Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কর্ণাটক নির্বাচন : ১:১ অঙ্কের প্রয়োজনীয়তা

রিমি মুৎসুদ্দি

 

‘প্রবোধ দিয়েছি মনকে:
পটভূমি আছে থমকে–’

থমকে যাওয়া পটভূমির পট দ্রুত পরিবর্তিত হয় রাজনীতিতে। কর্ণাটক-নির্বাচন অন্তত সেই কথাই বলে। আস্থা ভোটে হার স্বীকার করে বিজেপি নেতা ও কর্ণাটকের দুদিনের মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পা পদত্যাগ করলেন। আগামী সোমবার কংগ্রেস-জনতা দল (সেকুলার) জোটের নেতা কুমারাস্বামীর মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান।

প্রায় সমস্ত রাত্রি জুড়ে চলা তরজার অবসান ঘটিয়ে কর্ণাটকের ও সেই সঙ্গে বিজেপির ভাগ্য খুব সামান্য সময়ের জন্য মনে হয়েছিল নির্ণয় হল। তবু ১৫ দিন পরে পরীক্ষার সম্পূর্ণ ফলাফল পাওয়া যাবে এমনটাই ঠিক ছিল। ১৫ দিন সময় বিজেপি কেন যে কোনও দলের জন্যই বিরাট পাওয়া। যদিও ১৫ দিন অব্ধি অপেক্ষা করতে হয়নি। বিধায়ক কেনাবেচার খেলায় বিজেপির হার হয় ও রাজ্যের দুদিনের মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পা আস্থা ভোটের পরাজয় মেনে নিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

এই জয় পরাজয় আসলে একটাই প্রশ্নের সম্মুখে ভারতের রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষিতকে দাঁড় করিয়ে দেয়। তা হল ওয়ান ইজ টু ওয়ান? অর্থাৎ একটি দল ও বাকিরা সবাই মিলে আরেকটি দল — এই অনুপাতের অঙ্কই এখন সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর বোঝা জরুরি?

কর্ণাটক নির্বাচনের আগেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, কংগ্রেস আর জনতা দল (সেকুলার)-এর জোটবদ্ধ হয়ে এই ভোটযুদ্ধে নামা উচিত। অথচ সেই জোটবদ্ধ হতে হলই, তবে নির্বাচনের ফলাফলের পর।

যদিও গোয়া ও মণিপুরের বিধানসভা নির্বাচনে চিত্রটা ছিল উল্টো। কংগ্রেস একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হওয়া সত্ত্বেও নির্বাচন পরবর্তী জোটের প্রেক্ষিতে বিজেপি সরকার গড়ার আহ্বান পেয়েছিল। কর্ণাটকের ক্ষেত্রে চিত্রটা পাল্টে গেল। কংগ্রেস নেতারা কর্ণাটকের রাজ্যপালের এই সিদ্ধান্তকে বেআইনি ও সংবিধানবিরোধী বলছেন। জেনে নেওয়া যাক, ভারতের সংবিধান কী বলে এই বিষয়ে–

ভারতীয় সংবিধানের আর্টিকল, ১৬৪ অনুযায়ী, মুখ্যমন্ত্রী পদে নিয়োগ করতে পারেন একমাত্র রাজ্যপাল। আর তার ভিত্তি—

১) যে দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে। রাজ্যপাল সেই দলকেই সরকার গড়ার অনুমতি দেবেন।

২) নির্বাচন পূর্ববর্তী জোট যদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় তাহলে তাদের সরকার গড়ার অনুমতি দেওয়া হবে।

৩) ম্যাজিক সংখ্যা না ছুঁলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে রাজ্যপাল সিদ্ধান্ত নেবেন।

সুপ্রিম কোর্টে এর আগেও এ নিয়ে একাধিক মামলা চলেছিল। ২০০৬ সালে রামেশ্বর প্রসাদ বনাম ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়ার একটা মামলায় পাঁচজন বিচারপতি নিয়ে যে সংবিধান বেঞ্চ বসেছিল, তাঁরা আর-এস সরকারিয়া কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক ও রাজ্যে সরকার গঠনের বিষয়ে রাজ্যপালের দায়িত্ব ও ক্ষমতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট মতামত দিয়েছিলেন। এর ভিত্তিতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ডাঃ এ পি জে আবদুল কালাম,  দেশের সমস্ত রাজ্যের রাজ্যপালদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ভারতীয় সংবিধানে রাজ্যপালের ক্ষমতা বিষয়ে প্রচুর চেক ও ব্যালেন্স থাকা সত্ত্বেও রাজ্যপাল নিরপেক্ষভাবে তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করে রাজ্যের আভ্যন্তরীণ সুষ্ঠ শাসনব্যবস্থা বজায় রেখে ও কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে একটা সুসম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রেও নিজের বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন।

কর্ণাটক নির্বাচনের ফলাফল পর্যবেক্ষণ করলে চিত্রটা দাঁড়ায় — ২২৪টি আসনের মধ্যে ২২২টি আসনে নির্বাচন হয়েছে। বিজেপি এককভাবে পেয়েছে ১০৪ ও একটি নির্দল মিলে ১০৫। কংগ্রেস ৭৮ আর জেডি (সেকুলার) ৩৭। কংগ্রেস ও জেডি নির্বাচন পরবর্তী জোট করলে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ১১৫। যদিও তা সংখ্যাগরিষ্ঠতার ম্যাজিক ফিগার ১১২-কে ছুঁতে পারছে। বিজেপির হাতে পনেরো দিনের সময় ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠতার ম্যাজিক ফিগার অর্জন করার। তারা বিধায়ক কিনে নেওয়ার খেলাও শুরু করেছিল।

সুপ্রিম কোর্টের দরজা খুলিয়ে এই মধ্যরাত অব্ধি চলা বিচার ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘The longest hearing in Indian political history’. এর আগে এই মধ্যরাতে বিচার হয়েছিল ইয়াকুব মেননের ফাঁসি রদ মামলায়। সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন একজন বিচারপতি বলেছেন, এস আর বোম্মাই মামলার শুনানিতে স্পষ্ট ঘোষণা করা হয়েছিল, ‘রাজ্যপাল ভবন কোনও দলের সামর্থ্য নির্ণয়ের জায়গা নয়। দলীয় সামর্থ্য নির্ণয়ের জন্য হাউস আছে।’

কংগ্রেস, জেডি-র জোট যদি নির্বাচন পূর্ববর্তী হত তাহলে সংবিধানের আর্টিকল ১৬৪ অনুযায়ী, জোটবদ্ধ হওয়া দলগুলিকে একটি দল ধরা হত। এবং সেক্ষেত্রে অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারে কংগ্রেস, জেডি সরকার গড়ার আহ্বান পেত।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ওয়ান ইজ টু ওয়ান অঙ্কের কথাই বারবার বলেছেন। বিজেপি-কে আটকাবার এই একটাই উপায়। যদিও ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচন ফলাফল একদম উল্টো কথাই বলেছিল। সারদা, নারদার পরও মমতা ম্যাজিকই কাজ করে গিয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রীর সেই অমোঘ কথা — ‘আপনারা প্রার্থী দেখবেন না। আমাকে দেখুন। আমাকে ভরসা করে সিদ্ধান্ত নেবেন।’

পশ্চিমবঙ্গে সদ্য শেষ হওয়া রক্তাক্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনও বিজেপি-র কাছে এক কড়া বার্তা। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে খুব তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়তে হবে। ‘অপারেশন কমল’ বাংলার দরজায় সহজে প্রবেশপত্র পাবে না।