিহিত তিন লাইনের এ একটি অপ্রাকৃত সংসার। শুধু বাশো নয়, পরবর্তীতে মাশাওকা সিকি, ইসা কোবাইসি, বুসান হাইকু রচনায় নতুন দিগন্তের সন্ধান দেন। জাপানি সংস্কৃতি ও জেন দর্শনের আলো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ১৯ শতকে তা গোটা বিশ্বজুড়ে তুমুল আলোড়ন ফেলে। এই কাব্যশৈলী প্রভাবিত করেছিল রবীন্দ্রনাথ’কেও। বাশো সহ হাইকু গ্র‍্যান্ড মাস্টার’দের বহু কবিতা তিনি নিজে অনুবাদ করেন। সচেতনভাবে চর্চা করেন স্বতন্ত্র হাইকু রচনার। বর্তমান শতাব্দীতে ভারতীয় পদ্যসাহিত্যের জগতে উঠে আসে বহু প্রথিতযশা হাইকু কবিদের নাম। রমেশ কালা, রাজীব লাঠের, পরেশ তিওয়ারি, গৌতম কুমার নাদকার্নী, জোহানেস মঞ্জরেকর, মাধুরি পিল্লাই-রা ইংরাজি সাহিত্যে নবপ্রজন্মের হাইকু-কারদের মধ্যে অন্যতম। মুম্বই নিবাসী রোশেল পোটকার এই আধুনিক প্রজন্মের প্রতিভাবান হাইকু কবি সম্প্রদায়ের অগ্রগণ্য।

ইংরাজি সাহিত্যের ছাত্রী ও অনুরাগী রোশেল দেশের প্রথমসারির হাইকু কবিদের মধ্যে বিবেচিত হলেও তাঁর আত্মপ্রকাশ ছোটগল্পের হাত ধরে। ‘দ্য অ্যারিথমেটিক অফ দ্য ব্রেস্টস এন্ড আদার স্টোরিজ’ তাঁর বহুল পঠিত ছোটগল্প সংকলন। তাঁর গল্প ‘ছিটমহল’ সেরা এশীয় ছোটগল্পের সংকলনে স্থান পায়। ‘ফোর ডিগ্রিজ অফ সেপারেশন’ কাব্যগ্রন্থটি তাঁকে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়। ‘গার্ল ফ্রম লালবাজার’ কবিতাটি গ্রেগরি ও’ডোনগঘ ইন্টারন্যাশনাল পোয়েট্রি সম্মানের জন্য মনোনীত হয়। তাঁর অন্য কবিতা ‘সেলুলার’ ২০১৭ সালে হাংরি হিল আন্তর্জাতিক কবিতা পুরস্কারে মনোনয়ন এবং ‘গ্রাউন্ড আপ’ কবিতাটি ডেভিড বার্ল্যান্ড পুরস্কারে সম্মানিতও হয়। আইরিশ কবি গ্যাব্রিয়েল রোজেনস্টক-এর সঙ্গে যৌথভাবে রোশেল সম্পাদনা করেছেন ‘আ গারল্যন্ড অফ ফ্লাওয়ার’ গোয়ান-আইরিশ কাব্য সংকলনটি। পেয়েছেন হাইকু নিয়ে স্টার্লিং ইউনিভার্সিটিতে গবেষণার জন্য চার্লস ওয়ালেস রাইটার্স স্কলারশিপ’ও। ‘পেপার আসাইলাম’ তার সাম্প্রতিকতম হাইকু ও হাইবুনের (গদ্য ও হাইকু সংমিশ্রণ) বই। নিচে অনুবাদিত এক ডজন পদ্য রোশেলের এই বইটিরই অংশ।

নান্দীমুখে ফিরে আসা যাক। হাইকু লেখা যতটা শক্ত, বোধকরি তার অনুবাদ ততোধিক কঠিন। এ কথা বারবার মনে হয়েছে রোশেল পোটকারের কবিতাগুলি অনুবাদ করতে গিয়ে। প্রাচীন যুগে হাইকু রচয়িতাদের মধ্যে কাজ করত দার্শনিক বীক্ষণ ও আধ্যাত্মিকতার উন্মুক্ত উচ্ছ্বাস। সময় যতই পেরিয়েছে, ততই পরিবর্তিত হয়েছে হাইকু পর্যায় ও কাঠামো। পরিবর্তন আসে তার বিষয় নির্ভরতা নিয়েও। সাম্প্রতিককালে সামাজিক ও আর্থিক চেতনার সাথে পরিবেশ ও পরিস্থিতির নিরিখে নগরকেন্দ্রিক নগ্ন বিপন্নতা উঠে আসে আধুনিক হাইকুতে। রোশেলের হাইকু সেই ধারায় সম্পৃক্ত। তবুও সেই অস্থিরতা ও বিপন্ন-বিস্ময়ের মধ্যবর্তী ক্ষীণরেখা ধরে উঠে আসে তার স্বতন্ত্র দর্শনের দিনলিপি। সৃষ্টি হয় এক নতুন ভাষাময়, দার্শনিক অভিব্যাক্তির। আর এখানেই রোশেল পোটকারের স্বতন্ত্রতা। দর্শনবোধ, মনঃবীক্ষণ ও পারিপার্শ্বিকতা সেখানে হাতে হাত ধরে চলেছে এগিয়ে। সার্থকতা পায় দিনান্তে লেখা দিনলিপি। আগেও বলেছি হাইকু লেখার মতই তার যথার্থ অনুবাদও এক অসম্ভব ক্রিয়া। তবু সামান্য এই চেষ্টা তুলে ধরা হল আধুনিক ভারতীয় হাইকুর দিকদর্শন জরিপ করার উদ্দেশ্যে। অনুবাদিত এক ডজন হাইকু রোশেল পোটকারের নিহিত সমাজ ও জীবন দর্শনের প্রতিফলন তুলে ধরবে বলে আশাবাদী।

১.

ট্রাফিকের গর্জন—
মোহনার গান মনে পড়ে
নদী যেখানে মিশেছে সমুদ্রে

২.

বন্দি—
যেন সূর্য দীঘল গাছ
কোনও অন্ধকূপের কাচে

৩.

আমের ফলন—
চামড়া ভেদ করা সেই
উপচে পড়া ভোর

৪.

শামুকের খোলস—
আমাদের অবসরঘর
যেমন পড়ে থাকে একা

৫.

পুনর্মিলন—
তার ঠোঁটে লেগে থাকা
হালকা মদের ঘ্রাণ

৬.

কাঠের নিভৃত ঠিকানা—
ছোট্ট পিঁপড়ে তার
শস্য নামিয়ে রাখে

৭.

প্রাতঃকালীন বিষাদ…
ছায়াপথ উগরে
তারাদের কাছে ডেকে নেয়

৮.

আকাশে ফসফরাস–
দাউদাউ
গুলমোহর জ্বলে ওঠে

৯.

ঘুনপোকার গুনগুন—
পিতামহের সমাধিসৌধে
ঝিকিয়ে ওঠা আলো

১০.

একাকিত্বের গান—
ডিম ফুটে পৃথিবীর
আলো দেখা হল না যাদের

১১.

ডোরাকাটা বিড়াল—
আমাদের ফেলে আসা
গতজন্মের দাগ

১২.

সূর্যগ্রহণ—
গুঁটিপোকা শেষমেশ
আগুনের স্বাদ চিনে ফেলে

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4888 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...